Monday, March 12, 2018

ঐতিহাসিক ১১ মে কোরআন দিবস: কুরআনের মর্যাদা রক্ষায় মাইলস্টোন এবং জামায়াতে ইসলামী

-  শাহাদাতুর   রহমান   সোহেল

১১ মে ঐতিহাসিক কুরআন দিবস। প্রতিবছর ১১ মে এটি কুরআন দিবস হিসাবে পালিত হয়ে থাকে। ১৯৮৫ সালের ১১ মে কুরআনের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জে ঈদগাহ ময়দানে আয়োজিত সমাবেশে সংঘটিত হয় এক পৈশাচিক, নারকীয় হত্যাকান্ড। ১৯৮৫ সালের এই দিনে চাঁপাইনবাবগঞ্জে পুলিশের গুলিতে আটজন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। দিনটিকে স্মরণে রাখার জন্য সেই থেকে এই দিবস পালিত হয়ে আসছে। ঘটনার সূত্রপাত ভারতে ১৯৮৫ সালের ১২ এপ্রিল। এদিন ভারতের দুইজন উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদী নাগরিক পদ্মপল চোপরা ও শীতল সিং কোরআনের সকল আরবি কপি ও অনুবাদ বাজেয়াপ্ত করার জন্য কলকাতা হাইকোর্টে একটি রীট আবেদন করে। রীটে বলা হয়, কুরআনে এমন কিছু আয়াত আছে যেখানে কাফির ও মুশরিকদের হত্যা এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রেরণা দেয়া হয়েছে, তারা কুরআনে উল্লেখিত সূরা বাকারার ১৯১নং আয়াত ও সূরা তওবার ৩১ নং আয়াতের রেফারেন্স দিয়ে মামলা দায়ের করেছিল। কোরআন যেহেতু কাফের মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করা, তাদের হত্যা করার কথা বলেছে সেহেতু কুরআন একটি সাম্প্রদায়িক উস্কানী দাতা গ্রন্থ এবং এই গ্রন্থ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্ম দিতে পারে। তাই একে বাজেয়াপ্ত করার দাবি তুলে মামলা দায়ের করে। ভারতীয় সংবিধানের ২২৩ নং ধারা সি আর পিসি ১১৫(ক) ও ২৯৫ (ক) উদ্ধৃতি দিয়ে তারা আল কোরআনকে ভারতীয় সংবিধান বিরোধী বলে উল্লেখ করে। বিচারপতি মিসেস পদ্মা খাস্তগীর মামলা গ্রহণ করেন। তিনি ১২ই এপ্রিল এ বিষয়ে তিন সপ্তাহের মধ্যে এফিডেভিট প্রদানের জন্য রাজ্য সরকারের প্রতি নির্দেশ দেন। এ ঘটনায় গোটা ভারতে মুসলমানদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের প্রতিটি মুসলিম দেশ এর প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।

কুরআনকে বাজেয়াপ্ত করার মামলার খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে কলকাতাসহ সারাবিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়। ১০ মে জুমার নামাজ শেষে বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে হাজার হাজার ইসলামী ছাত্র-জনতার মিছিল ও সমাবেশে মিলিত হলে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। সারাদেশের মত চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঈদগাহ ময়দানে আয়োজন করা হয় এক প্রতিবাদ সমাবেশ। ১১ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঈদগাহ ময়দানে আয়োজিত সমাবেশে ১৪৪ ধারা জারি করে পুলিশ। এদিন্ ইসলামী জনতা শুধুমাত্র দোয়া করার অনুমতি চাইলে তা না দিয়ে জনতার উপর গুলী বর্ষণ করে পুলিশ। এতে স্কুল ছাত্র, কৃষক, রিক্সাওয়ালা ও রেল শ্রমিকসহ গুলিবিদ্ধ হয়ে ৮ জন শাহাদাত বরণ করেন। ঘটনার দিন বেলা ১১ টার সময় সমাবেশের আহবায়ক মাওলানা হোসাইন আহমদকে এসপি অফিসে ডেকে সমাবেশ বন্ধ করার জন্য চাপ দেয়া হয়। কিন্তু ইসলামী জনতা দলে দলে আসতে থাকে ঈদগাহ ময়দানের দিকে। উপায় না দেখে ঈদগাহ ময়দানে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। শুধুমাত্র দোয়া করে জনতাকে শান্ত করে চলে যাবো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সেই আবেদনও শুনেনি ম্যাজিষ্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লা। এসময় ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লা সেই সুযোগ দেয়া হবে না বলে গালিগালাজ করতে থাকে, ব্যাটা মৌলবাদীদের দেখে নেবো বলেও প্রকাশ্য হুমকি দেয়। এসময় ইসলামী জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়লে ম্যাজিষ্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লার নির্দেশে এলোপাতাড়ি গুলী বর্ষণ শুরু করে পুলিশ। পুলিশের গুলীতে প্রথমেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ১০ম শ্রেণীর ছাত্র শিবির কর্মী আব্দুল মতিন। হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করে। এ ঘটনায় শীষ মোহাম্মদ, রশিদুল হক, ৮ম শ্রেণীর ছাত্র সেলিম, সাহাবুদ্দীন, কৃষক আলতাফুর রহমান সবুর, রিক্সা চালক মোক্তার হোসেন ও রেল শ্রমিক নজরুল ইসলাম শহীদ হন। আহত হয় অর্ধ শতাধিক মানুষ। চাঁপাইনবাবগঞ্জের হাসপাতালে তিল ধারণের ঠাঁই না থাকায় আহতদের চিকিৎসার জন্য রাজশাহীতে পাঠানো হয়। ন্যক্কারজনকভাবে রাজশাহী নেয়ার পথেও আহতদের ওপর পুনরায় আক্রমণ চালানো হয়। বাড়ি বাড়ি তল্লাশির নামে হয়রানি করা হয়। নতুন করে পুলিশি নির্যাতনের পাশাপাশি মামলা দায়ের করা হয়। কুরআনের অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যেখানে সকল মুসলমানের কর্তব্য সেখানে ইসলামী জনতার উপর গুলী বর্ষণ করে ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় রচনা করেছিল বাংলাদেশের কিছু মুসলমান নামধারী পুলিশ। বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের নিদের্শদাতা ম্যাজিষ্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লা এখন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা। বর্বরোচিত এই হত্যাকান্ডের বিচারতো হয়ইনি, বরং উল্টো হয়রানি করা হয়েছিল মুসলিম জনতাকে।

ছবিঃ ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লা

চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসী পরদিন ১২ মে সকল বাধা উপেক্ষা করে কারফিউ ভেঙে জুমার নামাজের পর নৃশংস হত্যা বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে শোককে শক্তিতে পরিণত করতে রাজপথে নেমে আসে । এ দিকে সারা বাংলাদেশে এমন নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানানো হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের এমন ঘটনা সারা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৩ মে প্রশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালন করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কুরআনপ্রেমিক মানুষ। 

বাংলাদেশের এ ঘটনার ফলে সারা বিশ্বে একটি জনমত সৃষ্টি হয় এবং এর ফলশ্রুতিতে ভারত সরকার তটস্থ হয়ে হাইকোর্ট রায়টি প্রত্যাহারের নির্দেশ দিলে ১৩ ই মে মামলাটি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি বি. সি বাসক বামনের আদালতে স্থানান্তরিত হয় এবং তিনি উক্ত মামলাটি খারিজ করে দেন। সেই থেকেই বাংলাদেশের ইসলামপ্রিয় জনগণ ১১ মে'র সেই দিনকে স্মরণ করে “কোরআন দিবস” হিসেবে পালন করে আসছে।

কুরআনের মর্যাদা রক্ষার সেই মহান সফল সংগ্রাম বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং সহযোগী ইসলামী ছাত্রশিবিরের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল। আর এখনো প্রধাণতঃ এদের দ্বারাই এই দিবসটি কোরআন দিবস হিসাবে পালিত হয়। এই দিবসটি দেশবাসীর কাছে আরো ভালোভাবে তুলে ধরতে হবে এবং সেই শাহাদাতের তামান্না নিয়ে আল-কোরআনকে বিজয়ী বিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এগিয়ে যেতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন, আমিন। 

১১ মে ঐতিহাসিক কোরআন দিবস ।কোরআনের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে  
১১ মে ঐতিহাসিক কুরআন দিবস নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র 


১৯৮৫ সালের ১১ মে’র ঘটনা জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাসে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, আল-কোরআনের মর্যাদা ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় জামায়াতে ইসলামীর নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের একটি অংশমাত্র। এরজন্য জামায়াতে ইসলামী নীচের কাজগুলোসহ আরো কাজ অব্যাহত রেখেছে:
১) আল-কোরআন বুঝে আয়ত্ব করা তথা অধ্যয়নের জন্য ব্যাপকভাবে কোরআনের তাফসীর গ্রন্থ প্রচার ও প্রচলনের ব্যবস্থা করেছে। এই তাফসীর গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে তাফহীমুল কোরআন, তাফসীর ফি জিলালিল কোরআন, তাফসীরে ইবনে কাসীর, তাফসীরে ওসমানী ইত্যাদি।
২) বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী প্রথম তাফসীরুল কোরআন মাহফিল প্রচলন করে এবং দেশজুড়ে এর বিস্তার ঘটায়। অধিকন্তু এই তাফসীর মাহফিলের ভিডিও ক্যাসেট পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে দেয়। পরে অন্যান্যরাও তাফসীর মাহফিল করে বর্তমানে। 
৩) বর্তমানে ফ্রী কোরআন শিক্ষার আন্দোলন জামায়াতে ইসলামী দেশজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমানে মসজিদসহ বিভিন্ন স্থানে জামায়াতের সক্রিয় জনশক্তি একাজে নিয়োজিত হয়েছে। একে জামায়াত নিজ জনশক্তির ব্যক্তিগত কাজের অংশ করে দিয়েছে। 
৪) রাছুল (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) আল-কোরআনকে বিজয়ী বিধান হিসাবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী মরণপণ সংগ্রাম-আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। অন্য ইসলামী শক্তি গুলো মুখে রাছুল ও সাহাবায়ে কেরামের ভক্তি দেখালেও রাছুল (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-এর মূল কাজের বিষয়ে দুর্বল, কোন কোন সময় বিরোধীও। 

১১ মেতে আরেকটি স্মরণীয় ঐতিহাসিক ঘটনা: ১১ মে তারিখে ১৮৫৭ ঐতিহাসিক বৃটিশবিরোধী আজাদী আন্দোলনের সিপাহীরা দিল্লী অধিকার করেন এবং মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহকে সম্রাট ঘোষণা করেন।

Thursday, March 1, 2018

ইসলাম ও সাংবাদিকতা -সাকী মাহবুব


সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা, সাংবাদিকরা দেশের জাগ্রত বিবেক। সাংবাদিকদের প্রধান ও একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে সত্যের সংরক্ষণ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা। তাই জ্ঞানী, গুণী, কবি-সাহিত্যিকরা বলে থাকেন, সাংবাদিকদের কলমের ক্ষমতা তরবারির চেয়ে ধারালো ও শক্তিশালী। সহজেই অনুমেয় যে, কলম এমন একটি অস্ত্র যা সর্বাধুনিক মারণাস্ত্রের চেয়েও মারাত্মক। এই কলমের সামান্য দুই ফোঁটা কালি পৃথিবীর সমস্ত ধনসম্পদের চেয়েও বেশি মূল্যবান। সেই কলম যখন কোনো সাংবাদিকের হাতের অস্ত্র হয় তখন তার ক্ষমতাও বেড়ে যায় অন্তহীনভাবে। সাংবাদিকগণ সমাজ ও দেশের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও অত্যাবশ্যকীয় শ্রেণি। তাদের উচিত সত্য ও নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন করা। এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলে সংবাদপত্রের চরিত্র নষ্ট হয়। এ ধরনের সাংবাদিকতাকে সাম্প্রতিককালে হলুদ সাংবাদিকতা নামে অভিহিত করা হচ্ছে। সংবাদপত্র হচ্ছে লোকশিক্ষক। জনকল্যাণের জন্য তা যেন সঠিকভাবে কাজ করে সে দিকে সাংবাদিকদের আন্তরিক হতে হবে। তাহলে সংবাদপত্র তার সঠিক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।

সংবাদপত্রে যেমন আছে সৎ নির্ভীক সাংবাদিক, তেমনি আছেন অসৎ সাংবাদিক। অথচ নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য সংবাদ পরিবেশনই সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকের প্রধান কর্তব্য। ইসলাম ও সাংবাদিকতা বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে জানা গেল চৌদ্দ শত বছর আগে সাংবাদিকতা বিষয়ে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা: যে গাইডলাইন দিয়ে গেছেন তা এক কথায় অনন্য।
ইসলামে সাংবাদিকতা এক ধরনের আমানত। আর এ আমানত হচ্ছে, যে কোনো তথ্য ও সংবাদকে বস্তুনিষ্ঠভাবে গণমাধ্যমে তুলে ধরা। নিজস্ব চিন্তা কিংবা দল মতের রঙচঙ মাখিয়ে সংবাদকে আংশিক বা পুরোপুরি পরিবর্তন করে উপস্থাপন করা কিছুতেই ইসলাম সমর্থিত নয়। এ ক্ষেত্রে করণীয় হলো কোনোরূপ সংযোজন-বিয়োজন ছাড়াই সংবাদ পরিবেশন করা এবং সংবাদের অঙ্গসজ্জায় কেবল নিরেট সত্যকেই তুলে ধরা। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো।’ (সূরা আহজাব : ৭০) এ সম্পর্কে পবিত্র হাদিস শরীফে অত্যন্ত চমৎকার একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। রাসূল সা: বলেন, ‘আল্লাহ ঐ ব্যক্তির চেহারাকে উজ্জ্বল করুন যিনি আমাদের থেকে যা শুনেছেন তা হুবহু ধারণ করে অন্যের কাছে অবিকল কায়দায় পৌঁছে দিয়েছেন।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি) সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূলের এই নির্দেশনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশের আগে তথ্য যাচাই-বাছাই করতে হয়। যে খবরটি মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছে তা আদৌ সত্য কিনা তা যাচাইয়ের নিয়ম আছে সংবাদ জগতে।
কোনো ধর্ম, আদর্শ, মতবাদ ও সভ্যতাই মানুষকে মিথ্যাবাদী হতে শিখায় না। ইসলামও এর ব্যতিক্রম নয়। ইসলামে মিথ্যা বলা মহাপাপ বা কবিরা গুনাহ। রাসূল সা: বলেন, আমি কি তোমাদের কবিরা গুনাহ সম্পর্কে অবহিত করব না? কথাটি তিনি তিনবার বলেছেন। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! হ্যাঁ, অবশ্যই। তিনি বলেন, আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করা এবং মা-বাবার অবাধ্য হওয়া। এরপর হেলান দেয়া থেকে সোজা হয়ে বসে রাসূল সা: বললেন, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া ও মিথ্যা সংবাদ প্রচার করা। (বুখারি) তাই সংবাদের তথ্য যাচাই ও সত্যতা নিরূপণ করা সাংবাদিকের অপরিহার্য কর্তব্য। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনেও রয়েছে চমৎকার দিকনির্দেশনা। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কাছে যদি কোন পাপাচারী ব্যক্তি সংবাদ নিয়ে আসে তবে তোমরা তা যাচাই-বাছাই করে নাও, যাতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি সাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে যাতে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদের অনুতপ্ত না হতে হয়।’ (সূরা হুজুরাত : ৬)
সাংবাদিকদের জন্য কুরআনের এই আয়াতটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদকর্মীরা যদি কোনো তথ্য সঠিকভাবে যাচাই না করে মিডিয়ায় প্রচার করে দেন, তাহলে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। যার মাশুল ঐ সংবাদকর্মী দিতে পারবে না। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই না করে সংবাদ গ্রহণ ও পরিবেশন নিষেধ করেছেন। অনেক সংবাদকর্মী লোকমুখে যা শুনেন তাই মিডিয়ায় প্রচার করে দেন। এটিও ইসলামে নিষিদ্ধ। আল্লাহর রাসূল সা: বলেন, একজন ব্যক্তি মিথ্যুক হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তাই বলে বেড়ায়। (মুসলিম শরিফ, আবু দাউদ)
সততা একজন সাংবাদিকের সবচেয়ে বড় গুণ। অসৎ লোককে কেউ বিশ্বাস করে না। অনেক যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকলেও অসততার কারণে একজন সাংবাদিকের অর্জিত সব সম্মান ধুলায় মিশে যেতে পারে। সাংবাদিকতার পথ হচ্ছে লোভ ও প্রলোভনের পিচ্ছিল পথ। সেই প্রলোভনকে জয় করতে না পারলে কোনো সাংবাদিকের পক্ষে দেশ ও সমাজের জন্য দায়িত্ব পালন অর্থহীন। সে হিসেবে বলা যায়, সাংবাদিকের হাতে কলম আছে বলেই তারা সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বলতে পারেন না। এমনটি সুস্থ সাংবাদিকতার বিপরীত কাজ। এটা অন্যায়ও বটে। ক্ষেত্রবিশেষ দেখা যায়, অনেক সাংবাদিক মিথ্যা ও বানোয়াট খবর প্রচার করে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করছেন। লোভের বশবর্তী হয়ে অন্যায়কে সমর্থন করছেন। ইসলামী শরিয়ত এ ধরনের ন্যক্কারজনক কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য বিশেষ নির্দেশ প্রদান করেছে। নিষেধ করা হয়েছে কুপ্রবৃত্তির অনুসারী হওয়ার। ইসলাম বলেছে মানবকল্যাণের জন্য সত্য সংবাদ পৌঁছে দিতে। তাই সংবাদ সংগ্রহের সময় চোখ, কান, বিবেক খোলা রাখতে হবে।
ব্যক্তিস্বার্থ কিংবা দলীয়স্বার্থ বিবেচনা করে অনেক সাংবাদিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করেন। শোনা যায়, নিউজ রুমে অনেক নিউজ কিল করা হয়। এমনটি কিছুতেই কাম্য নয়। সত্য গোপন করাকে ইসলাম পাপ হিসেবে বিবেচনা করে। আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না, আর যে ব্যক্তি তা গোপন করে, অবশ্যই তার অন্তর পাপী।’ (সূরা আল বাকারা : ২৮৩) জনস্বার্থে আসল তথ্য গোপন না করে তা প্রকাশ করা উচিত। মানুষ তথ্য জানার জন্য অধীর আগ্রহে পত্রিকা পড়েন কিংবা টিভির পর্দায় চোখ রাখেন। জ্ঞাত বিষয়কে গোপন করা সম্পর্কে পবিত্র হাদিসে কঠোর নিন্দা করা হয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর রা: হতে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেন, যে ব্যক্তি জ্ঞাত বিষয়কে গোপন করল কিয়ামতেরর দিন আল্লাহ তায়ালা তাকে আগুনের লাগাম পরাবেন। (সহীহ ইবনে হিব্বান, মুস্তাখারাজ আলা সহিহ মুসলিম) ব্যক্তিগত আক্রোশে কাউকে হেয় করার মানসে কারো একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য জনগণের সামনে তুলে ধরা ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই অন্যায় কাজ। আল্লাহ বলেন, ‘কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের কখনো যেন সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে।’ (সূরা মায়েদা : ৮) হাদিসে এসেছে হযরত ইবনে আব্বাস রা: হতে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেন, যে ব্যক্তি কোনো মুসলিম ব্যক্তির দোষ গোপন রাখল আল্লাহ তায়ালা (দুনিয়া)ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। (বুখারি শরিফ)
তবে কোনো ব্যক্তির দোষ যদি এমন এমন পর্যায়ের হয় যে, তাতে সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতি হয় তখন তা উন্মুক্ত করে তার আসল চরিত্র প্রকাশ করে দেয়া দরকার, যাতে সে আর মানুষের ক্ষতি না করতে পারে। আমাদের দেশের অনেক জ্ঞানী, গুণী, বুদ্ধিজীবী আছেন যারা তাদের লেখনীতে বিরুদ্ধ মতাদর্শের লোকদের শক্তভাবে তিরস্কার কিংবা চরিত্র হনন করেন, যা একেবারে কাম্য নয়। শুধুমাত্র বিপরীত মতাদর্শের হওয়ার কারণে জনগণের সামনে তার ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলা ইসলাম হারাম মনে করে। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোনো নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাকে মন্দ নামে ডাকা গুনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তওবা না করে, তারাই জালিম। (সূরা আল হুজুরাত ১১) সাংবাদিকতা ইসলামী দাওয়াতেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, আর তা কিছুতেই নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্য সীমাবদ্ধ নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তুমি বলো, হে মানবসমাজ, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সবার কাছে আল্লাহর রাসূল।’ (সূরা আরাফ : ১৫৮) অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘মহান সে সত্তা, যিনি তার বান্দার প্রতি ফোরকান (কুরআন) অবতীর্ণ করেছেন, যাতে সে বিশ্ব জগতের জন্য সতর্ককারী হতে পারে।’ (সূরা আল ফোরকান : ১) কাজেই সব ধর্ম, বর্ণ, জাতি গোত্র, শ্রেণি, পেশার মানুষকে নিয়েই সংবাদ পরিবেশন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো সম্প্রদায়কে প্রাধান্য দেয়ার সুযোগ নেই। কোনো শক্তির কাছে মাথা নত না করে ভয়শূন্য চিত্তে সংবাদ পরিবেশন করাই ইসলামের দাবি। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য উচ্চারণ করাই উত্তম জিহাদ।’ আল্লাহপাক বলেন, ‘এবং তোমাদের মধ্যে এমন একটা জামাত থাকা উচিত যারা কল্যাণের দিকে আহবান করবে। অর্থাৎ সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করবে এবং এরাই সফলকামী।’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৪)
বর্তমান প্রেক্ষাপটে যে লেখনীটার সবচেয়ে বেশি দরকার এবং সবারই কাম্য তা হচ্ছে নির্ভীক সাংবাদিকতা। একজন নির্ভীক সাংবাদিকের ক্ষুরধার মসির আঘাতে ভেঙে চুরমার হয়ে যায় মাকড়সার জালের মতো অত্যাচারী শাসকদের নীলনকশা। কারণ একজন নির্ভীক সাংবাদিকের ধারালো কলমের ফলা শানিত তরবারির চেয়েও অসীম ক্ষমতাময় ও প্রলয়ঙ্করী। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘হযরত মুয়াজ রা: বললেন, রাসূল সা: আমাকে বলেছেন, হে মুয়াজ, তুমি সত্য বলতেই থাকো যদিও তা তিক্ত হয়। মূলত সত্য প্রকাশে আপসহীনতা একজন আদর্শ সাংবাদিকের অন্যতম কর্তব্য। সাংবাদিকরা নতজানু হয়ে কাজ করলে গণমাধ্যমের কার্যকারিতাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। ইসলাম সাংবাদিকদের সত্য বলার অধিকার আরো সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।
একজন সাংবাদিক সর্বদা সত্য ও সততার প্রতি একনিষ্ঠ থাকবেন; তিনি সব ধরনের নেতিবাচকতা এড়িয়ে ইতিবাচকতাকে অগ্রাধিকার দেবেন। খারাপ শব্দ ও খারাপ দৃশ্য এড়িয়ে মার্জিত শব্দ ও নির্দোষ চিত্র তুলে ধরতে সচেষ্ট থাকবেন। এ প্রসঙ্গে কুরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমার বান্দাদেরকে বল, তারা যেন এমন কথা বলে, যা অতি সুুন্দর। (সূরা বনি ইসরাইল : ৫৩) যেহেতু আল্লাহ তায়ালা সাংবাদিকদের মেধা দিয়েছেন, যোগ্যতা দিয়েছেন, তারা লিখতে পারেন, নতুন নতুন অনবদ্য রচনা ও গঠনমূলক লেখা সৃষ্টি করতে পারেন, তাই তাদেরকে অবশ্য অবশ্যই মনে রাখতে হবে, তাদেরকে প্রদান করা এই যোগ্যতা মহান আল্লাহর এক অসীম নিয়ামত। এটি একটি আমানত। এই আমানতকে কোনোভাবেই বিনষ্ট করা যাবে না, হেলায় ফেলায় খোয়ানো যাবে না। কেননা পবিত্র কুরআনে মুমিনদের গুণাবলী প্রকাশ করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা আমানতের কথা বলেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা তাদের আমানত ও চুক্তিকে রক্ষা করে।’ (সূরা মুমিনুন : ৮) অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা প্রত্যেকের আমানত সঠিকভাবে আদায় কর।’ (সূরা আন নিসা : ৫৮) পবিত্র হাদিসে আমানতের খেয়ানত করাকে মুনাফিকের আলামত হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
মিথ্যা তথ্য প্রকাশ জঘন্য অপরাধ। ইসলামে মিথ্যার কোনো আশ্রয় নেই। কুরআন ও হাদিসের বহু জায়গায় মিথ্যাকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। মিথ্যাতো নয়ই বরং আল্লাহ তায়ালা সঠিক কথা বলতে বলেছেন। ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল।’ (সূরা আল আহজাব : ৭০)
সুতরাং একজন আদর্শ সাংবাদিকের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অন্যায়, অত্যাচার, অনৈতিক ও অসামাজিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। মিথ্যা ও পাপের বিরুদ্ধে কলম ধরতে হবে। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ তথা অধর্মের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের বজ্রকঠিন শপথ গ্রহণ করতে হবে। আজ সমাজের অধিকার বঞ্চিত ও অসহায় জনতা কলম সৈনিকদের প্রতি নির্বাক চেয়ে আছে। এখনো তাদের মনে বিশ্বাস, মেঘে ঢাকা সূর্যটা উদয়ের পথে, আলো ছড়াবে দিগদিগন্তে। মনে রাখতে হবে, সংবাদপত্র কর্মীদের যাত্রা বাহুবলে নয়, বিদ্যাবলে। অসি বলে নয়, মসি বলে। মসি ও বিদ্যা নামক সাংবাদিকদের সেই ক্ষুব্ধ শক্তি আবার ফেনিল সমুদ্রের তরঙ্গের মতো উদ্বেলিত হোক। শুধু সত্যের জন্য, আম-জনতার জন্য। এমনি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় সম্পূর্ণ আল্লাহর ওপর ভরসা করে সাহসের সঙ্গে, নিঃসংকোচে, নিঃস্বার্থভাবে, সব ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে যখন কলম সৈনিকরা অস্ত্র চালনা করতে থাকবেন তখন কোনো রক্তচক্ষু কিংবা প্রলোভন নির্ভীক সাংবাদিকতার অগ্রযাত্রাকে কেউ রুখতে পারবে না ইনশাআল্লাহ।
লেখক : প্রাবন্ধিক , গবেষক

Friday, February 23, 2018

সোস্যাল মিডিয়ার প্রভাব : তারুণ্যের অবক্ষয় -সীমান্ত আকরাম

সোস্যাল মিডিয়া বলতে আমরা সাধারণত সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমকে বুঝি। আমরা যাকে ফেসবুক নামে চিনি এটি একটি সোস্যাল মিডিয়া। এ রকম আরো অনেক রয়েছে যেমনÑ টুইটার, মাইস্পেস, ইমু, হোয়াইটস আপ, ভাইবার, গুগল প্লাস, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব ইত্যাদি। সোস্যাল মিডিয়াকে সংজ্ঞায় রূপান্তরিত করলে যা দাঁড়ায় তা হলো, আমরা যার মাধ্যমে আমাদের নিত্যদিনের খবর সামান্য সময়ের মাধ্যমে এক স্থান থেকে হাজারো মানুষের কাছে লিখিত বা ভিডিওর মাধ্যমে একই সময়ে পাঠাতে পারি তার নাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যম আমাদের জীবনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। এর মাধ্যমেই আমাদের অনেক চাহিদাই খুব সহজে পূর্ণতার মুখ দেখে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের যদিও আমরা লাভবান হচ্ছি কিন্তু এর ক্ষতিকর প্রভাব বহুমাত্রিকতায় বিস্তৃত। আমাদের যুবসমাজের মাঝে এর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে নানানভাবে। পৃথিবীতে ফেসবুক ব্যবহারকারী ১ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে অধিকাংশই যুবক এতে কোন সন্দেহ নেই। যদিও আগামী প্রজন্মের জন্য এটি একটি ভালো দিক। কিন্তু যখন এই ফেসবুক নামক বস্তুটি কিংবা অন্য যাই হোক না কেন আমাদের যুবকরা তাদের পড়ার টেবিলে নিয়ে এসে ব্যবহার করে তখন সেটিকে কিভাবে সম্ভাবনার দোহাই দেবো। আমরা দেখি তরুণরা সোস্যাল মিডিয়ার সামনে যে সময় ব্যয় করে অপর দিকে পড়ার টেবিলে এর তুলনায় খুবই কম সময় দিচ্ছে। একটি জরিপে দেখা গেছে, ১০০ জন তরুণদের মধ্যে ১ ঘণ্টা থেকে একটু বেশি সময় ধরে ৩২ জন, ২-৩ ঘণ্টায় ৪৩ জন, ৪-৫ ঘণ্টায় ১৮ জন, ৬-৭ ঘণ্টায় ৪ জন এবং ৮ ঘণ্টা থেকে তার বেশি সময় ধরে সোস্যাল মিডিয়ায় নিমজ্জিত থাকে ৩ জন।
সরকারি হিসাবে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় সাত কোটি। গত মার্চ মাসে টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত মার্চ মাস শেষে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ছয় কোটি ৬৭ লাখ। অর্থাৎ দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীর হাতে এখন ইন্টারনেট। আর এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রসার কতটা দ্রুতগতিতে হচ্ছে তা অন্য একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, প্রতি ১২ সেকেন্ডে একটি করে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলা হচ্ছে বাংলাদেশে, যা দেশের জন্মহারের চেয়েও বেশি। আর এদের অধিকাংশই তরুণ।
ডিচ দ্য লেবেল নামে অ্যান্টি-বুলিং বা উৎপীড়নবিরোধী একটি দাতব্য সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তরুণদের ভীত ও উদ্বিগ্ন করে তুলছে। এই সংস্থাটি ১০ হাজার তরুণ-তরুণীর ওপর জরিপ চালিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের সবার বয়সই ১২-২০ বছরের মধ্যে। এই জরিপে অংশ নেয়াদের প্রতি তিনজনের একজন জানিয়েছে, সাইবার-বুলিং বা অনলাইন উৎপীড়ন বিষয়ে তারা সব সময় আতঙ্কে থাকে। জরিপে অংশ নেয়া প্রায় অর্ধেকই জানিয়েছে, সোস্যাল মিডিয়ার কারণে তাদের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা হয়েছে। অনলাইনে তাদের সাথে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো নিয়ে তারা আলোচনা করতে চায় না। অনলাইনে বিরূপ আচরণের শিকার হওয়া অনেকেই তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কিছু খন্ডিত অংশ প্রকাশ করেছেন। জরিপে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ইনস্টাগ্রামকে অত্যন্ত নেতিবাচক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। প্রতিবেদনের তথ্য মতে, বৈশ্বিকভাবে অনলাইন নিপীড়ন ব্যাপক পরিসরে ছড়িয়ে পড়েছে। জরিপে অংশ নেয়া ৭০ শতাংশ স্বীকার করেছে, তারা অনলাইনে অন্যের সাথে নিপীড়নমূলক আচরণ করে এবং ১৭ শতাংশ দাবি করে, তারা অনলাইনে অন্যের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউট (ওআইআই) একই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৫ বছরের তরুণদের ওপর জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে ৩০ শতাংশ নিয়মিত অনলাইন উৎপীড়নের শিকার।
উন্নয়নশীল এবং উন্নত দেশগুলোর বেশির ভাগ বাসিন্দা বলছেন, শিক্ষার প্রসারে ইন্টারনেটের ভূমিকা ব্যাপক। ৩২টি দেশে জরিপ চালিয়ে এই তথ্য পাওয়া গেছে। ‘পিউ গ্লোবাল অ্যাটিটিউড সার্ভে’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটির জরিপে দেখা গেছে, ইন্টারনেট ব্যক্তিগত সম্পর্ক উন্নয়নে অবদান রাখে। অন্যদিকে অর্থনীতিতেও ইন্টারনেটের ভূমিকা রয়েছে। গবেষণায় উঠে এসেছে, উন্নয়নশীল এবং উন্নত দেশগুলোর মানুষের দৈনন্দিন কাজে কিভাবে ইন্টারনেট সহায়ক হয়েছে। এসব দেশের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগের প্রসারে এখন তারা তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান কাজে লাগাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, কিভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এটি ব্যবহার করে সামাজিক কাজে যুক্ত হচ্ছেন। এসব ব্যবহারকারীদের মধ্যে শতকরা ৩৬ ভাগ বলেছেন ইন্টারনেট ভালো কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্যদিকে শতকরা ৩০ ভাগ ব্যবহারকারী বলেছেন ইন্টারনেট খারাপ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেখানে শতকরা ৪২ ভাগ ব্যবহারকারী বলেছেন, ইন্টারনেট মানুষের নৈতিকতার বিকাশে নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। জরিপ চালানো ৩২টি দেশের শতকরা ৪৪ ভাগ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। উন্নত দেশগুলোর তালিকায় আছে চিলি, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র। যেখানে চিলি ও রাশিয়ায় ১০ জনের ৭ জন ইন্টারনেট ব্যবহার করে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা শতকরা ৮৭ ভাগ। জরিপ চালানো উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় পাকিস্তান এবং বাংলাদেশও রয়েছে।
সোস্যাল মিডিয়ার সবচেয়ে মারাত্মক যে দিক তা হলো ভিডিও সাইটগুলো। এটাকে যদিও আমরা পুরোপুরি সোস্যাল যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে নাও বলি তবু সামাজিক মাধ্যমই হয়ে উঠেছে আমাদের জন্য আজকাল। এই ভিডিও সাইটগুলোতে আমাদের জন্য খারাপ সে খবর অপেক্ষা করছে তা হলো এই সাইটে নৈতিক অবক্ষয়জনিত ভিডিওগুলোর প্রবেশকারী অন্যগুলোর থেকে প্রায় ৪০ ভাগ বেশি। আর তার ৮০ ভাগ এর বয়সই ১৬-২৩।

সোস্যাল মিডিয়ায় কতিপয় ক্ষতিকর দিকসমূহ
১. সোস্যাল সাইট মানেই হলো অসংখ্য অ্যাপসের ছড়াছড়ি। আর এই অ্যাপসগুলোর বেশির ভাগই অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকর। এক গবেষণায় দেখা গেছে, সোস্যাল সাইট ব্যবহারকারীদের বিশাল একটা সংখ্যা তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করেন, শুধুমাত্র অ্যাপস চেক করতে গিয়ে এদের মধ্যে অধিকাংশ তার পিসির কার্যক্ষমতা সম্পূর্ণ নষ্ট করে ফেলেন অ্যাপস এর দ্বারা এবং আরেক অংশের আইডি হ্যাক হয়ে যায় শুধুমাত্র অতিরিক্ত নানান রকমের অ্যাপস ব্যবহারে।
২. যারা অনেক বেশি সোস্যাল সাইটগুলোতে সময় দেন, ব্যক্তিগত জীবনে তাদের সাথে পরিবারের বেশ দূরত্ব সৃষ্টি হয়! দেখা যায়, তারা দিন শেষে বাড়ি ফিরে অথবা সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতেও পরিবারকে সময় না দিয়ে সময় দেয় সোস্যাল মিডিয়াগুলোতে যার ফলে মানুষিক থেকে শুরু করে বাহ্যিক পর্যন্ত সব দিক থেকে দূরত্ব সৃষ্টি হয় পরিবার এর সাথে।
৩. বিখ্যাত নিউজ চ্যানেল সিএনএনের সোস্যাল রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি ভিত্তিহীন খবর প্রচার করা হয় সোস্যাল সাইটগুলোতে, যা মিডিয়া সম্পর্কে সমাজে খারাপ ধারণা সৃষ্টি করছে। এতে জনসাধারণের মাঝে বিভ্রান্তিরও সৃষ্টি হচ্ছে।
৩. দেখা গেছে, টুইটার, ফেসবুক, লিঙ্কডইন, মাইস্পেস, হাইফাইভ, বাদু, নিং ইত্যাদিসহ, বাংলাদেশীদের উপস্থিতি রয়েছে এমন সাইটগুলোও অনর্থক আর আজেবাজে প্রচুর মন্তব্যে ভরা। এসব সাইট প্রচুর পরিমাণে অপব্যবহার হচ্ছে। অনেক ব্লগের লেখা খুব বেশি সম্পাদনা করা হয় না। সেসব ব্লগে যার যা খুশি তা-ই লিখে দিচ্ছেন।
৪. সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে ধর্মীয় বিষয়ে মিথ্যা খবর ছড়িয়ে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা চালানো হয়। অনেক সময় সফলতাও হচ্ছে তারা। গুজব তৈরির জন্য তারা এসকল সাইট সর্বোচ্চ ব্যবহার করছেন।
৫. সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সোস্যাল সাইটগুলোতে প্রশ্নফাঁসের উৎসব চলছে! সব ধরনের পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হয়ে যাচ্ছে এই মাধ্যমগুলোতে, ফলে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে শিক্ষাক্ষেত্রসহ সব রকমের প্রশাসনিক কার্যক্রম।
৬. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষার ফলাফল ও পরবর্তীতেও নিজেদের ক্যারিয়ারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
৭. অতিরিক্ত সোস্যাল সাইটের প্রতি আসক্তি এবং এর অপব্যবহার শুধুমাত্র পরিবার ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের জন্যই যে ক্ষতিকর তা না, এটা সমস্যা তৈরি করতে পারে আপনার কর্মক্ষেত্রেও!
এসব নৈতিক অধঃপতনের কারণে দেখা যাচ্ছে- আস্থা, ভালোবাসা ও বিশ্বাস এখন আর আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতার সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। ফলে এমন সব ঘটনা ঘটছে, যা শুনে বা খবরের কাগজে পড়ে শিউরে উঠতে হচ্ছে। সন্তানের হাতে মা-বাবা খুন, মা-বাবার হাতে সন্তান খুন, তিন-চার সন্তান রেখে মায়ের পরকীয়া, প্রেমিকের হাত ধরে পলায়ন, ধনাঢ্য ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার সন্তান কর্তৃক ব্যস্ততার কথা বলে বাবার লাশ আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে হস্তান্তর, বৃদ্ধ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে ছুড়ে ফেলে আসার মতো ঘটনা ঘটছে অহরহ। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তিকে অবলম্বন করে অনৈতিক ও অবৈধ প্রেমে আবদ্ধ হয়ে তরুণরা নিষ্ঠুর, নির্মম হয়ে উঠছে। এসব বিষয়গুলো কখনো কখনো তাদেরকে আত্মধ্বংসী করে তুলছে।
অবক্ষয়ের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রকে। ইন্টারনেট প্রযুক্তিনির্ভর মাধ্যমের ব্যবহার যেমন মানুষের কাছে পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে, ঠিক তেমনি মানুষের মধ্যে অবাধ যৌনাচারকেও উসকে দিচ্ছে। আজকে পর্নোগ্রাফি যেভাবে বানের পানির মতো গ্রাস করছে, তাতে শিশু-কিশোররা ব্যাপক হারে যৌন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। স্কুলগামী টিনঅ্যাজারদের মোবাইলে পর্নোগ্রাফি ছবি অভিভাবকদের অসহায় ও শঙ্কিত করে তুলেছে। যার ফলশ্রুতিতে ধর্ষণের সংস্কৃতিতে নাকাল হচ্ছে দেশ-সমাজ-পরিবার।

আমাদের করণীয়
১. আমাদের যুবকদের মাঝে ধর্মীয় চেতনা জাগিয়ে তোলা আবশ্যক। সেটা যে ধর্মেরই হোক না কেন। কারণ কোন ধর্মই আমাদের নৈতিক অবক্ষয় শিখায় না।
২. আমাদের যুবকদের জন্য সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হতে হবে তাদের পরিবার। যাতে সে কোনো ভালোবাসার অভাবে নতুন ভালোবাসা না খুঁজে।
৩. বাবা-মাকে আমাদের ছেলেমেয়েদের জানাতে হবে তার দৌরাত্ম্য কত। মানে তার সামাজিক অবস্থান থেকে সে কী করতে পারে আর কী পারে না।
৪. শুধু ভালোবাসা নয় প্রয়োজনে শাসন ও তাদের থেকে কাম্য। কারণ যিনি ভালোবাসেন শাসন সেই করতে পারেন।
৫. বাবা-মাকে খোঁজ রাখতে হবে কে বা কারা আমার ছেলে বা মেয়ের বন্ধু হচ্ছে।
৬. ইন্টারনেট ব্যবহারে আমরা কী করতে পারি না সে শিক্ষা আমাদের পরিবার থেকেই পাওয়া উচিত।
৭. ফেসবুক থেকে সকল মাধ্যমগুলোতে বাবা এবং মায়েদের ফ্রেন্ড রাখা উচিত, এবং সকলের প্রোফাইল পাবলিক থাকা উচিত।
৮. ছেলেমেয়েদের মোবাইল ও কম্পিউটার ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাবা-মায়েদের সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
৯. ছেলে বা মেয়ে কোন ভুল করে ফেললেও তাকে কাছে নিয়ে আপন করে আবার নিজেকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করতে হবে।
উপরোক্ত দিকগুলো থেকে আরো ভালো অনেক দিক আমাদের জানার বাইরে আছে যা আমাদেরকে খুঁজে নিয়ে আমাদের সন্তানদের মানুষ করে সকল নৈতিক অবক্ষয় থেকে বাঁচাতে হবে। আমাদের খারাপ দিকগুলোকে আমরা চিহ্নিত করে যদি আমাদের তরুণদের সামনে তুলে ধরতে পারি তাহলে এটা আমাদের জন্য অভিশাপ নয় আশীর্বাদও হবে।
সরকারের পক্ষ থেকেও মিডিয়াকে কল্যাণমুখী করতে ভূমিকা রাখতে হবে। ড্রাগ, ফ্রি-সেক্স প্রতিরোধেও সরকারকে ভূমিকা পালন করতে হবে। অপরাধীর কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে । সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে উদ্যোগ নিতে হবে। দল-মতের ঊর্ধ্বে ওঠে দেশপ্রেম, ধর্মীয় মূল্যবোধ, নৈতিকতা এবং আমাদের ঐতিহ্যবাহী বিশ্বাসের সাজে সজ্জিত হয়ে পথ চলতে হবে। সব ধর্মের লোকদেরকে যার যার ধর্মীয় বিশ্বাসের শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে কাজ করতে হবে। কারণ প্রত্যেক ধর্মই নৈতিকতা, সহিষ্ণুতা, ধৈর্য, মানবতাবোধ, ন্যায়বিচার, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, পরের সম্পদে লোভ না করা, অন্যায়কে ঘৃণা করার শিক্ষা দেয়।
আমাদের সমাজের এই নৈতিক অবক্ষয়ও কিন্তু আমাদের এই হাতে পাওয়া মাধ্যমগুলো থেকেই হয়েছে। যা আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি। এই অবক্ষয় এখনই ঠেকাতে না পারলে আমরা আর আমাদের যুবসমাজ পুরোটাই অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া থেকে কেহ ঠেকাতে পারবে না!
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

Wednesday, February 21, 2018

ইরানের গন্তব্য কোন পথে? -মাসুমুর রহমান খলিলী


ইরানে শাসন বিরোধী বিক্ষোভের অবসান ঘটেছে প্রায় দু’সপ্তাহ আগে। যুক্তরাষ্ট্র এই বিক্ষোভকে শাসন পরিবর্তন পর্যন্ত নিয়ে যেতে চাইলেও সেটি শেষ পর্যন্ত হয়নি। ১৯৫৩ সালে আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এভাবে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেকের সরকারের পতন ঘটিয়েছিল। মার্কিন শ্রেণিবিন্যাসিত দলিলগুলো অবমুক্ত করার পর এর এখন আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাওয়া যাচ্ছে। আমেরিকা বা সিআইএ’র শাসন পরিবর্তনের সেই সক্ষমতা এখন সম্ভবত সেভাবে নেই। বলা হচ্ছে এর আগে তুরস্ক একবার এই ধরনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এবার ব্যর্থ হলো ইরানের ক্ষেত্রে।

ইরান দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় পারস্য উপসাগরের তীরে অবস্থিত একটি প্রভাবশালী মুসলিম রাষ্ট্র। বিশ্বের সবচেয়ে পর্বতময় দেশগুলোর একটি ইরানে হিমালয়ের পরেই এশিয়ার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ দামভান্দ অবস্থিত। দেশটির জনগণ জাতিগত ও ভাষাগতভাবে বিচিত্র হলেও এরা প্রায় সবাই মুসলিম। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ অঞ্চলটি ইসলামের শিয়া মতাবলম্বীদের কেন্দ্র। ইরানে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডার রয়েছে। পারস্য উপসাগরের অন্যান্য তেলসমৃদ্ধ দেশের মতো ইরানেও তেল রফতানি ২০শ শতকের শুরু থেকে দেশটির অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি।
খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে বর্তমান ইরান ছিল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য পারস্যের কেন্দ্র। প্রায় ২০০০ বছর ধরে এ অঞ্চলের অধিবাসীরা নিজেদের দেশকে ‘ইরান’ নামে ডাকত। ইরান নামটি এই এলাকায় বসতি স্থাপনকারী আর্য গোত্রের নাম থেকে নেয়া। কিন্তু গ্রিকরা এই অঞ্চলকে পাস্র্ বলে ডাকত আর সেখান থেকে ইউরোপীয় ভাষায় এর নাম হয় পার্সিয়া। ১৯৩৫ সালে ইরানের শাসক দেশটিকে কেবল ‘ইরান’ বলে ডাকার অনুরোধ জানানোর পর থেকে এখন এই নামেই সারা বিশ্বে দেশটি পরিচিত। ১৫০১ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত রাজতন্ত্রী ইরান শাহ কিংবা রাজারা শাসন করতেন। ১৯৭৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সংঘটিত ইরানি বিপ্লব রাজতন্ত্রের পতন ঘটায় এবং ইরানে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র স্থাপন করে।
ইরান ভৌগোলিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত। এর উত্তরে আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, কাস্পিয়ান সাগর ও তুর্কমেনিস্তান; পূর্বে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান; দক্ষিণে ওমান উপসাগর, হরমুজ প্রণালী ও পারস্য উপসাগর এবং পশ্চিমে ইরাক ও তুরস্ক। তেহরান ইরানের বৃহত্তম শহর ও রাজধানী; শহরটি ইরানের উত্তর অঞ্চলে অবস্থিত।
২০০৬ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ইরানের জনসংখ্যা ৭ কোটির কিছু বেশি। এখন এ সংখ্যা ৮ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে এক-চতুর্থাংশের বয়স ১৫ বছর বা তার কম। জাতিগত ও ভাষাগতভাবে বিচিত্র দেশ ইরানের বাইরে প্রবাসে আরও প্রায় ৪০ লক্ষ ইরানি নাগরিক বসবাস করেন। এরা মূলত উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ, তুরস্ক, পারস্য উপসাগরীয় দেশসমূহ এবং অস্ট্রেলিয়াতে বাস করেন। সিআইএ ফ্যাক্টবুক অনুসারে ইরানের জাতিগুলোর মধ্যে পারসিক জাতি ৫১%, আজেরি জাতি ২৪%, গিলাকি জাতি ও মাজান্দারানি জাতি ৮%, কুর্দি জাতি ৭%, আরব জাতি ৩%, লুর জাতি ২%, বেলুচি জাতি ২%, তুর্কমেন জাতি ২% এবং অন্যান্য ১%।
জাফরি শিয়া ইসলাম ১৬শ শতক থেকে ইরানের রাষ্ট্রধর্ম। ইরানের ১৯৭৯ সালের সংবিধান শিয়া ধর্মগুরুদের সরকারে গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বমূলক পদে স্থান দেয়। ইরানের ৯০ শতাংশের মতো মুসলিম শিয়া মতাবলম্ব^ী। আর এদের প্রায় সবাই জাফরি শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী। জাফরি শিয়ারা মনে করেন হযরত মুহাম্মদ সা.-এর ১২ জন উত্তরাধিকারী ইমাম আছেন। ইরানের বাকি জনগণ সুন্নি ধর্মাবলম্বী।
ইরানে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর নেতা হলেন রাহবার আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। ইরান ইসলামী বিপ্লবের স্থপতি আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির মৃত্যুর পর তিনি রাহবার হন।  খামেনি মৃত্যুবরণ করলে অথবা কর্তব্য পালন করতে অক্ষম বলে মনে করা হলে তিন সদস্যের একটি কাউন্সিল তার কাজ করবেন।  ইরানের প্রেসিডেন্ট (বর্তমানে হাসান রূহানি), বিচার বিভাগের প্রধান (এখন সাদেগ লারিজানি) এবং ইরানের সংবিধান ব্যাখ্যা করার দায়িত্বে নিয়োজিত গার্ডিয়ান কাউন্সিলের প্রধান (বর্তমানে আহমদ জান্নাতি) এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। ৮ বছরের জন্য নির্বাচিত ৮৮ সদস্যের বিশেষজ্ঞ পরিষদ নতুন রাহবার নির্বাচিত না করা পর্যন্ত এই পরিষদ রাহবারের দায়িত্ব পালন করবে।
ইরানের রাজনীতিতে তিনটি ধারা রয়েছে। এর একটি হলো রক্ষণশীল মূলনীতিবাদী ধারা, আরেকটি হলো সংস্কারবাদী ধারা আর অপরটি হলো মধ্যপন্থী উদার ধারা। বিশেষজ্ঞ পরিষদের বিগত নির্বাচনের সময় সংস্কারবাদীরা তাদের জয় হয়েছে বলে দাবি করেছিল। আবার রক্ষণশীলদের দাবি ছিল তাদের বিজয় হয়েছে।  কিন্তু পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দেখা গেছে আয়াতুল্লাহ আহমদ জান্নাতির মতো একজন রক্ষণশীল ধর্মীয় নেতা নির্বাচিত হয়েছেন।  এখানে মূলত মধ্যপন্থী স্বতন্ত্র ধারাটিই নির্ণায়ক ভূমিকা রেখেছে বলে মনে হয়।
সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি নিজে রক্ষণশীল ধারার ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হলেও তার কাজে এক ধরনের ভারসাম্য বজায় থাকে। রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদের দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে সংস্কারবাদীরা আন্দোলন শুরু করলে তিনি আহমাদিনেজাদের পক্ষেই ভূমিকা রাখেন। কিন্তু রুহানির দ্বিতীয় মেয়াদে আহমাদিনেজাদ আবার প্রেসিডেন্ট হতে চাইলে তিনি সেটি অনুমোদন করেননি। স্বাস্থ্যগতভাবে খামেনির অবস্থা বেশ দুর্বল হয়ে গেছে বলে মনে করা হয়। ৭৮ বছর বয়সী এই নেতা দেশটির সাবেক স্পিকার ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ছিলেন। যুদ্ধে তিনি একটি হাত হারিয়েছেন। সংস্কারবাদীদের সাথে কোন কোন সময় তার কিছুটা বিরোধ দেখা দিলেও খোমেনির পর তিনি মোটামুটিভাবে বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে রাহবারের দায়িত্ব পালন করেছেন।
ইরানের যে কোন পরিবর্তনে রাহবারের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আয়াতুল্লাহ খোমেনির সময় আয়াতুল্লাহ মোন্তাজেরিকে তার উত্তরসূরি মনে করা হতো। কিন্তু শেষ দিকে এসে তিনি ছিটকে পড়েন। আয়াতুল্লাহ খামেনি তার উত্তরাধিকারী মনোনীত হন। নতুন রাহবার হিসেবে আয়াতুল্লাহ আহমদ জান্নাতি ও প্রেসিডেন্ট হাসান রূহানির কথা বলা হচ্ছে। বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হাসান রুহানি অনেক আশা জাগানোর মাধ্যমে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ৬ বিশ্বশক্তির সাথে পারমাণবিক চুক্তি করেন। ইরানিরা ধারণা করেছিল তাদের ওপর বহু বছর ধরে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে। তারা অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে পাবে। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে রুহানি নির্বাচিত হওয়ার পরও আন্তর্জাতিক অবরোধ পুরোপুরি ওঠেনি। বরং আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন করে পারমাণবিক চুক্তির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কথা বলছেন। আর ইরানের বিরুদ্ধে নতুন করে আগ্রাসী বক্তব্য দিতে শুরু করেছেন। অন্য দিকে আয়াতুল্লাহ জান্নাতি বহু বছর ধরে অভিভাবক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রক্ষণশীলদের বাইরেও তার প্রভাব রয়েছে।
প্রেসিডেন্ট রুহানির ব্যাপারে খানিকটা আশাভঙ্গের কারণে ডিসেম্বরের শেষ দিকে সূচিত বিক্ষোভ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কোন ধরনের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া ছড়িয়ে পড়া এই বিক্ষোভে জনগণের মধ্যে যে অপ্রাপ্তি বা ক্ষোভ রয়েছে তা স্পষ্ট হয়। প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে একটি সমৃদ্ধ দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইরানিদের দুরবস্থার একটি কারণ যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ছাপিয়ে দেয়া অবরোধ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ইরান তার অর্থনৈতিক সম্পদের একটি বড় অংশ আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের জন্য ইরাক সিরিয়া লেবানন ইয়েমেনে ব্যয় করার কারণে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করা করা যায়নি। ফলে ইরানি মুদ্রার অব্যাহত অবমূল্যায়ন হয়েছে এবং নতুন কাজ সৃষ্টি করা যায়নি। এর পাশাপাশি ইরানি শাসনের বিরুদ্ধে যেমন আন্তর্জাতিক চক্রান্ত বেড়েছে তেমনিভাবে অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ দমন করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাড়াবাড়িও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর বিরুদ্ধে অসন্তোষের প্রকাশ ঘটেছে সাম্প্রতিক বিক্ষোভে।
ইরানের শাসনব্যবস্থা তথা অনুসৃত ইসলামী ধ্যান ধারণাকে মূল্যায়ন করতে হলে সেখানকার বাস্তবতা ও প্রেক্ষিত দিয়েই এর বিচার করতে হবে। ইরানের ৮ কোটি মানুষের মধ্যে ৯০ শতাংশের মতো শিয়া ধারার জাফরি মুসলিম। শিয়া ধর্মমতের সামাজিক প্রভাব সুন্নি ধারার চেয়ে বেশি। শিয়া আলেমদের সামাজিক প্রভাবও একইভাবে প্রবল। এর ফলে ইরানের যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা তাতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের গভীর প্রভাব দেখা যায়। কয়েক শতাব্দীর রাজতান্ত্রিক শাসন সেই প্রভাবকে মুছে দিতে পারেনি। ফলে ১৯৭৯ সালে রাজতন্ত্রবিরোধী গণবিপ্লবের পর ক্ষমতা ধর্মীয় নেতাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। আর ইরানের সর্বোচ্চ নেতৃত্বে যারা রয়েছেন তারা কেউ এই ব্যবস্থার অবসান কামনা করেন না যদিও তাদের মধ্যে কর্মপন্থা নিয়ে কিছুটা মতের ব্যবধান রয়েছে।
ইরানের বর্তমান গণতন্ত্রকে পাশ্চাত্য প্রকৃত গণতন্ত্র হিসেবে মূল্যায়ন করে না। তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সেখানে মুক্তভাবে যে কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন না। যারা ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ধ্যান ধারণায় বিশ্বাস করে অভিভাবক পরিষদ কেবল তাদেরকে প্রার্থী হওয়ার অনুমোদন দেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হলেন রাহবার যিনি নির্বাচিত নন। বাস্তব ক্ষেত্রে এই সমালোচনার অনেকখানি এক তরফা ও পক্ষপাতদুষ্ট।
ইরানি ব্যবস্থার শীর্ষ পদ রাহবার নির্বাচিত করেন ৮৮ সদস্যের বিশেষজ্ঞ পরিষদ। এই বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে ৮ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। রাহবার একবার নির্বাচিত হলে তার কোন নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে না কিন্তু দায়িত্ব পালনে তিনি অক্ষম বিবেচিত হলে বিশেষজ্ঞ পরিষদ তাকে পদচ্যুত করতে পারেন। বিপ্লবের পর থেকে অনেক অন্তর্ঘাতী ঘটনার পরও দেশটিতে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তনে কোন ধরনের ব্যত্যয় ঘটেনি। রাষ্ট্রের এখন যে মৌলিক চরিত্র সেটি জনগণের ভোটের মধ্য দিয়েই অবয়ব পেয়েছে। পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র চর্চার দেশগুলোতেও রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোতে অবিশ্বাসীরা ক্ষমতায় যেতে পারেন না। ইরানের ব্যবস্থা তার চেয়ে ব্যতিক্রম নয়।
ইরানের শাসনব্যবস্থার সামনে বেশ কয়টি মৌলিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত: ইরানের ইসলামী ব্যবস্থার সাফল্যের একটি প্রধান নির্ণায়ক হলো এই ব্যবস্থায় জনগণ কতটা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকছে সেটি। এবারের বিক্ষোভের একটি বড় ইস্যু ছিল বৈষম্য। এখনো ইরানি সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বৈষম্য রয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে দরিদ্রদের জন্য বেশ কিছু নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে। কিন্তু কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অপ্রতুল। রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাফল্যের জন্য এই অর্থনৈতিক দিকটিকে কোনভাবেই উপেক্ষা করা যায় না।
রাষ্ট্র হিসেবে ইরান অনেকখানি প্রভাব বিস্তারবাদী নীতি গ্রহণ করে। নীতিগতভাবে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগঠন হামাসকে এক সময় সহায়তা করে ইরান। আবার একই সাথে ইরাক লেবানন ইয়েমেনে বিভিন্ন প্রক্সি বাহিনী গড়ে তুলে তাদের সরাসরি সহায়তা করে। আরব জাগরণের অংশ হিসেবে সিরিয়ায় বাশার আসাদবিরোধী বিদ্রোহ দমনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করে তেহরান। ইয়েমেনে হুজি বিদ্রোহেও সরাসরি জড়িয়ে পড়ে ইরান। এসব নীতির কারণে সৌদি আরবের নেতৃত্বে রাজতান্ত্রিক সুন্নি দেশগুলোর সাথে প্রত্যক্ষ সংঘাত তৈরি হয় ইরানের। সিরিয়ায় ইরানপন্থীদের কার্যত বিজয়ে সৌদি আরব অধিকতর হুমকির মধ্যে পড়ে যায়। সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করার পরও ইয়েমেনে হুজিদের বিরুদ্ধে জয়ী হতে না পারার পরে সৌদি আরবকে দেখা যায় নেপথ্যে ইসরাইলের সাথে সমঝোতা প্রতিষ্ঠায়। সৌদি আরব একই সাথে ইরান ও মুসলিম ব্রাদারহুডকে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে চিহ্নিত করে আর ইসরাইলবিরোধী ছয় দশকের নীতিকে নমনীয় করে তেলআবিবের সাথে সমঝোতা করে অভিন্ন শত্রু ইরানের মোকাবেলা করার জন্য। এই মেরুকরণের মধ্যে জেরুসালেম ইস্যুতে ইরান পালন করে প্রত্যক্ষ ভূমিকা। এভাবে সৌদি আরব ইসরাইল আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিপক্ষে পরিণত হয় ইরান।
ইরানের বিরুদ্ধে এই ব্যাপকভিত্তিক আঞ্চলিক শত্রুতার পরিস্থিতি যখন তৈরি হয় তখন দেশটি বিভিন্ন আরব দেশের প্রক্সি যুদ্ধে অর্থ ব্যয় করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন ও সুশাসনে মনোযোগী হতে পারেনি। এর ফলে বছর পাঁচেকের ব্যবধানে একদিকে ইরানি রিয়েলের দাম এক-তৃতীয়াংশে নেমে আসে আর অন্য দিকে বেকারত্বের হার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। এই ধরনের একটি অবস্থা বাইরের প্রতিপক্ষের সামনে অভ্যন্তরীণ বিরোধকে কাজে লাগানোর সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। আর ঠিক এই সময়টাকেই অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য বেছে নেয়ার পেছনে বিভিন্ন পক্ষের ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ থাকতে পারে। অনানুষ্ঠানিক সূত্রের তথ্যানুসারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানে শাসন পরিবর্তনের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য সিআইএর কাউন্টার টেরোরিজম উইংয়ের প্রধানকে দায়িত্ব দিয়েছেন। রুশ বার্তা সংস্থা স্পুটনিকের প্রতিবেদনেও এই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। অন্য দিকে ইসরাইল মনে করছে জেরুসালেমকে রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার যে কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে তা বাস্তবায়ন করতে হলে ইরানকে চাপে রাখতে হবে। তেহরানে শাসন পরিবর্তন হোক বা না হোক অন্তত জেরুসালেমের ব্যাপারে দেশটির ভূমিকা নমনীয় করা গেলে সেটিই হবে তেলআবিবের জন্য বড় সাফল্য। আর সৌদি আরব গত এক দশকের বেশি সময়ে ইরানের প্রভাবের কাছে কেবলই জমি হারিয়েছে। ইয়েমেন থেকে হুজিদের নিক্ষেপিত ক্ষেপণাস্ত্র রিয়াদে আঘাত হানার পর ইরান-হুমকি তার জন্য ইসরাইলি শত্রুতার চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৮ কোটি মানুষের দেশ ইরানে ১৯৮৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বাধীন ইসলামী বিপ্লবের পর দীর্ঘ রাজতান্ত্রিক উত্তরাধিকারের অবসান ঘটিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক সব ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হয়। এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতার আসনে রাখা হয় একজন ধর্মীয় নেতাকে যিনি পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হলেও ক্ষমতাধর অভিভাবক পরিষদ, নির্বাচক পরিষদ, বিচার বিভাগ, নিরাপত্তা বাহিনী এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। আর এই নিয়ন্ত্রণ এতটা গভীর যে একবার এই পদে আসীন ব্যক্তিকে আমৃত্যু স্বপদে বহাল থাকতে দেখা যায়। যদিও সর্বোচ্চ নেতার অপসারণের ব্যবস্থাও সংবিধানে রাখা হয়েছে। তবে প্রেসিডেন্ট বা সংসদের নির্বাচন কারা করতে পারবেন তা ধর্মীয় নেতাদের প্রাধান্যপূর্ণ অভিভাবক পরিষদ নিয়ন্ত্রণ করলেও নির্বাচন হয় অবাধ এবং নিরপেক্ষ। জনগণ যে সব প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তাদের মধ্য থেকে মুক্তভাবে প্রার্থী বাছাই করতে পারেন। এই ধরনের ব্যবস্থাকে পাশ্চাত্য মুক্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসাবে স্বীকার করে না সত্যি কিন্তু তাদেরই চরম স্বৈরতান্ত্রিক সরকারগুলোর সাথে নিজেদের স্বার্থে বিশেষ মিত্রতা গড়ে তুলতে দেখা যায়।
প্রশ্ন হলো ঠিক এ সময়টাতে কেন ইরানে ব্যাপকভিত্তিক সরকারবিরোধী বিক্ষোভে ইন্ধন দেয়া হয়েছে। যেখানে থানায় আক্রমণ অথবা বিক্ষোভ দমনের গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জনতার ওপর চাপিয়ে দেয়ার মতো অন্তর্ঘাতী ঘটনাও ঘটছে। খ্রিষ্টপূর্ব হাজার বছর পূর্বের পারসিক সভ্যতার উত্তরাধিকার ইরান বিপ্লবের পর থেকে এক ধরনের অস্থির অবস্থার মধ্য দিয়ে চলে এসেছে। বিপ্লবের কয়েক বছরের মধ্যেই ইরাকের সাথে প্রায় দশকব্যাপী যুদ্ধ শুরু হয়। ইরানিরা মনে করে যে তাদের দেশকে অস্থির করে অঙ্কুরে বিপ্লব ধ্বংসের জন্য এই যুদ্ধ সাদ্দাম হোসেনের মাধ্যমে তেহরানের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। অন্য দিকে ইরানবিরোধী আরব নেতৃত্ব আয়াতুল্লাহ খোমেনির ইসলামী বিপ্লব রফতানির হুমকি এই যুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল বলে মনে করে। এই কারণে সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় সব দেশ সাদ্দামের পেছনে দাঁড়ায় যদিও পরে সাদ্দামের কুয়েত দখলের পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়। ইরান-ইরান যুদ্ধের অবসানের পরও নানা ইস্যুকে কেন্দ্র করে ইরানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চলতে থাকে। সর্বশেষ ফাইভ প্লাস ওয়ান বিশ্বশক্তির সাথে পারমাণবিক সমঝোতার পরও সেই নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি ওঠে যায়নি। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতায় ট্রাম্পের আগমন ঘটে আর ইরানবিরোধী মার্কিন অবস্থান আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়।
ইরানি নেতৃত্বকে অবশ্যই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানে বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। বিশ্বব্যংকের বিবেচনায় উচ্চ মধ্য আয়ের দেশ ইরানে বিশ্বের বৃহত্তম গ্যাস মজুদ রয়েছে। তেলের মজুদ রয়েছে এখানে বিশ্বের চতুর্থ সর্বাধিক। প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম প্রস্তুত এবং শিল্প উন্নয়নেও দেশটি যথেষ্ট এগিয়েছে নানা ধরনের অবরোধ ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও। কিন্তু এটিকে জনগণের জীবন মানোন্নয়নে সেভাবে রূপান্তর করা যায়নি। সার্বিক বিবেচনায় ইরানের অগ্রাধিকার পুনর্বিন্যাস করার প্রয়োজন রয়েছে। তা না হলে এখন যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে তা দমন করা সম্ভব হলেও এর উপাদানগুলো নানাভাবে দেশটিতে থেকে যাবে এবং সময়ে সময়ে বাইরের মদদ পেয়ে তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এ কারণে ইরানকে সতর্ক নীতি ও কৌশল নিতে হবে এখনই। তবে সংস্কার করতে গিয়ে ইরানি ব্যবস্থাকে অস্থির কোন অবস্থায় ঠেলে দেয়া যাবে না। ইরানে এখন যে পদ্ধতি তা মোটা দাগে সেখানকার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। সেখানে সংস্কার আনা যায় কিন্তু এই ব্যবস্থার আমূল কোনো পরিবর্তন নয়। তবে এটি এমন কোন ত্রুটিমুক্ত শাশ্বত ব্যবস্থা নয় যা সুন্নি দেশসমূহ অনুসরণ করতে পারে কারণ ইরানি সমাজ ও সুন্নি প্রধান সমাজের ধরন ও বৈশিষ্ট্য এক নয়। মুসলিম ব্রাদারহুড যে ধরনের ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চায় সেটি সুন্নি সমাজের বাস্তবতাকে সামনে রেখেই। এ ব্যবস্থায় প্রচলিত গণতন্ত্র এবং ইসলামী পদ্ধতির একটি সমন্বয় থাকে।
ইরানের যে শক্তি সেটি ইসলামী বিশ্বের জন্য অনেক বড় একটি শক্তি। কিন্তু এটাকে সম্প্রদায়গত বিরোধে না লাগিয়ে ইসলামের মূল শত্রুদের বিরুদ্ধে শক্তি অর্জনে কাজে লাগাতে পারলে তা হবে ইতিবাচক। কোন শাসনই যেমন ত্রুটিমুক্ত নয় তেমনিভাবে প্রতিটি শাসনের কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। মুসলিম বিশ্বভুক্ত রাষ্ট্র সেটি সৌদি আরব ইরান বা তুরস্ক যেই দেশই হোক না কেন বিরোধ ও মতের ব্যবধানে শক্তি ক্ষয় না করে অভিন্ন শত্রুর মোকাবেলায় মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। এসব দেশকে নিজেদের জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তি শিক্ষা এবং প্রতিরক্ষায় শক্তি অর্জন করতে হবে। এই নীতি ইরানকে মুসলিম দুনিয়ায় অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Wednesday, January 24, 2018

অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের আল্লাহর দরবারে চোখের পানি ফেলে শহীদ হবার জন্য ফরিয়াদ

১৯৯৬ সালের কেন্দ্রীয় রুকন সম্মেলনে তৎকালীন আমীরের জামায়াত মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব আল্লাহর দরবারে চোখের পানি ফেলে শহীদ হবার জন্য যে ফরিয়াদ করেছিলেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হয়ত উনার সেই ফরিয়াদ সেদিন কবুল করে নিয়েছিলেন:
(একবার ক্লিক করে ভিডিও চালু না হলে ২য় বার ক্লিক করুন)

Popular Posts