বিভিন্ন ধরনের সামরিক অস্ত্র তৈরীর পাশাপাশি ইরান এখন মহাকাশ প্রযুক্তিতে ও হাত দিয়েছে। ইতিমধ্যেই ইরান তার নিজস্ব প্রযুক্তিতে মহাশুন্যে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়েছে। নিংসন্দেহে এটা একটি বিরাট অর্জন। ইরান তার নিজস্ব প্রযুক্তিতে চালু করেছে হেভি ওয়াটার তৈরীর ইন্ডাষ্ট্রি, যা প্রযুক্তি ক্ষেত্রে তার উন্নতিরই সাক্ষ্য বহন করে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র গত ৫ই নভেম্বর থেকে ইরানের বিরুদ্ধে আবারো অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে। ইরানের রফতানি আয়ের প্রধান উৎস জ্বালানী তেলের রফতানি শুন্যের কোটায় নামিয়ে আনার মাধ্যমে ইরানের অর্থনীতি দুর্বল করা এবং এর মাধ্যমে ইরানের সরকার পরিবর্তনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য। ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত এই অর্থনৈতিক অবরোধকে ইসরাইল বরাবরের মতই সমর্থন জানিয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞার জবাবে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি অত্যন্ত দৃঢ় ও দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছে -তারা কিছুতেই এই অবরোধ মানবেনা এবং এই অবরোধকে তারা মোকাবেলা করেই এগিয়ে যাবে। বিশ্বের দুই পরাশক্তি রাশিয়া এবং চীন বরাবরের মতই ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধের নিন্দা জানিয়েছে এবং তারা ইরানের পাশে দাড়িয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ও এই অর্থনৈতিক অবরোধের বিরোধিতা করেছে। অপরদিকে ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও এই অবরোধের বিরোধিতা করেছে। এভাবে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ইস্যুতে বিশ্ব বরাবরের মতই বিভক্ত হয়েছে এবং অনেক শক্তিশালী দেশ ইরানের পাশে দাড়িয়েছে। আর এটা ইরানের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। সুতরাং ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা অবরোধে ইরান দুর্বল হবে না বরং সময়ের প্রেক্ষাপটে শক্তিশালী হবে।
ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত এই নিষেধাজ্ঞার প্রধান কারণ ইরানের পরমাণু কর্মসুচি। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের মতে ইরানের হাতে পরমাণু অস্ত্র থাকা বিশ্বের শান্তির জন্য হুমকি। ইরান যদি ও বারবার বলেছে- তার পরমাণু কর্মসুচী শান্তিপূর্ন এবং এটা তার দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুত চাহিদা মেটানোর জন্য, তবু যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আশংকা ইরান গোপনে পরমাণু বোমা তৈরীর জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। আর এজন্যই ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের দীর্ঘ বৈরিতা এবং দীর্ঘদিন ধরেই অর্থনৈতিক অবরোধ ছিল। ইরানের পরমাণু কর্মসুচী বন্ধ করার জন্য ২০১০ সালের ৯ জুন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইরানের বিরুদ্ধে চতুর্থ দফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। ইরানের বিরুদ্ধে এর আগেও তিন বার নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছিল। অবশেষে দীর্ঘ আলোচনা শেষে বিগত ২০১৫ সালের ১৪ ই জুলাই অষ্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় ইরানের পরমাণুু কর্মসুচি নিয়ে ইরানের সাথে বিশে^র ছয় পরাশক্তির সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির একপক্ষ হচ্ছে ইরান আর অপর পক্ষ হচ্ছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতার অধিকারী পাঁচটি পরমাণু শক্তিধর দেশ -যুক্তরাষ্ট্র ,রাশিয়া, চীন, বৃটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানি। তবে ইসরাইল বরাবরই এই চুক্তির বিরোধীতা করেছে। চুক্তিটি ওই বছরের ২০ শে জুলাই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদেও সর্বসম্মতভাবে পাশ হয়। চুক্তিটির সার সংক্ষেপ হচ্ছে – ইরান একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা পর্যন্ত তার পরমাণু কর্মসুচী চালাবে, তবে পরমাণু বোমা বানাবে না। বিনিময়ে ইরানের ওপর আরোপিত অথনৈতিক অবরোধ উঠে যায়। এই চুক্তির মাধ্যমে ইরানের পরমাণু কর্মসুচী নিয়ে ইরানের সাথে পশ্চিমা বিশ্বের দীর্ঘদিনের যে দ্বন্দ্ব, বৈরিতা এবং বাকযুদ্ধ ছিল তা থেকে বিশ্ববাসী আপাতত মুক্তি পায়। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে ক্ষমতার অধিষ্ঠিত হবার পর থেকেই ইরানের সাথে সম্পাদিত এই সমঝোতা চুক্তি থেকে সরে আসার কথা বলতে থাকেন এবং অবশেষে ২০১৮ সালের ৮ ই মে আনুষ্ঠানিকভাবে এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৫ ই নভেম্বর থেকে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র আবারো অর্থনৈতিক অবরোধ ঘোষণা করেন। তবে ইরানের সাথে সম্পাদিত চুক্তির অবশিষ্ট পাঁচটি দেশ – রাশিয়া, চীন, বৃটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানি এই চুক্তি মেনে চলার অঙ্গীকার করেন।
ইরানের পরমাণু কর্মসুচী বন্ধ এবং ইরানকে দুর্বল করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের যে অবিরাম প্রচেষ্টা তারই ধারাবাহিকতায় গত ৫ ই নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে আরোপিত এই নিষেধাজ্ঞায় ইরানের পরমাণু কর্মসুচী ধ্বংস হবে না এবং ইরান অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ও হবে না। তবে সাময়িক সমস্যায় পড়বে মাত্র, যা কাটিয়ে উঠা ইরানের পক্ষে কঠিন হবে না। ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তো বরাবরই আরোপিত ছিল। এবারের অবরোধ ও অতীতের অবরোধের মতই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। সেই ১৯৭৯ সালে খোমেনীর নেতৃত্বে ইরানে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতা দখলের পর থেকেই কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের সাথে ইরানের বৈরিতা চলছে। এই বৈরীতা চলে আসছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে। এসব মোকাবেলা করেই কিন্তু ইরান টিকে আছে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় ইরানের পরমাণু কর্মসুচী বন্ধ হয়ে যাবে এবং ইরান দুর্বল হয়ে যাবে এমনটি ভাবার কারণ নেই। মনে রাখতে হবে ইরান সবদিক দিয়ে শক্তিশালী একটি রাষ্ট্র। আয়তন, জনসংখ্যা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক সবদিক দিয়েই ইরান অনেক শক্তিশালী। তেল, গ্যাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ ইরানের রয়েছে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি। অধিকন্তু ইরানে ক্ষমতায় রয়েছে একটি বিপ্লবী সরকার, যাদের পিছনে রয়েছে শক্তিশালী ও স্বতঃস্ফূত জনসর্মথন, যারা কট্টর ইসলামপন্থী, দেশপ্রেমিক, জাতীয়তাবাদী ও যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল বিরোধী। সুতরাং ইরানের মত একটি দেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে সফলতা অর্জন করা কারো পক্ষে অতটা সহজ নয়। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলসহ পশ্চিমাদের সাথে ইরানের বিরোধ থাকলেও বিশ্বের অধিকাংশ শক্তিশালী রাষ্ট্রের সাথেই তার রয়েছে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা। বিশ্বের দুই বৃহৎ পরাশক্তি রাশিয়া এবং চীনের সাথে ইরানের রয়েছে দীর্ঘদিনের গভীর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক। দেশ দুটির সাথে ইরানের দীর্ঘদিনের এবং গভীর প্রযুক্তি এবং সামরিক সম্পর্ক ও রয়েছে। অপরদিকে কিউবা, ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিলসহ অধিকাংশ ল্যাটিন আমেরিকার দেশের সাথেই ইরানের ভাল রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। একইভাবে উদীয়মান পরাশক্তি ভারতের সাথে ও রয়েছে ইরানের সখ্যতা। পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের শক্তিশালী দেশ পাকিস্তান, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, সিরিয়া, ইরাক এবং সুদানের সাথে ইরানের রয়েছে নিবিড় একটি সম্পর্ক। একইভাবে ইসরাইলের চরম শত্রু ফিলিস্তিনের হামাস এবং লেবাননের হিজবুল্লাহর সাথে ইরানের রয়েছে অন্যরকম সেতুবন্ধন। এতগুলো শক্তিশালী রাষ্ট্রের সাথে যার বন্ধুত্ব, অর্থনৈতিক অবরোধে তাকে দুর্বল করাটা সম্ভব নয়। আর ইরানের ব্যবসা বানিজ্য কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বরাবরই কম। তাছাড়া এবারের অবরোধ কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা আরোপিত । তার সাথে ইসরাইল ছাড়া কেউই নাই। পরমাণু সমঝোতা চুক্তি করে আবার সেই সমঝোতা চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়াটা আর্ন্তজাতিক পরিমণ্ডলে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। অপরদিকে চুক্তি স্বাক্ষরকারী রাশিয়া, চীন, বৃটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানি কর্তৃক চুক্তি মেনে চলার প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে আরো দুর্বল করেছে ।
রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের পাশাপাশি ইরান কিন্তু প্রযুক্তি এবং সামরিক খাতে ও যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছে। ইরান এখন তৈরী করছে বিভিন্ন ধরনের গাড়ী এবং মেশিনারী। ইরান সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তিতে সেনাবাহিনীর জন্য তৈরী করেছে কামান, ট্যাংক, রকেট এবং ভুমি থেকে ভুমিতে নিক্ষেপযোগ্য দুরপাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র। বিমানবাহিনীর জন্য তৈরী করেছে অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান এবং আকাশ থেকে নিক্ষেপ যোগ্য ক্ষেপনাস্ত্র। একইভাবে নৌবাহিনীর জন্য তৈরী করেছে অত্যন্ত দ্রুত গতির টর্পেডো আর অত্যাধুনিক ফ্রিগেট। স্বাভাবিকভাবেই সামরিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ইরানের সফলতা অনস্বীকার্য। এদিকে বিভিন্ন ধরনের সামরিক অস্ত্র তৈরীর পাশাপাশি ইরান এখন মহাকাশ প্রযুক্তিতে ও হাত দিয়েছে। ইতিমধ্যেই ইরান তার নিজস্ব প্রযুক্তিতে মহাশুন্যে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়েছে। নিংসন্দেহে এটা একটি বিরাট অর্জন। ইরান তার নিজস্ব প্রযুক্তিতে চালু করেছে হেভি ওয়াটার তৈরীর ইন্ডাষ্ট্রি, যা প্রযুক্তি ক্ষেত্রে তার উন্নতিরই সাক্ষ্য বহন করে। ইরান ঘোষণা করেছে সে উচ্চ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে সক্ষম এবং পরমাণু জ্বালানী সে বিদেশে রপ্তানী করবে। স্বাভাবিকভাবেই একথা নিশ্চিতে বলা যায় ইরান জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখায় একটি অবস্থান তৈরী করেছে, যার উপর ভিত্তি করে ইরানের অগ্রগতি শুরু হয়েছে। প্রযুক্তি এখন ইরানীদের আয়ত্তে আর এটাকে এখন কেবল বিকশিত করার পালা। এ অবস্থায় ইরানের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ ইরানের জনগনকে ঐক্যবদ্ধ করবে এবং ইরানের বিজ্ঞানীদেরকে নতুন নতুন আবিস্কারের নেশায় উদ্ধুদ্ধ করবে। আর এ নেশা ইরানীদেরকে এনে দেবে প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং নতুন নতুন আবিষ্কারের সফলতা। যে জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই এতটা সফলতা অর্জন করেছে সেই জাতি নিশ্চয়ই অবরোধের কাছে হার মানবে না। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধে ইরান দুর্বল হবে না বরং স্বনির্ভরতা অর্জন করবে।
লেখক : প্রকৌশলী এবং উন্নয়ন গবেষক
ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত এই নিষেধাজ্ঞার প্রধান কারণ ইরানের পরমাণু কর্মসুচি। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের মতে ইরানের হাতে পরমাণু অস্ত্র থাকা বিশ্বের শান্তির জন্য হুমকি। ইরান যদি ও বারবার বলেছে- তার পরমাণু কর্মসুচী শান্তিপূর্ন এবং এটা তার দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুত চাহিদা মেটানোর জন্য, তবু যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আশংকা ইরান গোপনে পরমাণু বোমা তৈরীর জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। আর এজন্যই ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের দীর্ঘ বৈরিতা এবং দীর্ঘদিন ধরেই অর্থনৈতিক অবরোধ ছিল। ইরানের পরমাণু কর্মসুচী বন্ধ করার জন্য ২০১০ সালের ৯ জুন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইরানের বিরুদ্ধে চতুর্থ দফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। ইরানের বিরুদ্ধে এর আগেও তিন বার নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছিল। অবশেষে দীর্ঘ আলোচনা শেষে বিগত ২০১৫ সালের ১৪ ই জুলাই অষ্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় ইরানের পরমাণুু কর্মসুচি নিয়ে ইরানের সাথে বিশে^র ছয় পরাশক্তির সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির একপক্ষ হচ্ছে ইরান আর অপর পক্ষ হচ্ছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতার অধিকারী পাঁচটি পরমাণু শক্তিধর দেশ -যুক্তরাষ্ট্র ,রাশিয়া, চীন, বৃটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানি। তবে ইসরাইল বরাবরই এই চুক্তির বিরোধীতা করেছে। চুক্তিটি ওই বছরের ২০ শে জুলাই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদেও সর্বসম্মতভাবে পাশ হয়। চুক্তিটির সার সংক্ষেপ হচ্ছে – ইরান একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা পর্যন্ত তার পরমাণু কর্মসুচী চালাবে, তবে পরমাণু বোমা বানাবে না। বিনিময়ে ইরানের ওপর আরোপিত অথনৈতিক অবরোধ উঠে যায়। এই চুক্তির মাধ্যমে ইরানের পরমাণু কর্মসুচী নিয়ে ইরানের সাথে পশ্চিমা বিশ্বের দীর্ঘদিনের যে দ্বন্দ্ব, বৈরিতা এবং বাকযুদ্ধ ছিল তা থেকে বিশ্ববাসী আপাতত মুক্তি পায়। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে ক্ষমতার অধিষ্ঠিত হবার পর থেকেই ইরানের সাথে সম্পাদিত এই সমঝোতা চুক্তি থেকে সরে আসার কথা বলতে থাকেন এবং অবশেষে ২০১৮ সালের ৮ ই মে আনুষ্ঠানিকভাবে এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৫ ই নভেম্বর থেকে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র আবারো অর্থনৈতিক অবরোধ ঘোষণা করেন। তবে ইরানের সাথে সম্পাদিত চুক্তির অবশিষ্ট পাঁচটি দেশ – রাশিয়া, চীন, বৃটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানি এই চুক্তি মেনে চলার অঙ্গীকার করেন।
ইরানের পরমাণু কর্মসুচী বন্ধ এবং ইরানকে দুর্বল করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের যে অবিরাম প্রচেষ্টা তারই ধারাবাহিকতায় গত ৫ ই নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে আরোপিত এই নিষেধাজ্ঞায় ইরানের পরমাণু কর্মসুচী ধ্বংস হবে না এবং ইরান অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ও হবে না। তবে সাময়িক সমস্যায় পড়বে মাত্র, যা কাটিয়ে উঠা ইরানের পক্ষে কঠিন হবে না। ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তো বরাবরই আরোপিত ছিল। এবারের অবরোধ ও অতীতের অবরোধের মতই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। সেই ১৯৭৯ সালে খোমেনীর নেতৃত্বে ইরানে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতা দখলের পর থেকেই কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের সাথে ইরানের বৈরিতা চলছে। এই বৈরীতা চলে আসছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে। এসব মোকাবেলা করেই কিন্তু ইরান টিকে আছে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় ইরানের পরমাণু কর্মসুচী বন্ধ হয়ে যাবে এবং ইরান দুর্বল হয়ে যাবে এমনটি ভাবার কারণ নেই। মনে রাখতে হবে ইরান সবদিক দিয়ে শক্তিশালী একটি রাষ্ট্র। আয়তন, জনসংখ্যা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক সবদিক দিয়েই ইরান অনেক শক্তিশালী। তেল, গ্যাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ ইরানের রয়েছে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি। অধিকন্তু ইরানে ক্ষমতায় রয়েছে একটি বিপ্লবী সরকার, যাদের পিছনে রয়েছে শক্তিশালী ও স্বতঃস্ফূত জনসর্মথন, যারা কট্টর ইসলামপন্থী, দেশপ্রেমিক, জাতীয়তাবাদী ও যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল বিরোধী। সুতরাং ইরানের মত একটি দেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে সফলতা অর্জন করা কারো পক্ষে অতটা সহজ নয়। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলসহ পশ্চিমাদের সাথে ইরানের বিরোধ থাকলেও বিশ্বের অধিকাংশ শক্তিশালী রাষ্ট্রের সাথেই তার রয়েছে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা। বিশ্বের দুই বৃহৎ পরাশক্তি রাশিয়া এবং চীনের সাথে ইরানের রয়েছে দীর্ঘদিনের গভীর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক। দেশ দুটির সাথে ইরানের দীর্ঘদিনের এবং গভীর প্রযুক্তি এবং সামরিক সম্পর্ক ও রয়েছে। অপরদিকে কিউবা, ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিলসহ অধিকাংশ ল্যাটিন আমেরিকার দেশের সাথেই ইরানের ভাল রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। একইভাবে উদীয়মান পরাশক্তি ভারতের সাথে ও রয়েছে ইরানের সখ্যতা। পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের শক্তিশালী দেশ পাকিস্তান, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, সিরিয়া, ইরাক এবং সুদানের সাথে ইরানের রয়েছে নিবিড় একটি সম্পর্ক। একইভাবে ইসরাইলের চরম শত্রু ফিলিস্তিনের হামাস এবং লেবাননের হিজবুল্লাহর সাথে ইরানের রয়েছে অন্যরকম সেতুবন্ধন। এতগুলো শক্তিশালী রাষ্ট্রের সাথে যার বন্ধুত্ব, অর্থনৈতিক অবরোধে তাকে দুর্বল করাটা সম্ভব নয়। আর ইরানের ব্যবসা বানিজ্য কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বরাবরই কম। তাছাড়া এবারের অবরোধ কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা আরোপিত । তার সাথে ইসরাইল ছাড়া কেউই নাই। পরমাণু সমঝোতা চুক্তি করে আবার সেই সমঝোতা চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়াটা আর্ন্তজাতিক পরিমণ্ডলে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। অপরদিকে চুক্তি স্বাক্ষরকারী রাশিয়া, চীন, বৃটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানি কর্তৃক চুক্তি মেনে চলার প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে আরো দুর্বল করেছে ।
রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের পাশাপাশি ইরান কিন্তু প্রযুক্তি এবং সামরিক খাতে ও যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছে। ইরান এখন তৈরী করছে বিভিন্ন ধরনের গাড়ী এবং মেশিনারী। ইরান সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তিতে সেনাবাহিনীর জন্য তৈরী করেছে কামান, ট্যাংক, রকেট এবং ভুমি থেকে ভুমিতে নিক্ষেপযোগ্য দুরপাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র। বিমানবাহিনীর জন্য তৈরী করেছে অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান এবং আকাশ থেকে নিক্ষেপ যোগ্য ক্ষেপনাস্ত্র। একইভাবে নৌবাহিনীর জন্য তৈরী করেছে অত্যন্ত দ্রুত গতির টর্পেডো আর অত্যাধুনিক ফ্রিগেট। স্বাভাবিকভাবেই সামরিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ইরানের সফলতা অনস্বীকার্য। এদিকে বিভিন্ন ধরনের সামরিক অস্ত্র তৈরীর পাশাপাশি ইরান এখন মহাকাশ প্রযুক্তিতে ও হাত দিয়েছে। ইতিমধ্যেই ইরান তার নিজস্ব প্রযুক্তিতে মহাশুন্যে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়েছে। নিংসন্দেহে এটা একটি বিরাট অর্জন। ইরান তার নিজস্ব প্রযুক্তিতে চালু করেছে হেভি ওয়াটার তৈরীর ইন্ডাষ্ট্রি, যা প্রযুক্তি ক্ষেত্রে তার উন্নতিরই সাক্ষ্য বহন করে। ইরান ঘোষণা করেছে সে উচ্চ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে সক্ষম এবং পরমাণু জ্বালানী সে বিদেশে রপ্তানী করবে। স্বাভাবিকভাবেই একথা নিশ্চিতে বলা যায় ইরান জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখায় একটি অবস্থান তৈরী করেছে, যার উপর ভিত্তি করে ইরানের অগ্রগতি শুরু হয়েছে। প্রযুক্তি এখন ইরানীদের আয়ত্তে আর এটাকে এখন কেবল বিকশিত করার পালা। এ অবস্থায় ইরানের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ ইরানের জনগনকে ঐক্যবদ্ধ করবে এবং ইরানের বিজ্ঞানীদেরকে নতুন নতুন আবিস্কারের নেশায় উদ্ধুদ্ধ করবে। আর এ নেশা ইরানীদেরকে এনে দেবে প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং নতুন নতুন আবিষ্কারের সফলতা। যে জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই এতটা সফলতা অর্জন করেছে সেই জাতি নিশ্চয়ই অবরোধের কাছে হার মানবে না। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধে ইরান দুর্বল হবে না বরং স্বনির্ভরতা অর্জন করবে।
লেখক : প্রকৌশলী এবং উন্নয়ন গবেষক