আহমদ মনসুর :
পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় রসূলুল্লাহ (স.)-এর জীবনী রচিত হয়েছে, তাঁর জীবনের বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে প্রচুর লেখা হয়েছে। আমরা যখন আধুনিক বিজ্ঞান-দর্শন ও বিভিন্ন টেকনিক্যাল জ্ঞানের জন্য পশ্চিমা জ্ঞান - বিজ্ঞান মন্দিরে ধর্ণা দেই তখন আমাদের খেয়াল থাকে না যে, পশ্চিমা জগৎ আধ্যাত্মিক প্রশান্তি লাভের জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল। আমরা যখন সাহিত্যে নীতিবোধ বা ধর্মের উপস্থিতিকে সাহিত্য গুণের পরিপন্থী মনে করি তখন পশ্চিমা জগতের অনেক শীর্ষ স্থানীয় সাহিত্য- শিল্পী ধর্মকে সাহিত্যের কেন্দ্র শক্তি হিসেবে গ্রহণ করে তাদের সাহিত্য সম্ভার বিশ^কে উপহার দিয়ে থাকেন। তারা শুধু ধর্মের জয়গান গেয়েই থেমে থাকেন না বরং ইসলামের নবী প্রসঙ্গ নিয়ে সাহিত্য রচনা করে তৃপ্তি লাভ করে ধন্য হন।
পশ্চিমা জগতের অনেকেই ধর্মাশ্রয়ী লেখক হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন। যেমন, সাহিত্যিক ঔপন্যাসিক জুলিয়াস গ্রিণ। ১৯০০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর প্যারিসে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর পিতা মাতা ছিলেন আমেরিকান, কিন্তু গ্রিন জীবনের বেশির ভাগ সময় ফ্রান্সে কাটিয়েছেন এবং প্যারিসকেই তিনি নিজের শহর বলে মনে করেছেন।
জুলিয়াস গ্রিন শতাব্দীর তিন -চতুর্থাংশ সময় জুড়ে এমন এক বিশাল সাহিত্য জগত নির্মাণ করেছেন যার ব্যাপ্তি তলস্টয়-এর শিল্পকর্ম থেকে বিস্তৃত। টি, এস. ইলিয়ট, আন্দ্রেজিঁদ, ম্যালকম লাউরী, জর্জ অরওয়েল এবং রাইনের মারিয়া লিরকের মত বিশ্ব বিশ্রুত কবি সাহিত্যিকগণ গ্রিনের অনুরক্ত পাঠক।
পারলৌকিক বিশ্বাস ছিল গ্রিনের জীবনের প্রধান অবলম্বন। আন্দ্রেজিঁদ ধর্মীয় গোড়ামীর অভিযোগ এনে গ্রিনকে প্রায়ই সমালোচনা করতেন। জিঁদের ধর্ম চেতনার সমালোচনা করে ম্যুরিয়াক লিখেছিলেন, তিনি শয়তানের পথ বেছে নিয়েছেন। এ মন্তব্যে গ্রিন মর্মাহত হয়ে তার জার্নালে লিখেছিলেন’। ‘অদৃষ্টের ব্যাপারে ম্যুরিয়াক কি জানেন? শেষ বিচারের মালিক তো একমাত্র আল্লাহ।’
গ্রিনের চিন্তার মধ্যে ধর্মের প্রগাঢ়তা কত গভীর ছিল তা তাঁর কয়েকটি বাণী থেকে উপলদ্ধি করা সম্ভব। যেমন তিনি বলেন, Faith means walkink in water- বিশ্বাসের অর্থ হচ্ছে পানির উপর দিয়ে হেটে চলা। তিনি আল্লাহর রহমতের উপর বেশি আশা করে লিখেছেন, Even I go down as far as Hell, God’s arm is long enough to pull me up again - এমনকি আমি যদি জাহান্নামে নেমে যাই, স্রাষ্টার হাত এত দীর্ঘ যে, তিনি আমাকে আবার টেনে তুলবেন।
আল্লাহর পথে মৃত্যুকেই ধর্মের সার বিবেচনা করে গ্রিন লিখেছন : To be ready to die, for some one, you have never seen, whose Voice you have never heard that is the whole of Christianity-
তুমি যাকে কখনো দেখনি, যার কথা কখনো শোননি তাঁর জন্য মরতে প্রস্তুত থাকাই হচ্ছে ধর্মের সার কথা। গ্রিনের এ কথার মধ্য দিয়ে ধর্মের প্রতি তাঁর গভীর আন্তরিকতা প্রকাশ পেয়েছে।
গ্রিন যখন Christianity- এর জন্য মরণ বরণ করতে প্রস্তুত তখনই দেখতে পাই নোবেল বিজয়ী হোসে সারামাগোকে ধর্মের মূল কথাকে বিস্তৃতভাবে প্রকাশ করতে। পর্তুগালের দক্ষিণ অঞ্চলে ১৯২২ সনের ১৬ নভেম্বর এই ঔপন্যাসিক জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৮ সালে সারামাগো নোবেল সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং বিতর্কিত উপন্যাস হচ্ছেThe Gospel according to Jesus Christ (1991)। এই উপন্যাসে তিনি দেখিয়েছেন যে, অতি সাধারণ মানুষের ন্যায় আল্লাহ যীশু খৃষ্টকে বলেছেন যে, পৃথিবীতে তুমি একটি নতুন ধর্ম স্থাপন করবে কিংবা ঐ একই কথা, তোমার নামে তা স্থাপিত হবে। এবং হানাহানি অসহিষ্ণুতা হিংসা অর্থাৎ সব ধরনের অশ্রুরক্ত আত্মহুতির শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াবে ঐ ধর্ম। এ উপন্যাসের মূল চরিত্র পৃথিবীর সব দুঃখ দুর্দশা, অবিচার অনাচারের জন্য দোষী করা হয় স্রাষ্টাকে। ফলে পর্তুগালের রাজনীতিকরা এই বইয়ের প্রকাশনা ও বিক্রি বন্ধ করে দেন এবং European literary award for fiction এ এই বইয়ের নাম পাঠান থেকে বিরত থাকেন।
শুধু হোসে সারা মোগেই নন, এমন আরও দুই একজন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ধর্মের ব্যাপারে মানুষের ভক্তি ও বিশ্বাসকে নড়বড়ে করে তুলতে ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছেন। ২০০১ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত ভি. এস. নাইপল এ বিষয়ে কম পিছিয়ে নেই। তাঁর বিখ্যাত বই ‘বিয়ন্ড বিলিফ’ বইটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ‘ইসলামের কাছে নিজকে সঁপে দেয়ার মানে চরম নির্বুদ্ধিতা ’। তিনি নিজের শেকড়ের প্রতি অনুরক্ত থেকে লেগেছেন ইসলামের পেছনে। তিনি আবিস্কার করেছেন তৃতীয় বিশে^র অপরাপর সমস্যার চেয়ে বড় আপদ হচ্ছে ইসলাম। নাইপল উক্ত বইয়ে লেখেন, “পশ্চিম হচ্ছে জ্ঞান- বিজ্ঞান সমালোচনা, কারিগরী বিদ্যা, আর যাবতীয় হিতকর কেজো প্রতিষ্ঠানের আধার। আর ইসলাম হচ্ছে এর উপর ভয়ানকভাবে ক্ষিপ্ত আর নির্ভরশীল এক প্রতিবন্ধী, যে কিনা ক্রমশ নতুন আর অপ্রতিরোধ্য এক শক্তির অস্তিত্ব আঁচ করতে পারছে। পশ্চিমা বিশ্ব ইসলামকে কতই না ভালো জিনিস উপহার দিয়েছে। আর যারা ইসলামর কাছে নিজেদেরকে সঁপে দিয়েছিল তারা তা ভিতরের তাগিদ থেকে করেনি”। ইসলামের প্রতি এ ধরনের মন্তব্য নাইপলের বুদ্ধিবৃত্তিক বিপর্যয় ব্যতিত কিছু নয়। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এডওয়ার্ড সাইদ নাইপলের ‘বিয়ন্ড বিলিফ’ এর সমালোচনা করে যে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করেন তা শান্তিকামী ধর্মীয় বিশ্বাসে গভীর চিত্তের মানুষদের হৃদয়ে চিন্তার ঝড় তোলে। এডওয়ার্ড সাইদ বলেন, “বড় খেদের কথা হচ্ছে, ইসলামকে নিয়ে লেখা নাইপলের সর্বশেষ বইটিকে বৃহৎ একটি ধর্ম সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা বলে বিশ^াস করা হবে। এর ফলে আরো বেশি সংখ্যক মুসলমান দুর্ভোগ আর অপমানের শিকার হবেন। আর পশ্চিমা দুনিয়ার সঙ্গে তাদের ফারাকটা আরও বাড়বে ও গভীর হবে।”
ধর্মবোধ ও ইসলামকে যখন কোন কোন সাহিত্যিক এভাবে মানুষের জন্য বিকৃত বিশ্লেষণের মাধ্যমে হেয় প্রতিপন্ন করতে চান তখন আমরা দেখি কিছু কিছু সাহিত্যসেবী এহেন বিভ্রম এড়িয়ে কর্পুরধর্মী মেধা বর্জিত রস সম্ভোগ পরিত্যাগ করে ধর্মের সশ্রদ্ধ অধ্যয়নে লিপ্ত হন। ধর্ম পাঠে যারা মেধা সমৃদ্ধ তারাই ধর্মীয় ভাবধারায় সাহিত্যের একটা নতুন যুগ গড়ে তোলার প্রয়াসে সন্ধানশীল। এ সব সন্ধানশীল সাহিত্যিকগণ রসুলের জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছেন সহিত্য সৌধের উঁচু মিনার।
আলোচনা করা যাক এজরা পাউন্ডের কথা। মার্কিন কবি এজরা পাউন্ড তাঁর বিরাট কাব্যগ্রন্থ, একটি মাত্র কবিতায় তিনি লিখেছেন আজীবন, সেটা হচ্ছে Cantoes মানে অংশ। সে দীর্ঘ কবিতাটি বর্তমান কালের একটি জীবন জিজ্ঞাসার প্রতিশ্রুতি।
Thrones ক্যানটোজের একটি অধ্যায়। যেখানে তিনি একটি জায়গায় রসূলে খোদার উল্লেখ করে ইউরোপের লোকদেরকে বলেছেন, তোমরা তো সব সময় হাতই পাতলে এবং হাত পেতে কেবল গ্রাস করতে চাচ্ছ, গ্রহণ করতে চাচ্ছ, কিন্তু পৃথিবীতে এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি অনবরত দানই করেছেন। তিনি মানুষের কাছে কোন কিছু চাননি। রসূলে খোদা সম্পর্কে এই অসাধারণ উক্তি - এ নিয়ে কেউ কখনো আলোচনা করে না। Thrones -এর মধ্য্যে এ উক্তিটি যে আছে তাও অনেকে জানে না। বলার এক মাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে হবে।(১)
সুইডেনের মনীষী লেখক জি. ওয়াইডেন গ্রেন তাঁর সদ্য প্রকাশিত ‘পয়গম্বরের স্বর্গারোহন ও স্বর্গীয় গ্রন্থ নামক গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, কয়েকজন পয়গম্বর তাঁদের নির্ধারিত কর্তব্য পালনের পর হয় একটি ঐশীগ্রন্থ কিংবা একটি ব্যবস্থাপত্র অথবা হজরত মুসার মতো কতগুলো বিধান- লিপি লাভ করেছেন। অবশ্য মুসলিম জাহানে রসূলুল্লাহর ‘মেরাজ’ -এর যে ভূমিকা, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর হার্টম্যান তাঁর এক গ্রন্থে প্রমাণ করেছেন, রহস্যবাদী ও কবি, উভয় শ্রেণীর লেখকদের রচিত কতিপয় গ্রন্থের যে বিষয় বস্তু, তার আদর্শ হচ্ছে রসূলুল্লাহর এই ‘মেরাজ।’ প-িত বুসেট এই সমস্যাটি নিয়ে বিশেষভাবে আলোচন্ করেছেন।(২)
পৃথিবীতে এমন কোন মানব নাই যাঁহার সাথে সর্বোত্তম ব্যক্তিত্ব রসূলুল্লাহর তুলনা হইতে পারে।
...উইনউড্ বলিয়াছেন, “মুহম্মদ (স.) অধিক করেন নাই বলিয়া দুঃখ না করিয়া আমাদের উচিত তিনি যে এত করিয়াছেন তাহার জন্য অবাক হওয়া। ইতিহাসের উপর ব্যক্তি বিশেষের প্রভাবের উদাহরণ হিসাবে তাঁহার জীবন হইল যোগ্যতম উদাহরণ। এই একক ব্যক্তি তাঁহার জাতিকে গৌরাবান্বিত করিয়াছেন, অর্ধেক পৃথিবী জুড়ে তাঁহার ভাষা ব্যাপ্ত করিয়াছেন। বারো শত বৎসর পূর্বে ব্যঙ্গ বিদ্রুপের মুখে তিনি মানুষের কাছে যে বাণী প্রচার করিয়াছেন, আজ তাহাই লন্ডনে, প্যারিসে, বার্লিনে, মক্কায় -যেখানে তিনি কাজ করিয়াছেন, মদীনায়- যেখানে তিনি ইন্তেকাল করিয়াছেন, কনস্ট্যান্টিনোপলে, কায়রোতে, ফেজে টিমবুকটুতে, জেরুজালেমে, দামেস্কে, বসরায়, বাগদাদে, বোখারায়, কাবুলে, কলিকাতায়, পিকিং-এ, মধ্য-এশিয়ার উচ্চ ভূমিতে, ভারতীয় দ্বীপ পুঞ্জের দ্বীপসমূহে, মানচিত্রে স্থান পায়নি এমন সব স্থানে, তৃষ্ণার্ত মরুর মরুদ্যানে, অজানা নদীর তীরবর্তী গন্ডগ্রামে, পন্ডিত অথবা অনুগামিগণ গভীর মনোনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করেন।(৩)
“রোমান্টিক যুগের কবি (১৭৯৪- ১৮৩২ গ্যেটে। রোমান্টিক যুগের কাজ হল এমন কোনো নতুন সূত্র বা তত্ত্ব বা শক্তির কিংবা তাদের নূতন কোনো সম্বন্ধ বিন্যাসের আবিষ্কার যার দ্বারা আবার ঐ ভেঙ্গে ছত্রাকার হয়ে যাওয়া জীবনকে কোন একটি মূল দ্যোতনা ও প্রবেগের মধ্যে গেঁথে নেওয়া যায়।
গ্যেটে যা সমাধান দিলেন তাকে বলা যায় বুদ্ধি মুক্তি বিশোধন, বিশ্বব্যাপী প্রসারণ। “গ্যেটে এই প্রকাশিত জগতের বস্তু প্রাণ- মনকে তার চেতনার দ্বারা আয়ত্ব বা উদ্ভাসিত করতে চেয়েছিলেন। একটা অধ্যয়ন তত্ত্বের বুদ্ধিগত প্রতিফলন ছিল তাঁর চেতনায়, যা ফুটে উঠেছিল তাঁর ‘ম্যাহোমেটস গেসাঙ্গ’ শীর্ষক এক অপূর্ব কবিতায়। গ্যেটে এই কবিতায় রসুলুল্লাহর জীবনকে একটি নদীর সঙ্গে তুলনা করেছেন, যে নদী অন্য মস্ত উপনদী, প্রবাহ ইত্যাদির জলধারা বহন করে সমুদ্র বক্ষে নিয়ে যাচ্ছে।
রসূলুল্লাহর মহৎ ব্যক্তিত্বের কালজয়ী স্তুতিবাদ ধ্বণিত হয়েছে তার ‘ম্যাহোমেটস গেসাঙ্গ’ শীর্ষক কবিতায়। কবিতাটির শুরু ছিল নিম্নরূপ :
প্রস্তরগাত্র থেকে প্রবাহমান
নির্ঝরটির দিকে তাকিয়ে দেখ।
কী তার দীপ্তি,
আসমানের নক্ষত্রপূঞ্জকে হার মানায়।
মেঘমালারও ঊর্ধ্ব দেশে
যে সহৃদয় ফেরেশতারা বিচরণ করেন
তারাই লালন করেছেন,
গড়ে তুলেছেন
এই প্রাণবন্ত শিশুকে
পাহাড় চূড়াবলীর কঠোর অথচ দয়ার্দ পরিবেশে।”
‘গ্যেটের উপরে কোরআনের প্রভাব সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ আমাদের লভ্য। তিনি এ মহাগ্রন্থের দ্বিতীয় সূরাতে ইসলামের অন্তর্নিহিত বাণীর সন্ধান লাভ করেন। এই কিতাব, “এতে সন্দেহের কোন আবকাশ নেই.” এ ধরনের বর্ণনা তাঁকে একান্তভাবে অনুপ্রাণিত করে। তিনি বলেন: এভাবে সুরার পর সুরা বিবৃত হয়ে চলেছে। বিশ্বাস ও অবিশ্বাসকে পরিষ্কার ভাষায় পৃথক করে দেখান হয়েছে। বিশ্বাসীর স্থান উঁচুতে আর অবিশ্বাসীদের স্থান নীচুতে। বেহেশত্ অপেক্ষা করছে বিশ্বাসীর জন্যে, আর দোযখ অবিশ্বাসীর জন্যে। এই পবিত্র গ্রন্থের বিশাল বক্ষে রয়েছে বিধিসিদ্ধ এবং অবিধেয় বস্তু ও বিষয়াবলী সম্বন্ধে বিস্তৃত নির্দেশ, ইহুদী ও খ্রিষ্ট ধর্মীয় ঐতিহ্যাশ্রিত পৌরাণিক কাহিনী সমষ্টি, ব্যাখ্যা, পুনরুক্তি, অন্তহীন অতিভাষণ - এমন কত কি! কিন্তু আপনি একবার অভিনিবেশ সহকারে এ-গ্রন্থ অধ্যয়ন শুরু করলে আর ছাড়া পাবেন না। বারবার আপনি ত্যক্ত হয়ে এ বই তুলে রাখবেন, কিন্তু আবার নামিয়ে হাতে নিতে হবে। এমনি বিকর্ষণ ও আকর্ষণের মধ্য দিয়ে আপনি দেখতে পাবেন যে আপনার অন্তর গভীর প্রশংসায় ভরে উঠছে এবং শেষতক্ ভক্তিতে নুয়ে পড়েছে। ... ইসলামী একেশ্বর বাদের প্রতি গ্যেটে গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর মতে “আল্লাহর এই নিরঙ্কুশ হাতিয়ার দিয়েই মুহাম্মদ (স.) বিশ্ব বিজয়ী হয়েছিলেন।”
গ্যেটের নিম্নোক্ত বাণী সুপ্রসিদ্ধ :
“ইসলামের অর্থ যদি হয় আল্লাহর বিধানের প্রতি আত্মসমর্পণ, তবে আমরা সকলেই ইসলামী নীতি অনুযায়ী বেঁচে থাকি এবং ইসলামী নীতি অনুযায়ীই মৃত্যুবরণ করি।”(৪)
গ্যেটের সমসাময়িক বিলাতের বিখ্যাত কবি উইলিয়ম ব্লেক ( ১৭৫৭- ১৮২৭)। কবি ধর্মের বিজয় বার্তা প্রচার করতে চেয়েছেন। কবি লিখলেন:
Bring me my bow of burning gold!
Bring me my arrows of desire!
Bring me my spear! oh clouds unfold!
Bring me my chariot of fire!
I will not erase from mental flight.
কবি তাঁর এ লেখার মধ্য দিয়ে অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যাবার দৃঢ় ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। যতদিন না ইংল্যাণ্ডের ভূমিতে পবিত্র জেরুজারেনমের অবস্থান তথা ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠিত না হবে ততদিন তার হাত থেকে তরবারি খসে পড়বে না আর হৃদয়ের বাসনা থাকবে জাগরুক।
উইলিয়ম ব্লেক একজন অতীয়ন্দ্রবাদী বিশ্বাসী কবি ছিলেন। কবি তার প্রভাব বিস্তার করেছেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আইরিশ জাতীয়তাবাদী কবি উইলিযম বাটলার ইয়েটস-এর উপর। ইয়েটস এ সত্য স্বীকার করে বলেছেন, ব্লেকের প্রফেটিক বই আমার মনোরাজ্যে বিপ্লব ঘটিয়েছে। ইয়েটস ছিলেন অলৌকিকতায় বিশ্বাসী বৈজ্ঞানিক জড়বাদ বিরোধী অপ্রাকৃত ও থিওসফিতে আকৃষ্ট কবি। ইয়েটস সন্ধান করেছেন চিরন্তনকে, যা তাঁর ‘সেইলিং টু বাইজেন্টাইন’ (Sailing to Byzantium) কবিতায় পরিস্ফুটিত হয়েছে।
কবি সত্তা ব্যক্তিত্ব নিরালম্ব বস্তু নয়, অর্থাৎ দেশ ও কাল গত পরিবেশ নিরপেক্ষ নয়। পশ্চিমা সাহিত্যিকদের সাহিত্য চর্চা তাদের পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু অন্তরের সুর স্থান কালের সীমারেখা না মেনে সব দেশে সবকালে একই রকম বেজে উঠেছে। তাই সাহিত্যে ধর্মীয় চেতনার প্রতিফলন সব দেশে সব কালে কম বেশি ছিল, আজও আছে। কিন্তু সামাজিক বিবর্তন ও পরিবর্তনের ধারায় যারা সাহিত্য থেকে ধর্মীয় মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে শুধু রসের চর্চায় মেতে থাকতে চান তারা অন্তরের ডাক শোনেন না বা শোনলেও বুঝতে অক্ষম। আজ বাংলা সাহিত্যে যারা অন্তরের বেজে ওঠা সুরকে বধিরতার ভনিতায় শুনতে না রাজ তাদের উচিত পাশ্চাত্য সাহিত্যের আঙ্গিনায় হাজির হয়ে গ্যেটে, ব্লেক, ওয়ার্ডস ওয়ার্থ, ইয়েটস প্রমুখদের সাথে তাল মিলিয়ে সাহিত্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা।
তথ্যসূত্র :
(১) সাহিত্য ও বিশ্বাস-সৈয়দ আলী আহসান
(২) ড.এ্যানমেরী শিমেল-তারী
(৩) নতুন আলোকে ইকবালের চিন্তাধারা - লেঃ কর্ণেল কে . এ রশীদ
(৪) ইকবাল ও গ্যেটে-মুমতাজ হাসান।
Source: www.dailysangram.com
No comments:
Post a Comment