Friday, February 23, 2018

সোস্যাল মিডিয়ার প্রভাব : তারুণ্যের অবক্ষয় -সীমান্ত আকরাম

সোস্যাল মিডিয়া বলতে আমরা সাধারণত সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমকে বুঝি। আমরা যাকে ফেসবুক নামে চিনি এটি একটি সোস্যাল মিডিয়া। এ রকম আরো অনেক রয়েছে যেমনÑ টুইটার, মাইস্পেস, ইমু, হোয়াইটস আপ, ভাইবার, গুগল প্লাস, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব ইত্যাদি। সোস্যাল মিডিয়াকে সংজ্ঞায় রূপান্তরিত করলে যা দাঁড়ায় তা হলো, আমরা যার মাধ্যমে আমাদের নিত্যদিনের খবর সামান্য সময়ের মাধ্যমে এক স্থান থেকে হাজারো মানুষের কাছে লিখিত বা ভিডিওর মাধ্যমে একই সময়ে পাঠাতে পারি তার নাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যম আমাদের জীবনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। এর মাধ্যমেই আমাদের অনেক চাহিদাই খুব সহজে পূর্ণতার মুখ দেখে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের যদিও আমরা লাভবান হচ্ছি কিন্তু এর ক্ষতিকর প্রভাব বহুমাত্রিকতায় বিস্তৃত। আমাদের যুবসমাজের মাঝে এর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে নানানভাবে। পৃথিবীতে ফেসবুক ব্যবহারকারী ১ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে অধিকাংশই যুবক এতে কোন সন্দেহ নেই। যদিও আগামী প্রজন্মের জন্য এটি একটি ভালো দিক। কিন্তু যখন এই ফেসবুক নামক বস্তুটি কিংবা অন্য যাই হোক না কেন আমাদের যুবকরা তাদের পড়ার টেবিলে নিয়ে এসে ব্যবহার করে তখন সেটিকে কিভাবে সম্ভাবনার দোহাই দেবো। আমরা দেখি তরুণরা সোস্যাল মিডিয়ার সামনে যে সময় ব্যয় করে অপর দিকে পড়ার টেবিলে এর তুলনায় খুবই কম সময় দিচ্ছে। একটি জরিপে দেখা গেছে, ১০০ জন তরুণদের মধ্যে ১ ঘণ্টা থেকে একটু বেশি সময় ধরে ৩২ জন, ২-৩ ঘণ্টায় ৪৩ জন, ৪-৫ ঘণ্টায় ১৮ জন, ৬-৭ ঘণ্টায় ৪ জন এবং ৮ ঘণ্টা থেকে তার বেশি সময় ধরে সোস্যাল মিডিয়ায় নিমজ্জিত থাকে ৩ জন।
সরকারি হিসাবে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় সাত কোটি। গত মার্চ মাসে টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত মার্চ মাস শেষে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ছয় কোটি ৬৭ লাখ। অর্থাৎ দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীর হাতে এখন ইন্টারনেট। আর এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রসার কতটা দ্রুতগতিতে হচ্ছে তা অন্য একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, প্রতি ১২ সেকেন্ডে একটি করে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলা হচ্ছে বাংলাদেশে, যা দেশের জন্মহারের চেয়েও বেশি। আর এদের অধিকাংশই তরুণ।
ডিচ দ্য লেবেল নামে অ্যান্টি-বুলিং বা উৎপীড়নবিরোধী একটি দাতব্য সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তরুণদের ভীত ও উদ্বিগ্ন করে তুলছে। এই সংস্থাটি ১০ হাজার তরুণ-তরুণীর ওপর জরিপ চালিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের সবার বয়সই ১২-২০ বছরের মধ্যে। এই জরিপে অংশ নেয়াদের প্রতি তিনজনের একজন জানিয়েছে, সাইবার-বুলিং বা অনলাইন উৎপীড়ন বিষয়ে তারা সব সময় আতঙ্কে থাকে। জরিপে অংশ নেয়া প্রায় অর্ধেকই জানিয়েছে, সোস্যাল মিডিয়ার কারণে তাদের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা হয়েছে। অনলাইনে তাদের সাথে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো নিয়ে তারা আলোচনা করতে চায় না। অনলাইনে বিরূপ আচরণের শিকার হওয়া অনেকেই তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কিছু খন্ডিত অংশ প্রকাশ করেছেন। জরিপে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ইনস্টাগ্রামকে অত্যন্ত নেতিবাচক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। প্রতিবেদনের তথ্য মতে, বৈশ্বিকভাবে অনলাইন নিপীড়ন ব্যাপক পরিসরে ছড়িয়ে পড়েছে। জরিপে অংশ নেয়া ৭০ শতাংশ স্বীকার করেছে, তারা অনলাইনে অন্যের সাথে নিপীড়নমূলক আচরণ করে এবং ১৭ শতাংশ দাবি করে, তারা অনলাইনে অন্যের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউট (ওআইআই) একই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৫ বছরের তরুণদের ওপর জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে ৩০ শতাংশ নিয়মিত অনলাইন উৎপীড়নের শিকার।
উন্নয়নশীল এবং উন্নত দেশগুলোর বেশির ভাগ বাসিন্দা বলছেন, শিক্ষার প্রসারে ইন্টারনেটের ভূমিকা ব্যাপক। ৩২টি দেশে জরিপ চালিয়ে এই তথ্য পাওয়া গেছে। ‘পিউ গ্লোবাল অ্যাটিটিউড সার্ভে’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটির জরিপে দেখা গেছে, ইন্টারনেট ব্যক্তিগত সম্পর্ক উন্নয়নে অবদান রাখে। অন্যদিকে অর্থনীতিতেও ইন্টারনেটের ভূমিকা রয়েছে। গবেষণায় উঠে এসেছে, উন্নয়নশীল এবং উন্নত দেশগুলোর মানুষের দৈনন্দিন কাজে কিভাবে ইন্টারনেট সহায়ক হয়েছে। এসব দেশের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগের প্রসারে এখন তারা তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান কাজে লাগাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, কিভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এটি ব্যবহার করে সামাজিক কাজে যুক্ত হচ্ছেন। এসব ব্যবহারকারীদের মধ্যে শতকরা ৩৬ ভাগ বলেছেন ইন্টারনেট ভালো কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্যদিকে শতকরা ৩০ ভাগ ব্যবহারকারী বলেছেন ইন্টারনেট খারাপ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেখানে শতকরা ৪২ ভাগ ব্যবহারকারী বলেছেন, ইন্টারনেট মানুষের নৈতিকতার বিকাশে নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। জরিপ চালানো ৩২টি দেশের শতকরা ৪৪ ভাগ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। উন্নত দেশগুলোর তালিকায় আছে চিলি, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র। যেখানে চিলি ও রাশিয়ায় ১০ জনের ৭ জন ইন্টারনেট ব্যবহার করে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা শতকরা ৮৭ ভাগ। জরিপ চালানো উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় পাকিস্তান এবং বাংলাদেশও রয়েছে।
সোস্যাল মিডিয়ার সবচেয়ে মারাত্মক যে দিক তা হলো ভিডিও সাইটগুলো। এটাকে যদিও আমরা পুরোপুরি সোস্যাল যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে নাও বলি তবু সামাজিক মাধ্যমই হয়ে উঠেছে আমাদের জন্য আজকাল। এই ভিডিও সাইটগুলোতে আমাদের জন্য খারাপ সে খবর অপেক্ষা করছে তা হলো এই সাইটে নৈতিক অবক্ষয়জনিত ভিডিওগুলোর প্রবেশকারী অন্যগুলোর থেকে প্রায় ৪০ ভাগ বেশি। আর তার ৮০ ভাগ এর বয়সই ১৬-২৩।

সোস্যাল মিডিয়ায় কতিপয় ক্ষতিকর দিকসমূহ
১. সোস্যাল সাইট মানেই হলো অসংখ্য অ্যাপসের ছড়াছড়ি। আর এই অ্যাপসগুলোর বেশির ভাগই অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকর। এক গবেষণায় দেখা গেছে, সোস্যাল সাইট ব্যবহারকারীদের বিশাল একটা সংখ্যা তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করেন, শুধুমাত্র অ্যাপস চেক করতে গিয়ে এদের মধ্যে অধিকাংশ তার পিসির কার্যক্ষমতা সম্পূর্ণ নষ্ট করে ফেলেন অ্যাপস এর দ্বারা এবং আরেক অংশের আইডি হ্যাক হয়ে যায় শুধুমাত্র অতিরিক্ত নানান রকমের অ্যাপস ব্যবহারে।
২. যারা অনেক বেশি সোস্যাল সাইটগুলোতে সময় দেন, ব্যক্তিগত জীবনে তাদের সাথে পরিবারের বেশ দূরত্ব সৃষ্টি হয়! দেখা যায়, তারা দিন শেষে বাড়ি ফিরে অথবা সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতেও পরিবারকে সময় না দিয়ে সময় দেয় সোস্যাল মিডিয়াগুলোতে যার ফলে মানুষিক থেকে শুরু করে বাহ্যিক পর্যন্ত সব দিক থেকে দূরত্ব সৃষ্টি হয় পরিবার এর সাথে।
৩. বিখ্যাত নিউজ চ্যানেল সিএনএনের সোস্যাল রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি ভিত্তিহীন খবর প্রচার করা হয় সোস্যাল সাইটগুলোতে, যা মিডিয়া সম্পর্কে সমাজে খারাপ ধারণা সৃষ্টি করছে। এতে জনসাধারণের মাঝে বিভ্রান্তিরও সৃষ্টি হচ্ছে।
৩. দেখা গেছে, টুইটার, ফেসবুক, লিঙ্কডইন, মাইস্পেস, হাইফাইভ, বাদু, নিং ইত্যাদিসহ, বাংলাদেশীদের উপস্থিতি রয়েছে এমন সাইটগুলোও অনর্থক আর আজেবাজে প্রচুর মন্তব্যে ভরা। এসব সাইট প্রচুর পরিমাণে অপব্যবহার হচ্ছে। অনেক ব্লগের লেখা খুব বেশি সম্পাদনা করা হয় না। সেসব ব্লগে যার যা খুশি তা-ই লিখে দিচ্ছেন।
৪. সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে ধর্মীয় বিষয়ে মিথ্যা খবর ছড়িয়ে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা চালানো হয়। অনেক সময় সফলতাও হচ্ছে তারা। গুজব তৈরির জন্য তারা এসকল সাইট সর্বোচ্চ ব্যবহার করছেন।
৫. সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সোস্যাল সাইটগুলোতে প্রশ্নফাঁসের উৎসব চলছে! সব ধরনের পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হয়ে যাচ্ছে এই মাধ্যমগুলোতে, ফলে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে শিক্ষাক্ষেত্রসহ সব রকমের প্রশাসনিক কার্যক্রম।
৬. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষার ফলাফল ও পরবর্তীতেও নিজেদের ক্যারিয়ারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
৭. অতিরিক্ত সোস্যাল সাইটের প্রতি আসক্তি এবং এর অপব্যবহার শুধুমাত্র পরিবার ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের জন্যই যে ক্ষতিকর তা না, এটা সমস্যা তৈরি করতে পারে আপনার কর্মক্ষেত্রেও!
এসব নৈতিক অধঃপতনের কারণে দেখা যাচ্ছে- আস্থা, ভালোবাসা ও বিশ্বাস এখন আর আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতার সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। ফলে এমন সব ঘটনা ঘটছে, যা শুনে বা খবরের কাগজে পড়ে শিউরে উঠতে হচ্ছে। সন্তানের হাতে মা-বাবা খুন, মা-বাবার হাতে সন্তান খুন, তিন-চার সন্তান রেখে মায়ের পরকীয়া, প্রেমিকের হাত ধরে পলায়ন, ধনাঢ্য ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার সন্তান কর্তৃক ব্যস্ততার কথা বলে বাবার লাশ আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে হস্তান্তর, বৃদ্ধ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে ছুড়ে ফেলে আসার মতো ঘটনা ঘটছে অহরহ। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তিকে অবলম্বন করে অনৈতিক ও অবৈধ প্রেমে আবদ্ধ হয়ে তরুণরা নিষ্ঠুর, নির্মম হয়ে উঠছে। এসব বিষয়গুলো কখনো কখনো তাদেরকে আত্মধ্বংসী করে তুলছে।
অবক্ষয়ের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রকে। ইন্টারনেট প্রযুক্তিনির্ভর মাধ্যমের ব্যবহার যেমন মানুষের কাছে পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে, ঠিক তেমনি মানুষের মধ্যে অবাধ যৌনাচারকেও উসকে দিচ্ছে। আজকে পর্নোগ্রাফি যেভাবে বানের পানির মতো গ্রাস করছে, তাতে শিশু-কিশোররা ব্যাপক হারে যৌন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। স্কুলগামী টিনঅ্যাজারদের মোবাইলে পর্নোগ্রাফি ছবি অভিভাবকদের অসহায় ও শঙ্কিত করে তুলেছে। যার ফলশ্রুতিতে ধর্ষণের সংস্কৃতিতে নাকাল হচ্ছে দেশ-সমাজ-পরিবার।

আমাদের করণীয়
১. আমাদের যুবকদের মাঝে ধর্মীয় চেতনা জাগিয়ে তোলা আবশ্যক। সেটা যে ধর্মেরই হোক না কেন। কারণ কোন ধর্মই আমাদের নৈতিক অবক্ষয় শিখায় না।
২. আমাদের যুবকদের জন্য সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হতে হবে তাদের পরিবার। যাতে সে কোনো ভালোবাসার অভাবে নতুন ভালোবাসা না খুঁজে।
৩. বাবা-মাকে আমাদের ছেলেমেয়েদের জানাতে হবে তার দৌরাত্ম্য কত। মানে তার সামাজিক অবস্থান থেকে সে কী করতে পারে আর কী পারে না।
৪. শুধু ভালোবাসা নয় প্রয়োজনে শাসন ও তাদের থেকে কাম্য। কারণ যিনি ভালোবাসেন শাসন সেই করতে পারেন।
৫. বাবা-মাকে খোঁজ রাখতে হবে কে বা কারা আমার ছেলে বা মেয়ের বন্ধু হচ্ছে।
৬. ইন্টারনেট ব্যবহারে আমরা কী করতে পারি না সে শিক্ষা আমাদের পরিবার থেকেই পাওয়া উচিত।
৭. ফেসবুক থেকে সকল মাধ্যমগুলোতে বাবা এবং মায়েদের ফ্রেন্ড রাখা উচিত, এবং সকলের প্রোফাইল পাবলিক থাকা উচিত।
৮. ছেলেমেয়েদের মোবাইল ও কম্পিউটার ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাবা-মায়েদের সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
৯. ছেলে বা মেয়ে কোন ভুল করে ফেললেও তাকে কাছে নিয়ে আপন করে আবার নিজেকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করতে হবে।
উপরোক্ত দিকগুলো থেকে আরো ভালো অনেক দিক আমাদের জানার বাইরে আছে যা আমাদেরকে খুঁজে নিয়ে আমাদের সন্তানদের মানুষ করে সকল নৈতিক অবক্ষয় থেকে বাঁচাতে হবে। আমাদের খারাপ দিকগুলোকে আমরা চিহ্নিত করে যদি আমাদের তরুণদের সামনে তুলে ধরতে পারি তাহলে এটা আমাদের জন্য অভিশাপ নয় আশীর্বাদও হবে।
সরকারের পক্ষ থেকেও মিডিয়াকে কল্যাণমুখী করতে ভূমিকা রাখতে হবে। ড্রাগ, ফ্রি-সেক্স প্রতিরোধেও সরকারকে ভূমিকা পালন করতে হবে। অপরাধীর কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে । সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে উদ্যোগ নিতে হবে। দল-মতের ঊর্ধ্বে ওঠে দেশপ্রেম, ধর্মীয় মূল্যবোধ, নৈতিকতা এবং আমাদের ঐতিহ্যবাহী বিশ্বাসের সাজে সজ্জিত হয়ে পথ চলতে হবে। সব ধর্মের লোকদেরকে যার যার ধর্মীয় বিশ্বাসের শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে কাজ করতে হবে। কারণ প্রত্যেক ধর্মই নৈতিকতা, সহিষ্ণুতা, ধৈর্য, মানবতাবোধ, ন্যায়বিচার, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, পরের সম্পদে লোভ না করা, অন্যায়কে ঘৃণা করার শিক্ষা দেয়।
আমাদের সমাজের এই নৈতিক অবক্ষয়ও কিন্তু আমাদের এই হাতে পাওয়া মাধ্যমগুলো থেকেই হয়েছে। যা আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি। এই অবক্ষয় এখনই ঠেকাতে না পারলে আমরা আর আমাদের যুবসমাজ পুরোটাই অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া থেকে কেহ ঠেকাতে পারবে না!
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

Wednesday, February 21, 2018

ইরানের গন্তব্য কোন পথে? -মাসুমুর রহমান খলিলী


ইরানে শাসন বিরোধী বিক্ষোভের অবসান ঘটেছে প্রায় দু’সপ্তাহ আগে। যুক্তরাষ্ট্র এই বিক্ষোভকে শাসন পরিবর্তন পর্যন্ত নিয়ে যেতে চাইলেও সেটি শেষ পর্যন্ত হয়নি। ১৯৫৩ সালে আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এভাবে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেকের সরকারের পতন ঘটিয়েছিল। মার্কিন শ্রেণিবিন্যাসিত দলিলগুলো অবমুক্ত করার পর এর এখন আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাওয়া যাচ্ছে। আমেরিকা বা সিআইএ’র শাসন পরিবর্তনের সেই সক্ষমতা এখন সম্ভবত সেভাবে নেই। বলা হচ্ছে এর আগে তুরস্ক একবার এই ধরনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এবার ব্যর্থ হলো ইরানের ক্ষেত্রে।

ইরান দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় পারস্য উপসাগরের তীরে অবস্থিত একটি প্রভাবশালী মুসলিম রাষ্ট্র। বিশ্বের সবচেয়ে পর্বতময় দেশগুলোর একটি ইরানে হিমালয়ের পরেই এশিয়ার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ দামভান্দ অবস্থিত। দেশটির জনগণ জাতিগত ও ভাষাগতভাবে বিচিত্র হলেও এরা প্রায় সবাই মুসলিম। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ অঞ্চলটি ইসলামের শিয়া মতাবলম্বীদের কেন্দ্র। ইরানে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডার রয়েছে। পারস্য উপসাগরের অন্যান্য তেলসমৃদ্ধ দেশের মতো ইরানেও তেল রফতানি ২০শ শতকের শুরু থেকে দেশটির অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি।
খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে বর্তমান ইরান ছিল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য পারস্যের কেন্দ্র। প্রায় ২০০০ বছর ধরে এ অঞ্চলের অধিবাসীরা নিজেদের দেশকে ‘ইরান’ নামে ডাকত। ইরান নামটি এই এলাকায় বসতি স্থাপনকারী আর্য গোত্রের নাম থেকে নেয়া। কিন্তু গ্রিকরা এই অঞ্চলকে পাস্র্ বলে ডাকত আর সেখান থেকে ইউরোপীয় ভাষায় এর নাম হয় পার্সিয়া। ১৯৩৫ সালে ইরানের শাসক দেশটিকে কেবল ‘ইরান’ বলে ডাকার অনুরোধ জানানোর পর থেকে এখন এই নামেই সারা বিশ্বে দেশটি পরিচিত। ১৫০১ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত রাজতন্ত্রী ইরান শাহ কিংবা রাজারা শাসন করতেন। ১৯৭৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সংঘটিত ইরানি বিপ্লব রাজতন্ত্রের পতন ঘটায় এবং ইরানে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র স্থাপন করে।
ইরান ভৌগোলিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত। এর উত্তরে আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, কাস্পিয়ান সাগর ও তুর্কমেনিস্তান; পূর্বে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান; দক্ষিণে ওমান উপসাগর, হরমুজ প্রণালী ও পারস্য উপসাগর এবং পশ্চিমে ইরাক ও তুরস্ক। তেহরান ইরানের বৃহত্তম শহর ও রাজধানী; শহরটি ইরানের উত্তর অঞ্চলে অবস্থিত।
২০০৬ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ইরানের জনসংখ্যা ৭ কোটির কিছু বেশি। এখন এ সংখ্যা ৮ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে এক-চতুর্থাংশের বয়স ১৫ বছর বা তার কম। জাতিগত ও ভাষাগতভাবে বিচিত্র দেশ ইরানের বাইরে প্রবাসে আরও প্রায় ৪০ লক্ষ ইরানি নাগরিক বসবাস করেন। এরা মূলত উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ, তুরস্ক, পারস্য উপসাগরীয় দেশসমূহ এবং অস্ট্রেলিয়াতে বাস করেন। সিআইএ ফ্যাক্টবুক অনুসারে ইরানের জাতিগুলোর মধ্যে পারসিক জাতি ৫১%, আজেরি জাতি ২৪%, গিলাকি জাতি ও মাজান্দারানি জাতি ৮%, কুর্দি জাতি ৭%, আরব জাতি ৩%, লুর জাতি ২%, বেলুচি জাতি ২%, তুর্কমেন জাতি ২% এবং অন্যান্য ১%।
জাফরি শিয়া ইসলাম ১৬শ শতক থেকে ইরানের রাষ্ট্রধর্ম। ইরানের ১৯৭৯ সালের সংবিধান শিয়া ধর্মগুরুদের সরকারে গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বমূলক পদে স্থান দেয়। ইরানের ৯০ শতাংশের মতো মুসলিম শিয়া মতাবলম্ব^ী। আর এদের প্রায় সবাই জাফরি শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী। জাফরি শিয়ারা মনে করেন হযরত মুহাম্মদ সা.-এর ১২ জন উত্তরাধিকারী ইমাম আছেন। ইরানের বাকি জনগণ সুন্নি ধর্মাবলম্বী।
ইরানে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর নেতা হলেন রাহবার আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। ইরান ইসলামী বিপ্লবের স্থপতি আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির মৃত্যুর পর তিনি রাহবার হন।  খামেনি মৃত্যুবরণ করলে অথবা কর্তব্য পালন করতে অক্ষম বলে মনে করা হলে তিন সদস্যের একটি কাউন্সিল তার কাজ করবেন।  ইরানের প্রেসিডেন্ট (বর্তমানে হাসান রূহানি), বিচার বিভাগের প্রধান (এখন সাদেগ লারিজানি) এবং ইরানের সংবিধান ব্যাখ্যা করার দায়িত্বে নিয়োজিত গার্ডিয়ান কাউন্সিলের প্রধান (বর্তমানে আহমদ জান্নাতি) এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। ৮ বছরের জন্য নির্বাচিত ৮৮ সদস্যের বিশেষজ্ঞ পরিষদ নতুন রাহবার নির্বাচিত না করা পর্যন্ত এই পরিষদ রাহবারের দায়িত্ব পালন করবে।
ইরানের রাজনীতিতে তিনটি ধারা রয়েছে। এর একটি হলো রক্ষণশীল মূলনীতিবাদী ধারা, আরেকটি হলো সংস্কারবাদী ধারা আর অপরটি হলো মধ্যপন্থী উদার ধারা। বিশেষজ্ঞ পরিষদের বিগত নির্বাচনের সময় সংস্কারবাদীরা তাদের জয় হয়েছে বলে দাবি করেছিল। আবার রক্ষণশীলদের দাবি ছিল তাদের বিজয় হয়েছে।  কিন্তু পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দেখা গেছে আয়াতুল্লাহ আহমদ জান্নাতির মতো একজন রক্ষণশীল ধর্মীয় নেতা নির্বাচিত হয়েছেন।  এখানে মূলত মধ্যপন্থী স্বতন্ত্র ধারাটিই নির্ণায়ক ভূমিকা রেখেছে বলে মনে হয়।
সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি নিজে রক্ষণশীল ধারার ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হলেও তার কাজে এক ধরনের ভারসাম্য বজায় থাকে। রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদের দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে সংস্কারবাদীরা আন্দোলন শুরু করলে তিনি আহমাদিনেজাদের পক্ষেই ভূমিকা রাখেন। কিন্তু রুহানির দ্বিতীয় মেয়াদে আহমাদিনেজাদ আবার প্রেসিডেন্ট হতে চাইলে তিনি সেটি অনুমোদন করেননি। স্বাস্থ্যগতভাবে খামেনির অবস্থা বেশ দুর্বল হয়ে গেছে বলে মনে করা হয়। ৭৮ বছর বয়সী এই নেতা দেশটির সাবেক স্পিকার ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ছিলেন। যুদ্ধে তিনি একটি হাত হারিয়েছেন। সংস্কারবাদীদের সাথে কোন কোন সময় তার কিছুটা বিরোধ দেখা দিলেও খোমেনির পর তিনি মোটামুটিভাবে বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে রাহবারের দায়িত্ব পালন করেছেন।
ইরানের যে কোন পরিবর্তনে রাহবারের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আয়াতুল্লাহ খোমেনির সময় আয়াতুল্লাহ মোন্তাজেরিকে তার উত্তরসূরি মনে করা হতো। কিন্তু শেষ দিকে এসে তিনি ছিটকে পড়েন। আয়াতুল্লাহ খামেনি তার উত্তরাধিকারী মনোনীত হন। নতুন রাহবার হিসেবে আয়াতুল্লাহ আহমদ জান্নাতি ও প্রেসিডেন্ট হাসান রূহানির কথা বলা হচ্ছে। বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হাসান রুহানি অনেক আশা জাগানোর মাধ্যমে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ৬ বিশ্বশক্তির সাথে পারমাণবিক চুক্তি করেন। ইরানিরা ধারণা করেছিল তাদের ওপর বহু বছর ধরে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে। তারা অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে পাবে। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে রুহানি নির্বাচিত হওয়ার পরও আন্তর্জাতিক অবরোধ পুরোপুরি ওঠেনি। বরং আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন করে পারমাণবিক চুক্তির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কথা বলছেন। আর ইরানের বিরুদ্ধে নতুন করে আগ্রাসী বক্তব্য দিতে শুরু করেছেন। অন্য দিকে আয়াতুল্লাহ জান্নাতি বহু বছর ধরে অভিভাবক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রক্ষণশীলদের বাইরেও তার প্রভাব রয়েছে।
প্রেসিডেন্ট রুহানির ব্যাপারে খানিকটা আশাভঙ্গের কারণে ডিসেম্বরের শেষ দিকে সূচিত বিক্ষোভ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কোন ধরনের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া ছড়িয়ে পড়া এই বিক্ষোভে জনগণের মধ্যে যে অপ্রাপ্তি বা ক্ষোভ রয়েছে তা স্পষ্ট হয়। প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে একটি সমৃদ্ধ দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইরানিদের দুরবস্থার একটি কারণ যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ছাপিয়ে দেয়া অবরোধ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ইরান তার অর্থনৈতিক সম্পদের একটি বড় অংশ আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের জন্য ইরাক সিরিয়া লেবানন ইয়েমেনে ব্যয় করার কারণে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করা করা যায়নি। ফলে ইরানি মুদ্রার অব্যাহত অবমূল্যায়ন হয়েছে এবং নতুন কাজ সৃষ্টি করা যায়নি। এর পাশাপাশি ইরানি শাসনের বিরুদ্ধে যেমন আন্তর্জাতিক চক্রান্ত বেড়েছে তেমনিভাবে অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ দমন করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাড়াবাড়িও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর বিরুদ্ধে অসন্তোষের প্রকাশ ঘটেছে সাম্প্রতিক বিক্ষোভে।
ইরানের শাসনব্যবস্থা তথা অনুসৃত ইসলামী ধ্যান ধারণাকে মূল্যায়ন করতে হলে সেখানকার বাস্তবতা ও প্রেক্ষিত দিয়েই এর বিচার করতে হবে। ইরানের ৮ কোটি মানুষের মধ্যে ৯০ শতাংশের মতো শিয়া ধারার জাফরি মুসলিম। শিয়া ধর্মমতের সামাজিক প্রভাব সুন্নি ধারার চেয়ে বেশি। শিয়া আলেমদের সামাজিক প্রভাবও একইভাবে প্রবল। এর ফলে ইরানের যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা তাতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের গভীর প্রভাব দেখা যায়। কয়েক শতাব্দীর রাজতান্ত্রিক শাসন সেই প্রভাবকে মুছে দিতে পারেনি। ফলে ১৯৭৯ সালে রাজতন্ত্রবিরোধী গণবিপ্লবের পর ক্ষমতা ধর্মীয় নেতাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। আর ইরানের সর্বোচ্চ নেতৃত্বে যারা রয়েছেন তারা কেউ এই ব্যবস্থার অবসান কামনা করেন না যদিও তাদের মধ্যে কর্মপন্থা নিয়ে কিছুটা মতের ব্যবধান রয়েছে।
ইরানের বর্তমান গণতন্ত্রকে পাশ্চাত্য প্রকৃত গণতন্ত্র হিসেবে মূল্যায়ন করে না। তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সেখানে মুক্তভাবে যে কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন না। যারা ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ধ্যান ধারণায় বিশ্বাস করে অভিভাবক পরিষদ কেবল তাদেরকে প্রার্থী হওয়ার অনুমোদন দেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হলেন রাহবার যিনি নির্বাচিত নন। বাস্তব ক্ষেত্রে এই সমালোচনার অনেকখানি এক তরফা ও পক্ষপাতদুষ্ট।
ইরানি ব্যবস্থার শীর্ষ পদ রাহবার নির্বাচিত করেন ৮৮ সদস্যের বিশেষজ্ঞ পরিষদ। এই বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে ৮ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। রাহবার একবার নির্বাচিত হলে তার কোন নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে না কিন্তু দায়িত্ব পালনে তিনি অক্ষম বিবেচিত হলে বিশেষজ্ঞ পরিষদ তাকে পদচ্যুত করতে পারেন। বিপ্লবের পর থেকে অনেক অন্তর্ঘাতী ঘটনার পরও দেশটিতে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তনে কোন ধরনের ব্যত্যয় ঘটেনি। রাষ্ট্রের এখন যে মৌলিক চরিত্র সেটি জনগণের ভোটের মধ্য দিয়েই অবয়ব পেয়েছে। পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র চর্চার দেশগুলোতেও রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোতে অবিশ্বাসীরা ক্ষমতায় যেতে পারেন না। ইরানের ব্যবস্থা তার চেয়ে ব্যতিক্রম নয়।
ইরানের শাসনব্যবস্থার সামনে বেশ কয়টি মৌলিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত: ইরানের ইসলামী ব্যবস্থার সাফল্যের একটি প্রধান নির্ণায়ক হলো এই ব্যবস্থায় জনগণ কতটা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকছে সেটি। এবারের বিক্ষোভের একটি বড় ইস্যু ছিল বৈষম্য। এখনো ইরানি সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বৈষম্য রয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে দরিদ্রদের জন্য বেশ কিছু নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে। কিন্তু কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অপ্রতুল। রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাফল্যের জন্য এই অর্থনৈতিক দিকটিকে কোনভাবেই উপেক্ষা করা যায় না।
রাষ্ট্র হিসেবে ইরান অনেকখানি প্রভাব বিস্তারবাদী নীতি গ্রহণ করে। নীতিগতভাবে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগঠন হামাসকে এক সময় সহায়তা করে ইরান। আবার একই সাথে ইরাক লেবানন ইয়েমেনে বিভিন্ন প্রক্সি বাহিনী গড়ে তুলে তাদের সরাসরি সহায়তা করে। আরব জাগরণের অংশ হিসেবে সিরিয়ায় বাশার আসাদবিরোধী বিদ্রোহ দমনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করে তেহরান। ইয়েমেনে হুজি বিদ্রোহেও সরাসরি জড়িয়ে পড়ে ইরান। এসব নীতির কারণে সৌদি আরবের নেতৃত্বে রাজতান্ত্রিক সুন্নি দেশগুলোর সাথে প্রত্যক্ষ সংঘাত তৈরি হয় ইরানের। সিরিয়ায় ইরানপন্থীদের কার্যত বিজয়ে সৌদি আরব অধিকতর হুমকির মধ্যে পড়ে যায়। সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করার পরও ইয়েমেনে হুজিদের বিরুদ্ধে জয়ী হতে না পারার পরে সৌদি আরবকে দেখা যায় নেপথ্যে ইসরাইলের সাথে সমঝোতা প্রতিষ্ঠায়। সৌদি আরব একই সাথে ইরান ও মুসলিম ব্রাদারহুডকে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে চিহ্নিত করে আর ইসরাইলবিরোধী ছয় দশকের নীতিকে নমনীয় করে তেলআবিবের সাথে সমঝোতা করে অভিন্ন শত্রু ইরানের মোকাবেলা করার জন্য। এই মেরুকরণের মধ্যে জেরুসালেম ইস্যুতে ইরান পালন করে প্রত্যক্ষ ভূমিকা। এভাবে সৌদি আরব ইসরাইল আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিপক্ষে পরিণত হয় ইরান।
ইরানের বিরুদ্ধে এই ব্যাপকভিত্তিক আঞ্চলিক শত্রুতার পরিস্থিতি যখন তৈরি হয় তখন দেশটি বিভিন্ন আরব দেশের প্রক্সি যুদ্ধে অর্থ ব্যয় করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন ও সুশাসনে মনোযোগী হতে পারেনি। এর ফলে বছর পাঁচেকের ব্যবধানে একদিকে ইরানি রিয়েলের দাম এক-তৃতীয়াংশে নেমে আসে আর অন্য দিকে বেকারত্বের হার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। এই ধরনের একটি অবস্থা বাইরের প্রতিপক্ষের সামনে অভ্যন্তরীণ বিরোধকে কাজে লাগানোর সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। আর ঠিক এই সময়টাকেই অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য বেছে নেয়ার পেছনে বিভিন্ন পক্ষের ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ থাকতে পারে। অনানুষ্ঠানিক সূত্রের তথ্যানুসারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানে শাসন পরিবর্তনের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য সিআইএর কাউন্টার টেরোরিজম উইংয়ের প্রধানকে দায়িত্ব দিয়েছেন। রুশ বার্তা সংস্থা স্পুটনিকের প্রতিবেদনেও এই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। অন্য দিকে ইসরাইল মনে করছে জেরুসালেমকে রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার যে কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে তা বাস্তবায়ন করতে হলে ইরানকে চাপে রাখতে হবে। তেহরানে শাসন পরিবর্তন হোক বা না হোক অন্তত জেরুসালেমের ব্যাপারে দেশটির ভূমিকা নমনীয় করা গেলে সেটিই হবে তেলআবিবের জন্য বড় সাফল্য। আর সৌদি আরব গত এক দশকের বেশি সময়ে ইরানের প্রভাবের কাছে কেবলই জমি হারিয়েছে। ইয়েমেন থেকে হুজিদের নিক্ষেপিত ক্ষেপণাস্ত্র রিয়াদে আঘাত হানার পর ইরান-হুমকি তার জন্য ইসরাইলি শত্রুতার চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৮ কোটি মানুষের দেশ ইরানে ১৯৮৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বাধীন ইসলামী বিপ্লবের পর দীর্ঘ রাজতান্ত্রিক উত্তরাধিকারের অবসান ঘটিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক সব ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হয়। এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতার আসনে রাখা হয় একজন ধর্মীয় নেতাকে যিনি পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হলেও ক্ষমতাধর অভিভাবক পরিষদ, নির্বাচক পরিষদ, বিচার বিভাগ, নিরাপত্তা বাহিনী এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। আর এই নিয়ন্ত্রণ এতটা গভীর যে একবার এই পদে আসীন ব্যক্তিকে আমৃত্যু স্বপদে বহাল থাকতে দেখা যায়। যদিও সর্বোচ্চ নেতার অপসারণের ব্যবস্থাও সংবিধানে রাখা হয়েছে। তবে প্রেসিডেন্ট বা সংসদের নির্বাচন কারা করতে পারবেন তা ধর্মীয় নেতাদের প্রাধান্যপূর্ণ অভিভাবক পরিষদ নিয়ন্ত্রণ করলেও নির্বাচন হয় অবাধ এবং নিরপেক্ষ। জনগণ যে সব প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তাদের মধ্য থেকে মুক্তভাবে প্রার্থী বাছাই করতে পারেন। এই ধরনের ব্যবস্থাকে পাশ্চাত্য মুক্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসাবে স্বীকার করে না সত্যি কিন্তু তাদেরই চরম স্বৈরতান্ত্রিক সরকারগুলোর সাথে নিজেদের স্বার্থে বিশেষ মিত্রতা গড়ে তুলতে দেখা যায়।
প্রশ্ন হলো ঠিক এ সময়টাতে কেন ইরানে ব্যাপকভিত্তিক সরকারবিরোধী বিক্ষোভে ইন্ধন দেয়া হয়েছে। যেখানে থানায় আক্রমণ অথবা বিক্ষোভ দমনের গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জনতার ওপর চাপিয়ে দেয়ার মতো অন্তর্ঘাতী ঘটনাও ঘটছে। খ্রিষ্টপূর্ব হাজার বছর পূর্বের পারসিক সভ্যতার উত্তরাধিকার ইরান বিপ্লবের পর থেকে এক ধরনের অস্থির অবস্থার মধ্য দিয়ে চলে এসেছে। বিপ্লবের কয়েক বছরের মধ্যেই ইরাকের সাথে প্রায় দশকব্যাপী যুদ্ধ শুরু হয়। ইরানিরা মনে করে যে তাদের দেশকে অস্থির করে অঙ্কুরে বিপ্লব ধ্বংসের জন্য এই যুদ্ধ সাদ্দাম হোসেনের মাধ্যমে তেহরানের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। অন্য দিকে ইরানবিরোধী আরব নেতৃত্ব আয়াতুল্লাহ খোমেনির ইসলামী বিপ্লব রফতানির হুমকি এই যুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল বলে মনে করে। এই কারণে সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় সব দেশ সাদ্দামের পেছনে দাঁড়ায় যদিও পরে সাদ্দামের কুয়েত দখলের পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়। ইরান-ইরান যুদ্ধের অবসানের পরও নানা ইস্যুকে কেন্দ্র করে ইরানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চলতে থাকে। সর্বশেষ ফাইভ প্লাস ওয়ান বিশ্বশক্তির সাথে পারমাণবিক সমঝোতার পরও সেই নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি ওঠে যায়নি। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতায় ট্রাম্পের আগমন ঘটে আর ইরানবিরোধী মার্কিন অবস্থান আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়।
ইরানি নেতৃত্বকে অবশ্যই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানে বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। বিশ্বব্যংকের বিবেচনায় উচ্চ মধ্য আয়ের দেশ ইরানে বিশ্বের বৃহত্তম গ্যাস মজুদ রয়েছে। তেলের মজুদ রয়েছে এখানে বিশ্বের চতুর্থ সর্বাধিক। প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম প্রস্তুত এবং শিল্প উন্নয়নেও দেশটি যথেষ্ট এগিয়েছে নানা ধরনের অবরোধ ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও। কিন্তু এটিকে জনগণের জীবন মানোন্নয়নে সেভাবে রূপান্তর করা যায়নি। সার্বিক বিবেচনায় ইরানের অগ্রাধিকার পুনর্বিন্যাস করার প্রয়োজন রয়েছে। তা না হলে এখন যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে তা দমন করা সম্ভব হলেও এর উপাদানগুলো নানাভাবে দেশটিতে থেকে যাবে এবং সময়ে সময়ে বাইরের মদদ পেয়ে তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এ কারণে ইরানকে সতর্ক নীতি ও কৌশল নিতে হবে এখনই। তবে সংস্কার করতে গিয়ে ইরানি ব্যবস্থাকে অস্থির কোন অবস্থায় ঠেলে দেয়া যাবে না। ইরানে এখন যে পদ্ধতি তা মোটা দাগে সেখানকার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। সেখানে সংস্কার আনা যায় কিন্তু এই ব্যবস্থার আমূল কোনো পরিবর্তন নয়। তবে এটি এমন কোন ত্রুটিমুক্ত শাশ্বত ব্যবস্থা নয় যা সুন্নি দেশসমূহ অনুসরণ করতে পারে কারণ ইরানি সমাজ ও সুন্নি প্রধান সমাজের ধরন ও বৈশিষ্ট্য এক নয়। মুসলিম ব্রাদারহুড যে ধরনের ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চায় সেটি সুন্নি সমাজের বাস্তবতাকে সামনে রেখেই। এ ব্যবস্থায় প্রচলিত গণতন্ত্র এবং ইসলামী পদ্ধতির একটি সমন্বয় থাকে।
ইরানের যে শক্তি সেটি ইসলামী বিশ্বের জন্য অনেক বড় একটি শক্তি। কিন্তু এটাকে সম্প্রদায়গত বিরোধে না লাগিয়ে ইসলামের মূল শত্রুদের বিরুদ্ধে শক্তি অর্জনে কাজে লাগাতে পারলে তা হবে ইতিবাচক। কোন শাসনই যেমন ত্রুটিমুক্ত নয় তেমনিভাবে প্রতিটি শাসনের কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। মুসলিম বিশ্বভুক্ত রাষ্ট্র সেটি সৌদি আরব ইরান বা তুরস্ক যেই দেশই হোক না কেন বিরোধ ও মতের ব্যবধানে শক্তি ক্ষয় না করে অভিন্ন শত্রুর মোকাবেলায় মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। এসব দেশকে নিজেদের জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তি শিক্ষা এবং প্রতিরক্ষায় শক্তি অর্জন করতে হবে। এই নীতি ইরানকে মুসলিম দুনিয়ায় অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Wednesday, January 24, 2018

অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের আল্লাহর দরবারে চোখের পানি ফেলে শহীদ হবার জন্য ফরিয়াদ

১৯৯৬ সালের কেন্দ্রীয় রুকন সম্মেলনে তৎকালীন আমীরের জামায়াত মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব আল্লাহর দরবারে চোখের পানি ফেলে শহীদ হবার জন্য যে ফরিয়াদ করেছিলেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হয়ত উনার সেই ফরিয়াদ সেদিন কবুল করে নিয়েছিলেন:
(একবার ক্লিক করে ভিডিও চালু না হলে ২য় বার ক্লিক করুন)

Tuesday, January 23, 2018

ইস্তাম্বুলের বিজয় এবং কিছু কথা -প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন আরবাকান, অনুবাদ : বুরহান উদ্দিন


আজ নতুন একটি যুগের এবং নতুন একটি বিজয়ের প্রয়োজন। যার জন্য সমগ্র মানবতা আজ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। নতুন একটি শান্তিময় দুনিয়া গঠন করার জন্য আমাদের এই মুসলিম জাতি পুনরায় নেতৃত্ব দেবে। সম্মানিত একটি জাতির এবং সম্মানিত একটি ইতিহাসের উত্তরাধিকারীগণ এই বিজয়ের পতাকাবাহী হিসেবে কাজ করবে।

ইস্তাম্বুল বিজয়ের খুব বেশি আগে নয় মাত্র ৫০ বছর পূর্বে ১৪০০ সালের শুরুর দিকে তইমুর লং যখন আনাতলিয়াতে আক্রমণ করছিল তখন সবাই ভেবেছিল যে সব কিছুই ধ্বংস হয়ে গেছে। মুসলিমবিশ্ব সবচেয়ে বড় দুর্দশায় নিপতিত হয়েছিল। কিন্তু মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে আমাদের এই জাতি সব কিছুকে সাজিয়ে গুছিয়ে, ইস্তাম্বুলের বিজয়ের মধ্য দিয়ে একটি যুগের অবসান ঘটিয়ে নতুন এক সোনালি যুগের সূচনা করেছিল। তেমনিভাবে আজও একটি নতুন যুগের নতুন একটি বিজয়ের প্রয়োজন। কিন্তু এর জন্য ইস্তাম্বুলের বিজয়কে খুব ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
আমাদের প্রিয়নবী মানবতার মুক্তির দূত মুহাম্মদ সা: এই হাদিসের মাধ্যমে আমাদেরকে ইস্তাম্বুুল বিজয়ের সুসংবাদ দান করেছিলেন।
অর্থাৎ অবশ্য অবশ্যই ইস্তাম্বুল বিজিত হবে। সেই বিজয়ের সেনাপতি কতই না উত্তম সেনাপতি আর সেই বিজয়ের সৈনিকগণ কতই না উত্তম। (মুসনাদে আহমাদ)
এই হাদিস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। কী বলা হয়েছে এই হাদিসে? ‘লাতুফতাহান্নাল কন্সতান্তিনিয়্যাতা’ এই কথা বলা হয়েছে। এখানে লামে তাকিদ এবং নুনে সাকিলা এর দ্বারা বক্তব্যকে জোরালো করা হয়েছে। অর্থাৎ ইস্তাম্বুল অবশ্য অবশ্যই বিজিত হবে। বিজয়ের জন্য মৌলিক শর্ত হলো এমন দৃঢ়বিশ্বাস। অর্থাৎ যদি বিজয় করতে চাই তাহলে অবশ্যই আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে। দৃঢ়ভাবে এবং সন্দেহাতীতভাবে আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে। মুহাম্মদ সা: “অবশ্যই অবশ্যই বিজয় হবে”- এই কথা বলার কারণে মুসলমানগণ এই সম্মানের অংশীদার হওয়ার জন্য বহুবার বিজয়াভিযান পরিচালনা করেছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের মধ্য থেকে এই মহান সম্মান, সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহকে নসিব করেছেন।
সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ তার বাল্যকাল থেকেই ইস্তাম্বুল বিজয়ের স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন। এই হাদিস শরিফে বর্ণিত এই বিরল সম্মানের অংশীদার হওয়ার জন্য তিনি রাতদিন কঠোর সাধনা করেছিলেন। বলতে গেলে, ইস্তাম্বুুল বিজয়ের জন্য সুলতান ফাতিহ পাগলপারা হয়ে গিয়েছিলেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ও তাঁকে এই মহান সম্মানের ভাগীদার করেছিলেন।
সুতরাং আমরা যে দাওয়াত এবং আন্দোলনকে বিশ্বাস করি সেই আন্দোলনকে তার লক্ষ্যপানে পৌঁছানোর জন্য আমাদেরকেও সেই আন্দোলনের জন্য পাগলপারা হতে হবে।
সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ সিংহাসনে সমাসীন হওয়ার সাথে সাথেই দিন রাত কঠোর পরিশ্রম করে ইস্তাম্বুুলের বিজয়ের জন্য সকল প্রকার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন। দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর শহর ইস্তাম্বুলের বিজয়ের জন্য তিনি সকল কিছুকে সুসংহত করেছিলেন। ২ লাখ সৈন্যের অংশগ্রহণে এক বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করেন। এর পাশাপাশি তিনি প্রচুর পরিমাণে আগুনের গোলা তৈরি করেন। এগুলো ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি। “ঈমান খাসি ছাগল থেকেও দুধ করতে পারে।” এই কথার ওপর আস্থা রেখে পাহাড়ের ওপর দিয়ে জাহাজ চালিয়েছিলেন।
যদি একটি বিজয় চাই তাহলে ঈমান, আত্মবিশ্বাস, আগ্রহের পাশাপাশি সেই সময়ের সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তির অধিকারী হতে হবে এবং সবচেয়ে উন্নত পন্থা গ্রহণ করতে হবে।
১৪৫৪ সালের ৬ এপ্রিল বাইজান্টাইন সম্রাটকে আত্মসমর্পণের আহবান জানান। এটা হলো মুসলমানদের মূলনীতি। রক্তপাত যাতে না হয় এই জন্য তিনি এই আহবান জানিয়েছিলেন। কিন্তু বাইজান্টাইনগণ এটাকে গ্রহণ না করে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সুলতান ফাতিহও আক্রমণের নির্দেশ দান করেন। এর আগে তিনি তার সকল সেনাবাহিনীকে নিয়ে নামাজ আদায় করেন এবং বিজয়ের জন্য মহামহিম সম্রাট আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে দোয়া করেন। দোয়া করার সময় অসহায় এক বান্দার মতো আকুতি মিনতি করে দোয়া করেন।
দোয়া করার পর সেনাবাহিনীকে আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে, তিনি তার ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করার সময় পাহাড়সমূহকে কাঁপিয়ে দিচ্ছেন এমন এক নরশার্দূলের ন্যায় তাঁকে দেখা যাচ্ছিল।
ইয়া আল্লাহ! কত বিশাল এক যুদ্ধ, কত বড় উদ্যম, কত মহান এক প্রয়াস। ২৯ মে ফজরের সময় প্রাচীরগুলোকে ভেঙে ফেলা হয়েছিল। ইস্তাম্বুুলের বিজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। বাইজান্টাইনের প্রাচীরে সর্বপ্রথম ইসলামের পতাকা উত্তোলন করার ভাগ্য উলুবাতলি হাসানের হয়েছিল। সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহর সেনাবাহিনী ভেঙে ফেলা প্রাচীরের ভেতর দিয়ে তীব্রতার সাথে স্রোতের মত ইস্তাম্বুলে প্রবেশ করেছিল। এইভাবে একটি যুগের পতন হয়ে অন্য যুগের সূচনা হয়েছিল। ইস্তাম্বুল বিজয় হওয়ার পর বিজয়ী সেনাপতি সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ আল্লাহ তালার শুকরিয়া আদায় করার জন্য আয়াসুফিয়াকে (ঐধমরধঝঁভরুধ) মসজিদে রূপান্তরিত করেন এবং ২ রাকাত শুকরানা নামাজ আদায় করেন। এর পর তিনি হজরত আইয়ুব আল আনসারির কবর জিয়ারত করতে যান। এইভাবে সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ এত বড় বিজয়ের পর অত্যন্ত বিনয়ী হয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের শুকরিয়া জ্ঞাপনের এক অনুপম দৃষ্টান্ত পেশ করেন।
আজ আমরা মুসলিম হিসেবে, প্রাচীরের সামনে অবস্থানকারী সেনাবাহিনীর মত। আমরা আজ নতুন এক বিজয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছি। আগামী দিনের বিজয়ের জন্য নতুন উদ্দামে লড়ে যাচ্ছি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি তিনি আমাদেরকে এমন মর্যাদাসম্পন্ন একটি জাতির উত্তরাধিকারী করেছেন। ইস্তাম্বুলের বিজয় থেকে আমরা যে সকল শিক্ষা নিতে পারি এর মধ্যে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো হজরত আইয়ুব আল আনসারি রা:।
জিহাদের ঘোষণা শুনার সাথে সাথে হজরত আইয়ুব আল আনসারি রা:, কুরআনে কারিম বন্ধ করে সাথে সাথে উঠে দাঁড়ান। তার সন্তানগণ তাঁকে এই বলে বাধা দেন, “বাবা তুমি বস, বসে বসে কুরআন পড়, নিজেকে বিপদের মুখে ঠেলে দিও না।” উত্তরে তিনি তাদেরকে বলেছিলেন, “হে আমার প্রিয় সন্তানরা, তোমরা আমাকে বলছ তুমি বস বসে কুরআন পড়। কিন্তু আমি যখন কুরআন পড়ি, কুরআন তখন আমাকে বলে উঠে দাঁড়াও জিহাদ কর।
এই মহান সাহাবী ৯০ বছর বয়সে ইস্তাম্বুলের প্রাচীরের কাছে আসেন। তার বয়সের কারণে তার নিরাপত্তার জন্য সৈন্যগণ তাঁকে তাদের পেছনে রাখতে চেয়েছে কিন্তু তারা তাঁকে তা করতে পারেনি। যুদ্ধের সেই কঠিন মুহূর্তে আগুন এবং তীরের নিচে দাঁড়িয়ে তিনি সৈন্যদেরকে “দুনিয়াবি কাজে মশগুল হয়ে জিহাদ থেকে দূরে থেকে নিজেদেরকে হুমকির মুখে ঠেলে দিও না” এই আয়াতটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন এবং তরুণ সৈন্যদেরকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিয়েছিলেন। এত ত্যাগ তিতিক্ষার পর মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর বাইজান্টাইনের প্রাচীরের পাদদেশে তাঁকে শাহাদাত নসিব করেন।
“ইসলাম কেমন একটি দ্বীন?” এই বিষয়ে যদি কেহ উৎসাহ বোধ করেন সে যেন ৯০ বছর বয়সে ইস্তাম্বুল বিজয়ের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করতে আসা হযরত আইয়ুব আল আনসারি রা:-এর দিকে তাকায়। ইসলামের মূল রূপ হলো এটা। দ্বীন ইসলাম হলো, জিহাদের দ্বীন। এই জন্য আপনারা শুধুমাত্র নামাজ পড়বেন, তাসবিহ তাহলিল পাঠ করবেন এই কথা বলা হলো মূর্খতা। যদি তাই হতো এই মহান সাহাবী, রাসূল সা: মদিনায় হিযরত করার পর যার ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তিনি মদিনা থেকে পৃথক না হয়ে সেখানে সবচেয়ে সুন্দর পদ্ধতিতে নামাজ পড়তেন এবং তাসবিহ তাহলিলে মশগুল থাকতেন।
ইস্তাম্বুুলের বিজয়ের জন্য হযরত আকশেমসেদ্দিনের ভূমিকাও অনেক বিশাল। তাকেও আমাদেরকে আমাদের আদর্শ হিসেবে স্মরণ করতে হবে। তিনি ছিলেন একজন বড় আলেম। ইস্তাম্বুুলের বিজয়াভিযানে তিনি আমাদের জন্য এক অনুপম দৃষ্টান্ত। ফাতিহর একজন উস্তাদ হিসেবে, প্রতিটি গুহায় গিয়ে গিয়ে তিনি সৈন্যদেরকে উৎসাহ উদ্দীপনা জুগিয়েছিলেন।
সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ যখন ইস্তাম্বুল বিজয় করেছিলেন তখন তিনি ছিলেন ২১ বছরের একজন টগবগে যুবক। ইস্তাম্বুলের বিজয় যেমন অনেক বড় এবং মহান একটি ব্যাপার ঠিক তেমনিভাবে যারা ২১ বছর বয়সে এই বিজয়ের জন্য ঈমানের বলে বলীয়ান কাজ করেছেন তারাও তেমন মহান এবং মর্যাদাবান। একটি দেশের আসল শক্তি ট্যাংক, ক্ষেপণাস্ত্র এবং অর্থবিত্ত নয়। বরং একটি দেশের আসল শক্তি হলো ঈমানের বলে বলীয়ান যুবসমাজ।

Wednesday, January 17, 2018

খিলাফত-পরবর্তী তুরস্কের রাজনৈতিক ইতিহাস -বুরহান উদ্দিন

বর্তমান বিশ্বপ্রেক্ষাপটে তুরস্ক উদীয়মান শক্তি। জ্বালানির মূল কেন্দ্রস্থল মধ্যপ্রাচ্য হওয়ায় এবং ইহুদিদের পুণ্যভূমি ফিলিস্তিনে হওয়ায় বর্তমান বিশ্বে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। এক কথায় বলতে গেলে মধ্যপ্রাচ্য যার নিয়ন্ত্রণে থাকবে সেই হবে বিশ্বমোড়ল। উসমানী খিলাফতের পতনের পূর্বে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য ছিল খিলাফতের অধীনে। আর ইসলামের ইতিহাসে তিনটি খিলাফত ছিল সবচেয়ে বড়। উমাইয়্যা খিলাফত; আব্বাসী খিলাফত এবং উসমানী খিলাফত। এর মধ্যে উসমানী খিলাফতের ইতিহাস ছিল সবচেয়ে সমৃদ্ধ। তাদের সময়েই ইউরোপের বিশাল একটি অংশ মুসলিম শাসনের অধীনে আসে এবং সমগ্র দুনিয়াতে ইসলাম একটি অপরাজেয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। কিন্তু মুসলিম শাসকদের ইসলামবিমুখতা এবং ইহুদিবাদীদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই উসমানী খিলাফতের পতন ঘটে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লিথুনিয়া থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত ৩০টি পয়েন্টে সমগ্র দুনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে উসমানী সেনাবাহিনী অসম বীরত্ব প্রদর্শনের পরও হেরে যায়। এবং পরবর্তীতে মাত্র ৩ বছরের বাবধানে তুরস্কের আলেমদের নেতৃত্বে বর্তমান তুরস্ক স্বাধীনতা লাভ করে। এর পর ইউরোপিয়ান দেশগুলো খিলাফতের ব্যাপারে আপত্তি করতে থাকে এবং তাদের দাবির মুখে ১লা নভেম্বর ১৯২২ সালে তৎকালীন সুলতান; সুলতান ওয়াহদেদ্দিনকে তুরস্ক থেকে নির্বাসিত করা হয়। অবশেষে লোজান চুক্তির মাধ্যমে ইউরোপিয়ান দেশগুলোর আপত্তির মুখে ২৯ অক্টোবর প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে এবং ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম মুসলিমগণ নেতৃত্ববিহীন হয়ে পড়ে।
এর অব্যবহিত পরই মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক এবং তার অধীনস্থগণ তুরস্ক থেকে ইসলাম ও ইসলামের নিশানা মুছে দেয়ার লক্ষ্যে মুসলমানদের ওপর চরম জুলুম নির্যাতন শুরু করে। আজানকে তুরকিশ ভাষায় দেয়াতে বাধ্য করে; ইসলামী শিক্ষা নিষিদ্ধ করে; টুপিওয়ালা মানুষ দেখলেই তাদেরকে হেনস্তা করা হতো। সেই সময়ে হাজার হাজার আলেমকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে এবং অতীত ইতিহাসকে সম্পূর্ণ রূপে মুছে ফেলার জন্য আরবি হরফকে তুলে দিয়ে তদস্থলে ল্যাটিন বর্ণমালা চালু করে এক রাতেই গোটা জাতিকে অজ্ঞতার অন্ধকারে ঠেলে দেয়। বিজাতীয় সভ্যতা সংস্কৃতিকে আমদানি করা হয়; মেয়েদেরকে মিনি খোলামেলা পোশাক পরিধান করতে বাধ্য করে এবং হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। মুসলিম পারিবারিক আইন পরিবর্তন করে তদস্থলে ইউরোপিয়ান পারিবারিক আইন প্রবর্তন করা হয়। এক কথায় বলতে গেলে ইউরোপের আদলে দেশকে গড়ে তুলার জন্য ইউরোপের নগ্ন সংস্কৃতিকে আমদানি করা হয়।
১৯৩৮ সালে মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক মৃত্যুবরণ করেন। তার সঙ্গী-সাথীগণ ছিলেন তার যোগ্য উত্তরসূরি, তারা তাকে কোন প্রকার জানাজা ছাড়াই দাফন করেন। কিন্তু তার মৃত্যুর মধ্য দিয়েই জুলুম নির্যাতনের অবসান হয়নি; তার সতীর্থ ইসমেত ইননু কামাল আতাতুর্কের সময়ের সেই একই জুলুম নির্যাতনকে অব্যাহত রাখেন। তার মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া উত্তরসূরিরা জবঢ়ঁনষরপধহ চবড়ঢ়ষব’ং চধৎঃু নামে একটি দল গঠন করে পুনরায় সরকার গঠন করে এবং ১২ বছর পর্যন্ত একই জুলুম নির্যাতন অব্যাহত রাখে। তাদের এই জুলুম নির্যাতন যখন চরম পর্যায়ে তখন মুসলিমগণ আস্তে আস্তে এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের পরামর্শে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করে। ১৯৫০ সালের নির্বাচনে আদনান মেন্দ্রেসের দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি বিজয় লাভ করে। তারা ক্ষমতায় এসে ইসলামের ওপর সকল নিষেধাজ্ঞাকে প্রত্যাহার করে; মসজিদগুলোকে নামাজের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়; আরবিতে আজান দেয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়া হয়। আরবিতে আজান শুনে কোটি কোটি মানুষ কান্নায় ভেঙে পড়েন; ঐতিহাসিকদের বর্ণনামতে তুরস্কের মুসলিমগণ সেদিন এতটাই আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিলেন যে এর আগে বা পরে তারা আর কোন দিন এতটা আনন্দিত হতে পারেননি।
ইসলামের ওপর সকল নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে তিনি মুসলমানদেরকে স্বস্তি দেন এবং আমেরিকার সাথে নতুন করে সম্পর্ক গড়ে তুলেন। তিনি মোট ১০ বছর ক্ষমতায় আসীন ছিলেন। ১৯৬০ সালে বামপন্থী ও ইসলামবিদ্বষী সেনাবাহিনী এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে।
এই সামরিক সরকার ৫ বছর তুরস্ককে শাসন করে। ১৯৬৪ সালে উবসড়পৎধঃ চধৎঃু অন্যতম সদস্য সোলেয়মান ডেমিরেল আদালেত পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁকে তুরস্কের জনগণ আদনান মেন্দ্রেসের উত্তরসূরি হিসাবে ভোট দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে এবং তার নেতৃত্বে আদালেত পার্টি অনেকবার সরকার গঠন করে। কিন্তু ৯০-এর দশকে তিনি নিজেকে একজন ম্যাসন (ইয়াহুদিদের দালাল) বলে স্বীকার করে নেন। তিনি তুরস্কে এখন ম্যাসন ডেমিরেল নামে পরিচিত। ১৯৬৫ সালে ডেমিরেল ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তুরস্ক এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। তার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ডানপন্থী বামপন্থী গ্রুপ সৃষ্টি হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শিখাঙ্গনে একের পর এক ছাত্রহত্যার ঘটনা ঘটতে থাকে, শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ব্যাহত হয়। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এই অবস্থা জারি থাকে।
১৯৬৯ সালে তুরস্কের রাজনীতিতে এক নতুন ধারার সূচনা হয়। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান আলেম-উলামাদের পরামর্শে এবং ইসলামী চেতনায় উজ্জীবিত একদল মুসলমানকে নিয়ে ইসলামী আন্দোলনের সূচনা করেন। তিনি মিল্লি নিজাম নামে একটি নতুন দল গঠন করেন। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য বিপজ্জনক এই অভিযোগে ১ বছর পরই এই দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। এই দল নিষিদ্ধ হওয়ার সাথে সাথেই নাজমুদ্দিন এরবাকান মিল্লি সালামেত নামে নতুন একটি দল গঠন করে ১৯৭৩ সালে সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং ৪৮ আসনে বিজয় লাভ করে নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে এই ৪৮ আসন ছাড়া কোনো দলই সরকার গঠন করতে পারছিল না। সুলেয়মান ডেমিরেল তখন ডানপন্থী দল হিসেবে তুরস্কে পরিচিত হওয়ায় নাজমুদ্দিন এরবাকান তার সাথে সুস্পষ্ট শর্তের ভিত্তিতে কোয়ালিশন সরকার গঠনের আগ্রহ প্রকাশ করেন কিন্তু তিনি এ সকল শর্তের ভিত্তিতে নাজমুদ্দিন এরবাকানের সাথে সরকার গঠন করতে অস্বীকার করেন কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে বামপন্থী দলের নেতা বুলেন্ত এজেবিদ তার সকল শর্ত মেনে নিয়ে তার সাথে সরকার গঠন করেন। তার এই কোয়ালিশন সরকারের সময় ৬ হাজার মুসলিমকে মুক্ত করে দেয়া, সাইপ্রাসকে গ্রিস থেকে মুক্ত করে তুরকিশ সাইপ্রাস গঠন করা ও মুসলিমদেরকে জুলুমমুক্ত করা, নতুন করে মাদরাসা শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করা; হাজার হাজার কুরআন কোর্স চালু করা; মাদরাসার ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেয়া; সাইদ বদিউজ্জামান নুরসির রিসালায়ই নুরের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা; সেনানিবাসসহ সকল সরকারি অফিস আদালতে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা; ইসলামী বইপুস্তক প্রকাশের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া; অশ্লীলতা বেহায়াপনা দূর করার লক্ষ্যে আইন করাসহ অনেক কাজ করেন। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৮ এই সময়ের মধ্যে তিনি ২৭০টি ভারি শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন যার মধ্যে বিমান তৈরির কারখানা থেকে শুরু করে সকল কিছুই ছিল। তার এই উদ্যম দেখে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অন্য দলকে তার সাথে কোয়ালিশন ছিন্ন করতে বাধ্য করে এবং সরকার নতুন নির্বাচনের আয়োজন করে।
১৯৭৮ সালে পুনরায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং এই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির ফলে মিল্লি সালামেত পার্টির আসন ২৮ এ নেমে আসে কিন্তু এবারও তারা নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হয় কিন্তু এবার তারা নিঃস্বার্থ ভাবে অফধষবঃ চধৎঃু কে সমর্থন করে। এই সময়ে ইসলামী আন্দোলন তুরস্কের রাজনীতিতে এক নিয়ামক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯৮৯ সালের ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পক্ষে সংসদ এবং সংসদের বাইরে মজবুত ভূমিকা পালন করে এবং আমেরিকা ইরাককে দিয়ে ইরানের ওপর হামলার বিপক্ষে মধ্যপ্রাচ্যে জনমত গঠনে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে। এইভাবে মুসলিম বিশ্বের ওপর ইঙ্গ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন ভূমিকা পালন করে।

রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে তুরস্ক যখন সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল এটাকে সাম্রাজ্যবাদীরা ভালো চোখে দেখেনি। তারা ১৯৮০ সালে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়। সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের পর সকল দলকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ নাজমুদ্দিন এরবাকানসহ আরও অনেক রাজনীতিবিদকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং তাদেরকে জেলে প্রেরণ করে। হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে জেলে পুরে এবং শত শত মানুষকে হত্যা করে। সেনাবাহিনী ডানপন্থী ও বামপন্থী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই সামরিক অভ্যুত্থানের প্রভাব এতটাই প্রকট ছিল যে অনেক ঐতিহাসিক এই জন্য বলে থাকেন যে আধুনিক তুরস্কের ২টি ইতিহাস রয়েছেÑ একটি হলো ১৯৮০-এর আগে আরেকটি ১৯৮০ সালের পরের ইতিহাস।
সামরিক শাসন ৩ বছর পর্যন্ত জারি থাকে এবং পরবর্তীতে তারা রাজনীতিতে প্রবেশ করে নতুন দল গঠনের মাধ্যমে রাজনীতি শুরু করে। ১৯৮৩ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে এরবাকনের দল মিল্লি সালামেত পার্টির সংসদ সদস্য তুরগুত অজাল গড়ঃযবৎষধহফ ঢ়ধৎঃু নামে একটি দল গঠন করে ক্ষমতায় আরোহণ করে। এই সময়ে রেফাহ পার্টি; জরমযঃ ধিু চধৎঃু, ঘধঃরড়হধষরংঃ গড়াবসবহঃ ঢ়ধৎঃু নামে আরও কয়েকটি দলের জন্ম হয়। ১৯৮৯ সালের এক রেফারেন্ডামের মাধ্যমে নাজমুদ্দিন এরবাকান; বুলেন্ত এজেবিত পুনরায় রাজনীতি করার অধিকার ফিরে পান। এরবাকান রেফাহ পার্টির প্রধান নির্বাচিত হন।
এইভাবে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তুরগুত অজালের নেতৃত্বে গড়ঃযবৎষধহফ চধৎঃু তুরস্ককে শাসন করে। তুরগুত অজাল ১৯৯৩ সালে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে প্রেসিডেন্ট হন এবং ১৯৯৪ সালে তাঁকে বিষপানে হত্যা করা হয়। তুরগুত অজালের মৃত্যুর পর তুরস্কের জাতীয় সংসদ সুলেয়মান ডেমিরেলকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়। এই সময় ১৯৯৪ সালের স্থানীয় নির্বাচনে রেফাহ পার্টি বিপুল বিজয় অর্জন করে। তুরগুত অজালের মৃত্যুর পর তার দলের সদস্যরা ব্যাপকভাবে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ায় এবং এরবাকান জাতির সামনে এক ভিশন নিয়ে আসায় রাজনীতির দৃশ্যপট দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে রেফাহ পার্টি বিজয় লাভ করে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীদের দালালরা তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসি শুরু করে এবং পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের জুন মাসে এরবাকানের নেতৃত্বে রেফাহ পার্টি জরমযঃ ডধু চধৎঃু র নেত্রী তানসু চিল্লারের সাথে সরকার গঠন করে। এরবাকান ক্ষমতা গ্রহণ করেই জনগণের ক্ষমতায়ন শুরু করেন। সকল দরিদ্রকে সরকারিভাবে ভাতা দেয়া শুরু করেন। হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়ার পাশাপাশি মাদরাসা শিক্ষার প্রসারে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। জনগণের মধ্যে ইসলামের প্রচার প্রসারের জন্য ইসলামি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক প্রসার ঘটান ও আলেম ওলামাদেরকে সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা প্রধান করেন। উ-৮ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সুদের হারকে কমিয়ে নিয়ে আসেন। মাত্র ১১ মাসের শাসনামলে ৩৩ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করেন। সকলের বেতন তিনি ১০০ ভাগ বৃদ্ধি করেন। কোন কোন ক্ষেত্রে ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করেন। জনগণের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগী হন। শিল্পায়নে গতি ফিরিয়ে এনে ৫ বছরের মধ্যে তুরস্ককে জাপান ও জার্মানির শিল্পায়নকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। মুসলিম দেশগুলোকে নিয়ে কমন মার্কেট চালু করেন। তার এই সকল উত্তরোত্তর সফলতায় ইয়াহুদিরা রেফাহ পার্টিকে বন্ধ করার লক্ষ্যে সকল প্রকার প্রপাগান্ডা চালায় ও তার পার্টি শরিয়ত কায়েম করবে এই অভিযোগে তাকে সরানোর জন্য সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করে। এই অবস্থায় এরবাকান এই শর্তে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দেন যে তার কোয়ালিশন পাটির নেত্রী তানসুকে প্রধানমন্ত্রী করতে হবে। কিন্তু মাসন ও ইয়াহুদিদের ধারক সোলেয়মান ডেমিরেল বিশ্বাসঘাতকতা করে মেসুদ ইলমাজকে প্রধানমন্ত্রী করে। এইভাবে রেফাহ পার্টিকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি নাজমুদ্দিন এরবাকানকেও রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। এর তিন মাস পর ১৯৯৭ সালে পুনরায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ইসলামপন্থী গণ রেফাহ পার্টির অন্যতম নেতা রেজায় কুতানের নেতৃত্বে ফাজিলেত পার্টি গঠন করে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ১১৪টি আসন লাভ করে। কিন্তু কিছুদিন পর এই দলটিকেও নিষিদ্ধ করে। এরপর গঠিত হয় সাদেত পার্টি। এবং শুধুমাত্র ফাজিলেত পার্টি ছাড়া অন্য সকল দল মিলে সরকার গঠন করে কিন্তু তাদের দুর্নীতিতে জনগণের নাভিশ্বাস উঠতে শুরু করে। অর্থনীতিতে মারাত্মক ধস নামে এবং মুদ্রাস্ফীতি সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে পড়ে। অবশেষে ২০০২ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। এই নির্বাচনে রজব তায়্যিব এরদোগানের নেতৃত্বে একে পার্টি ৩৪.৩ শতাংশ ভোট পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং এরপর ২০০৭ সালে ৩৮.৬ এবং ২০১১ সালের নির্বাচনে ৪৯.৮ শতাংশ ভোট পেয়ে দেশ পরিচালনা করছে। হ

লেখক :Student, Middle East Technical University, Department of Economics.

Popular Posts