ড. মো. নূরুল আমিন : ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ব্রতি বর্তমান বিশ্বের প্রাচীনতম ইসলামী আন্দোলন ও দল মিসরের ইখওয়ানুল মুসলেমিনের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও দলটির রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম ও জাস্টিস পার্টির চেয়ারম্যান, মিসরের ইতিহাসে প্রথমবারের ন্যায় অবাধ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসি কারাগারে অন্তরীণ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন)। মৃত্যুকালে তিনি তার জন্য গঠিত বিশেষ আদালতে কাচের খাঁচায় দাঁড়িয়ে মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগের জবাব দিচ্ছিলেন। এ অবস্থায় হঠাৎ তিনি অজ্ঞান হয়ে খাঁচার মধ্যে পড়ে যান। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী ২০ মিনিট পর্যন্ত তার সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসেননি। আদালত তার প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য কোনও ডাক্তারও ডাকেনি। পরে তাকে হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় তার এই মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না, তার এই মৃত্যুকে রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞ বলে অভিজ্ঞমহল মনে করেন। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিত প্রাণ এই মহান নেতার অকাল মৃত্যু প্রকৃতপক্ষে শাহাদাতের মৃত্যু। জেলখানায় সরকারি নির্যাতন উপেক্ষা ও অবহেলায় ছয় বছরে তিনি এতই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন যে, জালেমের কারাগারে জালেম নির্মিত কাচের খাঁচায় দাঁড়িয়ে কথা বলার ক্ষমতাও তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছেন। এটা ছিল একটা রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড, ঠাণ্ডা মাথায় খুন। এই খুনের সাথে মিশরের সামরিক শাসক জেনারেল সিসিও তার সহযোগী কর্মকর্তাবৃন্দ, মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতালিপ্সু শাসকরা এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ইসলামী বিদ্বেষী ইহুদিবান্ধব শক্তি ও রাষ্ট্রসমূহ যৌথভাবে জড়িত ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রগুলোর বেশির ভাগ মিশরের গণতান্ত্রিক ও ইসলামী পুনরুত্থানে শংকিত ছিল। তারা মুরসি হত্যাকাণ্ড ও ইখওয়ান ধ্বংসে সিসিকে সহায়তা করেছে বলে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মত প্রকাশ করেছেন। ড. মুরসি বহু প্রতিভার অধিকারী একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ ছিলেন। মিশরের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হওয়া ছাড়াও তিনি ছিলেন একাধারে একজন প্রথিতযশা প্রকৌশলী, ডক্টরেট ডিগ্রীধারী উঁচুমানের শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, কুরআনে হাফেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিভাগীয় প্রধান, ইখওয়ানুল মুসলেমিনের অন্যতম শীর্ষ নেতা এবং ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টির চেয়ারম্যান। রাজনীতির কথা বাদ দিলেও তিনি একজন উচ্চ শিক্ষিত প্রথম শ্রেণীর নাগরিক, ইসলামী ও পাশ্চাত্য উভয় শিক্ষায় শিক্ষিত মননশীল একজন ব্যক্তি। কারাগারে তার প্রতি আচরণ ছিল নিকৃষ্ট ও অমানবিক। তাকে শারীরিক ও মানসিক উভয়ভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। কুরআন ছিল তার প্রাণ। কুরআনী বিধান বাস্তবায়ন ছিল তার জীবনের লক্ষ্যমাত্রা। কারাগারে তিনি জালেমদের কাছে এক জিলদ কুরআন চেয়েছিলেন কিন্তু পাননি। তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “আমি তাদের কাছে কারাগারে একটা কুরআন চেয়েছিলাম, তারা দেয়নি। কিন্তু ওরা জানেনা ৪০ বছর আগে আমি কুরআন মুখস্ত করেছি। কুরআনকে ছু’তে চেয়েছিলাম,” একজন মুমিনের জীবনে এই ঘটনা অত্যন্ত মর্মান্তিক।
ড. মুরসি ডায়াবেটিস এবং লিভার ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন। এই উভয় রোগের চিকিৎসা, পরিচর্যা এবং সময়ে সময়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা অপরিহার্য। প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা পাওয়া তার মৌলিক অধিকারের অপরিহার্য অংশ ছিল। জেলখানায় তাকে চিকিৎসা সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তার রক্তের সুগার লেবেল কমে যাওয়ায় তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসার সুযোগ দেয়া হলে তিনি হয়তো এভাবে মারা যেতেন না। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনগণের নেতা হিসেবে মিশরের অবৈধ সরকার ড. মুরসির প্রতি ন্যূনতম সম্মান দেখানো তো দূরের কথা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতিও সামান্যতম সম্মান প্রদর্শন করেননি। অবশ্য মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ লংঘন এবং গণহত্যায় পটু জেনারেল সিসির সরকারের কাছে এই দয়া, মানবিকতা ও নৈতিক মূল্যবোধ আশা করাও বৃথা। মিশরের ইতিহাসের সবচেয়ে অবাধ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটাধিক্যে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর যেতে না যেতেই দেশটির সামরিক প্রধান জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি ২০১৩ সালে রক্তাক্ত মিলিটারী ক্যুর মাধ্যমে ড. মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশটির কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। এই ক্যুতে তার গৃহীত পদক্ষেপ সমূহ নীতি-নৈতিকতা, মানবতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী বলে প্রমাণিত হয় এবং তিনি গণহত্যার জন্য এক নির্মম কসাইয়ের খেতাব পান। তার নির্দেশে মিশরীয় সৈন্যরা ২০১৩ সালের ১৪ই আগস্ট কায়রোর রাবা আল আদাবিয়া স্কয়ারে একই দিন ১৫০০ লোককে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ড থেকে যারা বেঁচেছিলেন তাদের গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় এবং সেখানে তাদের সীমাহীন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার বানানো হয়। এখানেই শেষ নয়, ইখওয়ানুল মুসলেমিনকে বেআইনি ঘোষণা করে তাদের লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে জেলে নিক্ষেপ করা হয়। গ্রেফতাকৃতদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে তার সৃষ্ট ক্যাঙ্গারু আদালতে বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে তাদের জেল জরিমানা এবং ফাঁসির শাস্তি দেয়া হয়।
পাশ্চাত্যের সরকারগুলো এবং গণতন্ত্রের প্রবক্তারা নব্য এই ফেরাউনের এই নির্মম অমানবিকতার কোনও প্রতিবাদ করেনি বরং ইসরাইলের ইন্ধনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলো ইসলাম নির্মূলের হাতিয়ার হিসাবে সিসিকে ব্যবহার করেছে। প্রতিবেশী মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ আরব রাজতান্ত্রিক দেশগুলো নিজেদের গদীকে হুমকিমুক্ত করার জন্য মিশরের গণতান্ত্রিক উত্থানকে প্রতিহত করার জন্য সিসিকে সহযোগিতা করেছে। এমনও শোনা গেছে যে, পার্শ্ববর্তী একটি মুসলিম দেশের একজন বাদশাহ স্বয়ং কায়রো বিমানবন্দরে ব্যক্তিগত বিমানে কোটি কোটি ডলারের তহবিল নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। তিনি বিমান থেকে নামেননি, আল সিসি বিমানে উঠে তাকে সালাম জানিয়ে এই তোহফা গ্রহণ করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ পাশ্চাত্য দেশগুলোর ইসলাম বিদ্বেষী শাসক ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ইসরাইলকে নিয়ে মিশরের এই অবৈধ স্বৈরশাসককে শুধু উৎসাহিত করেনি বরং মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক দেশগুলোকেও নানাভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। তারা ড. মুরসি ও তার দলের উপর নির্যাতন প্রত্যক্ষ করে সিসিকে বাহবা দিচ্ছিলেন। ড. মুরসি কারাগারে কিভাবে আছেন তা দেখা ও জানার কারুরই সুযোগ ছিল না। তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দল কাউকেই তার সাথে দেখা করতে দেয়া হচ্ছিল না। এই অবস্থায় ২০১৮ সালে ড. মুরসির পরিবারের অনুরোধে বৃটিশ হাউজ অব কমন্স এর ফরেন এফেয়ার্স সংক্রান্ত সিলেক্ট কমিটির একজন সাবেক সভাপতি ও এমপি জনাব ত্রিসপিন ব্লান্ট মিশর সফর এবং জেলখানায় ড. মুরসির অবস্থা প্রত্যক্ষ করতে রাজি হন। জনাব ব্লান্ট মিশর সরকারের অনুমতি নিয়ে এই সফর করেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট মুরসির অবস্থা অবহিত হয়ে একটি রিপোর্ট প্রদান করেন। রিপোর্ট অনুযায়ী সিসি প্রশাসন ড. মুরসির প্রতি এতই নিষ্ঠুর ও অমানবিক ছিলেন যে, প্রায় ছয় বছরে মাত্র তিনবার তারা ড. মুরসির পরিবারকে তার সাথে সাক্ষাতের অনুমতি দিয়েছিল।
ব্লান্ট রিপোর্টে কয়েকটি মর্মান্তিক বিষয় উঠে আসে। ড. মুরসি ডায়াবেটিস ও লিভার রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তাকে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অথচ মিশরীয় ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তিনি এই সেবা পাওয়ার যোগ্য। সেখানে তার চলাফেরা বা হাঁটা, ব্যায়ামেরও কোন ব্যবস্থা ছিল না। জেলকোড অনুযায়ী তিনি ভিআইপি মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। তাকে সাধারণ কয়েদি হিসাবে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে রাখা হয়েছে। রাত দিন ২৪ ঘণ্টার ২৩ ঘণ্টাই তিনি অন্ধকারে থাকতেন, মাত্র এক ঘণ্টা আলোর মুখ দেখতেন। তাকে প্রদত্ত খাবারের মান ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। তিনি খেতে পারতেন না। তিনি নিয়মিত অজু, গোসলের পানি পেতেন না। চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা ও ওষুধ পথ্যের অভাবে তার স্বাস্থ্য দিন দিন খারাপ হচ্ছিল এবং তিনি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছিলেন। জনাব ব্লান্ট আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, যদি এ অবস্থা অব্যাহত থাকে তাহলে ড. মুরসি শীঘ্রই মৃত্যুবরণ করবেন। প্রকৃতপক্ষে হয়েছেও তাই। এটা মৃত্যু নয়, ঠাণ্ডা মাথায় খুন, নরহত্যা। বৃটিশ সরকারের কাছে পেশ করা এই রিপোর্টের উপর তারা কোনও ব্যবস্থা নেননি, কেন নেননি তা সবাই জানেন। তার মৃত্যু শহীদি মৃত্যু, আল্লাহ তার শাহাদাত কবুল করুন, তাকে জান্নাতুল ফেরদাউসে স্থান দিন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারকে ধৈর্য ধরার তৌফিক দিন। আমরা তার মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্ত কামনা করি।
ড. মুরসির শাহাদাতের মাধ্যমে ইসলামিক বিশ্ব একজন মহান নেতাকে হারালো। তার জীবন ও সংগ্রাম এবং ইসলামের জন্য ত্যাগ যুগ যুগ ধরে ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
ফ্যাসিষ্ট ও মিলিটারী ডিক্টেটার আল সিসির অস্ত্রের মুখে ক্ষমতা দখল ও ড. মুরসির ইসলামী সরকারের পতনকে কেউ কেউ গণতন্ত্রের পতন বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং দাবি করছেন যে, গণতান্ত্রিক পন্থায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এই মন্তব্য ও বিশ্বাসটি সঠিক নয়। এখানে গণতন্ত্র সফল হয়েছে। জনগণ নানা প্ররোচনার মুখেও বিপুল ভোটে ড. মুরসিকে জয়ী করে ক্ষমতায় পৌঁছিয়ে দিয়েছে। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ক্ষমতালিপ্সা, ফ্যাসিবাদ, ইহুদী, খৃস্টান শক্তির ইসলাম বৈরিতা এবং প্রতিবেশী অগণতান্ত্রিক শক্তির মিথস্ক্রিয়ায় ড. মুরসিকে সরে যেতে হয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবেই ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রবণতার মোকাবিলা করতে হবে। দাওয়াত ও তরবিয়ত ব্যক্তি ও দলীয় চরিত্রকে পবিত্র ও সংহত করার জন্য তো থাকবেই। এখানে বিভ্রান্তির অথবা হতাশার কিছু নেই বলেই আমার বিশ্বাস।
Source: www.dailysangram.com
No comments:
Post a Comment