ইরানে শাসন বিরোধী বিক্ষোভের অবসান ঘটেছে প্রায় দু’সপ্তাহ আগে। যুক্তরাষ্ট্র এই বিক্ষোভকে শাসন পরিবর্তন পর্যন্ত নিয়ে যেতে চাইলেও সেটি শেষ পর্যন্ত হয়নি। ১৯৫৩ সালে আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এভাবে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেকের সরকারের পতন ঘটিয়েছিল। মার্কিন শ্রেণিবিন্যাসিত দলিলগুলো অবমুক্ত করার পর এর এখন আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাওয়া যাচ্ছে। আমেরিকা বা সিআইএ’র শাসন পরিবর্তনের সেই সক্ষমতা এখন সম্ভবত সেভাবে নেই। বলা হচ্ছে এর আগে তুরস্ক একবার এই ধরনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এবার ব্যর্থ হলো ইরানের ক্ষেত্রে।
ইরান দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় পারস্য উপসাগরের তীরে অবস্থিত একটি প্রভাবশালী মুসলিম রাষ্ট্র। বিশ্বের সবচেয়ে পর্বতময় দেশগুলোর একটি ইরানে হিমালয়ের পরেই এশিয়ার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ দামভান্দ অবস্থিত। দেশটির জনগণ জাতিগত ও ভাষাগতভাবে বিচিত্র হলেও এরা প্রায় সবাই মুসলিম। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ অঞ্চলটি ইসলামের শিয়া মতাবলম্বীদের কেন্দ্র। ইরানে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডার রয়েছে। পারস্য উপসাগরের অন্যান্য তেলসমৃদ্ধ দেশের মতো ইরানেও তেল রফতানি ২০শ শতকের শুরু থেকে দেশটির অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি।
খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে বর্তমান ইরান ছিল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য পারস্যের কেন্দ্র। প্রায় ২০০০ বছর ধরে এ অঞ্চলের অধিবাসীরা নিজেদের দেশকে ‘ইরান’ নামে ডাকত। ইরান নামটি এই এলাকায় বসতি স্থাপনকারী আর্য গোত্রের নাম থেকে নেয়া। কিন্তু গ্রিকরা এই অঞ্চলকে পাস্র্ বলে ডাকত আর সেখান থেকে ইউরোপীয় ভাষায় এর নাম হয় পার্সিয়া। ১৯৩৫ সালে ইরানের শাসক দেশটিকে কেবল ‘ইরান’ বলে ডাকার অনুরোধ জানানোর পর থেকে এখন এই নামেই সারা বিশ্বে দেশটি পরিচিত। ১৫০১ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত রাজতন্ত্রী ইরান শাহ কিংবা রাজারা শাসন করতেন। ১৯৭৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সংঘটিত ইরানি বিপ্লব রাজতন্ত্রের পতন ঘটায় এবং ইরানে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র স্থাপন করে।
ইরান ভৌগোলিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত। এর উত্তরে আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, কাস্পিয়ান সাগর ও তুর্কমেনিস্তান; পূর্বে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান; দক্ষিণে ওমান উপসাগর, হরমুজ প্রণালী ও পারস্য উপসাগর এবং পশ্চিমে ইরাক ও তুরস্ক। তেহরান ইরানের বৃহত্তম শহর ও রাজধানী; শহরটি ইরানের উত্তর অঞ্চলে অবস্থিত।
২০০৬ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ইরানের জনসংখ্যা ৭ কোটির কিছু বেশি। এখন এ সংখ্যা ৮ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে এক-চতুর্থাংশের বয়স ১৫ বছর বা তার কম। জাতিগত ও ভাষাগতভাবে বিচিত্র দেশ ইরানের বাইরে প্রবাসে আরও প্রায় ৪০ লক্ষ ইরানি নাগরিক বসবাস করেন। এরা মূলত উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ, তুরস্ক, পারস্য উপসাগরীয় দেশসমূহ এবং অস্ট্রেলিয়াতে বাস করেন। সিআইএ ফ্যাক্টবুক অনুসারে ইরানের জাতিগুলোর মধ্যে পারসিক জাতি ৫১%, আজেরি জাতি ২৪%, গিলাকি জাতি ও মাজান্দারানি জাতি ৮%, কুর্দি জাতি ৭%, আরব জাতি ৩%, লুর জাতি ২%, বেলুচি জাতি ২%, তুর্কমেন জাতি ২% এবং অন্যান্য ১%।
জাফরি শিয়া ইসলাম ১৬শ শতক থেকে ইরানের রাষ্ট্রধর্ম। ইরানের ১৯৭৯ সালের সংবিধান শিয়া ধর্মগুরুদের সরকারে গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বমূলক পদে স্থান দেয়। ইরানের ৯০ শতাংশের মতো মুসলিম শিয়া মতাবলম্ব^ী। আর এদের প্রায় সবাই জাফরি শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী। জাফরি শিয়ারা মনে করেন হযরত মুহাম্মদ সা.-এর ১২ জন উত্তরাধিকারী ইমাম আছেন। ইরানের বাকি জনগণ সুন্নি ধর্মাবলম্বী।
ইরানে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর নেতা হলেন রাহবার আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। ইরান ইসলামী বিপ্লবের স্থপতি আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির মৃত্যুর পর তিনি রাহবার হন। খামেনি মৃত্যুবরণ করলে অথবা কর্তব্য পালন করতে অক্ষম বলে মনে করা হলে তিন সদস্যের একটি কাউন্সিল তার কাজ করবেন। ইরানের প্রেসিডেন্ট (বর্তমানে হাসান রূহানি), বিচার বিভাগের প্রধান (এখন সাদেগ লারিজানি) এবং ইরানের সংবিধান ব্যাখ্যা করার দায়িত্বে নিয়োজিত গার্ডিয়ান কাউন্সিলের প্রধান (বর্তমানে আহমদ জান্নাতি) এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। ৮ বছরের জন্য নির্বাচিত ৮৮ সদস্যের বিশেষজ্ঞ পরিষদ নতুন রাহবার নির্বাচিত না করা পর্যন্ত এই পরিষদ রাহবারের দায়িত্ব পালন করবে।
ইরানের রাজনীতিতে তিনটি ধারা রয়েছে। এর একটি হলো রক্ষণশীল মূলনীতিবাদী ধারা, আরেকটি হলো সংস্কারবাদী ধারা আর অপরটি হলো মধ্যপন্থী উদার ধারা। বিশেষজ্ঞ পরিষদের বিগত নির্বাচনের সময় সংস্কারবাদীরা তাদের জয় হয়েছে বলে দাবি করেছিল। আবার রক্ষণশীলদের দাবি ছিল তাদের বিজয় হয়েছে। কিন্তু পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দেখা গেছে আয়াতুল্লাহ আহমদ জান্নাতির মতো একজন রক্ষণশীল ধর্মীয় নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। এখানে মূলত মধ্যপন্থী স্বতন্ত্র ধারাটিই নির্ণায়ক ভূমিকা রেখেছে বলে মনে হয়।
সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি নিজে রক্ষণশীল ধারার ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হলেও তার কাজে এক ধরনের ভারসাম্য বজায় থাকে। রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদের দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে সংস্কারবাদীরা আন্দোলন শুরু করলে তিনি আহমাদিনেজাদের পক্ষেই ভূমিকা রাখেন। কিন্তু রুহানির দ্বিতীয় মেয়াদে আহমাদিনেজাদ আবার প্রেসিডেন্ট হতে চাইলে তিনি সেটি অনুমোদন করেননি। স্বাস্থ্যগতভাবে খামেনির অবস্থা বেশ দুর্বল হয়ে গেছে বলে মনে করা হয়। ৭৮ বছর বয়সী এই নেতা দেশটির সাবেক স্পিকার ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ছিলেন। যুদ্ধে তিনি একটি হাত হারিয়েছেন। সংস্কারবাদীদের সাথে কোন কোন সময় তার কিছুটা বিরোধ দেখা দিলেও খোমেনির পর তিনি মোটামুটিভাবে বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে রাহবারের দায়িত্ব পালন করেছেন।
ইরানের যে কোন পরিবর্তনে রাহবারের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আয়াতুল্লাহ খোমেনির সময় আয়াতুল্লাহ মোন্তাজেরিকে তার উত্তরসূরি মনে করা হতো। কিন্তু শেষ দিকে এসে তিনি ছিটকে পড়েন। আয়াতুল্লাহ খামেনি তার উত্তরাধিকারী মনোনীত হন। নতুন রাহবার হিসেবে আয়াতুল্লাহ আহমদ জান্নাতি ও প্রেসিডেন্ট হাসান রূহানির কথা বলা হচ্ছে। বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হাসান রুহানি অনেক আশা জাগানোর মাধ্যমে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ৬ বিশ্বশক্তির সাথে পারমাণবিক চুক্তি করেন। ইরানিরা ধারণা করেছিল তাদের ওপর বহু বছর ধরে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে। তারা অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে পাবে। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে রুহানি নির্বাচিত হওয়ার পরও আন্তর্জাতিক অবরোধ পুরোপুরি ওঠেনি। বরং আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন করে পারমাণবিক চুক্তির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কথা বলছেন। আর ইরানের বিরুদ্ধে নতুন করে আগ্রাসী বক্তব্য দিতে শুরু করেছেন। অন্য দিকে আয়াতুল্লাহ জান্নাতি বহু বছর ধরে অভিভাবক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রক্ষণশীলদের বাইরেও তার প্রভাব রয়েছে।
প্রেসিডেন্ট রুহানির ব্যাপারে খানিকটা আশাভঙ্গের কারণে ডিসেম্বরের শেষ দিকে সূচিত বিক্ষোভ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কোন ধরনের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া ছড়িয়ে পড়া এই বিক্ষোভে জনগণের মধ্যে যে অপ্রাপ্তি বা ক্ষোভ রয়েছে তা স্পষ্ট হয়। প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে একটি সমৃদ্ধ দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইরানিদের দুরবস্থার একটি কারণ যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ছাপিয়ে দেয়া অবরোধ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ইরান তার অর্থনৈতিক সম্পদের একটি বড় অংশ আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের জন্য ইরাক সিরিয়া লেবানন ইয়েমেনে ব্যয় করার কারণে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করা করা যায়নি। ফলে ইরানি মুদ্রার অব্যাহত অবমূল্যায়ন হয়েছে এবং নতুন কাজ সৃষ্টি করা যায়নি। এর পাশাপাশি ইরানি শাসনের বিরুদ্ধে যেমন আন্তর্জাতিক চক্রান্ত বেড়েছে তেমনিভাবে অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ দমন করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাড়াবাড়িও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর বিরুদ্ধে অসন্তোষের প্রকাশ ঘটেছে সাম্প্রতিক বিক্ষোভে।
ইরানের শাসনব্যবস্থা তথা অনুসৃত ইসলামী ধ্যান ধারণাকে মূল্যায়ন করতে হলে সেখানকার বাস্তবতা ও প্রেক্ষিত দিয়েই এর বিচার করতে হবে। ইরানের ৮ কোটি মানুষের মধ্যে ৯০ শতাংশের মতো শিয়া ধারার জাফরি মুসলিম। শিয়া ধর্মমতের সামাজিক প্রভাব সুন্নি ধারার চেয়ে বেশি। শিয়া আলেমদের সামাজিক প্রভাবও একইভাবে প্রবল। এর ফলে ইরানের যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা তাতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের গভীর প্রভাব দেখা যায়। কয়েক শতাব্দীর রাজতান্ত্রিক শাসন সেই প্রভাবকে মুছে দিতে পারেনি। ফলে ১৯৭৯ সালে রাজতন্ত্রবিরোধী গণবিপ্লবের পর ক্ষমতা ধর্মীয় নেতাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। আর ইরানের সর্বোচ্চ নেতৃত্বে যারা রয়েছেন তারা কেউ এই ব্যবস্থার অবসান কামনা করেন না যদিও তাদের মধ্যে কর্মপন্থা নিয়ে কিছুটা মতের ব্যবধান রয়েছে।
ইরানের বর্তমান গণতন্ত্রকে পাশ্চাত্য প্রকৃত গণতন্ত্র হিসেবে মূল্যায়ন করে না। তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সেখানে মুক্তভাবে যে কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন না। যারা ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ধ্যান ধারণায় বিশ্বাস করে অভিভাবক পরিষদ কেবল তাদেরকে প্রার্থী হওয়ার অনুমোদন দেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হলেন রাহবার যিনি নির্বাচিত নন। বাস্তব ক্ষেত্রে এই সমালোচনার অনেকখানি এক তরফা ও পক্ষপাতদুষ্ট।
ইরানি ব্যবস্থার শীর্ষ পদ রাহবার নির্বাচিত করেন ৮৮ সদস্যের বিশেষজ্ঞ পরিষদ। এই বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে ৮ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। রাহবার একবার নির্বাচিত হলে তার কোন নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে না কিন্তু দায়িত্ব পালনে তিনি অক্ষম বিবেচিত হলে বিশেষজ্ঞ পরিষদ তাকে পদচ্যুত করতে পারেন। বিপ্লবের পর থেকে অনেক অন্তর্ঘাতী ঘটনার পরও দেশটিতে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তনে কোন ধরনের ব্যত্যয় ঘটেনি। রাষ্ট্রের এখন যে মৌলিক চরিত্র সেটি জনগণের ভোটের মধ্য দিয়েই অবয়ব পেয়েছে। পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র চর্চার দেশগুলোতেও রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোতে অবিশ্বাসীরা ক্ষমতায় যেতে পারেন না। ইরানের ব্যবস্থা তার চেয়ে ব্যতিক্রম নয়।
ইরানের শাসনব্যবস্থার সামনে বেশ কয়টি মৌলিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত: ইরানের ইসলামী ব্যবস্থার সাফল্যের একটি প্রধান নির্ণায়ক হলো এই ব্যবস্থায় জনগণ কতটা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকছে সেটি। এবারের বিক্ষোভের একটি বড় ইস্যু ছিল বৈষম্য। এখনো ইরানি সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বৈষম্য রয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে দরিদ্রদের জন্য বেশ কিছু নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে। কিন্তু কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অপ্রতুল। রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাফল্যের জন্য এই অর্থনৈতিক দিকটিকে কোনভাবেই উপেক্ষা করা যায় না।
রাষ্ট্র হিসেবে ইরান অনেকখানি প্রভাব বিস্তারবাদী নীতি গ্রহণ করে। নীতিগতভাবে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগঠন হামাসকে এক সময় সহায়তা করে ইরান। আবার একই সাথে ইরাক লেবানন ইয়েমেনে বিভিন্ন প্রক্সি বাহিনী গড়ে তুলে তাদের সরাসরি সহায়তা করে। আরব জাগরণের অংশ হিসেবে সিরিয়ায় বাশার আসাদবিরোধী বিদ্রোহ দমনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করে তেহরান। ইয়েমেনে হুজি বিদ্রোহেও সরাসরি জড়িয়ে পড়ে ইরান। এসব নীতির কারণে সৌদি আরবের নেতৃত্বে রাজতান্ত্রিক সুন্নি দেশগুলোর সাথে প্রত্যক্ষ সংঘাত তৈরি হয় ইরানের। সিরিয়ায় ইরানপন্থীদের কার্যত বিজয়ে সৌদি আরব অধিকতর হুমকির মধ্যে পড়ে যায়। সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করার পরও ইয়েমেনে হুজিদের বিরুদ্ধে জয়ী হতে না পারার পরে সৌদি আরবকে দেখা যায় নেপথ্যে ইসরাইলের সাথে সমঝোতা প্রতিষ্ঠায়। সৌদি আরব একই সাথে ইরান ও মুসলিম ব্রাদারহুডকে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে চিহ্নিত করে আর ইসরাইলবিরোধী ছয় দশকের নীতিকে নমনীয় করে তেলআবিবের সাথে সমঝোতা করে অভিন্ন শত্রু ইরানের মোকাবেলা করার জন্য। এই মেরুকরণের মধ্যে জেরুসালেম ইস্যুতে ইরান পালন করে প্রত্যক্ষ ভূমিকা। এভাবে সৌদি আরব ইসরাইল আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিপক্ষে পরিণত হয় ইরান।
ইরানের বিরুদ্ধে এই ব্যাপকভিত্তিক আঞ্চলিক শত্রুতার পরিস্থিতি যখন তৈরি হয় তখন দেশটি বিভিন্ন আরব দেশের প্রক্সি যুদ্ধে অর্থ ব্যয় করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন ও সুশাসনে মনোযোগী হতে পারেনি। এর ফলে বছর পাঁচেকের ব্যবধানে একদিকে ইরানি রিয়েলের দাম এক-তৃতীয়াংশে নেমে আসে আর অন্য দিকে বেকারত্বের হার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। এই ধরনের একটি অবস্থা বাইরের প্রতিপক্ষের সামনে অভ্যন্তরীণ বিরোধকে কাজে লাগানোর সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। আর ঠিক এই সময়টাকেই অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য বেছে নেয়ার পেছনে বিভিন্ন পক্ষের ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ থাকতে পারে। অনানুষ্ঠানিক সূত্রের তথ্যানুসারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানে শাসন পরিবর্তনের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য সিআইএর কাউন্টার টেরোরিজম উইংয়ের প্রধানকে দায়িত্ব দিয়েছেন। রুশ বার্তা সংস্থা স্পুটনিকের প্রতিবেদনেও এই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। অন্য দিকে ইসরাইল মনে করছে জেরুসালেমকে রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার যে কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে তা বাস্তবায়ন করতে হলে ইরানকে চাপে রাখতে হবে। তেহরানে শাসন পরিবর্তন হোক বা না হোক অন্তত জেরুসালেমের ব্যাপারে দেশটির ভূমিকা নমনীয় করা গেলে সেটিই হবে তেলআবিবের জন্য বড় সাফল্য। আর সৌদি আরব গত এক দশকের বেশি সময়ে ইরানের প্রভাবের কাছে কেবলই জমি হারিয়েছে। ইয়েমেন থেকে হুজিদের নিক্ষেপিত ক্ষেপণাস্ত্র রিয়াদে আঘাত হানার পর ইরান-হুমকি তার জন্য ইসরাইলি শত্রুতার চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৮ কোটি মানুষের দেশ ইরানে ১৯৮৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বাধীন ইসলামী বিপ্লবের পর দীর্ঘ রাজতান্ত্রিক উত্তরাধিকারের অবসান ঘটিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক সব ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হয়। এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতার আসনে রাখা হয় একজন ধর্মীয় নেতাকে যিনি পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হলেও ক্ষমতাধর অভিভাবক পরিষদ, নির্বাচক পরিষদ, বিচার বিভাগ, নিরাপত্তা বাহিনী এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। আর এই নিয়ন্ত্রণ এতটা গভীর যে একবার এই পদে আসীন ব্যক্তিকে আমৃত্যু স্বপদে বহাল থাকতে দেখা যায়। যদিও সর্বোচ্চ নেতার অপসারণের ব্যবস্থাও সংবিধানে রাখা হয়েছে। তবে প্রেসিডেন্ট বা সংসদের নির্বাচন কারা করতে পারবেন তা ধর্মীয় নেতাদের প্রাধান্যপূর্ণ অভিভাবক পরিষদ নিয়ন্ত্রণ করলেও নির্বাচন হয় অবাধ এবং নিরপেক্ষ। জনগণ যে সব প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তাদের মধ্য থেকে মুক্তভাবে প্রার্থী বাছাই করতে পারেন। এই ধরনের ব্যবস্থাকে পাশ্চাত্য মুক্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসাবে স্বীকার করে না সত্যি কিন্তু তাদেরই চরম স্বৈরতান্ত্রিক সরকারগুলোর সাথে নিজেদের স্বার্থে বিশেষ মিত্রতা গড়ে তুলতে দেখা যায়।
প্রশ্ন হলো ঠিক এ সময়টাতে কেন ইরানে ব্যাপকভিত্তিক সরকারবিরোধী বিক্ষোভে ইন্ধন দেয়া হয়েছে। যেখানে থানায় আক্রমণ অথবা বিক্ষোভ দমনের গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জনতার ওপর চাপিয়ে দেয়ার মতো অন্তর্ঘাতী ঘটনাও ঘটছে। খ্রিষ্টপূর্ব হাজার বছর পূর্বের পারসিক সভ্যতার উত্তরাধিকার ইরান বিপ্লবের পর থেকে এক ধরনের অস্থির অবস্থার মধ্য দিয়ে চলে এসেছে। বিপ্লবের কয়েক বছরের মধ্যেই ইরাকের সাথে প্রায় দশকব্যাপী যুদ্ধ শুরু হয়। ইরানিরা মনে করে যে তাদের দেশকে অস্থির করে অঙ্কুরে বিপ্লব ধ্বংসের জন্য এই যুদ্ধ সাদ্দাম হোসেনের মাধ্যমে তেহরানের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। অন্য দিকে ইরানবিরোধী আরব নেতৃত্ব আয়াতুল্লাহ খোমেনির ইসলামী বিপ্লব রফতানির হুমকি এই যুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল বলে মনে করে। এই কারণে সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় সব দেশ সাদ্দামের পেছনে দাঁড়ায় যদিও পরে সাদ্দামের কুয়েত দখলের পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়। ইরান-ইরান যুদ্ধের অবসানের পরও নানা ইস্যুকে কেন্দ্র করে ইরানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চলতে থাকে। সর্বশেষ ফাইভ প্লাস ওয়ান বিশ্বশক্তির সাথে পারমাণবিক সমঝোতার পরও সেই নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি ওঠে যায়নি। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতায় ট্রাম্পের আগমন ঘটে আর ইরানবিরোধী মার্কিন অবস্থান আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়।
ইরানি নেতৃত্বকে অবশ্যই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানে বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। বিশ্বব্যংকের বিবেচনায় উচ্চ মধ্য আয়ের দেশ ইরানে বিশ্বের বৃহত্তম গ্যাস মজুদ রয়েছে। তেলের মজুদ রয়েছে এখানে বিশ্বের চতুর্থ সর্বাধিক। প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম প্রস্তুত এবং শিল্প উন্নয়নেও দেশটি যথেষ্ট এগিয়েছে নানা ধরনের অবরোধ ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও। কিন্তু এটিকে জনগণের জীবন মানোন্নয়নে সেভাবে রূপান্তর করা যায়নি। সার্বিক বিবেচনায় ইরানের অগ্রাধিকার পুনর্বিন্যাস করার প্রয়োজন রয়েছে। তা না হলে এখন যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে তা দমন করা সম্ভব হলেও এর উপাদানগুলো নানাভাবে দেশটিতে থেকে যাবে এবং সময়ে সময়ে বাইরের মদদ পেয়ে তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এ কারণে ইরানকে সতর্ক নীতি ও কৌশল নিতে হবে এখনই। তবে সংস্কার করতে গিয়ে ইরানি ব্যবস্থাকে অস্থির কোন অবস্থায় ঠেলে দেয়া যাবে না। ইরানে এখন যে পদ্ধতি তা মোটা দাগে সেখানকার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। সেখানে সংস্কার আনা যায় কিন্তু এই ব্যবস্থার আমূল কোনো পরিবর্তন নয়। তবে এটি এমন কোন ত্রুটিমুক্ত শাশ্বত ব্যবস্থা নয় যা সুন্নি দেশসমূহ অনুসরণ করতে পারে কারণ ইরানি সমাজ ও সুন্নি প্রধান সমাজের ধরন ও বৈশিষ্ট্য এক নয়। মুসলিম ব্রাদারহুড যে ধরনের ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চায় সেটি সুন্নি সমাজের বাস্তবতাকে সামনে রেখেই। এ ব্যবস্থায় প্রচলিত গণতন্ত্র এবং ইসলামী পদ্ধতির একটি সমন্বয় থাকে।
ইরানের যে শক্তি সেটি ইসলামী বিশ্বের জন্য অনেক বড় একটি শক্তি। কিন্তু এটাকে সম্প্রদায়গত বিরোধে না লাগিয়ে ইসলামের মূল শত্রুদের বিরুদ্ধে শক্তি অর্জনে কাজে লাগাতে পারলে তা হবে ইতিবাচক। কোন শাসনই যেমন ত্রুটিমুক্ত নয় তেমনিভাবে প্রতিটি শাসনের কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। মুসলিম বিশ্বভুক্ত রাষ্ট্র সেটি সৌদি আরব ইরান বা তুরস্ক যেই দেশই হোক না কেন বিরোধ ও মতের ব্যবধানে শক্তি ক্ষয় না করে অভিন্ন শত্রুর মোকাবেলায় মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। এসব দেশকে নিজেদের জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তি শিক্ষা এবং প্রতিরক্ষায় শক্তি অর্জন করতে হবে। এই নীতি ইরানকে মুসলিম দুনিয়ায় অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
Source: http://www.chhatrasangbadbd.com