Thursday, August 17, 2017

ইকবাল ছিলেন আমার আধ্যাত্মিক সহায়' - সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী (রহঃ)


লিখেছেনঃ সুজন হাফিজ (বাশার ইবনে হাদীস)
[পাকিস্তানের একটি খ্যতনামা বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাহিত্যিক মাসিক পত্রিকা “সাইয়ারা” ১৯৬৩ সালের মে মাসে ইকবাল সংখ্যা প্রকাশ করে। জনাব গোলাম হোসাইন আজহার মাওলানা মওদূদী (রহঃ) সাহেবের আলোচ্য সাক্ষাতকারটি উক্ত বিশেষ সংখ্যার জন্য গ্রহণ করেন। এ সাক্ষাতকার কয়েকবার দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে।]
“ইকবাল আমার আধ্যাত্নিক সহায় ছিলেন…………”

কয়েক বছর আগে মাসিক তরজমানুল কুরআনের পাতা উল্টাতে গিয়ে উপরোক্ত বাক্যটি আমার চোখে পড়ে। আমার মনে হল, বাক্যটিতে প্রবল আবেগ অনুভূতির ছোঁয়া রয়েছে। এ বাক্যটির মূলে কোন্‌ মনস্তাত্ত্বিক রহস্য রয়েছে, জানা দরকার ছিল। বহুবার হয়েছে মাওলানার সাথে এ বিষয়ে কথা বলি। কিন্তু প্রতিবারই মাওলানার ব্যস্ততার কথা মনে পরতেই সে ইচ্ছা চাপা পড়ে যায়। এবার যখন সাইয়ারার ইকবাল সংখ্যার প্রয়োজন পড়েছে, আমি সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বহু দিনের অপূর্ণ ইচ্ছাটা মাওলানাকে জানালাম। মাওলানা আমাকে কোন একদিন বিকেলে তার কাছে যেতে বললেন। আমি ১৪ ই এপ্রিল বিকেলে উপস্থিত হলাম। নিম্নে মাওলানার সাথে আমার কথোপকথন এর সারসংক্ষেপ তুলে ধরছি-

★মাওলানা! আপনি একবার লিখেছিলেন যে, ইকবাল আপনার আধ্যাত্মিক সহায় ছিলেন। এর পটভূমিকা কি?
ডক্টর ইকবাল আমাকে পাঠান কোট যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। তিনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, যে তুমি যদি এখানে এসে বস, তাহলে আমিও বছরে ৬ মাস এখানে এসে কাটাবো। এ আহ্বানে এমন একটা আকর্ষণ ছিল যে, আমি তাৎক্ষণিকভাবে উক্ত প্রস্তাব গ্রহণ করে নেই এবং হায়দারাবাদ থেকে পাঠানকোট চলে আসি। কিন্তু এ ঘটনার বেদনাদায়ক দিক এই যে, আমি মার্চ মাসে পাঠানকোটে স্থানান্তরিত হলাম। আর এপ্রিলে ডক্টর সাহেবের ইন্তিকাল হয়ে গেল। সে সময় এ ঘটনায় আমি নিদারুণভাবে মর্মাহত হই। তখনকার সেই অনুভূতি আমাকে এই বাক্যটি লিখতে উদ্বুদ্ধ করে।
★মাওলানা! আপনার মধ্যে ও মরহুম আল্লামা ইকবাল এর মধ্যে এ ব্যপারে যে আলাপ আলোচনা বা চিঠির আদান-প্রদান হয়, তা বিশদভাবে জানালে ভালো হয়।
সেই চিঠিপত্রগুলো তো আমার কাছে নেই। তবে অন্যান্য বিবরণ দিচ্ছি। মাওলানা স্বীয় স্বভাবসুলভ ধীর আওয়াজে বলতে শুরু করলেন-
চৌধুরী নিয়াজ আলী সাহেব ইসলামের সেবার উদ্দেশ্যে একটি প্রতিষ্ঠান কায়েম করার লক্ষ্যে জমি ওয়াকফ করেন এবং দালান কোঠা বানাতে আরম্ভ করেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি কি ধরনের হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে তার কোন সুনির্দিষ্ট ধারণা ছিল না, তিনি আমার কাছে পরামর্শ চান যে, কি ধরনের প্রতিষ্ঠান কায়েম করা উচিত। আমি একটা পরিকল্পনা লিখে দেই। এটি পরবর্তীকালে আমার দারুল ইসলামের পরিকল্পনাটিরই অনুরূপ ছিল।
ইতিমধ্যে তিনি আল্লামা ইকবালের কাছেও পরামর্শ চেয়ে চিঠি লিখেন। এ চিঠি লেখালেখির পুরো বৃত্তান্ত আমার জানা নেই। তবে চৌধুরী নিয়ায আলী সাহেবের কাছ থেকেই আমি জেনেছি যে, আমার পরিকল্পনাটি তিনি আল্লামা ইকবাল মরহুমকে দেখিয়েছিলেন এবং আল্লামা ইকবাল তা পছন্দ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, এ ধরনের কাজই বর্তমান সময়ের দাবী। এ সংক্রান্ত যাবতীয় চিঠিপত্র চৌধুরী নিয়াজ আলী সাহেবের নিকট সংরক্ষিত হয়েছে এবং তার কাছ থেকে তা সংগ্রহও করা যেতে পারে। বরঞ্চ আমার যতদূর মনে পড়ে, তিনি একবার তা প্রকাশও করেছেন।
সম্ভবতঃ ১৯৩৬ সালেরই কথা। আল্লামা ইকবাল এ বছর সর্বপ্রথম নজীর নিয়াজী অথবা মিয়া শফী সাহেবকে দিয়ে আমাকে হায়দারাবাদ ত্যাগ করে পাঞ্জাবে স্থানান্তরিত হবার অনুরোধ করে চিঠি লেখান। কিন্তু তখন আমি সেই অনুরোধ রক্ষায় অক্ষমতা প্রকাশ করি। কেননা তখন আমি হায়দ্রাবাদেই থাকার চিন্তা-ভাবনা করেছিলাম। আর যে ধরনের প্রতিষ্ঠান কায়েম করার প্রস্তাব তিনি দিয়েছিলেন, সে ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান কায়েম করার লক্ষ্যে হায়দারাবাদে আমি জমিও খরিদ করেছিলাম।
★আল্লামা ইকবাল আপনাকে পাঞ্জাব চলে আসার জন্য অন্য কোনো বিশেষ কারণও লিখেছিলেন নাকি?
শুধু এ বাসনা ব্যক্ত করেছিলেন যে, আমি যেন পাঞ্জাবে চলে আসি। এর চেয়ে কিছু লেখেননি। তখন তো আমি বুঝতে পারিনি এর পেছনে কি কল্যাণ চিন্তা সক্রিয় ছিল। তবে ১৯৩৭ সালের মাঝামাঝি নাগাদ আমি স্বতস্ফুর্তভাবে অনুভব করতে থাকি যে, ভারতের দক্ষিণ অঞ্চল ত্যাগ করে আমার উত্তর ভারতে চলে যাওয়া উচিত। সেই সময় চৌধুরী নিয়াজ আলী সাহেব আমাকে পাঞ্জাব সফর করার জন্য পীড়াপীড়ি করেন এবং একটি ইসলামী প্রতিষ্ঠান কায়েম করার জন্য যে জায়গাটি তিনি ওয়াকফ করেছিলেন, অন্তত সেই জায়গাটি দেখার জন্য আমাকে জোর অনুরোধ করেন। আমি নিজেও ভাবছিলাম, উত্তর ভারত সফর করে এমন একটি জায়গা আমার বাছাই করা উচিত যেখানে আমার আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুসারে কাজ করার সুযোগ পাব। এ চিন্তা- ভাবনার ফলেই ১৯৩৭ সালে সম্ভবতঃ আগস্ট মাসের শেষের সিকে পাঞ্জাব সফর করি এবং জলন্ধর ও লাহোর হয়ে পাঠানকোট উপনীত হই। এ সফরে মরহুম আল্লামা ইকবালের সাথে আমার বিস্তারিত আলোচনা হয়। তিনি আমাকে অনুরোধ করেন যে, চৌধুরী নিয়াজ আলী সাহেব যে জায়গা ওয়াকফ করেছেন, সেটাই যেন আমি বেছে নেই এবং চৌধুরী সাহেবের কাছে যে পরিকল্পনা আমি পাঠিয়েছিলাম, সে অনুসারে একটি প্রতিষ্ঠান যেন তৈরি করি।
★উত্তর ভারতকে কেন্দ্র করে কাজ শুরু করার ইচ্ছা আপনার কেন হল?
আমি উপলব্ধি করলাম যে, দক্ষিণ ভারতে কাজ করার সুযোগ দিন দিন কমে যাচ্ছে। আর মুসলমানদের ভবিষ্যতের ফয়সালা অনেকাংশে উত্তর ভারতেই হবে।
★আপনার ও আল্লামা ইকবালের মধ্যে যে বিস্তারিত আলোচনা হয় তার কোন কোন বিষয়ে হয়েছিল?
সে সময় যে কথাবার্তা হয়েছিল, তার বিষয়বস্তু ছিল এটাই যে, বর্তমানে মুসলমানদের জন্য কি ধরনের গঠন মূলক কাজের প্রয়োজন। এ ব্যপারে আমার ও মহুম আল্লামা ইকবালের চিন্তাধারা প্রায় একই রকম ছিল।এ কাজের জন্য আমি যে রূপরেখা দিয়াছিলাম, সেটাই তার মনোপুত ছিল। ঐ রূপরেখাই কিভাবে বাস্তবায়িত করা যায়, সেটাই আমার চিন্তা-ভাবনা করছিলাম। তবে বিস্তারিত আমার মনে নেই।
★ভারতে একটা ইসলামী আন্দোলন চালানো কি তখন আপনাদের লক্ষ্য ছিল?
সে সময় আন্দোলন আমাদের লক্ষ্য ছিল না। সে সময় আমাদের লক্ষ্য ছিল দু’টো। প্রথমতঃ যে তাত্ত্বিক ও জ্ঞানগত শূন্যতার কারণে বর্তমান যুগের মানুষের চোখে ইসলামী জীবনব্যবস্থা অসম্পূর্ণ ও অকার্যোপযোগী বলে মনে হয়, সেই শূন্যতা পূরণ করা। দ্বিতীয়তঃ এমন কিছু লোক তৈরি করা, যারা মুসলমানদের তাত্ত্বিক ও বাস্তব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারে। একটা নির্ভেজাল ও সর্বাত্মক ইসলামী আন্দোলনের ধারণা তখন আমাদের সামনে ছিল না।
★আল্লামা ইকবাল তখন তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে কোন কোন কাজের উপর অধিক গুরুত্ব দিতেন?
বেশি বিস্তারিত ভাবে মনে নেই। ইসলামী আইন ও দর্শনের পুনঃ সংকলন তার কাম্য ছিল। সে সময় এটিই ছিল আলোচ্য বিষয়।
★মাওলানা! শুনেছি, আল্লামা ইকবাল তরজুমানুল কোরআন বিশেষভাবে অধ্যায়ন করতেন?
এটা আমি পরে নাযীর নিয়াজী সাহেব ও মিয়া শফী সাহেবের কাছ থেকে জেনেছি যে, আল্লামা মরহুম অত্যন্ত মনোযোগের সাথে তরজুমানুল কোরআন' পড়তেন। তাছাড়া আল জিহাদ ফিল ইসলাম পরিয়ে শুনেছিলেন এবং খুবই পছন্দ করেছিলেন।
★মাওলানা! ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ইকবালের শ্রেষ্ঠত্বের মূল কারণটি কি?
সেই সময় আসলে এমন একজন মানুষের প্রয়োজন ছিল; যিনি পাশ্চাত্য শিক্ষায় গর্বিত সাধারণ লোকদের চেয়েও বেশি শিক্ষিত এবং পাশ্চাত্য বিদ্যায় তাদের চেয়েও দক্ষ ও পারদর্শী হবেন, আর তারপরও এত জোরদার ভাষায় ইসলামী জীবন পদ্ধতিকে সমর্থন করবেন, যে পাশ্চাত্য পূজারীরা তার সামনে কথা বলারই সাহস পাবে না। সেই দুর্লভ ব্যক্তিত্ব ছিল ইকবালের। সেকালে পাশ্চাত্য জ্ঞান- বিজ্ঞানের প্রবল প্রতাপ ছিল এবং এরূপ সাধারণ ধারণা প্রচলিত ছিল যে, পাশ্চাত্য সভ্যতার সাথে আপোষ (compromise) করা এবং পাশ্চাত্য মতবাদগুলোর সাথে ইসলামী দর্শনের সমন্বয় সাধন করা অপরিহার্য। আল্লামা ইকবাল এ ধারণা খন্ডন করেছিলেন। এটিই ইকবালের আসল অবদান। এ দিক থেকে দেখতে গেলে আল্লামা ইকবালের ব্যক্তিত্ব ইসলামী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ সহায় ছিল। সামগ্রিকভাবে তিনি যে অবদান রাখেন, তা অত্যন্তঃ গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। -( সাইয়ারা, মে, ১৯৬৩ এর সৌজন্যে)

No comments:

Post a Comment

Popular Posts