Tuesday, April 10, 2018

আফগানিস্তানে সোভিয়েত রাশিয়া বিরোধী জিহাদ, তা*লে*বান এবং জামায়াতে ইসলামী

-  শাহাদাতুর   রহমান   সোহেল


আমরা জানি আফগান মুজাহিদ সংগঠনগুলো বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী দীর্ঘ জিহাদের মাধ্যমে সোভিয়েত রাশিয়া পরাশক্তিকে আফগানিস্তানের মাটিতে পরাজিত করেছে। এই পরাজয়ই সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাংগনকে তরান্বিত করেছে। যার ফলে শধ্য এশিয়া ছয়টি মুসলিম রাষ্ট্রের স্বাধীন অভ্যুদয় সম্ভব হয়েছে। আফগানিস্তানের মুজাহিদ সংগঠনগুলোর  মধ্যে সবচেয়ে বড় দু'টি সংগঠন ছিল - (ক) হেজবে ইসলামী এবং (খ) জমিয়তে ইসলামী। এর মধ্যে জমিয়তে ইসলামী গড়ে তুলেছেন প্রফেসর বোরহানুদ্দীন রাব্বানী। তিনি এই সংগঠন গেড় তুলেছেন জামায়াতে ইসলামী রচিত বিপ্লবী ইসলামী সাহিত্য দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে। আর সবচেয়ে বড় মুজাহিদ সংগঠন, আফগান জিহাদের সর্বাধিক ভূমিকা পালনকারী, পশতুনদের সংগঠন এবং গুলবুদ্দীন হেকমতিয়ারের নেতৃত্বাধীন হেজবে ইসলামী জামায়াতে ইসলামীরই তত্ত্বাবধানে পরিচালিত মুজাহিদ সংগঠন ছিল। পরবর্তীকালে তাদের কোন ভুলত্রুটি থাকলে ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাদের জিহাদের গৌরব উজ্জ্বল ভূমিকা অনস্বীকার্য ঐতিহাসিক সত্য। রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগান জিহাদে বিজয়ে ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর অবদানই অবশ্যই অগ্রগামী। এখানে সাইয়েদ মুজতাবা হুসাইনের একটি উক্তি উল্লেখ্য: ‍‘‘বর্তমানে আফগানিস্তানে ইসলামী বিপ্লবের জন্য রুশের ন্যায় শক্তির বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম চলছে তা মওলানা মওদূদী রহ: ইসলামী তাবলীগের ফলশ্রুতি” (দৈনিক জাসারাত, সেপ্টেম্বর, ১৯৭৯, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দৃষ্টিতে জামায়াতে ইসলামী ও মাওলানা মওদূদী, সংগ্রহে: সাইয়েদ রাফে সামনান)

               রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগান জিহাদের পরবর্তীকালে উক্ত জিহাদকারী মুজাহিদ সংগঠনগুলোর ব্যর্থতার পটভূমিতে গড়ে উঠা তালেবান আন্দোলনে সাবেক হেজবে ইসলামীর বেশীর ভাগ মুজাহিদ কমান্ডার ও মুজাহিদ সৈনিকরা রয়েছেন। তারা জামায়াতে ইসলামীর তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছেন। তালেবান হচ্ছে পাকিস্তানের জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের দ্বারা প্রভাবিত সংগঠন। এই জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম দীর্ঘ বহু বৎসর যাবৎ জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের সাথে জোটভুক্ত আছে। অনলাইন মুক্ত বিশ্বকোষ wikipedia.org-তে বলা হয়েছে:  আদর্শিক প্রভাবক: তালেবানের ধর্মীয়/রাজনৈতিক দর্শন, বিশেষ করে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তার প্রথম শাসনামলে, প্রধান মুফতি রশিদ আহমদ লুধিয়ানভি এবং তার কাজ দ্বারা ব্যাপকভাবে উপদেশ ও প্রভাবিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংগঠনের পরিচালিত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নীতিগুলি অবশ্য আবুল আ'লা মওদুদী ও জামায়াত-ই-ইসলামী আন্দোলনের অনুকরণে তৈরি করা হয়েছিল

                তালেবান নেতা আব্দুল হাকিম মুজাহিদ ১৯৯৮ সালে আগষ্ট নয়াদিল্লীর দাওয়াত পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন। সেখানে তাকে প্রশ্ন করা হয়। ‘‘কিন্তু হেকমাতিয়ারের বিরুদ্ধে জিহাদী পদক্ষেপের দরুন আপনাদের অন্তরে কি কেবল কোমল অনুভূতি সৃষ্টি হতে পারে না? এ প্রশ্নের জবাবে উক্ত তালেবানের নেতা বলেন: ওদের সংগে আমাদের কিসের বিবাদ?........আমরা আফগানিস্তানে শরীয়ত চালু করেছি। রাব্বানী-হেমতিয়ার-মাসুদ আমাদের সহযোগিতা করুন, আমরা ওদেরকে বুকে তুলে নেবো” ( দৈনিক সংগ্রাম, ৩০শে অক্টোবর ১৯৯৮ইং)।

                আফগানিস্তানের তালেবানদের বিরুদ্ধে ইহুদীবাদী আন্তর্জাতিক সংবাদে মাধ্যমগুলো জোরালো অপপ্রচার রয়েছে। এ প্রসঙ্গে কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও সামগ্রিক প্রয়োজনে উক্ত তালেবান নেতার নারী শিক্ষার বিষয়ে একটি বক্তব্য উল্লেখ্য: ‘‘আমরা নবী করিম সা: এর এই বাণীকে উপেক্ষা  করতে পারি করে যাতে বলা হয়েছে শিক্ষা অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ বা আবশ্যক। আমি তো আগোই বলেছি, আফগানিস্তানে এখন মেয়েদের শিক্ষা অর্জন ও চাকরী গ্রহণের অধিকার রয়েছে কিন্তু সীমা ও শর্তের মধ্যে। আমাদের কাছে আসলে কি চাওয়া হচ্ছে? আমর কি হেজা বিরোধিতার সূত্রপাত ঘটাব? এমনটা কেমন করে সম্ভব? (সূত্র পূর্বোক্ত) উক্ত তালেবান নেতার অপর একটি বক্তব্য এখানে উল্লেখ্য যে: ‘‘মক্কা বিজয়ের পর নবী করিম (সা:) কাবাঘরে গমন করেন এবং মকামে ইব্রাহীম এর আসল ভিত্তি ঠিক রেখে মুশরিকদের নির্মিত বাহুল্য ও সীমালংঘিত অংশগুলোকে অপসারনের ব্যাপারে বিবেচনা করেন। অতএব তিনি আপন সিদ্ধান্ত বদলে দেন এবং বাড়ী ফিরে উম্মৎ জননী হযরত আয়েশা (রা:) কে সম্বোধন করে বলেন,  হে হুমাইরাহ! আমি চাই মাকামে ইব্রাহীমকে কায়েম রেখে গোটা কাবাঘর পূণর্নির্মান করতে, কিন্তু আমার আশংকা হচ্ছে, এমন করলে লোকেরা অসন্তোষ ছড়াবে। এঘটনা থেকে আপনি অনুমান করতে পারেন যে, ইসলাম প্রাচীন ঐতিহ্য বা সংস্কারকে শ্রদ্ধা জানায় এবং সে মানব সমাজের ধ্যান-ধারনাকে সামনে রেখে তাদের প্রতি মনোযোগ দেয় (সুত্র: পূর্বোক্ত)। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ছোটখাট ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিয়েও যারা বিবাদ বা বিতর্ক সৃষ্টি করে এমন বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের জন্য উক্ত তালেবান নেতার উদার বক্তব্য অবশ্যই শিক্ষণীয়।

                  এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ২০০১ সালের  নাইন - ইলেভেন-এর পর ন্যাটো জোটের সহায়তায় আফগানিস্তানে আমেরিকার আগ্রাসনের সময় গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার তালেবানকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। তার অনুগত হেজবে ইসলামীর মুজাহিদদেরকে তালেবানের সহায়তায় যুদ্ধের আহ্বান জানান। পরে আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের পতন হয়। এরপর তালেবানরা আমেরিকা সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদ অব্যাহত রাখে। এদিকে ইসলামপন্থী নেতা ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার বেশ কয়েক  মাস ধরে আলোচনা শেষে প্রায় ২০ বছর পর ২০১৭ সালে কাবুলে ফিরেন গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার। এখানে উল্লেখ্য, তালেবানদের মতই গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার একই পশতুন গোষ্ঠীতুক্ত। পশতুনরা আফগানিস্তানের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। 

পূর্ববর্তী তালেবান সরকারের প্রতি 
বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন
            বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর, মোমতাজুল মোহাদ্দেসীন মাওলানা আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ পূর্ববর্তী তালেবান শাসনাধীন আফগানিস্তান সফরের  বর্ণনা দিতে যেয়ে বলেন: “আমরা প্রবেশ পথ দিয়ে আফগানিস্তানের উপজাতীয় এলাকায় প্রবেশ করে আফগানিস্তানস্থ সীমান্তের কাস্টমস অফিস থেকে যাবতীয় অনুস্ঠানাদি সেরে সোজা আফগানিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী জালালাবাদের দিকে রওয়ানা হই। রাত আটটা নাগাদ জালালাবাদ উপস্থিত হয়ে প্রটোকল অফিসারের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি আমাদেরকে সরকারী গেস্ট হাউসে পৌছিয়ে দেন। এখানেই আমাদের থাকার ও খানাপিনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমরা এশার নামায আদায় করে রাতের খানা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আমি জালালাবাদ পৌঁছেই প্রটোকল অফিসারের কাছে কাবুল যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করি। তিনি বললেন, জালালাবাদ হতে সপ্তাহে মাত্র ১ দিন বিমান সার্ভিস চালু আছে। সুতরাং ৫/৬ দিনের আগে আপনি কোন বিমান পাচ্ছেন না। একথা শুনে আমি কাবুল সফরের পরিকল্পনা বাদ দেই এবং জালালাবাদের গভর্ণেরর সাথে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার জন্য তাকে অনুরোধ করি। ডেপুটি গভর্ণরের সাক্ষাৎ: পরের দিন ভোরে নামায, পায়চারী ও গোসল শেষ করে নাস্তা করে নেই। নাস্তার সময় প্রটোকল অফিসরা খবর দেন যে, আজই অর্থাৎ ২রা নভেম্বর বেলা ১১টায় গভর্ণর হাউসে ডেপুটি গভর্ণর জনাব মোল্লা সাদরে আমল আমাকে সাক্ষাতের সময় দিয়েছেন। কেননা গভর্ণর ঐদিন জালালাবাদে ছিলেন না। আমি আমার সাথী সীমান্ত প্রদেশের আমীর এডভোকেট ইব্রাহীম সাহেবকে নিয়ে ১১টা বাজার সামান্য পূর্বে গভর্ণর হাউজে হাজির হই। ওয়েটিং রুমে কিছুক্ষণ অবস্থান করার পরেই ডেপুটি গভর্ণর আমাদেরকে সাক্ষাৎকার দেন। পারস্পরিক সালাম, মোসাফাহা, কোলাকুলি ও কুশল বিনিময়ের পরে ডেপুটি গভর্নরের সাথে আমার আলোচনা শুরু হয়। আমি আমীরে জামায়াতে জনাব গোলাম আযম সাহেব ও জামায়াত নেতৃবৃন্দের সালাম তাকে পৌঁছাই এবং অনুরোধ করি তিনি যেন আমার এবং আমীরে জামায়াতের সালাম আফগানিস্তানের আমীরুল মোমেনীন মোল্লা মোহাম্মদ ওমর আল মুজাহিদকে পৌঁছান। আমি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর এ পরিচয় তার কাছে থাকলেও ১৯৬২ সনের পাক পার্লামেন্টে আমি ও সীমান্ত প্রদেশের মুফতি মাহমুদ এক সঙ্গে সদস্য ছিলাম একথা তাকে অবহিত করি। আফগানিস্তানে মুফতি মাহমুদ এক সর্বজন পরিচিত ব্যক্তিত্ব। তিনি এক সময় সীমান্ত প্রদেশের চীফ মিনিস্টারও ছিলেন। ১৯৮৯ সনে আফগানিস্তান থেকে রাশিয়ার বের হয়ে যাওয়ার পর মুজহেদীনদের পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধে আমরা যে খুবই মর্মাহত ছিলাম একথা তাকে বলি। অত:পর বর্তমান তালেবান সরকার কাবুলসহ দেশের প্রায় ৯৫% ভাগ ভূ-ভাগ দখল করে দেশে শান্তি ও নিরাপত্তা বহাল করায় জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ তালেবান সরকারের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন দান করেছে সে কথাও তাকে অবহিত করি। আমি আরবী ভাষায় তার সাথে কথা বলছিলাম এবং তিনি আমার কথা বুঝতে ছিলেন।  অত:পর তিনি কথা শুরু করেন। তিনি প্রথমেই বলেন যে, অবশ্যই জামায়াতে ইসলাামী আফগান জিহাদে দেশকে রুশ কবল মুক্ত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে আমাদের বিশ্বাস জামায়াতের এই ভূমিকা কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠির জন্য ছিল না। ছিল নীতি ও আদর্শের জন্য ।  তালেবান সরকার গৃহযুদ্ধের অবসান করে ঐ নীতি ও আদর্শ অর্থাৎ শরিয়তের আইন সারাদেশে চালু করেছে যার জন্য জামায়াতে ইসলামীসহ দুনিয়ার ইসলামী আন্দোলনসমূহ আফগান জিহাদে সাহায্য ও সমর্থন দিয়েছিল(`আফগানিস্তানে যা দেখেছিগ্রন্থ)

                   ইতিপূর্বে উল্লেখিত তালেবানদের সাথে আলোচনার প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে আমেরিকার সাথে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সমঝোতাকারী হিসাবে উপস্থিত ছিলেন তুর্কি প্রতিনিধিদল। আর বর্তমান তুরস্ক সম্পর্কে অন্যত্র বলা হয়েছে।  আর তালেবানদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগের কেন্দ্র কাতার।  কাতার হলো বর্তমানে জামায়াত-ইখওয়ানীদের সমাবেশস্থল। এখানে একটি কথা উল্লেখ্য যে, প্রথম তালেবান নেতা মোল্লা ওমর আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীকে উস্তাদ সম্মোধন করতেন। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির বিরুদ্ধে আফগান ও পাকিস্তান তালেবান তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। 

Edited time: july-2020


আফগানিস্তানে তালিবান বিজয়ের পর নীচের অংশটুকু এড করলাম:

আমি ২০২১ সালের ১৬ই আগষ্ট এই পোস্টটি ফেইসবুকের অনেক ইসলামী গ্রুপে শেয়ার করি। এরপর বিভিন্নজনে বিভিন্ন মন্তব্য করে, সেসবের জবাবও দিয়েছি । সেসব পরে দিচ্ছি। এখন পাকিস্তান জামায়াতের আমির মৌলানা সিরাজুল হক--এর প্রতিক্রিয়া এখানে দিচ্ছি। 

পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর আমীর সিরাজুল হক বলেছেন: 
Jamaat-e-Islami Ameer Sirajul Haq has said the "peaceful taking over" of Kabul by Taliban insurgents was actually a defeat of the US and a victory of Afghan people and the Islamic world.
It is hoped that after the humiliating defeat, the US would not invade any more countries, he was quoted as saying by The News International while addressing the central training workshop for the JI leaders and workers at Mansoorah here.
He lauded the Taliban for declaring peace, non-retaliation against opponents, protection of diplomats and foreigners, and amnesty for rivals which, he said, was unprecedented in the modern civilized world.
Siraj was quoted as saying by the newspaper that the defeat of the Western colonist powers for the third time in history by Afghanistan has further strengthened the dream of the liberation of Kashmir and Palestine, hoping that the day was not far when the sun of freedom would rise there.
অর্থাৎ: জামায়াতে ইসলামীর আমীর সিরাজুল হক বলেছেন, তালেবান বিদ্রোহীদের দ্বারা কাবুলের "শান্তিপূর্ণ দখল" আসলে আমেরিকার পরাজয় আর আফগান জনগণ এবং ইসলামী বিশ্বের জয়। আশা করা যায় যে, লজ্জাজনক পরাজয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র আর কোনো দেশে আক্রমণ করবে না। তিনি এখানে মনসুরায় জেআই নেতা ও কর্মীদের কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ কর্মশালায় ভাষণ দেওয়ার সময় বলেছিলেন।
তিনি শান্তি ঘোষণা, বিরোধীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ না নেওয়া, কূটনীতিক এবং বিদেশীদের সুরক্ষা এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার জন্য তালেবানের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, এটা আধুনিক সভ্য বিশ্বে নজিরবিহীন।
আমীর সিরাজুল হক সংবাদপত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে, আফগানিস্তানের কাছে ইতিহাসে তৃতীয়বারের মতো পশ্চিমা উপনিবেশিক শক্তির পরাজয় কাশ্মীর ও ফিলিস্তিনের মুক্তির স্বপ্নকে আরও শক্তিশালী করেছে, আশা করে যে সেদিন বেশি দূরে নয় যখন স্বাধীনতার সূর্য উঠবে সেখানে। 
Source: www.indiablooms.com

এই পোস্টটি ফেইসবুকের অনেক ইসলামী গ্রুপে শেয়ার করার পর একটি গ্রুপে একজন কমেন্ট করে বলেন: সোভিয়েত হঠাও এর পরবর্তী ইতিহাসে জমিয়তে ইসলামী খারাপ পথ বেছে নিয়েছিল। এর পরিণতিতে আহমাদ শাহ মাসুদ এবং রব্বানী দুইজনকেই জীবন দিতে হয়েছে। এর জবাবে আমি জানাই: “গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের হেজবে ইসলামীর সাথেই জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্ক । সে সম্পর্কে এই পোস্টে লেখা হয়েছে।” নামের সাদৃশ্যের বা অন্য কোন কারণে অনেকের এই বিষয়ে ভুল ধারনা আছে। জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্কযুক্ত গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের হেজবে ইসলামী আমেরিকাবিরোধী জিহাদে তালেবানের পক্ষে ছিল। আরো উল্লেখ্য যে, গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার বর্তমান বিজয়ী তালেবান সরকারে অন্যতম মুখ্য সমন্বয়ক হিসাবে অংশ নিয়েছেন।
গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের ইমামতিতে নামাজরত তালেবান নেতৃবৃন্দ

গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির সিরাজল হকের সাথে সাক্ষাতের ভিডিও:

আরেকজন পোস্টের শেষে আমার এই বক্তব্যের রেফারেন্স চেয়েছেন - "জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির বিরুদ্ধে আফগান ও পাকিস্তান তালেবান তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল।" আমি একটা লিংক দিয়েছি। তারা আসলে মৌখিক তীব্র প্রতিবাদের চেয়ে বেশী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। যে কেউ Bangladesh mission under Taliban threat - এই লংটেইল কীওয়ার্ড দিয়ে গুগুলে সার্চ করে দেখতে পারেন। ২০১৩ সালের অনেকগুলো লিংকে এসম্পর্কে জানতে পারবেন। আমি আরো জানাই - আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ হলে পাকিস্তান পার্লামেন্টসহ বিশ্বের বহু দেশের বহু ইসলামী সংগঠনই প্রতিবাদ জানিয়েছিল। এর মধ্যে সর্বাধিক শক্ত প্রতিবাদ যারা জানিয়েছিল তাদের মধ্যে বর্তমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান অন্যতম। আমি এই লিংকটা শেয়ার করেছি: Resolution passed: Abdul Quader Molla was innocent, Imran Khan claims

বিশ্বখ্যাত ইসলামিক স্কলার, শায়খ আল্লামা ডঃ ইউসুফ আল কারযাভী (হাফিঃ) -এর সাথে কাতারে তালেবান নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎ।

নীচে একজন তালেবান নেতার বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে সাক্ষাৎকার দেয়া হয়েছে। এটা তালেবান বিজয়ের আগের। তিনি সাতক্ষীয়া জেলায় জামায়াতের উপরে ভয়ংকর নির্যাতনের কথাও উল্লেখ করেন। 
(একবার ক্লিক করে ভিডিও চালু না হলে ২য় বার ক্লিক করুন)

বিঃদ্রঃ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনুসারে দাওয়াত, সংগঠন ও ইসলামের আলোকে গঠন এবং মানবসেবার মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম (জিহাদ) অব্যাহত রেখেছে। মূলতঃ আফগান, ইরান, তুরান কেউই ইসলামের মডেল নয়, কোরআন ও সুন্নাহ’র আলোকে নিজ দেশের অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে হবে।

Please browse these links:




সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ’র। মহান আল্লাহ অধিকতর সাফল্য অর্জনের তৌফিক দান করুন, আমিন

Friday, April 6, 2018

সময়ের কসম, নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত -মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত


মহাগ্রন্থ আল কুরআনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা হচ্ছে আল আসর। এই সূরাটির আয়াত তিনটি। এটি কুরআনের ছোট সূরাগুলোর অন্যতম। এই সূরাটি ছোট হলেও এর তাৎপর্য ব্যাপকতর। লেখার শিরোনামটি এই সূরারই প্রথম অংশের অর্থ। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালা এই সূরাতে সময়ের শপথ নিয়ে মানুষ যে ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত তা তুলে ধরেছেন, তার পাশাপাশি কারা ক্ষতির কবল থেকে মুক্ত থাকবে সে কথাও গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছেন। সূরাটির পুরো অর্থ নিম্নে তুলে ধরা হলো- সময়ের কসম। নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত। তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করতে থেকেছে এবং পরস্পরকে হক কথা ও সবর করার উপদেশ দিতে থেকেছে। (আল কুরআন : সূরা আসর)

ছোট্ট এই মাক্কি সূরাটিতে মহান আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট ভাষায়, মানুষের সাফল্য-ব্যর্থতা, কল্যাণ-অকল্যাণ এবং ধ্বংসের পথ বর্ণনা করেছেন। মানুষের জীবনের প্রতিটি সময়কে গুরুত্ব দিয়ে কাজে লাগিয়ে জীবনটাকে বদলে দেয়ার জন্য এই সূরার অনুসরণই যথেষ্ট। এই সূরার তাৎপর্য উপলব্ধি করে কাজ করতে পারলে সাফল্য অনিবার্য। ইমাম শাফেয়ি (রহ:) বলেন, মানুষ যদি এই একটি সূরা অর্থাৎ সূরা আসর নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে এটিই তাদের হেদায়েত তথা সফলতার জন্য যথেষ্ট। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত ওবাইদুল্লাহ বিন হিসন (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সাহাবিদের মধ্য থেকে যখন দুই ব্যক্তি মিলিত হতেন তখন তারা একজন অপরজনকে সূরা আসর না শোনানো পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হতেন না।’ (তাবারানি)
মহান আল্লাহর এখানে সময়ের কসম করার যথার্থ যুক্তি আছে। আল্লাহ সৃষ্টিকুলের কোনো বস্তুর শ্রেষ্ঠত্ব, অভিনবত্ব প্রকাশের জন্য কখনও কসম বা শপথ করেননি বরং যে বিষয়টি অকাট্যভাবে প্রমাণ করতে চেয়েছেন তার ক্ষেত্রেই তিনি সত্যতা প্রমাণ করতেই কসম খেয়েছেন। সময় অতি মূল্যবান একটি বিষয়। সময় বলতে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে বোঝায়। এটি কোনো দীর্ঘ সময়ের অর্থে নয়। ভবিষ্যতের গর্ভ থেকে বের হয়ে আসা বর্তমান অতীতে নিপতিত সময়কে বোঝানো হয়েছে। অতীতের কসম হলো ইতিহাসের সাক্ষ্য। বর্তমানের কসম হলো বর্তমানের অতিবাহিত সময়। মানুষকে কাজের জন্য সময় দেয়া হচ্ছে। সময় এক ধরনের মূলধন। মূলধন নামক মানুষের এই সময় দ্রুতই অতিবাহিত হচ্ছে। এর উদাহরণ দিতে গিয়ে ইমাম রাযি (রহ:) একজন মনীষীর উক্তি উল্লেখ করে বলেছেন- তাহলো, একজন বরফ বিক্রেতার কথা থেকেই আমি সূরা আল আসরের অর্থ বুঝতে পেরেছি যে বাজারে জোর গলায় চিৎকার করে বলছিল, দয়া করো এমন এক ব্যক্তির প্রতি যার পুঁজি (বরফ) গলে যাচ্ছে। তার এ কথা শুনে আমি বললাম, এইটিই হচ্ছে আসলে ‘নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত’ বাক্যের প্রকৃত অর্থ।
মানুষকে যে সময় (আয়ুষ্কাল) দেয়া হয়েছে তা বরফ গলে যাওয়ার মতো দ্রুত অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে। একে যদি নষ্ট করে দেয়া হয় অথবা ভুল কাজে ব্যয় করা হয় তাহলে সেটিই মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতি। কাজেই চলমান সময়ের কসম খেয়ে এই সূরায় যা বলা হয়েছে তার অর্থ এই যে, এই দ্রুত গতিশীল সময় সাক্ষ্য দিচ্ছে, সূরা আসরে বর্ণিত চারটি গুণাবলিশূন্য হয়ে যে মানুষ যে কাজেই নিজের জীবনকাল অতিবাহিত করে- তার সবটুকুই ক্ষতির সওদা ছাড়া কিছুই নয়। পরীক্ষার হলে যে ছাত্র প্রশ্নপত্রের উত্তর দেয়ার পরিবর্তে অন্য কাজে সময় নষ্ট করেছে, তাকে পরীক্ষার হলে টাঙানো ঘড়ির কাঁটা বলে দিচ্ছে তুমি নিজের ক্ষতি করছো। যে ছাত্র এই সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত নিজের প্রশ্নপত্রের জবাব দেয়ার কাজে ব্যয় করেছে একমাত্র সে-ই লাভবান হচ্ছে। আর রেজাল্টের দিন সেই ছেলেটিই সফলতা অর্জন করবে।

এ সূরায় চারটি গুণাবলির অধিকারী ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে যারা সময়ের বহমান ¯্রােতে ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা পাবে : ১. যারা ঈমান এনেছে ২. যারা সৎকাজ করতে থেকেছে ৩. যারা পরস্পরকে হকের উপদেশ দিতে থেকেছে এবং ৪. যারা পরস্পরকে সবর বা ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিতে থেকেছে। প্রথম কাজ হলো ঈমান আনা। শুধুমাত্র মুখে স্বীকার করলেই তাকে ঈমান আনা বলা হয় না বা ঈমানের দাবি পূরণ হয় না। বরং ঈমানের তিনটি ধাপ রয়েছে। তা হলো অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা, তারপর মুখে স্বীকৃতি তথা বিশ্বাস অনুযায়ী মুখে প্রকাশ করা, তৃতীয়ত বাস্তবে কাজে পরিণত করা। আল্লাহ বলেন, আসলে তারাই প্রকৃত মুমিন যারা আল্লাহ ও রাসূল (সা:)-এর প্রতি ঈমান এনেছে এরপর কোনরূপ সন্দেহে পতিত হয়নি। (সূরা হুজুরাত : আয়াত ১৫)

দ্বিতীয়ত, ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা পাবে তারা যারা আমলে সালেহ তথা সৎকাজ করতে থেকেছে। কুরআনের পরিভাষায় সালেহাত সমস্ত সৎকাজ এর অন্তর্ভুক্ত। কুরআনের দৃষ্টিতে, যে কাজের মূলে ঈমান আছে এবং যা আল্লাহ ও তার রাসূল (সা:) প্রদত্ত হেদায়েতের ভিত্তিতে সম্পাদিত হয়েছে তা সৎকাজ। ঈমানের পর সৎকাজের বর্ণনার অর্থ হলো ঈমানবিহীন কোনো সৎকাজের পুরস্কার পাওয়ার সুযোগ নেই। সৎকাজবিহীন ঈমান একটি দাবি ছাড়া আর কিছুই নয়। ঈমান ও সৎকাজ বীজ আর বৃক্ষের মতো। আল্লাহ এবং বান্দার হক আদায়, মা-বাবার খেদমত করা, বড়দের সম্মান করা, ছোটদের স্নেহ করা, আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীর হক আদায় করা, অপরকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকাও গুরুত্বপূর্ণ সৎকাজ।
ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার পরবর্তী দু’টি গুণ হলো- যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তারা পরস্পরকে হক কথা বলা, হক কাজ করা এবং ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিতে হবে। এর প্রাথমিক অর্থ হচ্ছে ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদের পৃথক না থেকে সম্মিলিতভাবে একটি সৎ সমাজ গড়ে তুলতে হবে। যেখানে নিজে হকের ওপর অবিচল থাকার পাশাপাশি অন্যকেও এ পথে আহ্বান করতে হবে। মনে রাখতে হবে সমাজে একা একা ভালো থাকা যায় না। কেউ যদি মনে করেন তিনি ভালো থাকবেন ঘরে কিংবা মসজিদের কোণে বসে তার পক্ষে তা সম্ভব হবে না। কারণ সমাজের ক্ষতির প্রভাব তার ওপরও কোনো না কোনো ভাবে পড়বে। ফলে একা একা হকের পথে থেকেও তিনি আসলেই ভালো থাকতে পারবেন না। সবাইকে ভালো পথে হকের পথে সত্যের পথে নিয়ে আসার মাধ্যমেই ভালো থাকা সম্ভব।
চতুর্থ গুণটি হলো সবর বা ধৈর্য। হকের নসিহত করতে গিয়ে বা হকের সমর্থন করতে গিয়ে যে সব সমস্যা ও বাধার মুখে নিপতিত হতে হয় তার মোকাবেলায় তারা পরস্পরকে অবিচল ও দৃঢ় থাকার উপদেশ দিতে থাকবে। হক এবং বাতিলের দ্বন্দ্ব চিরন্তন। যেখানেই হক সেখানেই বাতিল আঘাত হানার চেষ্টা করে। হক তথা সত্য পথে থেকে সফলতা অর্জন করতে গেলে বাধা-বিপত্তি আসবেই। ধৈর্যের সাথে তার মোকাবেলা করতে হবে। আর ধৈর্যশীলদের জন্যই আল্লাহর পুরস্কার নির্ধারিত।

লেখক : এমফিল গবেষক

Friday, March 23, 2018

মতিউর রহমান মল্লিকের হামদ গানের নতুন জগৎ -ড. নঈম আহমেদ


শিল্পী গায়ক নয়তো মোদের আসল পরিচয়
আল কুরআনের কর্মী মোরা বিপ্লবী নির্ভয়
শিল্পী থেকে কর্মী বড়
সুর ছড়িয়ে যাই ॥

বাংলা গানের জগতে মতিউর রহমান মল্লিক একজন সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীতসাধক। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী। তিনি ১৯৭৬ সালে ‘সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী’ প্রতিষ্ঠা করেন সে-সময় গণমাধ্যমে ইসলামী গান অবহেলিত ছিলো। বিশেষভাবে খালি কণ্ঠে বাজনা ছাড়া গান কল্পনাই করা হতো না। সময়ের দাবি অনুযায়ী এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামী গানের নতুন দিগন্ত তিনি সৃষ্টি করেন। [দ্র. আহমদ বাসির সম্পাদিত মতিউর রহমান মল্লিকের সাক্ষাৎকার, ঢাকা: মর্নিং ব্রিজ, ২০১৭, পৃ. ১৯] স্বকণ্ঠে স্বরচিত ও নিজের সুরারোপিত গানের অ্যালবাম প্রতীতি: এক (১৯৯৩) প্রকাশের মাধ্যমে তিনি সঙ্গীত প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। প্রতীতি: দুই (১৯৯৪) এই পরিচয়কে আরো বেশি প্রতিষ্ঠা দান করে। গীতিকার হিসেবেও তিনি সফলতার পরিচয় দেন। ঝংকার (১৯৭৮), যত গান গেয়েছি (১৯৮৭), প্রাণের ভেতরে প্রাণ (২০১০) এবং অপ্রকাশিত গীতিকাব্য চিরকালের গান তাঁর গানের সঙ্কলন একজন গীতিকার ও সঙ্গীত সাধকরূপে নিজেকে প্রকাশ করেন। এ ছাড়া সম্পাদনা করেছেন একাধিক গানের সঙ্কলন।
মতিউর রহমান মল্লিক কিভাবে ইসলামী সাংস্কৃতিক জগতে আসেন এবং গানের প্রতি অনুরাগী হলেন সে বিষয়ে নিজের মন্তব্য : ‘আমি একটি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। আমাদের পরিবারে আগে থেকেই একটি জারির দল ছিলো। আমার আব্বা ঐ জারি দলের জন্য বিশাল বিশাল জারি গান লিখে দিতেন। আর এই গান আমার ছোট চাচা আমাদের এলাকায় গেয়ে বেড়াতেন। দলের অন্যান্য সদস্যরা আমাদের আত্মীয়স্বজন ছিলো। আমার আব্বা কবিতা লিখতেন এবং সেই ব্রিটিশ আমলে আমার আব্বা ২-৩ মাইল দূরে গিয়ে পত্রিকা পড়ে আসতেন। রেডিওতে কবি ফররুখ আহমদ যে সাহিত্য আসর পরিচালনা করতেন কবিতা পাঠের ব্যবস্থা করতেন, সেই আসরে আমার বড় ভাই কবিতা পড়েছেন। যে কবিতা ফররুখ আহমদ নিজে অনুমোদন করেছেন। ছোটবেলা থেকে রেডিওতে গান শুনে শুনে গান লেখায় আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। এবং অনেক গান লিখেও ফেলেছিলাম। যার সবগুলোই ছিলো প্রেমের গান। আমি যখন ছাত্র ইসলামী আন্দোলনে যোগদান করেছিলাম, তখন আমার গান লেখার মোড় ঘুরে যায়। দেশ, মুসলমান, ইসলামী আন্দোলনের জয়গান লেখা শুরু করলাম। প্রেমের গানের লেখার পর্ব ছুটে গেল।’ [আবিদ আজমের নেয়া মতিউর রহমান মল্লিকের সাক্ষাৎকার, রহমান তাওহীদ সম্পাদিত রিদম, ঢাকা: ২০০৯, পৃ. ৭]
মতিউর রহমান মল্লিকের জীবনকালেই ‘কবি’ অভিধা তার নামের সাথে অবিভাজ্য হয়ে পড়ে। তিনি প্রধানত কবি, যদিও এ যাবৎ প্রকাশিত তার কবিতার সংখ্যা তার রচিত গানের তুলনায় কম। তবে এ কথা স্বীকার্য যে, কবি না হলে কেউ গান লিখতে পারে না। পৃথিবীর সকল গীতিকারই মূলত কবি। অনেক খ্যাতনামা কবির প্রখ্যাত অনেক কবিতাও গান আকারে গীত হয়ে থাকে। কবিতার মধ্যে যেমন মিল, ছন্দ, ধ্বনি, ব্যঞ্জনা ইত্যাদি রয়েছে, গানের মধ্যেও তার উপস্থিতি অপরিহার্য। তবে গানের মধ্যে গীতলতার দিকটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া, গান একটি নির্দিষ্ট সুর, তাল-লয় ও আকারে সীমাবদ্ধ থাকে, কবিতার ক্ষেত্রে অতটা বাধ্যবাধকতা নেই। তাই গান রচনার সময় কবিকে অধিকতর সচেতনতা ও শিল্পবোধের পরিচয় দিতে হয়। সেজন্য গীতিকার যখন শব্দ নিয়ে খেলা করেন, তখন তাকে সুর-তাল-লয় ও রাগ-রাগিণী সম্পর্কে সজাগ-সতর্ক থাকতে হয়। গানের সফলতা অনেকটা এর ওপর নির্ভরশীল। মতিউর রহমান মল্লিকের কবি-স্বভাবের মধ্যে গীতিধর্মিতার প্রাবল্য তাকে একজন সার্থক এবং বহুলপ্রজ গীতিকার হিসেবে সাফল্য ও খ্যাতি এনে দিয়েছে। মল্লিক নিজে একজন সুগায়ক ছিলেন। গান রচনার সাথে সাথে তিনি তাতে সুরারোপ করতেন ও গাইতেন। [মুহম্মদ মতিউর রহমান, মতিউর রহমান মল্লিকের কাব্যকর্ম, পৃ. ১৬১] সার্থক গীতিকার হওয়ার জন্য এটা এক অপরিহার্য গুণ। যিনি গায়ক তিনি গানের সুর, তাল, লয় ও রাগ-রাগিণী সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত। সার্থক গান রচনার জন্য এটা খুবই প্রয়োজন। তাঁর মধ্যে সে গুণের কমতি ছিল না। তাই তার রচিত গান সার্থক বলা যায়। তাঁর বহুমাত্রিক প্রতিভার মধ্যে গীতিকার হিসেবে তার সাফল্য তুলনামূলকভাবে অধিক।
তারুণ্য-যৌবনের কবি পরবর্তী কালে হয়ে ওঠেন বাংলা গানের সুরেলা পাখি। মতিউর রহমান মল্লিকের গানের বাণী ও সুরের মৌলিকতা ও বৈচিত্র্য বিশেষত্বপূর্ণ। উত্তরাধিকারের পথে নতুন বাঁক-বদল। তাঁর গানের কথার বিষয় নানা মাত্রিক, নানা সময়ের প্রয়োজনে সৃষ্টি। ইসলামী আন্দোলনের পথপরিক্রমায় জীবনাভিজ্ঞতার আলোকে তিনি গানের সম্ভার রচনা করেন। তাঁর গানের বিষয়বৈচিত্র্যকে নি¤েœাক্ত শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যথা: ক. হামদ, খ. নাতে রাসূল সা., গ. ইসলামী আন্দোলন, ঘ. দেশপ্রেম, ঙ. প্রকৃতি, চ. আধুনিক জীবনমুখী, ছ. আধ্যাত্মিক/ মৃত্যুচেতনা, জ. ইসলামী সংস্কৃতি, ঝ. বিবিধ।
তোমার সৃষ্টি যদি হয় এত সুন্দর
না জানি তাহলে তুমি কত সুন্দর
সেই কথা ভেবে ভেবে কেটে যায় লগ্ন
ভরে যায় তৃষিত এ অন্তর।
আল্লাহর প্রশংসামূলক বা তাঁর গুণের কথামালাসম্পন্ন সুরারোপিত গানকে হামদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পৃথিবীতে মানুষ প্রেরিত হয়েছে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে। আর প্রতিনিধির কাজ হলো আল্লাহর ইবাদত করা। সেই দিক বিবেচনায় প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব আল্লাহর প্রশংসা করা ও তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী জীবন অতিবাহিত করা। সৃষ্টিশীল মানুষ যারা হেদায়াত প্রাপ্ত তারা এ ক্ষেত্রে অগ্রগামী। বিশেষভাবে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী সমাজ আল্লাহর গুণ, কার্যাবলি ও মহিমা নিয়ে সৃজনশীল কাজ করে থাকেন। রাসূল সা:-এর সময়ে যে সমস্ত সাহাবী কবিতা লিখতেন তারা প্রধানত আল্লাহ ও রাসূলের জন্যই লিখতেন। হাসসান ইবনে সাবিত রা., আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়া রা., হযরত আলী রা. প্রমুখ সাহাবী আল্লাহর প্রশংসা, গুণাবলি ও শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে উৎকৃষ্ট কবিতা লিখেছেন। মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমী, শেখ সাদী, ফেরদৌসী প্রমুখ সাহিত্যিক হামদ রচনায় বিশ^সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। এই ধারা পরবর্তীকালে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আধুনিককালেও কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী সমাজ আল্লাহর মহিমা কীর্তনে সৃষ্টিশীল। আল্লামা ইকবাল এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকায় স্মরণীয়, বরণীয় ও প্রভাবশালী। বাংলা ভাষায় মধ্যযুগে অসংখ্য কবি আল্লাহর প্রশংসামূলক কবিতা লিখেছেন। আধুনিককালে কায়কোবাদ, মীর মশাররফ হোসন, গোলাম মোস্তফা, কাজী নজরুল ইসলাম ও ফররুখ আহমদ বিপুল পরিমাণে হামদ রচনা করেছেন।
এই ধারায় মতিউর রহমান মল্লিক বাংলা গানের ভুবনে হামদকে আরো এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহর একজন কৃতজ্ঞ বান্দা, কবি-সাহিত্যিক ও সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে তিনি বাংলা গানে নতুন সুর, ছন্দ, কথা, আবহ ও বাঁক এনেছেন। গোলাম মোস্তফা, কাজী নজরুল ইসলাম ও ফররুখ আহমদের মতো একই মতাদর্শের পথিক হয়েও একক গানের জগৎ নির্মাণ করেন। ‘প্রতীতি’ কণ্ঠসঙ্গীত পর্বের কিছু দৃষ্টান্ত :
দৃষ্টি তোমার খুলে রাখো দীপ্ত সৃষ্টির জন্য
দেখবে স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ কত না অনন্য ॥

বিহঙ্গ তার পক্ষ দোলায়
দূর বিমানে শূন্য কোলায়
কে রাখে ভাসিয়ে তারে ভাবনা সামান্য॥

সমতল আর পর্বতমালা
এই কোলাহল ঐ নিরালা
কার মহিমা জড়িয়ে রাখে গহনও অরণ্য॥
[প্রতীতি]

মাঠ ভরা ওই সবুজ দেখে
নীল আকাশে স্বপ্ন এঁকে
যার কথা মনে পড়ে
সে যে আমার পালনেওয়ালা॥
[প্রতীতি]

এসো গাই আল্লাহ নামের গান
এসো গাই গানের সেরা গান
তনুমনে তুলবো তুমুল
তূর্য তাল ও তান॥
[প্রতীতি]

বিশ্বজগতের বিশাল ও বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ, সৌন্দর্য ও নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলি যে কোন মানুষকে বিস্মিত ও ভাবুক করে তোলে। সৃষ্টিশীল কবি মতিউর রহমান মল্লিক গানের খাতায় এই পৃথিবীর রূপে-রসে-রঙে-রেখায় মনোযোগ দিয়ে আবেগে আপ্লুত এই ভেবে যে, আল্লাহ কিভাবে কী অসীম নির্মাণশৈলীতে এসব কিছু সৃষ্টি করেছেন। মানুষ ও প্রাণিকুলের রহস্য, চারপাশের পরিবেশ, চাঁদ-সূর্য-তারা-আলোকমালা, নদী-সমুদ্র-পর্বত-অরণ্য-জলাশয় এবং এই সবের মাঝে সুন্দরের সন্ধানে কবি আল্লাহর মহত্ত্ব ও অসীম কুদরত অনুভব করেছেন ও দেখেছেন। সৃষ্টির মাঝেই ¯্রষ্টার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ যে অনন্য সে অনুভব করার জন্যও শ্রোতাকে আহ্বান করেছেন। আল্লাহ যে পালনকর্তা ও রিজিকদাতা সে কথাও গভীরভাবে গানে ব্যক্ত করেন।
‘প্রতীতি’ প্রথম গানের সংকলনে এই হামদগুলো স্থান পায়। সৃষ্টির মাঝে ¯্রষ্টার ছায়া ও সৌন্দর্য উপলব্ধি করেন গীতিকার। কিছু কিছু গানে সুফি মতের প্রভাব লক্ষণীয়। সুফি মতের কেন্দ্রে আছে আল্লাহর ধারণা। বিভিন্ন সুফি মতবাদে আল্লাহর ধারণা তিন প্রকার: আত্মসচেতন ইচ্ছাশক্তি, সৌন্দর্যস্বরূপ এবং ভাব, আলো কিংবা জ্ঞান স্বরূপ। শকিক বলখি, ইব্রাহীম আদম, রাবিয়া বসরী প্রভৃতির ধারণায় আল্লাহ ইচ্ছাশক্তি স্বরূপ। সৃষ্টিলীলায় সেই ইচ্ছাশক্তিরই প্রকাশ। একত্ববাদ এর প্রাণ, তাই এটি আরবীয় বা শামীয় (Semitic)। পবিত্রতা, সংসার ধর্মে অনাসক্তি, আল্লাহ্ প্রেম ও পাপভীতিই এই মতের সুফিদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহকে রূপময়-লীলাময় প্রেমকামীরূপে কল্পনা করেছেন যাঁরা তাঁদের মতে, আল্লাহ নিজের মহিমার মুকুররূপে সৃষ্টি করেছেন জগৎ। তিনি এই সৃষ্টির মুকুরে নিজের রূপ নিজেই প্রত্যক্ষ করেছেন নার্সিসাসের মতো। এ তত্ত্বের প্রেক্ষিতে এ মতবাদী সুফিরা সৃষ্টিকে মনে করে রূপময়-লীলাময় আল্লাহর Manifestation বলে। এবং এর ভিত্তি হলো প্রেম। যেখানে রূপ, সেখানেই প্রেম, অথবা প্রেমই দান করে রূপদৃষ্টি। কাজেই এই তত্ত্বে বিশ্বাসী সুফিরা প্রেমবাদী, বিশ্বপ্রেম তাদের সাধনার লক্ষ্য ও পাথেয়। সব রিপু ও বিষয়-চিন্তা পুড়ে ছাই হয়ে উড়ে যায় এই প্রেমানলেÑ হৃদয় জুড়ে থাকে কেবল আল্লাহ। এই বোধের পরিণামে পাই অদ্বৈততত্ত্বÑ যার পরিণতি হচ্ছে ‘আনলহক’ বা ‘সোহম’ বোধে। এই মতের সুফিদের মধ্যে বায়জিদ বোস্তামি, মনসুর প্রমুখ প্রখ্যাত। [আহমদ শরীফ, বাংলার সুফি সাহিত্য, ঢাকা: সময় প্রকাশন, ২০০৩, পৃ. ২৪] অসীম, অনন্ত ও গুণাতীত অনাদি চিরন্তন সত্তার বোধ জন্মায় এই অভেদতত্ত্ব। সৃষ্টি মাত্রই ব্রহ্ম থেকে উৎপন্ন এবং ব্রহ্মেতে লীন। সুফি মতে, আল্লাহ হচ্ছেন ‘স্বয়ম্ভূ জ্যোতি’। Manifestation তথা মহিমার অভিব্যক্তি দানই এ জ্যোতির স্বভাব। এতেই তাঁর স্বতো প্রকাশ। নিজের মধ্যে ও বিশ্বে পরিব্যাপ্ত এই আলো দেখার আকুলতা মানবে সহজাত। আলোর স্বরূপ উপলব্ধির ও হৃদয়ে প্রতিষ্ঠার সাধনাই সুফিব্রত। এই সিদ্ধির ফলে মানুষ হয় ‘ইনসানুল কামেল’। প্রথমটি অধ্যাত্ম সাধনার ক্ষেত্রে আর শেষোক্তটি পার্থিব সমাজের। মতিউর রহমান মল্লিক উভয় ক্ষেত্রেই মনোযোগী।
লাইলাহা ইল্লাল্লাহ
নেই কেহ নেই আল্লাহ ছাড়া
পাখির গানে গানে
হাওয়ার তানে তানে
ঐ নামেরই পাই মহিমা
হলে আপনহারা ॥
আল্লাহ নামের গান গেয়ে দেখ
কেমন লাগে নামের সুর
ঐ নামে যে যাদু রাখা
ঐ নামে যে শহদ মাখা
পান করে দেখো কী মধুর ॥
[ঝংকার]

আজকে আমার প্রাণ-সাগরে
আল্লাহ নামের নুর
উথাল পাথাল ঢেউ তুলেছে
যেনো পাহাড় তুর ॥
[ঝংকার]

হাত পেতেছে এই গোনাহগার
তোমারি দরগায় খোদা তোমারি দরগায়
শূন্য হাতে ওগো তুমি
ফিরাইও না হায়, মোরে ফিরাইও না হায় ॥
আমার কণ্ঠে এমন সুধা
দাও ঢেলে দাও হে পরোয়ার
যদি পিয়ে এই ঘুমন্ত জাত
ভাঙে যেনো রুদ্ধ দ্বার।
[ঝংকার]
‘প্রতীতি’ কণ্ঠসঙ্গীতের পর ‘ঝংকার’ গীতিকাব্যে মতিউর রহমান মল্লিক হামদে আরো বৈচিত্র্য আনেন। আল্লাহ নামের উচ্চারণে, রূপে ও মহিমায় কবি দিশেহারা। তাঁর নামের গুণের মুগ্ধতায় কবি নূরের উজ্জ্বলতায় পাখিদের গানে, ঝরনার সুরে, সবুজে ও রোদে আল্লাহ নামের মহিমা অনুভব করেছেন। প্রাকৃতিক সবকিছুতেই তিনি ¯্রষ্টার সৃজনশৈলী লক্ষ করেছেন। সেই পর্যবেক্ষণ গানের কথায় শিল্পসম্মত রূপে প্রকাশ করেন।
তুমি দয়ার অথৈ পারাবার
দুঃখের সাগর তুমি কর পার
পাপী তাপি সব গোনাহগার
চাহি তোমার করুণা।-
[যত গান গেয়েছি]

আমাকে দাও সে ঈমান
আল্লাহ মেহেরবান
যে ঈমান ফাঁসির মঞ্চে
অসংকোচে
গায় জীবনের গান।
[যত গান গেয়েছি]

কথায় কাজে মিল দাও আমার
রাব্বুল আলামিন
আল জিহাদ ফি সাবিলিল্লায়
রাখো বিরামহীন।
[যত গান গেয়েছি]

ঈমানের দাবি যদি কোরবানি হয়
সে দাবি পূরণে আমি তৈরি থাকি যেন
ওগো দয়াময় আমার
প্রভু দয়াময়।
[যত গান গেয়েছি]

আমি পাখির কাছে বললাম
নদীর কাছে শুধালাম
তোমাদের গান তোমাদের সুর
কেন এমন মনোহর
কেন এমন সুন্দর
ওরা বললো শুধু বললো:
আমাদের কণ্ঠে ¯্রষ্টার নাম
অঙ্গে অঙ্গে তার সৃষ্টি দাম
আমাদের গান আমাদের সুর
তাই তো এমন মনোহর
তাই তো এমন সুন্দর।
[যত গান গেয়েছি]

যখন পথের দিশা দিয়েছো খোদা
তখন বিপথে তুমি নিও না
যেই পথ কোরানের
যেই পথ রসূলের
সেই পথ ছেড়ে যেতে দিও না।
[যত গান গেয়েছি]
‘যত গান গেয়েছি’ পর্বের হামদে মতিউর রহমান মল্লিক বাস্তব জীবন সংগ্রাম-আন্দোলনের দুর্গম পথে এবং ব্যক্তিগত মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন-নিবেদন করেছেন, করুণা ও সাহায্য চেয়েছেন এবং তাকেই সহায়-সম্বল ভেবেছেন। নিজেকে গোনাহগার-পাপী হিসেবে উপস্থাপন করে পরকালের অথৈ সাগর পারাপারের জন্য আকুল আবেদন করেছেন। সেই সাথে সেই ঈমানের জন্য দরখাস্ত করেছেন যে ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে স্বেচ্ছায় ফাঁসির মঞ্চে নির্ভীকভাবে দাঁড়াতে পারেন; আল্লাহর রাজ কায়েমের জন্য জিহাদে প্রাণ বিসর্জন দিতে পারেন। পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদের ময়দানে লড়াকু হতে ঈমানের জোর চাই, ঈমানের দাবি যে কোরবানি সেই কোরবানির জন্য সেই শক্তি কামনা করেছেন কবি আল্লাহর কাছে। যে পথ কোরআনের ও রাসূলের সেই পথের ঠিকানা যেহেতু একবার আল্লাহ দয়া করে দিয়েছেন সেই পথে যেন চলতে শক্তি দেন, সেই দোয়া করেছেন। আল্লাহর মহিমা ও গুণের কথা কবি ফুল-পাখি-নদীসহ প্রকৃতির কাছে জিজ্ঞাসা করে উত্তর পেয়েছেন এক আল্লাহর অসীম অনন্ত মহিমা। পরবর্তী গীতিকাব্য ‘প্রাণের ভেতরে প্রাণ’-এ হামদ নেই। অন্যান্য বিষয়ে গান আছে।
মতিউর রহমান মল্লিকের হামদের বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করা যায় এভাবে-
ক. আল্লাহর গুণাগুণ, রূপ-অরূপ, শক্তি-মহিমা-শ্রেষ্ঠত্ব, সর্বাত্মক সত্তার প্রশংসা তাঁর হামদে প্রকাশিত;
খ. জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর উপস্থিতি অনুভব করেছেন ও করুণা চেয়েছেন;
গ. বিশেষভাবে জীবন সংগ্রামে, ত্যাগে, লড়াইয়ে, কঠিন বিপদে ও দুঃখে জয়ী হতে আল্লাহর কাছে সাহায্য-সহযোগিতা ও শক্তি প্রার্থনা করেছেন;
ঘ. মহান রবের প্রতি গভীর বিশ্বাস, আস্থা, ভালোবাসা-প্রেমের পরিচয় হামদের মাঝে প্রতিফলিত;
ঙ. আল্লাহর মহত্ত্বের সাথে সাথে পৃথিবীতে তাঁর রাজত্ব কায়েমের কথাও নানাভাবে ব্যক্ত করেছেন;
চ. ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের উজ্জীবনে এই হামদগুলো অত্যন্ত প্রভাববিস্তারী;
ছ. সুর সংযেজনের দিক থেকে মৌলিকত্ব ও নতুনত্ব লক্ষণীয়।

মতিউর রহমান মল্লিকের হামদের সুর কবি নিজেই করেছেন নিজ সঙ্গীত প্রতিভায়। একদম নতুন সুর সংযোজন ঘটিয়েছেন এইসব হামদে যা বাংলা গানে অভিনব। নজরুলের গানের বা হামদের দূরগত প্রভাব থাকলেও প্রত্যক্ষ কোনো প্রভাব নেই এতে। শেষের দিকে কিছু গানে অন্যরাও সুর দিয়েছেন।
লেখক : কবি ও গবেষক

Wednesday, March 21, 2018

ছাত্রশিবিরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস এবং অবদান

উপমহাদেশের রাজনীতির একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য সক্রিয় ছাত্ররাজনীতির শক্ত অবস্থান, বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্র সংগঠনসমূহের রয়েছে ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী ভূমিকা। ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের আদর্শ, উদ্দেশ্য, কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতির মাঝে পার্থক্য থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতার ধারাবাহিকতায় এখানে যেমন রয়েছে ভিন্ন আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দলসমূহ তেমনি রয়েছে অনেক দলের অঙ্গীভূত ছাত্রসংগঠন। বাংলাদেশের বুকে রয়েছে পাকিস্তান আমল থেকে চলে আসা ছাত্র সংগঠনসমূহ। তারই পাশাপাশি কাজ করছে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে গড়ে ওঠা কতিপয় সংগঠন। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির স্বাধীন বাংলাদেশে গড়ে ওঠা, দলীয় লেজুড়বৃত্তিমুক্ত এক আলোকিত ছাত্রসংগঠনের নাম, একটি স্বতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকে পথচলা শুরু করে একে একে ৪১টি বছর পেছনে ফেলে এ সংগঠন রচনা করেছে এক গৌরবময় ইতিহাস। একটি গঠনমূলক গতিশীল গণতান্ত্রিক সংগঠন হিসেবে, একটি একক ও অনন্য অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে, মানুষ তৈরির কারখানা হিসেবে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির জনতার মনে, লক্ষ তরুণের হৃদয়ে করে নিয়েছে তার স্থায়ী আসন।
শিবিরের বিগত ৪১ বছরের ইতিহাসকে বিভিন্নভাবে বিবেচনা করা যায়। বাংলাদেশের মত একটি উন্নয়নশীল দেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে এই সংগঠনের অনেক রকম মূল্যায়ন হতে পারে, পৃথিবীর ৪র্থ বৃহত্তম মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র হিসেবেও হতে পারে অপর বিবেচনা। একটি অনন্য সংগঠনের প্রায় তিনযুগের ইতিহাস সত্যি সত্যিই সচেতন, নিরপেক্ষ ও যথার্থ বিবেচনার দাবি রাখে।
একটি নিরন্তর সংগ্রামরত ছাত্রসংগঠন হিসেবে ৪১ বছর ধরে অব্যাহত ধারায় কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির রচনা করেছে গৌরবময় ইতিহাস। এর সাথে যুক্ত হয়েছে অনেক ঐতিহ্য। দেশ-জনতার সুবিবেচনার জন্য সে বিষয়গুলো তুলে ধরাই এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।
শিবিরের আত্মপ্রকাশ সময়ের অনিবার্য বাস্তবতা কোন প্রেক্ষাপট ছাড়া যেমন কোন ঐতিহাসিক ঘটনা জন্ম নেয় না, তেমনি কোন প্রয়োজন ছাড়া সংগঠনেরও জন্ম হয় না। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠা ছিল তৎকালীন সময়ের এক অনিবার্য দাবি। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সামগ্রিক প্রেক্ষাপট এ ধরনের একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশকে অনিবার্য করে তোলে।
ক. স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিজয়ী হয় মুক্তিকামী মানুষ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা একটি স্বাধীন দেশ, একটি ভৌগোলিক মানচিত্র, একটি লাল-সবুজ পতাকা লাভ করলেও দেশের মানুষের জন্য প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা প্রদানকারী পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত সহসাই আমাদের সাথে ‘দাদাগিরি’ শুরু করে। সীমান্ত এলাকা দিয়ে চলে যেতে থাকে আমাদের দামী দামী সম্পদরাজি। প্রতিবাদ করার অপরাধে দেশের প্রথম রাজনৈতিক বন্দী হন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর এম.এ. জলিল। অল্প সময়ের মাঝেই দেখা দিলো দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয়, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সাংস্কৃতিক দেওলিয়াত্ব। সামগ্রিক অরাজকতা অতি অল্প সময়ের মাঝে দেশটির স্বাধীনতাকে এক ধরনের পরাধীনতায় রূপান্তরিত করলো। যাকে প্রখ্যাত গবেষক আবুল মনছুর আহমদ বললেন ‘বেশি দামে কেনা, কম দামে বেচা আমাদের স্বাধীনতা’।
৭১ থেকে ৭৫ এর সাড়ে তিন বছর সময়কাল। এ সময়ের মাঝেই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হলো একদলীয় স্বৈর সরকার ‘বাকশাল’। সকল দলের, সকল মতের টুঁটি চেপে ধরা হলো। ইসলামের নামে যে কোন দল বা সংগঠন করা নিষিদ্ধ হলো। সরকার নিয়ন্ত্রিত ৪টি পত্রিকা ছাড়া সকল পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হলো। কালা-কানুনের যাঁতাকলে পিষ্ট হলো মানুষ। হারালো বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা। ৩০ হাজার তরুণ প্রাণ দিলো প্রতিবাদ করতে গিয়ে। দেশ চলে গেলো “এক নেতা এক দেশ” শ্লোগানধারী একদল উচ্ছৃঙ্খল ও জিঘাংসু বাহিনীর কবলে। হাতে বালাশৃঙ্খল পরিহিত এই সব উচ্ছৃঙ্খল যুবকরা প্রশাসন নামক কুশাসনের ছত্রছায়ায় সর্বত্র জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুললো। সামগ্রিক এ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মানুষের কান্নার অধিকারও যেনো হারিয়ে গেলো। লক্ষ লক্ষ মানুষ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে জীবন দিলো, কাপড়ের অভাবে বাসন্তীরা ছেঁড়া জাল জড়িয়ে লজ্জা নিবারণ করতে বাধ্য হলো, মানুষে-কুকুরে কাড়াকাড়ি করলো ডাস্টবিনের উচ্ছ্বিষ্ট খাবার নিয়ে। ক্ষমতাশীনদের সন্তান-সন্ততিরা উঠে গেলো আইনের ঊর্ধ্বে। নিরীহ মানুষেরা শিকার হতে লাগলো কালো আইনের কঠোর থাবার।
খ. সোনার বাংলার স্বপ্ন : সোনার মানুষের অভাব বাংলাদেশ সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা এক স্বপ্নের দেশ। এক সময় এ দেশে টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়া যেতো। এখানে ছিল গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর গৃহ ভরা স্নেহপ্রীতি। তাই এই বাংলাকে বলা হতো ‘সোনার বাংলা’। বারবার ঔপনিবেশিক শাসন, বর্গীদের হানা এই বাংলার জনপদের সুখ-সমৃদ্ধি ও স্থিতি ছিনিয়ে নেয়ার অপপ্রয়াস পেয়েছে। সেজন্য যারাই মানুষকে আশার বাণী শুনিয়েছে তারাই বলেছে আমরা সোনার বাংলা কায়েম করবো। পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামেও এ কথা বলেই আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার মনে আশার আলো জাগানো হয়েছিলো, মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিলো। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি ছিটিয়ে দিলো কারা? সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান নিজেই বললেন- “মানুষ পায় সোনার খনি, আর আমি পেয়েছি চোরের খনি। আমার ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পিছনে সর্বত্র চোর। সাড়ে সাতকোটি বাঙ্গালীর জন্য সাড়ে সাত কোটি কম্বল এসেছে- আমার কম্বল কই?” একটি সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখা যতো সহজ তা বাস্তবায়ন তত সহজ নয়। এজন্য চাই একদল সোনার মানুষ। সৎ, সত্যনিষ্ঠ, যোগ্য, দেশপ্রেমিক একদল মানুষ -যাদের মূল্য হবে স্বর্ণের চেয়ে বেশি। এমন একদল মানুষ ছাড়া কিভাবে সম্ভব এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন? মূলত মানুষ তৈরী হয় শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে। আম খেতে হলে যেমন আমগাছের চারা লাগাতে হয়। তেমনি একদল সোনার মানুষ তৈরীর জন্য উপযুক্ত একটি শিা ব্যবস্থার প্রয়োজন। বিগত প্রায় সোয়া দুইশত বছর পর্যন্ত আমরা ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থাকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মেনে চলছি।
একজন খোদাভীতি সম্পন্ন, সত্যনিষ্ঠ, দেশপ্রেমিক যোগ্য লোক তৈরি করা -অন্তত এই শিক্ষা ব্যবস্থায় সম্ভব নয়। এই ছিল যখন বাংলাদেশের সামগ্রিক চিত্র তার সাথে যুক্ত হলো ১৯৭৫-এর ঐতিহাসিক পট-পরিবর্তন। এ সময় সপরিবারে নিহত হলেন দেশের স্বাধীনতার নায়ক, রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান- যিনি আবার ছিলেন একদলীয় শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এতবড় একটি বিয়োগান্তক ঘটনায় সাধারণ মানুষকে কাঁদতে দেখা যায়নি। উল্টো তারই সতীর্থ সহযোগীগণ মতায় বসলেন। অল্প সময়ের মাঝে ঘটে গেল অনেক ঘটনা। সামরিক শাসন, গণতান্ত্রিক উত্তরণের বিভিন্ন ধাপ গড়িয়ে দেশটি এক অদ্ভূত অবস্থানে চলে এলো। হতাশাক্লিষ্ট সাধারণ মানুষেরা বুঝতে পারছিলেন না কী হবে এই দেশের ভবিষ্যত? এমনি প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কতিপয় চিন্তাশীল ও সাহসী তরুণ মহান আল্লাহর উপর ভরসা করে সিদ্ধান্ত নিলো, তরুণ ছাত্রসমাজকে গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয়ে একটি আদর্শবাদী ছাত্রসংগঠনের জন্ম দেয়ার জন্য। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকে তাদের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হলো শান্তিকামী ছাত্র-তরুণদের প্রিয় কাফেলা “বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির” এর। শুরু হল একটি সুমধুর সঙ্গীতের শপথদীপ্ত অনুরণন –
“পদ্মা মেঘনা যমুনার তীরে আমরা শিবির গড়েছি
শপথের সঙ্গীন হাতে নিয়ে সকলে নবীজীর রাস্তা ধরেছি”
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির তার লক্ষ্য উদ্দেশ্য হিসাবে ঠিক করলো ‘‘আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসুল (সা:) প্রদর্শিত বিধান অনুযায়ী মানুষের সার্বিক জীবনের পুনর্বিন্যাস সাধন করে আল্লাহর সন্তোষ অর্জন”।
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে দ্বীন কায়েমের লক্ষে শিবির ঠিক করলো পাঁচ দফা কর্মসূচি। নবী-রাসুলদের আন্দোলনের ইতিহাসকে সামনে রেখে শিবির তিনদফা স্থায়ী কর্মসূচী হিসাবে গ্রহণ করলো দাওয়াত, সংগঠন ও প্রশিণের কর্মসূচি। অপরদিকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে গ্রহণ করলো শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা আন্দোলন এবং সামগ্রিক ইসলামী জীবনাদর্শের কর্মসূচী। এভাবেই শিবির স্থির করলো তার ৫ দফা বাস্তবসম্মত ও বৈজ্ঞানিক কর্মসূচি।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের যাত্রা ঘোষণা এ যেন ছিলো ঘনঘোর অন্ধকারে হঠাৎ আলোর ঝলকানি। হতাশা ও নিরাশার মাঝে এক শুভ্র আলোর হাতছানি। এ সংগঠন সবার প্রাণে ছড়িয়ে দিলো আশা ও সম্ভাবনার নতুন দীপ্তি। অতি অল্প সময়ের মাঝেই দেশের ইসলামপ্রিয় ছাত্র তরুণদের একক কাফেলায় পরিণত হয় ছাত্রশিবির। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-সুরমা-কর্ণফুলীসহ নাম না জানা অসংখ্য নদীর বাঁকে বাঁকে, শহরে, বন্দরে, নগরে, গ্রামে-গঞ্জের প্রতিটি জনপদে ছড়িয়ে পড়লো একটি হিল্লোল, একটি নাম- বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির।
শিবিরের অনুপম কর্মসূচি, আল্লাহর পথে সাধারণ ছাত্রসমাজকে উদারভাবে আহবান, সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় মজবুত ভ্রাতৃত্বের বন্ধনময় সংগঠন গড়ে তোলা, সংগঠিত ছাত্রদের জ্ঞান-চরিত্র ও মানবীয় গুণাবলীতে সমৃদ্ধ সুন্দর মানুষে পরিণত করা, ছাত্রদের অধিকার রক্ষা ও ক্যারিয়ার গঠনে সহযোগিতা প্রদান আর যাবতীয় শোষণ, নিপীড়ন ও গোলামী থেকে তাদের মুক্তির প্রয়াস ছাত্রশিবিরকে দেশের সর্ববৃহৎ ছাত্রসংগঠন হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে।
আল্লাহর রাহে কোরবানির মানসিকতা সম্পন্ন একদল জিন্দাদিল তরুণ বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির পথে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে। এসব তরুণদের কোন পিছুটানই ধরে রাখতে পারে না, পারে না লোভ-লালসা, দুনিয়াবী আকর্ষণ এদের কান্ত করতে। ঘরের টান বড় নয়, বড় এদের কাছে খোদার পথে নিরন্তর সংগ্রামের আহবান। এদেরই গান “আম্মা বলেন ঘর ছেড়ে তুই যাসনে ছেলে আর, আমি বলি খোদার পথে হোক এ জীবন পার।”
ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের এই নিরলস নিরাপোষ চেষ্টাই সংগঠনকে ৪১ বছরের মাঝে দিয়েছে এক অনন্য সাধারণ মজবুত ভিত্তি।
ছাত্রশিবির এক বিকল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম আমাদের দেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা একজন ছাত্রকে দুনিয়ায় চলার মতো জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কলা-কৌশল শিক্ষা দেয়। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় কোরআন-হাদিসের আলোকে দুনিয়ার জন্য কল্যাণকর মানুষ এবং আল্লাহর প্রকৃত বান্দা হিসেবে গড়ে তোলার কার্যকর ব্যবস্থা নেই। এ ব্যবস্থায় প্রতিটি ছাত্র তীব্র প্রতিযোগিতার মানসিকতা সম্পন্ন একজন দয়ামায়াহীন, দায়িত্ববোধহীন ভোগবাদী মানবে রূপ নেয়। তার ভেতর মানবতা, কল্যাণব্রত, খোদাভীতি ও জবাবদিহিতা জন্ম নেয় না।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিগত ৪১ বছরের শ্রমনিষ্ঠ প্রয়াসের ফলে আজ অবধি পরিপূর্ণ ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন না হলেও বাংলাদেশ প্রতি বছর সমৃদ্ধ হচ্ছে একদল আলোকিত মানুষের মাধ্যমে। লাভ করছে একদল সম্পূর্ণ নতুন ধরনের মানুষ। শিবির তার কর্মীদেরকে একটি সুন্দর সমন্বিত সিলেবাসের মাধ্যমে গড়ে তোলে। প্রতিটি কর্মীকে নিয়মিত রিপোর্ট রাখতে হয়। প্রতিদিন তাকে অর্থ ও ব্যাখ্যাসহ আল কুরআনের কিছু অংশ অধ্যয়ন করতে হয়। অধ্যয়ন করতে হয় এক বা একাধিক হাদীস, ইসলামী সাহিত্যের কমপক্ষে ১০টি পৃষ্ঠা, তাকে পত্র-পত্রিকা পড়তে হয়। প্রতিদিনই তাকে দিনশেষে নিজের কৃতকর্ম নিয়ে আত্ম-সমালোচনা করতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা এসব অধ্যয়নকে বাস্তবে রূপায়ন করতে হয়। তাকে ৫ ওয়াক্ত নামাজ জামায়াতে আদায় করতে হয়। এভাবে শিবির প্রতিটি তরুণকে জ্ঞানে ও চরিত্রে একজন সমন্বিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে।
শুধু তাই নয়, শিবিরের প্রতিটি কর্মীকে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩ ঘন্টা পাঠ্যপুস্তক অধ্যয়নের জন্য তাগিদ দেয়া হয়। সংগঠনের পক্ষ থেকে পড়ালেখার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিশেষভাবে দেখা হয় শিবির প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরিক্ষার জন্য গাইড ও কোচিং সেন্টারের ব্যবস্থা করছে। শিবির পরিচালিত কোচিং সেন্টারগুলো ও ভর্তি গাইডসমূহ ছাত্র-ছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের কাছে সর্বাধিক বিশ্বস্ত এবং কার্যকর। দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহের সেরা শিক্ষক ও ছাত্রগণ এসব কোচিংয়ে ক্লাস নিয়ে থাকেন। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নয় বরং ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি উপযোগী করে গড়ে তোলার জনকল্যাণমূলক মনোভাব নিয়ে এসব কোচিং পরিচালিত হয়। মেধাবী, অসচ্ছল ও দরিদ্র শিার্থীদেরকে স্বল্প ফি, এমনকি প্রয়োজনে সম্পূর্ণ বিনা ফিতেও কোচিং করানো হয়।
শিবির মেধাবী ও কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়মিত সংবর্ধনা প্রদান করে উৎসাহিত করে থাকে। গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের জন্য শিবিরের ব্যবস্থাপনায় রয়েছে বৃত্তির ব্যবস্থা। মেধার সুষ্ঠু ও সঠিক বিকাশ ঘটাতে তার স্বীকৃতি অপরিহার্য। বিষয়টিকে যথাযথ বিবেচনায় রেখেই শিবির মেধাবী ও কৃতি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন স্তরে নিয়মিত সংবর্ধিত ও উৎসাহিত করছে। স্থানীয়ভাবে শাখাসমূহ আয়োজন করে ৫ম ও ৮ম শ্রেণীর বৃত্তিপ্রাপ্তদের সংবর্ধনা। জাতীয় ও স্থানীয় বিশিষ্ট মেহমানদের উপস্থিতিতে এস.এস.সি/দাখিল, এইচ.এস.সি/ আলিম পরীক্ষায় অ+ প্রাপ্তদের নিয়ে আয়োজন হয় সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। ইসলামী ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে পরিচালিত ফ্রি কোচিং এবং বিনামূল্যে পুস্তক সরবরাহ কর্মসূচির সহায়তায় আজ বহু কৃতি ছাত্র ভাল ফলাফল করতে সম হয়েছে। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে যাচ্ছে ধূমপান, মাদকতা ও পরীক্ষায় নকলমুক্ত এক অনাবিল সুন্দর জীবনের পরশ। শিবিরের কর্মীগণ নিজেরা যেমন এসব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, তেমনি তারা অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করে এ ধরনের পরিচ্ছন্ন, সুন্দর ও অনুসরণীয় জীবনে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য। বাংলাদেশ সরকার ২০০৫ সালে ধূমপান বিরোধী যে আইন পাশ করেছে শিবির তা বাস্তবায়ন করে আসছে বিগত ৪০ বছর ধরে। যাত্রার শুরু থেকেই শিবির তার প্রতিটি কর্মীকে অভ্যস্ত করেছে নকলমুক্ত পরীক্ষায়।
শিবির তার কর্মীদের মাঝে আল্লাহ-প্রেম ও খোদাভীতি সৃষ্টির জন্য তাদেরকে অভ্যস্ত করে তোলে শব্বেদারী বা নৈশ ইবাদাতে যা তাদেরকে তাহাজ্জুদ আদায়ে অনুপ্রাণিত করে।
প্রতিভার লালন ও বিকাশের ক্ষেত্রে শিবির বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির কেবল প্রতিভা বিকাশ ও লালনের কাজই করে না বরং শিবির হচ্ছে প্রতিভা সন্ধানী একটি অনন্য সংগঠন। ছাত্রদের সুপ্ত প্রতিভা সন্ধানের জন্য শিবির প্রতি বছর তৃণমূল পর্যায় থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত আয়োজন করে বিভিন্ন কুইজ প্রতিযোগিতা, মেধা যাচাই, ক্যারিয়ার গাইডলাইন কনফারেন্স, কম্পিউটার মেলা, বিজ্ঞান মেলা, সাধারণ জ্ঞানের আসর, আবৃত্তি প্রতিযোগিতা, ক্রিকেট ও ফুটবল প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। এছাড়া শিবির আয়োজন করে থাকে আন্তঃস্কুল, আন্তঃকলেজ বিতর্ক প্রতিযোগিতা। এসব আয়োজন যেমনভাবে উদ্বুদ্ধ করে মেধাবী তরুণদের, তেমনিভাবে বের করে আনে প্রতিভাসমূহকে, যারা গড়ে তুলবে আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির দেশের একমাত্র ছাত্রসংগঠন যার রয়েছে নিয়মিত প্রকাশনা। সকল পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য রয়েছে শিবিরের কেন্দ্রীয় মাসিক ছাত্র সংবাদ। শিশু কিশোরদের জন্যও রয়েছে অনেক বাংলা ও ইংরেজি মাসিক সাময়িকী। এসব মাসিক পত্রিকায় লিখে যাদের লেখালেখির হাতেখড়ি হয়েছিল তাদের অনেকেই আজ দেশের খ্যাতনামা কবি,সাহিত্যিক। এছাড়া শিবিরের বড় বড় শাখাগুলোর প্রায় প্রতিটিরই রয়েছে নিজস্ব নিয়মিত প্রকাশনা। বড় শাখাগুলো মাসিক ও ত্রৈমাসিক পত্রিকাও প্রকাশ করছে।
অপসংস্কৃতির সয়লাবে ভেসে যাওয়া তরুণ-তরুণীদের নিয়ে সবাই যখন উদ্বিগ্ন অথচ কোন কর্মসূচি দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ তখন ‘‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির” গ্রহণ করেছে কার্যকর কর্মসূচি। আজ ৪১ বছর শেষে শিবির অনেক সমৃদ্ধ। কারণ তার রয়েছে সারাদেশে সর্বজনস্বীকৃত ২০০টিরও বেশি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী। এসব গোষ্ঠী নিয়মিত প্রশিক্ষণ, ওয়ার্কসপ ও প্রযোজনার মধ্য দিয়ে একঝাঁক তরুণ শিল্পী তৈরী করে যাচ্ছে প্রতি বছর। মঞ্চ অনুষ্ঠান ছাড়াও এসব গোষ্ঠীর রয়েছে নিয়মিত অডিও ভিডিও প্রকাশনার বিপুল সম্ভার। আর এসব ধারণ করে আছে- ইসলামী গান, দেশাত্মবোধক গান, জারী, ভাওয়াইয়া ও ভাটিয়ালী গান। রয়েছে আবৃত্তি, নাটক, কৌতুকের সমাহার যা একজন দর্শক শ্রোতাকে নির্মল আনন্দ ও ইসলামী মূল্যবোধের যৌথ আস্বাদ দান করে থাকে।
১৯৯৪ থেকে শিবির গড়ে তুলেছে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতি সংগঠনসমূহের ফোরাম। এই ফোরাম আয়োজন করে প্রশিণের, উৎসবের। আর প্রকাশ করে যাচ্ছে অসংখ্য অডিও-ভিডিও ক্যাসেট ও সিডি। একটি নতুন ধারার নাট্য ও চলচ্চিত্র আন্দোলনও দিন দিন এগিয়ে চলছে।
বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষিত তরুণদের মাঝে ইসলামী আচার-আচরণ, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি চর্চার ব্যাপারে শিবিরের রয়েছে বিরাট ভূমিকা। সবার মাঝে সালামের প্রচলন এসবের একটি। বড়দের শ্রদ্ধা ও ছোটদের স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ করা শিবিরের কালচার। এছাড়া শিবির ঈদকার্ড ও শুভেচ্ছা কার্ড বিনিময়ের প্রচলন করেছে। শিবির সববয়সীদের জন্য প্রকাশ করছে চমৎকার সব পোস্টার, স্টিকার, ভিউকার্ড, পোস্টকার্ড, কাস রুটিন, রমজানের সময়সূচি, নববর্ষের ডায়েরী, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি। এছাড়া বিজ্ঞান শিক্ষাকে আকর্ষণীয় করার জন্য সায়েন্স সিরিজ সহ অন্যান্য প্রকাশনা। ২০০০ সাল থেকে শিবির প্রকাশ করছে তিন পাতার বিষয়ভিত্তিক বড় ক্যালেন্ডার।
জাতীয় ইস্যুসমূহে শিবিরের ইতিবাচক ভূমিকা একটি ছাত্রসংগঠন হিসেবে জাতীয় রাজনীতির বিভিন্ন ইস্যু ও ক্রান্তিলগ্নে এ সংগঠন রেখে এসেছে ইতিবাচক ভূমিকা। ১৯৮১ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ডের পর ক্ষমতাসীন বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে ১৯৮২ সালে বন্দুকের নলের মুখে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখল করে স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট হোসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে শিবিরের ভূমিকা ছিল অগ্রণী ও বলিষ্ঠ। নব্বই দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টি.এস.সি, শাহবাগ ও দোয়েল চত্বর কেন্দ্রিক যে বিশাল ছাত্রজমায়েত ও আন্দোলন গড়ে উঠে তার অন্যতম সংগঠক ইসলামী ছাত্রশিবির। শিবিরের বহু নেতা-কর্মী স্বৈরশাসকের হাতে নিহত ও বন্দী হলেও শিবির মুহূর্তের জন্যও ঘাবড়ে যায়নি। শিবিরের বিশাল সমাবেশ ও মিছিল ছাত্র জনতার প্রাণে নতুন আশা ও প্রেরণা সঞ্চার করেছে।
স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের প্রধান নিয়ামক শক্তি ছিল ছাত্রদের গড়ে তোলা আন্দোলন, আর সে আন্দোলনের অন্যতম শরিক ছিল ইসলামী ছাত্রশিবির। ১৯৯২ সালে শিবিরকে রাখতে হয়েছে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা -যা বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। গণআদালতী ঘাদানিকদের তাণ্ডবের প্রতিবাদে শিবির ছিল ময়দানের লড়াকু শক্তি।
২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিলো বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির এক মহাক্রান্তিকাল। ১৯৯৬-এর নির্বাচনের মাধ্যমে মতায় আসা দলটি পর্যায়ক্রমে একদলীয় স্বৈরাচারে রূপ নিলে দেশের অন্যসব ছাত্র সংগঠনসহ শিবির গড়ে তোলে “সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য” -যার নিরলস প্রয়াসে দেশ ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসে। ২০০১ সালের নির্বাচনে শিবিরের ভূমিকা ছিল প্রচণ্ড প্রত্যয়দীপ্ত, পরিশ্রমী ও আত্মত্যাগী। বিষয়টি সর্বজনবিদিত ও প্রশংসিত।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যতো রকম সন্ত্রাস, রাহাজানি ও দেশদ্রোহী কাজ রয়েছে, শিবির বার বার তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছে। শিবির নিজে যেমন দলের মাঝে সন্ত্রাসীদের কোন স্থান রাখেনি তেমনি কোন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকেই শিবির প্রশ্রয় দেয় না। বারবার বোমা, সন্ত্রাস, হত্যাকাণ্ড যখন দেশের সার্বিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তোলে, তখন প্রতিপরে কেউ কেউ শিবিরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেও শিবির যে এসব অপরাধ থেকে বহু বহু দূরে তা প্রমাণ করতে পেরেছে।
১৯৯৯ সালে বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের ধর্মদ্রোহিতার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করে শিবির তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে তথাকথিত শান্তিচুক্তির নামে মূল ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করার অবিমৃষ্যকারীতার বিরুদ্ধে গণচেতনা সৃষ্টি, আত্মঘাতী ট্রানজিট ইস্যুতে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন, বিতর্কিত কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের নামে ধর্মহীন সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের সরকারী উদ্যোগের বিরুদ্ধে আন্দোলনসহ প্রতিটি জাতীয় ইস্যুতে শিবিরের ভূমিকা ছিল স্ফটিকস্বচ্ছ।
২০০৫-এ শিবির সার্ক শীর্ষ সম্মেলন নিয়ে গড়ে ওঠা অস্থিতিশীল ও দোদুল্যমান পরিস্থিতি এবং ৬৩ জেলায় চেইন বোমা হামলার ঘটনার পর দেশের সচেতন দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদদের নিয়ে আয়োজন করেছে গোলটেবিল বৈঠকের। এ আয়োজন ও আলোচনা দেশ ও জাতিকে নতুন আশায় উজ্জ্বীবিত করেছিলো।
শিবির সন্ত্রাসকে একটি জাতীয় ইস্যু হিসেবে গ্রহণ করে সারাদেশে সন্ত্রাস বিরোধী জনমত গঠন, সন্ত্রাস দমন ও সন্ত্রাস নির্মূলের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ক্ষেত্রে শিবির সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভা, র‍্যালী আয়োজন ছাড়াও সকল উদ্যোগে সর্বোত্তম সহযোগিতা প্রদান করে আসছে।
বাংলাদেশ ক্রিকেটদল ন্যাটওয়েস্ট সিরিজে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১ দিনের ম্যাচে জয়ী হলে শিবির নেতৃবৃন্দ বিজয়ী দল, কোচ ও তার কর্মকর্তাদের অভিনন্দিত করে বিবৃতি প্রদান করেন।
পার্বত্য শান্তি চুক্তি ও সেনা প্রত্যাহার পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা গেলে ভারত সহজেই চট্টগ্রাম বন্দর পেয়ে যাবে। এই লোভে শান্তিবাহিনী ও জনসংহতি সমিতির নেতা সন্তু লারমাকে ভারত অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষন দিয়ে পর্দার অন্তরাল থেকে সার্বিক সহযোগিতা করে আসছে। সরকার পার্বত্য অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহার করছে অন্যদিকে স্বাধিকার আন্দোলনের ডাক দিলেন সন্তু লারমা (নয়া দিগন্ত ১০.০৮.০৯)।
ভারতের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে এ দেশের সরকার ও জনগণকে সচেতন করতে কর্মসূচি নিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে সন্তু লারমার স্বাধিকার আন্দোলনের ডাক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অস্তিত্বকে ঝুঁকির সম্মুখীন করবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক দেশ কর্তৃক অন্য দেশে সন্ত্রাসে মদদদান অন্যতম বিতর্কিত একটি বিষয়। ভারতের অভিযোগ হলো, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন পরিচালনায় সাহায্য করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ দাবি করছে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করছে এই রকম ৩৯টি ঘাঁটি রয়েছে ভারতে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিবাহিনীর ৪৫টি সশস্ত্র ক্যাম্প খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবানের সন্নিকটস্থ বর্ডারিং এরিয়ায় ভারতে অবস্থিত। একইভাবে বঙ্গভূমি আন্দোলনেও বঙ্গসেনাদের ভারত সরাসরি মদদ দানের মাধ্যমে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। ছাত্রশিবির দেশের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই সন্ত্রাসের এই মরণখেলা থেকে উত্তরণ চায় এবং অব্যাহতভাবে এর বিরোধিতা করে আসছে।
সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ভারত বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসন ঠেকানোর অজুহাতে বাংলাদেশ ভারতের আন্তর্জাতিক সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করছে। এই কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার মধ্য দিয়ে ভারতের অবন্ধুত্বসুলভ নির্মম আচরণ প্রকাশ পায়। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ভারত বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে চায় না, চায় বাংলাদেশকে আবদ্ধ করে রাখতে। ভারতের এই আন্তর্জাতিক আইন বিরোধী কাজের জন্য ছাত্রশিবির দেশবাসীকে সাথে নিয়ে প্রথম থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। ইতিমধ্যে ভারত ১৩৫৭ কিলোমিটার এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেছে। তা ছাড়াও ভারতের দ্বিতীয় পর্যায়ে ২৪২৯.৫ কিলোমিটার কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ পরিকল্পনাধীন রয়েছে। এই কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের মধ্য দিয়ে ভারতের রাষ্ট্রীয় মতার উদ্ধত রূপটি প্রকাশ পেয়েছে। আর এর জের ধরে মিয়ানমারও সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার কাজে মনোযোগী হয়েছে। অর্থাৎ ভারতের সাথে নতুন করে এখন মিয়ানমার যোগ হলো। ফলে একসাথে দু’টো দেশকে এখন পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে যা বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য বিরাট হুমকি। ছাত্রশিবির চায় অনতিবিলম্বে উভয় দেশের সাথে যোগাযোগ করে তাদেরকে এহেন কাজ হতে বিরত রাখুক বাংলাদেশ সরকার।
২৮ অক্টোবর ২০০৬, রক্তের হোলি খেলা ও লগি বৈঠার তাণ্ডব ক্ষমতাসীন চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করে যখন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে মতা হস্তান্তরের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন চৌদ্দদলীয় জোট সিইসি বিচারপতি এম এ আজিজের পদত্যাগ ও সাংবিধানিকভাবে নির্ধারিত সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কে এম হাসানের পরিবর্তে বিচারপতি মাহমুদুল আমিনকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার দাবিতে আন্দোলনের শুরু করে। ২৮ অক্টোবর ২০০৬-এ চারদলীয় জোট যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে মতা হস্তান্তর করার কথা, তার পূর্বমুহূর্তে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে তাদের সর্বশেষ সমাবেশের আয়োজন করে। এ সমাবেশে শেখ হাসিনার নির্দেশে লগি-বৈঠা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আওয়ামী ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীরা। ঢাকার রাজপথে লগি-বৈঠা দিয়ে সাপের মতো হত্যা ও আহত করে জামায়াত ও শিবিরের অনেক নেতাকর্মীকে। ঐ দিন ঐ সমাবেশের ঘটনা বাংলাদেশের সুষ্ঠু রাজনীতির পরিক্রমায় এক শক্ত আঘাত। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সেদিন জানবাজি রেখে দেশের সার্বভোমত্ব রক্ষায় ভূমিকা রেখেছিল।
কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ২০০৮ সালের আপোষের নির্বাচনে মঈন সরকার কৃত অপরাধের দায়মুক্তির লক্ষ্যে আওয়ামীলীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে এবং এতে সরাসরি মধ্যস্থতা করে ভারত। যা কিছুদিন আগে প্রকাশিত প্রনব মুখার্জির বইতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসে ভারতের প্রেসক্রিপশনে এদেশের ইসলামপন্থীদের হত্যা করার উদ্যোগ নেয় ১৯৭১ সালের কাল্পনিক সব অভিযোগে। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় শিবির। এর ফলে ২০১৩ সালে শহীদ হয় বহু ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মী। অগণিত মানুষ গুলিবিদ্ধ ও পঙ্গুত্ব বরণ করেন। আওয়ামীলীগ সরকার একের পর এক হত্যা করে ৬ জন ইসলামপন্থী নেতাকে।
পাঁচ জানুয়ারীর নির্বাচন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী একতরফা নির্বাচন করে আওয়ামীলীগ সরকার। সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে একাই নির্বাচন করে আওয়ামীলীগ। দেশের সচেতন মানুষদের সাথে নিয়ে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে সোচ্চার ছিল ইসলামী ছাত্রশিবির। এর ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের প্রায় সবক’টি রাজনৈতিক দল নির্বাচন বয়কট করে। ১৫৪ টি আসনে কোন প্রতিদ্বন্দ্বীতাই হয়নি।
শিক্ষানীতির জন্য আন্দোলন শিক্ষা ব্যবস্থা একটি জাতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ৪৭ বছর পরও বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মূল্যবোধ ও চেতনার আলোকে দেশে কোন শিক্ষা-নীতি প্রণীত হয়নি। বরং ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীন শিক্ষানীতি চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। শিবির বরাবরই এসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে প্রথমত শিবিরের জনশক্তি ও সাধারণ জনগণকে সচেতন করে জনমত সংগ্রহের জন্য জাতীয় শিক্ষা সেমিনারের আয়োজন, স্থানীয় সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, গোলটেবিল বৈঠক, বুকলেট প্রকাশ, পুস্তিকা প্রকাশ, শিক্ষা স্মরণিকা প্রকাশ ও Workshop, গ্রুপ মিটিং ইত্যাদি কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। এছাড়া প্রতিবছর ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার দাবিতে ১৫ আগস্টকে “ইসলামী শিক্ষা দিবস” হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। প্রতিবছর দেশব্যাপী শিক্ষা সপ্তাহ পালন করা হয়। এ উপলক্ষে ঢাকায় জাতীয় বিজ্ঞান মেলা, জাতীয় সেমিনার, বিজ্ঞান মেলা, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভা, শিক্ষা সামগ্রী প্রদর্শন, Understanding Science Series প্রদর্শনী এবং “আমাদের শিক্ষা সংকট : উত্তরণের উপায়” শীর্ষক বুকলেট প্রকাশসহ বহুবিধ প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়।
শিক্ষা নিয়ে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকার শিক্ষা নিয়ে ষড়যন্ত্র করেছে। শিক্ষাখাতে যে ব্যয় বরাদ্দ দেয়া উচিত অনেক সময়েই তা দেয়া হয়নি। পাঠ্যপুস্তকে ব্রাহ্মণ্যবাদের আসর, দেরীতে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ দলীয়করণ, ইতিহাস বিকৃতি ও জাতিকে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি, বিপক্ষ শক্তি হিসাবে বিভক্ত করার গভীর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে শিবির সব সময় সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন ছিল ছাত্রশিবিরের বড় সফলতা। মিছিল, মিটিং, ছাত্রধর্মঘট, সমাবেশ বিক্ষোভ, ঘেরাও, লিফলেট, প্রচারপত্র বিতরণ ইত্যাদি কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে শিক্ষার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরণের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে ভূমিকা পালন করেছে।
মাদ্রাসা শিক্ষা বৈষম্যের প্রতিবাদ বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষা বরাবরই অবহেলিত। এবতেদায়ীর জন্য আওয়ামী সরকারের কোন বাজেট ছিল না। তাদের ফ্রি-বই বিতরণ ও বৃত্তির ব্যবস্থাও ছিল না। একটি মাত্র মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড। একটি মাত্র প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের জন্য ভাল ব্যবস্থা নেই। মাদ্রাসা ছাত্ররা বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে না। বিপুলসংখ্যক ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসাকে সমন্বয় করার জন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় নেই। সাধারণ প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসার মধ্যে বিরাট ব্যবধান করে রাখা হয়েছে। শিবির তার জন্মলগ্ন থেকেই মাদ্রাসার এ বৈষম্য দূর করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইসলামী শিক্ষা দিবস উদযাপন শিবির এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার গলদ তুলে ধরে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়নের লক্ষ্যে দীর্ঘ দিন থেকে ১৫ই আগস্টকে ইসলামী শিক্ষা দিবস হিসাবে পালন করে আসছে। ১৯৬৯ সালের এ দিনে ইসলামী শিক্ষার পক্ষে কথা বলতে গিয়ে জীবন দিতে হয়েছে শহীদ আব্দুল মালেককে। প্রতি বছর এ দিনকে সামনে রেখে সারা দেশে শিক্ষা সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভা ইসলামী শিক্ষার পক্ষে স্বাক্ষর অভিযানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে থাকে। একটি ছাত্র সংগঠনের এটি একটি ব্যতিক্রম উদ্যোগ।
সৃজনশীল প্রকাশনায় শিবির ইসলামী ছাত্রশিবিরের একটি সমৃদ্ধ প্রকাশনা বিভাগ রয়েছে। আধুনিক রুচিসম্মত এবং সামাজিক চাহিদা নির্ভর বিভিন্ন প্রকাশনা সামগ্রী এই বিভাগ থেকে প্রকাশ করা হয়। তথ্যবহুল দাওয়াতী কার্যক্রম, উপহার আদান প্রদান এবং সুস্থ বিনোদন চর্চায় শিবিরের প্রকাশনা সামগ্রী অনন্য। এই প্রকাশনা সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে নববর্ষের ৬ প্রকার ক্যালেন্ডার, ৪ প্রকার ডায়েরী, অসংখ্য ক্যাসেট, গান ও নাটকের সিডি এবং বহু রকমের কার্ড, ভিউকার্ড, স্টিকার, মানোগ্রাম, কোটপিন, চাবির রিং, চিঠির প্যাড ইত্যাদি প্রকাশনীর মাধ্যমে ছাত্র আন্দোলনের মাঝে একটি বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। শিবিরের প্রকাশনা সামগ্রী সর্বস্তরের মানুষের কাছে একটি অপরিহার্য সৌন্দর্য্যরে প্রতিক। তথ্যবহুল, গবেষণালব্ধ, বহু রং ও ডিজাইনের ক্যালেন্ডার ও ডায়েরি দেশ ও বিদেশে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। মনোরম সমসাময়িক প্রচ্ছদ নিয়ে মাসিক ছাত্রসংবাদ, বাংলা ও ইংরেজি কিশোর পত্রিকা, মাসিক ইংরেজি ম্যাগাজিন, ত্রৈমাসিক-At a Glance বের হয়, যা ইতিমেধ্যই পাঠকদের মনযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।
ছাত্রশিবিরের বিজ্ঞান সামগ্রী প্রকাশনাও সমৃদ্ধ। দেশে বিজ্ঞান শিক্ষার পশ্চাদপদতা দূর করার জন্য ইসলামী ছাত্রশিবির প্রকাশ করেছে পদার্থ, রসায়ন ও জীববিদ্যার উপর রেফারেন্স বই ও চার্ট পেপার। এ বইগুলো এস.এস.সি/দাখিল, এইচ.এস.সি/আলিম ও ডিগ্রীর প্রথম বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অনন্য ও অপরিহার্য শিক্ষা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বহুরঙ্গা ও দ্বিমাত্রিক চিত্রসহ সম্পূর্ণ ডি.টি.পি তে ও ইলাস্ট্রেটেড ডিজাইনে ছাপানো এ উচ্চমানের বইগুলো বাংলা ভাষায় ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়নি। ছাত্র-ছাত্রীদের আগ্রহ প্রয়োজন এবং একাডেমিক শিক্ষার যথার্থ তথ্য উপকরণ দিয়েই এই Understanding Science Series প্রকাশিত হয়েছে।
সাহিত্য সাংস্কৃতিক অঙ্গন একটি দেশের রাজনৈতিক বিপ্লবের জন্য প্রয়োজন সাংস্কৃতিক বিপ্লব। এ দেশের ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে সফলতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে শিবিরের রয়েছে নিজস্ব সাহিত্য সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ভান্ডার। জ্ঞান অর্জন ও মেধা বিকাশের পাশাপাশি একজন ছাত্রকে মানসিক বিকাশের জন্য এবং তার মধ্যে সহজভাবে ইসলামের জীবন পদ্ধতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরার জন্য রয়েছে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। অপসংস্কৃতির সয়লাব থেকে ছাত্র ও যুবসমাজকে রক্ষা করে তাদেরকে ইসলামী মূল্যবোধে উজ্জীবিত করতে হলেও প্রয়োজন পরিশীলিত সংস্কৃতির আয়োজন। সাহিত্য সংস্কৃতি মানেই অশ্লীলতা-বেহায়াপনা, পাশ্চত্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদের অন্ধ অনুকরণ এই ধারণার পরিবর্তন করতে শিবির বদ্ধপরিকর। ইসলামী ছাত্রশিবির সে জন্যই ইসলামী সাংস্কৃতির এক বিরাট জগতকে গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশে ইসলামী সংস্কৃতির প্রতীকে পরিণত হয়েছে। সাইমুম, প্রত্যয়, বিকল্প, উচ্চারণ, পাঞ্জেরী ও টাইফুন ইত্যাদি শিল্পীগোষ্ঠীর সমগ্র দেশেই সুনাম ও সুখ্যাতি রয়েছে। প্রতিবছর এইসব প্রতিষ্ঠান থেকে শত শত সাংস্কৃতিক কর্মী তৈরী হচ্ছে।
ছাত্রকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড ছাত্রদের কল্যাণমূখী কর্মকান্ড পরিচালনায় শিবির তৎপর। বাড়ি থেকে দূরে অবস্থানকারী ছাত্রদেরকে লজিং-এর ব্যবস্থা করে দেয়া, বেতন দানে অক্ষম ছাত্রদেরকে বেতন প্রদান, বই ক্রয়ে সহযোগিতাসহ, মেধাবী ও দরিদ্র ছাত্রদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা, শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, ফ্রী কোচিং, বিনামূল্যে প্রশ্নপত্র বিলি এবং কর্জে হাসানা প্রদান করে থাকে। প্রতিবছর ছাত্রশিবির থেকে বৃত্তি পায় অন্তত ৪৫ হাজার ছাত্রছাত্রী। ছাত্রশিবির তার কর্মীদেরকে পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর পরই তার বই শিবির পরিরচালিত লেন্ডিং লাইব্রেরিতে বিনামূল্যে বই প্রদান করতে উৎসাহিত করে। এছাড়াও শিবির বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ক্লাসের বই লেন্ডিং লাইব্রেরির জন্য সংগ্রহ করে থাকে। ফেরত দেয়ার শর্তে বই গরীব ও উপযুক্ত ছাত্রদের মাঝে বিতরণ করা হয়।
বাজারে প্রথম শ্রেণীর গাইড ও কোচিং বলতে যা বুঝায় সেগুলো ইসলামী ছাত্রশিবিরের। বুয়েট, কৃষি, ঢাকা, চট্টগ্রাম, ইসলামী ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, পলিটেকনিকসহ দেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিবিরের গাইড এবং কোচিং রয়েছে। এছাড়াও ক্লাস কোচিং, বৃত্তি কোচিংসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি কোচিং রয়েছে। বাজারের অন্য্যন্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত কোচিং এর মতো নয়। ছাত্রদেরকে ভর্তি উপযোগী করার জন্য ছাত্রকল্যাণমূলক মনোভাব নিয়ে এ কোচিং পরিচালিত হয়।
ইসলামী ছাত্রশিবির ছাত্রদেরকে নকল প্রবণতা থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করে। শিবিরের সাথী ও সদস্য শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছাত্ররা নকল করতে পারে না। কেউ নকল করলে তার সাথী বা সদস্য পদ বাতিল করা হয়। কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা না নিলেও শিবির তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। অন্য কোন ছাত্রসংগঠনে তা কল্পনা করা যায় না। বাংলাদেশে নকল বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রশিবির নামটা বেশ উজ্জ্বল।
অদম্য মেধাবী সংবর্ধনা ও বৃত্তি প্রদান শারীরিক অক্ষমতা, দারিদ্রের কষাঘাত ও বিভিন্ন প্রকার সামাজিক প্রতিকূলতাকে জয় করে যারা বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় কৃতিত্বে স্বাক্ষর রাখে এমন অদম্য মেধাবীদের ছাত্রশিবির সংবর্ধনা দিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য উদ্বুদ্ধ করে থাকে। শুধু তাই নয়, এসব অদম্য মেধাবীরা যেন বাকী পড়াশুনা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারে তা নিশ্চিত করতে ছাত্রশিবির তাদের শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থাও করে থাকে। কোন অপূর্ণতাই যেন তাদেরকে শিক্ষাজীবন থেকে ছুড়ে ফেলতে না পারে তা নিশ্চিত করতে দিয়ে থাকে ক্যারিয়ার গাইডলাইন, কোচিং সুবিধা ও আনুসঙ্গিক সহযোগিতা। ছাত্রসংগঠন হিসেবে ছাত্রশিবির এটি নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছে।
সমাজকল্যাণমূলক কর্মকান্ড নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে ইসলামী ছাত্রশিবির সমাজকল্যাণমূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে। সংকট ও দুর্যোগ মুহুর্তে ত্রাণ বিতরণ, উদ্ধারকাজ, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, শীতবস্ত্র বিতরণ বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ঔষধ বিতরণ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান, বাঁধ নির্মাণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, ডেঙ্গু প্রতিরোধ, রক্ত দান ও ব্লাড গ্রুপিং সহ নানাবিধ সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে শিবির সাধারণ ছাত্রজনতার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিবছর দশলক্ষ গাছের চারা রোপনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ পালন করে। যেকোন দূর্যোগে জনগণের পাশে সবার আগে যে সংগঠনটি দাঁড়ায় তার নাম ছাত্রশিবির। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার পাশাপাশি নতুন প্রজন্মকে সমাজ সচেতন করে গড়ে তোলা, সামাজিক দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। শিবির সে কাজটি প্রতিনিয়তই করে থাকে। বাংলাদেশের অন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ছাত্র সংগঠনের এ ধরনের উদ্যোগ খুবই গৌণ।
বন্যার্তদের সহযোগিতায় ছাত্রশিবির ভাটির দেশ বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয় এদেশের জনগণকে। উজানের নদীতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শত শত বাঁধ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রায় প্রতি বছরই দেশের কোন না কোন অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়। সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায় হাজার হাজার মানুষ। বাড়ি ঘর হারিয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু বাঁধ হয় তাদের শেষ আশ্রয়। খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা আর পানীয় জলের অভাবে দেখা দেয় মানবিক বিপর্যয়। এমতাবস্থায় ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে আসছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। বন্যা কবলিত এসব মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের দূর্ভোগ লাঘবে তরুণ সমাজকে সাথে নিয়ে ত্রাণ তৎপরতার মাধ্যমে খাদ্য, বস্ত্র ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করে আসছে ছাত্রশিবির। ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিমের মাধ্যমে দূর্গত এলাকার ভাগ্যাহত মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবারও ব্যবস্থা করে থাকে।
১৯৮৮, ১৯৯১, ১৯৯৮, ২০০০ সালের ভয়াবহ বন্যায় দূর্গত মানুষের সেবায় ছাত্রশিবিরের ভূমিকা ছিল অভাবনীয়। এছাড়াও প্রায় প্রতিটি বন্যায় ছাত্রশিবির দূর্গত মানুষের পাশে থেকেছে বরাবরের মতই। ২০০৭ সালের বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ ও ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ আঘাত হানার পর ছাত্রশিবির দেশের দক্ষিণাঞ্চলের দূর্গত ও ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সেবা ও উদ্ধার তৎপরতায় ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। ২০০৯ সালে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আঘাত হানে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’। এতে লন্ডভন্ড হয়ে যায় এ অঞ্চলের হাজার হাজার বসত-ভিটা, আবাদিজমি। সরকারি হিসেবেই এতে প্রাণ যায় ৩৩২ জনের। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় ছাত্রশিবিরের দায়িত্বশীল ভূমিকা সারা দেশে প্রশংসিত হয়। ছাত্রশিবিরের আহ্বানে সারাদেশ থেকেই তরুনসমাজ ত্রাণ তৎপরতা ও দূর্গতদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালে ভারতের গজলডোবা ও ফারাক্কা বাঁধের শত শত গেইট খুলে দেয়ায় দেশে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সেইসাথে প্রবল বর্ষণে বেড়ে যায় ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা। স্বৈরাচারী সরকারের চলমান জুলুম-নির্যাতন উপেক্ষা করে ছাত্রশিবির এগিয়ে যায় বন্যাদূর্গত মানুষের দোরগোড়ায়। যা মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলগুলোতে ভারতের অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয়ার ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি হয়। তদুপরি ভারতীয় ইউরেনিয়াম খনির দূষণে হাজার হাজার টন মাছ, হাজার হাজার হাঁস মারা যায়। সর্বশান্ত হয়ে পড়ে হাওড় পারের মানুষ। ছাত্রশিবির এই দূর্যোগে তাদের পাশে দাঁড়ায়। এছাড়াও বন্যা ও ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া মানুষদের কাছে জরুরী ত্রাণ পৌঁছে, বাড়িঘড় নির্মাণ করে দেয়া ছাত্রশিবিরের নিয়মিত কাজ।
বহির্বিশ্বে দুর্যোগে দূর্গতদের পাশে ছাত্রশিবির ২০১৫ সালের ২৫ শে এপ্রিল নেপালে ৭.৮ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয় নেপালের জনগণ। ছাত্রশিবির সে দুর্যোগে ছাত্রসংগঠন হিসেবে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ায়। বিধ্বস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষা উপকরণ বিতরণের পাশাপাশি আর্থিকভাবেও সহায়তা করে ছাত্রশিবির।
শীতার্ত মানুষের পাশে ছাত্রশিবির বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাক্কলন অনুযায়ী গ্রামাঞ্চলের ৪৭.১% লোক দারিদ্র্যসীমা এবং ২৪.৬% লোক চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর জন্য শীত ঋতুতে জীবন ধারণ অনেকটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তীব্র শৈত্যপ্রবাহ অচল করে দেয় তাদের জীবনযাত্রা। ছাত্রশিবির প্রতিবছরই শীতার্ত এই জনগোষ্ঠির কষ্ট লাঘবে শীতবস্ত্র বিতরণের কর্মসূচী পালন করে থাকে। সংগঠনের প্রত্যেক জনশক্তিকে অন্তত একজন শীতার্ত ব্যক্তিকে শীতবস্ত্র প্রদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করে থাকে। দেশের শীতপ্রধান উত্তরাঞ্চলসহ প্রতিটি শহর ও পল্লীর ছিন্নমূল শীতার্ত মানুষের জন্য ছাত্রশিবিরের এ কাজ সর্বমহলে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়ে আসছে। এর পাশাপাশি দেশের তরুন সমাজের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করছে। ফলে ইদানিংকালে তরুণদের বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকেও এসব কাজে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের।
ঈদ সামগ্রী বিতরণ বছরে মুসলমানদের জন্য দু’টি ঈদ নিয়ে আসে উৎসবের আমেজ আর অনাবিল আনন্দ। কিন্তু দারিদ্রপীড়িত একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠি বঞ্চিত হয় এই উৎসবের আমেজ থেকে। হাজার হাজার ছিন্নমূল পথশিশু আর দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত পরিবারের কাছে তাই ঈদের দিনটি কখনো কখনো বিষাদের দিনে পরিণত হয়। দায়িত্বশীল ছাত্রসংগঠন হিসেবে ছাত্রশিবির এসব দারিদ্রপীড়িত মানুষের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। হাসি ফোটাতে চেষ্টা করে ছিন্নমূল পথশিশুর মুখেও। নতুন পোষাক আর সেমাই-চিনি নিয়ে উপস্থিত হয় তাদের দরজায়। ভাগাভাগি করে নেয় ঈদের আনন্দ।
ঈদুল আযহায় ‘কুরবানী প্রোগ্রাম’ এর মাধ্যমে পশু কোরবানী করে দুস্থ ও অসহায়ের কাছে পৌঁছে দেয় কোরবানীর গোশত। অসহায় বঞ্চিতের মুখে হাসি ফোটাতে নিরন্তর ছুটে চলে তারুণ্যদীপ্ত ছাত্রশিবিরের হাজার হাজার জনশক্তি।
পথশিশু ইয়াতমদের মাঝে খাবার বিতরণ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসে ছাত্রশিবির ইয়াতিম ও পথশিশুদের মাঝে খাবার বিতরণ করে থাকে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসের বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্যে এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচী হিসেবে গুরুত্বের সাথে পালন করা হয়।
দূর্ঘটনা কবলিত মানুষের পাশে ছাত্রশিবির দেশের বিভিন্ন বড় দূর্ঘটনায় দূর্ঘটনা কবলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে ছাত্রশিবির। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঘটে যাওয়া ‘রানাপ্লাজা ট্রাজেডী’ ছিল দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ শিল্পদূর্ঘটনা। যা বিশ্বের ইতিহাসে ৩য় বৃহত্তম শিল্পদূর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এ দূর্ঘটনায় সরকারি হিসেবেই নিহত হয় ১১৬৭ জন গার্মেন্টস কর্মী। আহত হয় কয়েক হাজার শ্রমিক। দায়িত্বশীল ছাত্রসংগঠন হিসেবে ছাত্রশিবির এ দূর্ঘটনার উদ্ধারকাজে সরাসরি অংশগ্রহন করে। অনলাইনে সার্বক্ষণিক আপডেট জানিয়ে আরও বেশি মানুষকে উদ্ধারকাজে অংশগ্রহনের জন্য উদ্বুদ্ধ করে। উদ্ধারকাজে প্রয়োজনীয় সামগ্রী চেয়ে পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের প্রতি সহযোগিতার আহ্বান জানিয়ে টানা প্রচারণা চালায়।
মেডিকেল ক্যাম্প ও রক্তদান কর্মসূচী দুস্থ ও অসহায় মানুষের জন্য চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করণে ছাত্রশিবির বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসে ‘ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প’ এর মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে। পালন করে থাকে ‘রক্তদান কর্মসূচী’। এছাড়া দেশের প্রতিটি আঞ্চলিক শাখার জনশক্তিরা মূমূর্ষু রোগীদের বিনামূল্যে রক্তদান করে থাকেন। দেশের সর্ববৃহৎ ধূমপানমূক্ত ছাত্রসংগঠন হিসেবে রক্তদানের মাধ্যমে ছাত্রশিবির সারাদেশে জনগণের মাঝে ব্যাপক আস্থা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
মানবাধিকার সচেতনতায় ছাত্রশিবির দেশে কিংবা সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বে যেখানেই শোষিতের চিৎকার সেখানেই মানবাধিকার রক্ষার দাবিতে সোচ্চার কন্ঠে আওয়াজ তুলেছে ছাত্রশিবির। নিপীড়িত মানুষ ও মানবতা রক্ষার জন্য কথা বলেছে সাহসিকতার সাথে। বসনিয়া, চেচনিয়া, আজারবাইজান, ইরাক, কাশ্মীর, ফিলিস্তিন, গুজরাট, মায়ানমার যেখানেই মুসলমান নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে সেখানেই নির্যাতন বন্ধের জন্য বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়ে দেশের সরকার ও আন্তর্জাতিক বিশ্বকে নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে ছাত্রশিবির। ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’ শ্লোগানে মুখরিত করেছে রাজপথ। ভারতে বাবরী মসজিদ ভেঙে ফেলার প্রতিবাদে দেশের তৌহীদি জনতাকে সাথে নিয়ে গড়ে তুলেছে গণআন্দোলন। সভা, সমাবেশ, সেমিনার, বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছে সকল অমানবিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে।
দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ছাত্রশিবিরের রয়েছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। দেশের স্বার্থান্বেষী কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী কর্তৃক চালানো সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার কন্ঠে প্রতিবাদ জানিয়েছে ছাত্রশিবির। দেশের রাজনৈতিক চরম প্রতিকূল পরিবেশ চলাকালীন সময়ে ঝুকিপূর্ণ এলাকায় সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্থাপনা ও বাড়ি-ঘর পাহারা দিয়েছে ছাত্রশিবির। অন্যকোন দেশের মুসলিম নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে যেন কেউ এদেশের কোন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রোশ প্রকাশ না করে তা নিশ্চিত করতে সবসময় সচেতনভাবে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে ছাত্রশিবির।
বিগত কয়েক বছরে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক অপহরণ, গুম, ও নিখোঁজের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পর অপহরণ ও গুমের শিকার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গুমবিরোধী প্রোগ্রামের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি অপহৃত ব্যক্তিদের তাদের পরিবারের নিকট ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছে ছাত্রশিবির। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিমাসে মানবাধিকার প্রতিবেদন পেশ করে থাকে ছাত্রশিবির। যে প্রতিবেদনে দেশের অভ্যন্তরে গুম, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের মত মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় এমন সকল বিষয়ের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়।
সচেতন ছাত্রসংগঠন হিসেবে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন এবং এই পরিস্থিতির উন্নয়নে ছাত্রশিবির ভূমিকা রাখে। প্রতিমাসে ছাত্রশিবির বাংলাদেশের মানবাধিকার প্রতিবেদন পেশ করে। এখানে আমরা হত্যা, গুম, গ্রেপ্তার, নারীর প্রতি সহিংসতা, পারিবারিক সহিংসতা, রাজনৈতিক সহিংসতা, শিশুর প্রতি সহিংসতা, শিশুশ্রম, মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত মানুষেদের কথা এসব রিপোর্টে উঠে আসে। প্রতি মাসের রিপোর্টে মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য ছাত্রশিবির কিছু মৌলিক পরামর্শ এবং প্রস্তাবনা সংযুক্তি করে। ছাত্রশিবির নিজ সংগঠনের পক্ষ থেকে মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য সাধ্যনুসারে চেষ্টা করে।
ইসলাম প্রচারে দাওয়াহ কার্যক্রম ছাত্রশিবিরের লক্ষ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে, আল্লাহ প্রদত্ত রাসূল (সা) এর নির্দেশিত বিধান অনুযায়ী মানবজীবনের সার্বিক পুনর্বিন্যাস সাধন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় গলদ থাকায় এদেশে স্কুল কলেজ এমনকি মাদরাসাতেও ইসলামের সঠিক বক্তব্যের প্রসার নেই। যার দরুণ গোটা জাতি ইসলামের সঠিক শিক্ষা এবং নৈতিক শিক্ষা পাচ্ছে না। এই বিশাল সমস্যার জন্য আজ আমরা দূর্ণিতিপরায়ন জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে পরিচিত। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য স্কুল, কলেজ, মাদরাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলাম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ছাত্রদের মাঝে আমরা কুরআন, হাদীস ও ইসলামী সাহিত্য বিতরণ করে থাকি। কুরআন হাদীস থেকে সরাসরি জ্ঞান আহরণের জন্য আমরা ছাত্রদের এবং আমাদের জনশক্তিদের তাগিদ দিয়ে থাকি। এছাড়াও কুরআন ক্লাস, আলোচনা চক্র, পাঠচক্র, হাদীস পাঠ, দারসুল কুরআন, তাফসীরুল কুরআন মাহফিল, সীরাতুন্নবী মাহফিল আয়োজনের মাধ্যমে ইসলাম প্রচারে দাওয়াহ কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার ছাত্রশিবির ইসলাম প্রচারে এবং ইসলামের সঠিক শিক্ষা প্রচারে ম্যান টু ম্যান দাওয়াতের ব্যবস্থা করেছে।
পাঠাগার বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির মনে করে দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরীর জন্য জনশক্তিদের বই পড়ানোর বিকল্প নেই। তাই ছাত্রশিবির সারা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করেছে কয়েকহাজার লাইব্রেরী। এছাড়াও শিবির প্রতিষ্ঠা করেছে ‘শিবির অনলাইন লাইব্রেরী’। এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম অনলাইন লাইব্রেরীগুলোর অন্যতম।
অন্যান্য কার্যক্রম ছাত্রশিবির সৎ দক্ষ জাতি গঠনে প্রয়োজনীয় সব কর্মকান্ডের এবং ইভেন্টের আয়োজন করে। এরকমই একটা বিভাগ হচ্ছে বিতর্ক। সারাদেশে সবগুলো শাখায় এবং সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জনশক্তিদের বাগ্মীতা বাড়ানো, মুখের জড়তা দূর করা, সঠিক যুক্তির প্রয়োগ, কূটনৈতিক জ্ঞানের শিক্ষা ইত্যাদি যোগ্যতা অর্জনের জন্য বিতর্ক সভার আয়োজন করে থাকে। শিবিরের প্রতিটি শাখায় বিতর্ক ক্লাব রয়েছে। প্রতিবছর বিতর্ক প্রতিযোগীতা এবং কর্মশালার মাধ্যমে হাজার হাজার বিতার্কিক তৈরী হচ্ছে।
খেলাধূলায়ও পিছিয়ে নেই ছাত্রশিবির। খেলাধূলার মাধ্যমে শরীর গঠন, সুস্থ জাতি গঠনে ছাত্রশিবির ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। বিভিন্ন দিবসকে কেন্দ্র করে প্রতিটি শাখা নানান খেলাধূলার আয়োজন করে। প্রতিটি শাখায় একজন ক্রিয়া সম্পাদকের অধীনে ফুটবল টীম, ক্রিকেট টীম গঠিত হয়ে নিয়মিত অনুশীলনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে দেশী খেলাগুলোর মধ্যে হাডুডু, ঘুড়ি ওড়ানো, দৌড় প্রতিযোগীতা, নৌকাবাইচ ইত্যাদির আয়োজন করে থাকে।

Popular Posts