এডভোকেট আব্দুস সালাম প্রধান : ॥ পূর্বপ্রকাশিতের পর ॥
বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে জটিলতা : ইসলামী শরীয়তে যেহেতু বাল্য বিবাহ পরিহার করার ক্ষেত্রে কোন গোনাহ নেই। সে কারনে বাল্যবিবাহ পরিহার করাই বেশী যুক্তিযুক্ত। পৃথিবীর সব দেশের ছেলেমেয়েরা ছোট বেলায় একইভাবে বেড়ে উঠেনা। পৃথিবীর অনেক দেশের ছেলেমেয়েরা নয়, দশ, এগার বা বার বছর বয়সের মধ্যে বিশাল এক শক্তিশালী দেহের অধিকারী হয়। যেমন পাকিস্তানের খাইবার পাখতুন প্রদেশ, আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার দেশ সমূহের ছেলেমেয়েরা। কিন্তু বাংলাদেশ, ভারতের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। আমাদের বাংলাদেশের মেয়েরা ষোল থেকে আঠারো বৎসরের আগে এবং ছেলেরা আঠারো থেকে তেইশ বৎসরের আগে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে বিবাহের জন্য শক্তিশালী দেহের অধিকারী হয় না। তাছাড়াও বিবাহের পর দাম্পত্য জীবন যাপন, সন্তান গ্রহণ এবং সন্তান প্রতিপালনের ন্যায় দায়িত্বপালনের জন্য মানসিক ক্ষমতার অধিকারী হয় না। স্বল্প সংখ্যক ছেলে মেয়ে বার, তের, চৌদ্দ বৎসরের মধ্যেই সুস্থ সবল দেহের অধিকারী হতে দেখা যায়। কিন্তু সে সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। আমাদের দেশের প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা বাল্য বিবাহের ক্ষেত্রে নানারুপ জটিলতার সৃষ্টি করেছে। আমার জানা একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। দুজন অন্তরঙ্গ বন্ধু তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ককে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্য তাদের সদ্য জন্ম নেওয়া কন্যা ও পুত্রের সাথে বিবাহ দেয়। এ ধরনের বিবাহকে কোলাকুলি বিবাহ বলা হত। ছেলে শিশুটি বেড়ে উঠার একপর্যায়ে খারাপ বন্ধুদের সংস্পর্শে এসে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। পড়াশোনায় ভাল রেজাল্ট করতে না পেরে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে থেমে যায়। কিন্তু মেয়ে শিশুটি সুস্থ শরীরে বেড়ে উঠে। লেখাপড়াতেও ভাল ফলাফল করে। একপর্য়ায়ে বাল্যবিবাহটি অকার্যকর হয়ে যায়। বাল্যবিবাহটি অকার্যকর হবার কারনে দু বন্ধুর বন্ধুত্বের বন্ধন চিরতরে ছিন্ন হয়ে যায়।
মেয়েটি ভাল ছাত্রী হিসেবে স্নাতোকোত্তর পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করে উত্তীর্ণ হলেও তার পরিবারকে মেয়েটির পরবর্তী বিবাহের ক্ষেত্রে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। এ ধরনের জটিলতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়ার জন্য মেয়েটি দায়ী ছিল না। বরং তার পিতার সম্পাদিত বাল্যবিবাহই জটিলতার সৃষ্টি করেছিল। দুজন কিশোর কিশোরীর মধ্যে বা একজন পরিপূর্ণ সাবালক যুবক এবং একজন কিশোরীর মধ্যে বিবাহ দেয়ার ক্ষেত্রেও এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। ধরা যাক কোন নাবালিকা মেয়ে যাকে নাবালক অবস্থায় তার পিতা বা কোন অভিভাবক বিবাহ দিয়েছিল। সে যদি সাবালকত্ব অর্জনের পর দেখে যে তার স্বামী অশিক্ষিত বা মাদকাসক্ত বা কর্কশ স্বভাবের। তাহলে স্বামীর সাথে যৌনমিলনের পূর্বেই মেয়েটি তার বাল্যবিবাহ বাতিল করার অধিকার রাখে। ইসলামে এ ধরনের একটি সুন্দর নীতিমালা ইসলামে থাকার পরেও বাল্যবিবাহের কারণে মেয়েটির পরবর্তী বিবাহের ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হবে না তা কোনভাবেই বলা যাবে না। রসুলুল্লাহ (দ.) এর যুগে এবং পরবর্তীকালে সাহাবায়ে কেরামের যুগে তালাকপ্রাপ্তা বা বিবাহিতা কোন নারী অবিবাহিতা থাকত না। আমাদের দেশের পরিস্থিতি ভিন্ন। আমাদের দেশের তালাকপ্রাপ্তা বিধবা মেয়েদের পরবর্তী বিবাহ সহজসাধ্য নয়। আমাদের দেশের স্বাভাবিক সংস্কার হলো একজন অবিবাহিত যুবক অবশ্যই একজন অবিাহিতা মেয়েকে বিবাহ করবে। আর তালাকপ্রাপ্তা বা বাধ্য হয়ে তালাক গ্রহণকারী এবং বিধবা মেয়েরা যত সুন্দরই হোক তাদের বিবাহ হবে বয়স্ক কোন পুরুষের সাথে বা যাদের স্ত্রী বিয়োগ ঘটেছে বা ঘড়ে পূর্বের স্ত্রী আছে এমন পুরুষের সাথে বিবাহ দিতে হয়। ইদানিংকালে কিছু কিছু ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বাল্যবিবাহ পরিহার করাই হবে যুক্তিযুক্ত। তবে উঠতি বয়সের কিশোর কিশোরীদের মধ্যে অবাধ মেলামেশার ফলে যাতে কোন মেয়ে কিশোরী বয়সে গর্ভধারণ না করে, সেদিকে অভিভাবকদের কড়া নজর রাখতে হবে। শিশু বা কিশোর বয়সে ছেলেমেয়েদের বিবাহ দেয়া হলে তারা একটা বন্দী বা শৃঙ্খলিত জীবন নিয়ে তারা পরিপূর্ণ সাবালকত্বের বয়সে পা দেয়। অনেক সময় এ ধরনের বিবাহের মাধ্যমে জুড়ে দেয়া স্বামী স্ত্রীর সংসার সুখের হয় না। দুটি পরিবারের সু সম্পর্কের কারণেই সাধারণতঃ এধরনের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। কোন কারনে এধরনের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে দুটি পরিবার পরষ্পর শত্রুতে পরিণত হয়। বাল্যবিবাহ সম্পাদন এবং পরিহার দুটিই ইসলামে জায়েজ। যে জায়েজটি সমাজের জন্য বেশী কল্যাণকর সেটি গ্রহণ করা উচিৎ। ইসলামে এই নীতিমালাকে ইস্তিহ্সান বলা হয়। অর্থাৎ দুটি ভালর মধ্যে অপেক্ষাকৃত ভালটিকে গ্রহন করা। বাল্য বিবাহ আইনের মাধ্যমে বন্ধ করার চাইতে এর কুফল তুলে ধরে গণসচেতনতা সৃষ্টি করাই যথেষ্ঠ হবে। গণসচেতনতা সৃষ্টি হলে আইন প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না। এছাড়াও আমাদের দেশের জনগনের বিরাট একটি অংশ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। অনেক সময় হতদরিদ্র ঘরের পিতা মাতারা তাদের তরুণী বা যুবতী মেয়েকে আর্থিকভাবে সচ্চল অতিবয়স্ক পুরুষদের সাথে বিবাহ দেন। এধরনের বিবাহ এখনও সংঘটিত হচ্ছে। এধরনের বিবাহে কিছুদিনের মধ্যে অনেক মেয়েই বিধবা হন। তাদের যৌবনের বিরাট একটি অংশ বৈধব্য জীবন নিয়ে কাটিয়ে দিতে হয়।
ইসলামী বিবাহ আইনের খিয়ারই বুলুগ নীতি :
নাবালক বা নাবালিকার বিবাহ তাদের পিতা বা অভিভাবক কতৃক নাবালক অবস্থায় সম্পাদিত হইয়া থাকিলে সাবালকত্ব অর্জনের পর ঐ ধরনের বিবাহ বাতিল করার অধিকার ছেলেমেয়েদের রয়েছে। এই নীতিমালাটিকে ইসলামী আইনে খিয়ারই বুলুগ বলা হয়। এ ব্যাপারে ইসলামী আইনবিদগণের মধ্যে ইমাম আবু হানিফা (র.) এবং তার ছাত্ররা (আবু ইউসুফ র. ব্যতীত) অত্যন্ত উদার। আইনগত অভিভাবক পিতা, পিতার অবর্তমানে দাদাসহ যেকোন ডিফ্যাক্টো গার্ডিয়ান কর্তৃক নাবালক নাবালিকার বিবাহ সাবালকত্ব অর্জনের পর বাতিল করিবার অধিকার আছে মর্মে তাহারা ফতোয়া দিয়েছেন। এই ফতোয়ার স্বপক্ষে দলিল হলো সহীহ বুখারীর হাদিস নং ৫৩৩৮ এবং ৫৩৩৯। খানসা বিনতে খিযামা আনসারিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন তিনি যখন কুমারি ছিলেন তখন তার পিতা তাকে বিবাহ দেন। ঐ বিবাহ খানসার (রা.) পছন্দ ছিল না। রসুলুল্লাহ (দ.) তার নিকট সবকিছু শুনে বিবাহটি বাতিল ঘোষণা করেন। ইসলাম বিবাহযোগ্যা কুমারি, বিধবা এবং তালাক প্রাপ্তা সকল নারীর বিবাহ তার অনুমতি ছাড়া নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রসুলুল্লাহ (দ.) বলেছেন কোন কুমারী মেয়ের অনুমতি ছাড়া তার বিয়ে দেয়া যাবে না। রসুলুল্লাহ (দ.) কে জিজ্ঞাসা করা হলো কিভাবে (বিশেষতঃ কুমারী মেয়েদের ক্ষেত্রে) অনুমতি নেয়া হবে। তিনি বললেন (অনুমতি চাওয়ার পর) চুপ থাকাই তার সম্মতি। উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন কুমারী মেয়েদের অনুমতি গ্রহনের ক্ষেত্রে তাদের লাজুকতার বিষয়ে উলেল্লখ করে তিনি রসুলুল্লাহ (দ.) কে জিজ্ঞেস করলেন যে ইয়া রসুলুল্লাহ কুমারী মেয়েরা নিশ্চয়ই লজ্জা করে (বিবাহের অনুমতি দানের ক্ষেত্রে)। রসুলুল্লাহ (দ.) বললেন তার চুপ থাকাটাই তার সম্মতি। সহীহ বুখারী হাদিস নং ৩১৩৭। ইসলামে নারী পুরুষের বিবাহের ক্ষেত্রে তাদের সাবালকত্ব প্রাপ্তি হচ্ছে তাদেরসাধারন বয়স সীমা। উক্ত বয়সে পৌছার পরেই একজন যুবক যুবতী কেবল ইসলামের বিবাহ আইনের যাবতীয় শর্তাবলী যেমন ইজাব কবুল, মোহরানা, খোরপোশের বিধানসমূহ সরাসরি কার্যকর করা যায় সেই সাথে তালাকের বিধানসমূহ প্রয়োগ করা যায়।
গোটা বিশ্বের মুসলমান ছেলেমেয়েদের বিবাহের বয়সের মানদন্ড কত হওয়া উচিত : রসুলুল্লাহ (দ.) এবং মক্কায় ইসলাম গ্রহনকারী সাহাবায়ে কেরাম (রা.) নবুয়তের তের তম বর্ষে স্বপরিবারে মদীনায় হিজরত করেন। রসুলুল্লাহ (দ.) এর নেতৃত্বে মদীনায় একটি আদর্শ ইসলামী সমাজ বা একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামী রাষ্ট্র মদীনায় ইসলামী আইনের বাস্তবায়ন শুরু হয়। দ্বিতীয় হিজরী সনে তিনি তাঁর অতি আদরের ছোট মেয়ে ঊনিশ বৎসর বয়স্কা ফাতিমা (রা.) এর সহিত চব্বিশ বৎসর বয়স্ক চাচাতো ভাই আলী (রা.) এর বিবাহ দেন। মুসলীম উম্মাহ তাদের ছেলেমেয়েদের বিবাহের ক্ষেত্রে ফাতিমা (রা.) এবং আলী (রা.) এর বয়স কে আদর্শ বয়স হিসাবে গ্রহণ করতে পারে। বিশুদ্ধ মতানুযায়ী রসুলুল্লাহ (দ.) এর নবুয়ত লাভের সময় আলী (রা.) এর বয়স ছিল দশ বৎসর (তাবকাতে ইবনে সাদ)। আর ফাতেমা (রা.) ছিলেন রসুলুল্লাহ (দ.) এবং খাদিজাতুল কুবরা (রা.) এর ছোট মেয়ে। নবী করীম (দ.) এর ওহী লাভের পাঁচ বৎসর পূর্বে কাবা ঘর পূনঃনির্মাণের বছর ফাতিমা (রা.) জন্মগ্রহণ করেন। (সিয়ারুআলামআন্নুবালা দ্বিতীয় খন্ড পৃষ্ঠা ১১৯)। হিজরতের বৎসর ফাতেমা (রা.) এর বয়স ছিল আঠারো ছুঁই ছুঁই। আলী ও ফাতেমা (রা.) এর বিবাহের বয়স গণনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকগণের আরো কিছু বর্ণনা আছে। বর্ণনাগুলি পরস্পর বিরোধী হওয়ায় সেগুলি গ্রহণযোগ্য নয়। বিবাহের বয়সের এই সিমাটি মান্য করা ফরজ নয়। এই বয়স সীমার আগে বা পরেও বিবাহ হতে পারে। তবে নিঃসন্দেহে মেয়েদের বিবাহের ক্ষেত্রে ঊনিশ এবং ছেলেদের বিবাহের ক্ষেত্রে চব্বিশ বৎসরের বয়স সীমাকে সুন্নাহ সম্মত বয়স সীমা বলা যায়। নবী করিম (দ.) কখনই তাঁর উম্মতকে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে উৎসাহিত করেননি। বরং তিনি একজন মুসলিম যুবকের সাথে একজন কাছাকাছি বয়সের মুসলমান যুবতীর বিবাহ হোক সে বিষয়ে উৎসাহিত করে গিয়েছেন। বাংলাদেশের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ এ উল্লেখিত বিবাহের বয়স মেয়েদের জন্য কমপক্ষে আঠারো এবং ছেলেদের জন্য কমপক্ষে একুশ বৎসরের সীমাটি ইসলামী শরীয়তের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
রসুলুল্লাহ (দ.) এর সাথে আয়েশা (রা.) এর বিবাহ বাল্যবিবাহ ছিল কিনা : আধুনিক বিশ্বে মুসলমান তথা ইসলামী আদর্শকে হেয় করার জন্য এবং মহানবী (দ.) এর একাধিক বিবাহ ও অল্প বয়সী আয়েশা (রা.) কে বিবাহ করা নিয়ে একধরনের মিথ্যাচার করে তাঁর চরিত্র হনন করে মুসলমানদের মনে কষ্ট দেয়ার একটা মহাপ্রচার যুদ্ধ শুরু করা হয়েছে। এই প্রচারণার ফলে আল্লাহর শত্রুরা বিশেষ করে সাধারণ শিক্ষিত মুসলমানদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে যে মুহাম্মদ (দ.) এর সমস্ত কার্যক্রম ভালো বা প্রশংসনীয়। কিন্তু আয়েশা (রা.) এর সাথে তার বিবাহটি ব্যতিক্রম। আমার এক বন্ধু আমাকে একদিন বললেন বিষয়টির কারণে তিনি লজ্জাবোধ করেন (নাউজুবিল্লাহ)। তিনি বলেছিলেন বিষয়টি নবী (দ.) এর অন্যান্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে খাপ খায় না। ইদানিং এ ধরনের একটি বিষয় কতিপয় নাস্তিক মুরতাদ ব্লগার অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ আলোচনার ভিডিও প্রস্তুত করে ইউটিউবে আপলোড করেছেন। পাশ্চাত্যের কার্টুন ছবি নির্মাতারা হযরত আয়েশা (রা.) এর সাথে রসুলুল্লাহর বিবাহের কাহিনীকে অবলম্বন করে বেশ কিছু ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন ছবি নির্মাণ করে গুগল ও ইউটিউবে আপলোড করেছেন। তাদের আশা ভবিষ্যতের মুসলিম প্রজন্ম এসব দেখে যেন রসুলুল্লাহ (দ.) কে চরিত্রহীন, শিশু ধর্ষণকারী হিসাবে জানে। এ বিষয়ে প্রথম যুগের ইসলামী আইনবিদ ও বিশেষজ্ঞগণ কোন আলোচনা করেন নাই।
সে কারণে আধুনিক আলেম সমাজ ও ইসলামী বিশেষজ্ঞগণও এ বিষয়ে তথ্যভিত্তিক যুক্তিপূর্ণ কোন আলোচনা সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত বা সাধারন মুসলমানদের সামনে তুলে ধরেন নাই। ফলে নাস্তিক মুরতাদরা এক তরফা ডুগডুগি বাজানোর সুযোগ পেয়েছে। এ বিষয়ে একটি তথ্য নির্ভর বস্তুনিষ্ঠ জবাব সকল মুসলমানের নিকট থাকা উচিৎ। প্রাথমিক যুগের ইসলামী আইনবিদ, ঐতিহাসিক এবং রসুলুল্লাহ (দ.) এর জীবনী রচয়িতাগণের আলোচনায় দেখা যায় রসুলুল্লাহ (দ.) এর আপন ফুফাতো ভগ্নি যয়নাব বিনতে জাহাশ (রা.), যাকে তিনি তার পালিত পুত্র যায়িদ বিন হারেছা (রা.) এর সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন। পরে যয়নাব বিনতে জাহাশ (রা.) (যায়িদ বিন হারেছা (রা.)) কে স্বামী হিসাবে মেনে না নেয়ায় যায়িদ বিন হারেছা (রা.) তাকে তালাক দেন। পরে আল্লাহর হুকুমে রসুলুল্লাহ (দ.) যয়নাব বিনতে জাহাশ (রা.) কে বিবাহ করেন। পালিত ছেলের স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন সেই ধুয়া তুলে রসুলুল্লাহ (দ.) এর চরিত্র হননের ব্যাপক প্রচেষ্টা চালায় তৎকালীন মুনাফিক ও ইসলামের শত্রুরা। একটি যুদ্ধে আয়েশা (রা.) রসুলুল্লাহ (দ.) এর সাথে ছিলেন। যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে প্রাকৃতিক প্রয়োজনে আয়েশা (রা.) উটের পিঠে স্থাপিত হাউদাজ ছেড়ে দূরে চলে যান। ইতিমধ্যে যোদ্ধা দলের কাফেলা রসুলুল্লাহ (দ.) সহ চলতে শুরু করে। আয়েশা (রা.) সেখানে এসে কাউকে না পেয়ে দুঃখ ভরা মন নিয়ে শরীর চাদরে ঢেকে বসে থাকেন। সৈন্যদলের কোন কিছু নেয়া বাদ পড়েছে কিনা তা দেখার দায়িত্বপ্রাপ্ত সাহাবী সাফওয়ান বিন মুয়াত্তাল (রা.) সেখানে উপস্থিত হয়ে আয়েশা (রা.) কে দেখতে পান এবং তিনি নিজের উটের পিঠে তাকে উঠায়ে নিয়ে মদিনায় ফেরেন। ঘটনাটিকে নিয়ে মুনাফিকগণ আয়েশা (রা.) এর চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করে রসুলুল্লাহ (দ.) এর মনে কষ্ট দিতে থাকে। পরে হযরত আয়েশার (রা.) নির্দোষ হবার ব্যাপারে সুরা আন নুরের ২৩ নং আয়াত নাজিল হয়। এই আয়াতে আয়েশা (রা.) কে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়। মিথ্যা অপবাদ দান কারীদের কোরআনের বিধানের নির্ধারিত শাস্তি প্রদান করা হয়। হযরত আয়েশা (রা.) কে রসুলুল্লাহ (দ.) যদি মাত্র ছয় বছর বয়সে বিবাহ করে থাকেন তাহলে সে যুগে কেন বিষয়টি নিয়ে অপপ্রচার হল না ? অপপ্রচারটি শুরু হল রসুলুল্লাহ (দ.) এর ইন্তিকালের চৌদ্দ কিংবা পনের শত বৎসর পর। মনে হচ্ছে যেন আয়েশার (রা.) দরদে এদের কলিজা ফেটে যাচ্ছে। রসুলুল্লাহ (দ.) ঠিক কত বছর বয়সে আয়েশা (রা.) কে বিবাহ করেছেন নির্ভরযোগ্য হাদিছ গ্রন্থ বা তাবকাত ও রসুলুল্লাহ (দ.) সীরাত বা জীবনী রচয়িতা ইতিহাসবিদ এবং হাদিস বিশারদদের সন্নিবেশিত একাধিক তথ্য পাওয়া যায়। তথ্যসমূহের মধ্যে একটি তথ্যমতে আয়েশা (রা)কে রসুলুল্লাহ (দ.) ছয় বছর বয়সে বিবাহ করেন। আর দৈহিক মিলন করেন নয় বছর বয়সে। যদি এই তথ্যটিকে সত্য বলে মেনে নেয়া যায় তাতে মুসলমানদের লজ্জিত হবার কোন কারন নাই। এর কারন মুসলমানদের ইসলামের জ্ঞান লাভের দুটি মূল উৎস আল কোরআন এবং আল হাদিস। হাদিস হচ্ছে রসুলুল্লাহ (দ.) এর বাণী,কর্ম এবং অনুমোদন। প্রায় সত্তরটির অধিক হাদিস গ্রন্থের নাম আমরা জানতে পেরেছি। সবগ্রন্থে বর্ণনাকারী গণের নাম বাদ দিলে এবং শুধুমাত্র হাদিস অংশগুলো হিসেব করলে তা দশ হাজার অতিক্রম করে না। সিহাহ সিত্তাহ এবং মুয়াত্তা মালিক গ্রন্থগুলির হাদিসগুলিকে বিষয়ভিত্তিক আলাদা করলে দেখা যাবে হাদিসের সংখ্যা আট হাজারের নীচে। ঐ হাদিসগুলির মধ্যে বিরাট সংখ্যক হাদিসের বর্ণনাকারী আবু হুরায়রা (রা.)। তার পরের স্থান হযরত আয়েশা (রা.)। হযরত আবু হুরায়রা বর্ণিত হাদিস সংখ্যা পাঁচ হাজার তিনশত চুয়াত্তর। হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা দুই হাজার দুইশত দশ। আর একটি বর্ণনামতে চার হাজারের কিছু বেশী। যাহোক আয়েশা (রা.) কে যদি রসুলুল্লাহ বিবাহ না করতেন তাহলে কমপক্ষে দুই হাজার দুইশত দশটি হাদিস থেকে মুসলমানরা বঞ্চিত হত। আয়েশা (রা.) এর সঙ্গে রসুলুল্লাহ (দ.) এর সংসারে আরো নয়জন স্ত্রী একইসাথে বিদ্যমান ছিল। কিন্তু অন্য নয় জনের মধ্যে উম্মে সালমা (রা.) ছাড়া বাকি অন্যান্য উম্মুল মুমীনীনগণের মাধ্যমে হাতে গোনা কয়েকটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। আয়েশা (রা.) একাধারে হাদিস বর্ণনাকারী এবং ফকীহা অর্থাৎ ইসলামী আইন বেত্তাও ছিলেন। অনেক বড় বড় হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবী ফিকহি মাসআলার সমাধান দানের ক্ষেত্রে তার ধারে কাছেও পৌঁছতে পারেন নাই। আয়েশা (রা) এর যদি ছয় বছর বয়সে ৪৫ বা ৫০ বৎসর বয়সী মহানবী (দ.) এর সাথে বিবাহ হয়ে থাকে তাহলে ঐ বিবাহ দ্বারা আয়েশা (রা.) কি হারিয়েছেন? তিনি হারিয়েছেন ১৮ বৎসর বয়স থেকে পরবর্তী ৩২ বৎসর এর যৌন চাহিদা পূরণের মধুময় সময়। (চলবে)
No comments:
Post a Comment