Thursday, April 12, 2018

বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসী এবং রিসালায়ে নুর -আলী আহমাদ মাবরুর


বিংশ শতকে মুসলিম বিশ্বে যে কয়জন বড় মানের শিক্ষাবিদ ও ধর্মীয় সংস্কারক আবির্ভূত হয়েছিলেন তুরস্কের বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসী তার মধ্যে অন্যতম। তার গোটা জীবন, সংগ্রাম এবং সাধনা আমাদের জন্য প্রেরণাদায়ক। নুরসীকে তুরস্কের ইসলামের পুনর্জাগরণ প্রক্রিয়ার অন্যতম ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার জীবনের অনন্যসাধারণ কাজটি হলো রিসালায়ে নুর (ইংরেজিতে বলা হয় দ্য বুক অব লাইট)। মহাগ্রন্থ আল কুরআনকে যেভাবে সাইয়্যেদ নুরসী তার রিসালায়ে নুরে পর্যালোচনা করেছেন, তা অন্য কোন বইতে আমরা সেভাবে আর পাই না। এই গ্রন্থে আমাদের চারিপাশের প্রকৃতি এবং দৈনন্দিন জীবনের সাথে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতকে পর্যালোচনা করা হয়েছে। রিসালায়ে নুর হলো সেই অসাধারণ সৃষ্টি যা বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসীকে আজও চির অম্লান করে রেখেছে।

নুরসী তার জন্মভূমি তুরস্কে উস্তাদ বদিউজ্জামান হিসেবেই বেশি পরিচিত। তিনি এমন একজন বিদ্বান ছিলেন যিনি শুধুমাত্র ইসলামের বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনাই নয় বরং একই সঙ্গে আধুনিক প্রাকৃতিক বিজ্ঞান (সায়েন্স অব ন্যাচার বা ন্যাচারাল সায়েন্স) এবং এর অগ্রগতি সম্বন্ধেও দক্ষ ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন চিন্তাবিদ, তাত্ত্বিক, ধর্মীয় সংস্কারক, শিক্ষাবিদ এবং মানুষের মুক্তি সংগ্রামের লড়াকু একজন সৈনিক। তার শিষ্য বা ছাত্র কয়জন কিংবা কতজন মানুষ তার কাজ থেকে উপকৃত হয়েছে তার কোন সঠিক সংখ্যা এখনো জানা যায় না। কেননা তুর্কি নামক জাতিটির আজকের এই উত্থানের পেছনেও বদিউজ্জামান এবং তার রচনাবলির ঐতিহাসিক ভূমিকা আছে বলেই পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। প্রচন্ড ধরনের প্রতিকূল একটি ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশে থেকেও পুরোটা জীবন জুড়েই তিনি ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে কাজ করে গেছেন। শত নির্যাতনেও তিনি আপস করেননি বরং সার্থকতার সাথে একটি সফল আন্দোলনের সূতিকাগার রচনা করার জন্য নিজ জীবনকে উৎসর্গ করেছেন।
উস্তাদ বদিউজ্জামান ১৮৭৭ সালে তুরস্কের পূর্বাঞ্চলের বিটলিস নামক জেলার অধীনে নুরস্ নামক একটি গ্রামে জন্ম নেন। এই নুরস্ গ্রামে জন্ম নেয়ার কারণেই তার নামের শেষে নুরসী শব্দটি যোগ হয়েছে। তিনি ছিলেন একজন সাইয়্যেদ অর্থাৎ রাসূলের (সা.) বংশধর। পিতার দিক থেকে বিচার করলে তার আদি পুরুষ ইমাম হাসান (রা.) আর মায়ের দিক থেকে তার আদি পুরুষ ইমাম হোসাইন (রা.)।
৯ বছর বয়স পর্যন্ত নুরসী তার পরিবারের সাথেই ছিলেন। সেই সময়ে তার পড়াশোনার হাতেখড়ি হয় বড় ভাই মোল্লা আব্দুল্লাহর কাছে। আব্দুল্লাহও ইসলাম সম্বন্ধে খুব ভালো জ্ঞান রাখতেন। পরে নুরসী খুব অল্প সময়ের জন্য বিভিন্ন মাদ্রাসায় তৎকালীন সময়ের প্রসিদ্ধ আলেমদের সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ পান। ফটোগ্রাফিক মেমোরি (একবার পড়লেই সেটাকে মনে রাখার ক্ষমতা), উৎকর্ষ মানের বুদ্ধিমত্তা এবং অদম্য সাহসের কারণে নুরসী অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। আশপাশের মানুষও তার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিভার জন্য তাকে সমীহ করতে শুরু করে। তৎকালীন সময়ের অটোম্যান আলেমরা শিশু-কিশোরদের জন্য যে সিলেবাস বা কারিকুলাম নির্ধারণ করেছিলেন নুরসী মাত্র তিন মাসের মধ্যে তার পুরোটাই আত্মস্থ করে ফেলেন। তার প্রতিভা দেখে তার শিক্ষক মোল্লা ফেতুল্লাহ তাকে বদিউজ্জামান বা যুগের বিস্ময় নামে অভিহিত করতে শুরু করেন। তার মেধা ও মুখস্থ বিদ্যার কদর করতেন পূর্বতুরস্কের প্রায় সব আলেমই। সেই সময় পর্যন্ত ইসলামিক বিজ্ঞানের ওপর যে ৯০টি রচনাবলি ছিল বদিউজ্জামান নুরসী তার সবটাই বেশ কম সময়ের মধ্যে মুখস্থ করে ফেলেন। অথচ সাধারণভাবে তৎকালীন যে কোন সাধারণ ছাত্র এই একই কোর্সটি সুসম্পন্ন করতে গড়ে ১৫ বছর সময় নিতেন।
নিজ এলাকার পড়াশোনা শেষ করার পর নুরসী চলে যান ভ্যান নামক পূর্ব তুরস্কের একটি প্রদেশে। সেই সময়েই নুরসী প্রথমবারের মতো বুঝতে পারেন যে, বর্তমান সভ্যতার ক্রীড়নকেরা আধুনিক বিজ্ঞানের যে নানা দিক আবিষ্কার করেছেন সেগুলো আসলে মুসলমানদেরকে ভালোভাবে জানতে হবে। কেননা বিজ্ঞানের উৎকর্ষতাকে ভিত্তি করে যদি ইসলামের বার্তা মানুষের কাছে না পৌঁছানো যায় অর্থাৎ ইসলামকে যদি বিজ্ঞানময় হিসেবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করা না যায় তাহলে ইসলামের দাওয়াতি কাজ করে খুব একটা সফল হওয়া যাবে না। এই উপলব্ধি থেকেই তিনি বিজ্ঞানের নানা শাখা ও নানা অগ্রগতিকে আরো গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করেন। এবারও বেশ অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি গণিতশাস্ত্র, প্রাণিবিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, মহাকাশ বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভুগোল এবং দর্শনের ওপর বেশ দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি ভ্যান প্রদেশে জীবনের যে ১৫টি বছর পার করেন তার পুরো সময়টাই তিনি স্থানীয় উপজাতি ও গ্রামবাসীদের শিক্ষক ও পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন। তিনি সেই এলাকায় একটি মাদ্রাসা চালু করেন স্থানীয়ভাবে যার নাম দেয়া হয়েছিল হরহর। এই ১৫ বছর সময়ের মধ্যেই, নুরসী যুক্তিবিদ্যা বিশারদ ইসমাইল গেলেনবেভির বুরহান নামক বইটির উপর একটি নিরীক্ষাধর্মী বিশ্লেষণও রচনা করেন।
ইউরোপীয় আধুনিক বিজ্ঞান এবং ইসলামের প্রথাগত বিজ্ঞানের মধ্যে একটি সমন্বয় সাধন করার উদ্দেশ্যে উস্তাদ নুরসী এই উভয় ধারার বিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে বের করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সেই অনুভূতি থেকেই তিনি পূর্ব তুরস্কে একটি বিশ্ববিদ্যালয় চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। যার নাম দেয়া হয়েছিল ‘মেদরেসেত-উজ জেহরা’। এই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য তার সরকারের সমর্থন দরকার ছিল। সরকারি মহলের কাছ থেকে এই সহযোগিতা পাওয়ার অভিপ্রায়েই নুরসী ইস্তাম্বুলে গমন করেন। ইস্তাম্বুলের ফাতিহ এলাকার যেই বাড়িতে নুরসী সেই সময়ে থাকতেন তার দরজায় তিনি একটি পোস্টার লাগিয়ে রেখেছিলেন। সেখানে লেখা ছিল ‘এখানে সব সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়, সব প্রশ্নের উত্তরও এখানেই মিলে যায়- যদিও এখানে কেউ কোনো প্রশ্ন করে না।’
ধীরে ধীরে ইস্তাম্বুলের আলেমদের সাথেও নুরসীর পরিচয় হয়। তারা নুরসীর কাছে নানা ধরনের জিজ্ঞাসা নিয়ে আসতেন, নুরসীও তার বেশ সুন্দর করে উত্তর দিয়ে দিতেন। তাই নুরসীর ব্যাপারে তারা সকলেই সন্তুষ্ট ছিলেন। ফলে চারিদিকে নুরসীর বেশ সুনামও ছড়িয়ে পড়ে। আসলে নুরসী তার ঘরের দরজায় সেই পোস্টারটি লাগিয়েছিলেন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য আর তার সেই কৌশল বেশ কাজেও দিয়েছিল। কিন্তু যেই সরকারি মহলের সহযোগিতা পাওয়ার আশায় তিনি ইস্তাম্বুলে এসেছিলেন, তা তিনি পাননি, ফলে তার সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নও তখন পূরণ হয়নি। ইস্তাম্বুলের ক্ষমতাসীন খেলাফত সেই সময়ে নানা ধরনের রাজনৈতিক সঙ্কট এবং বিংশ শতকের শুরুতে হুট করে সৃষ্ট হওয়া চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবেলাতেই ব্যস্ত ছিলেন। তাই নুরসীর ডাকে তারা সাড়া দিতে পারেননি। আর এর পরপরই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং তারও পরে তুরস্কে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে পরিস্থিতি পুরোই পাল্টে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে নুরসীকে তার বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পটি স্থগিত করতে হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই নুরসী তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ রিসালায়ে নুর লেখার কাজে হাত দেন। এই বইটিতে ইসলামের বৈজ্ঞানিক চেতনাকে কাজে লাগিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের সকল প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেন। ফলে যেই উদ্দেশ্যে তিনি ‘মেদরেসেত-উজ-জেহরা’ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তার অনেকটাই এই রিসালায়ে নুরের মাধ্যমেই পূরণ হয়ে যায়।
ইস্তাম্বুলে নুরসী আরো বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত করেন। সেই সময়গুলোতে তিনি আসলে রাজনৈতিক ময়দানে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করার মধ্য দিয়ে ইসলামের খেদমত করতে চেয়েছিলেন। ইস্তাম্বুল থেকে আবার ভ্যানে ফিরে আসার পর তিনি স্থানীয় এলাকাবাসীর মধ্যে ইসলাম সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করেন। তিনি গ্রামবাসীকে সেই সময়ে যেই বিষয়গুলো সম্বন্ধে শিক্ষা দিতেন সেগুলোকে পরবর্তীতে এক জায়গায় করে তিনি ‘আল মুনাজারাত’ নামক একটি বইও রচনা করেন। এরপর নুরসী চলে যান দামেস্কে। সেখানে তিনি উমাইয়াদ মসজিদে বেশ কিছু খুতবা প্রদান করেন। সেই খুতবাগুলো পরবর্তীতে ‘দ্য দামেস্কাস সারমন’ নামক একটি বইতে সন্নিবেশিত হয়েছে। নুরসী এরপর যোগ দেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। তিনি ছিলেন একটি ব্যাটালিয়নের কমান্ডার। আর ব্যাটালিয়নের অধিকাংশ সদস্যই ছিল তার ছাত্র। তুরস্কের পূর্বাঞ্চলকে রাশিয়ান দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত রাখার জন্য তিনি সেই যুদ্ধে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধের দিনগুলোতে যখন চারিদিকে গোলাগুলির বিকট শব্দ তখনও ট্রেঞ্চে বসে তিনি শ্রুতিলিখন এবং অনুলিখনের মাধ্যমে ‘সাইনস অব মিরাকুলাস ইনিমিটেবিলিটি’ বা ‘ইশারাত আল ইজাজ’ নামক একটি বই রচনা করেন যা পবিত্র কুরআনের পর্যালোচনা ও ভাষ্য হিসেবে আজও সবর্জন স্বীকৃত হয়ে আছে।
রাশিয়ার সেনারা যখন বিটলিস অঞ্চলটি দখল করে নেয়, তখন তারা নুরসীকে আহত অবস্থায় আটক করে এবং তারা তাকে সাইবেরিয়াতে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে একটি কারাগারে নুরসী আড়াই বছর বন্দী ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়টাতে তিনি কাজ করার মত বা কিছু লেখার মত অবস্থায় ছিলেন না, পরিবেশও ছিলো না তেমন। কিন্তু সেই প্রতিকূলতার মধ্যেও নুরসী তার সহযাত্রী অন্যান্য বন্দীদের মাঝে নিয়মিতভাবে ধর্মীয় আলোচনা করতেন।
একদিন রুশ জেনারেল নিকোলাস বন্দিশিবির পরিদর্শনে এলে সকল বন্দী দাঁড়িয়ে নিকোলাসকে সম্মান প্রদর্শন করেন। কিন্তু বদিউজ্জামান নুরসী না দাঁড়িয়ে বসে থাকলেন। রুশ জেনারেল তাকে জিজ্ঞেস করলেন- বোধ হয় তুমি আমাকে চিনতে ভুল করেছো? নুরসী বসেই উত্তর দিলেন- তোমাকে চিনবো না কেন! তুমি নিকোলাস। রুশ জেনারেল ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললো- যদি তুমি জেনে-বুঝে আমাকে সম্মান প্রদর্শন না করে থাকো, তাহলে তুমি রাশিয়ার ঐতিহ্যের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করেছো। এই কথা শুনার পর ইসলামী আন্দোলনের বিপ্লবী নায়ক বদিউজ্জামান নুরসী নির্ভীক কণ্ঠের এমন সাহসী উচ্চারণের কথা শুনে বন্দিশিবিরে বন্দীরা পুরোপুরি স্তম্ভিত হয়ে গেল। রাগে-ক্ষোভে অপমানে রুশ জেনারেল নিকোলাসের চেহারা লাল বর্ণ হয়ে উঠলো। প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো নিকোলাসের চোখে। এই পরিস্থিতিতে বন্দী শিবিরের অন্যান্য বন্দীরা ভাবলো এখনই বোধ হয় নুরসীকে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করার জন্য নেয়া হবে। কিন্তু উস্তাদ নুরসীর চোখে মুখে ছিল না কোন ভীতির চিহ্ন। তিনি চিন্তাহীন চিত্তে দুনিয়া ও আরশের মালিক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ধ্যানে মগ্ন হয়ে গেলেন। রুশ জেনারেল নিকোলাস রাগান্বিত হয়ে নুরসীকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিয়ে প্রস্থান করলেন।
মৃত্যুদন্ডের আদেশেও নুরসীর মুখের স্নিগ্ধ হাসির সামান্যতম কমতি ছিল না। তিনি দৃপ্ত পায়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার বেদির দিকে এগিয়ে চললেন। রুশ জেনারেল আশ্চর্য হয়ে অপলক দৃষ্টিতে সৌম্য-শান্ত সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটু পরে তাকে হত্যা করে হবে- এটা জানার পরও নুরসীর মুখে ফুটে ছিল স্বর্গীয় হাসি। তারপর উস্তাদ নুরসী মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার আগে দুই রাকাত নামাজ পড়ার অনুমতি চাইলেন। অন্যদিনের চেয়ে তিনি তুলনামূলক দ্রুততার সাথে নামাজ আদায় করলেন। রুশ জেনারেল অবাক হয়ে নামাজের ভেতরে উস্তাদ নুরসীর একাগ্রতা লক্ষ করছিলেন। নামাজ আদায়ের এই দৃশ্য রুশ জেনারেল নিকোলাসের মনে ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি করে। অবশেষে নিকোলাস সাইয়্যেদ নুরসীর মৃত্যুদন্ড মওকুফ করে দিলেন। আর সাইয়্যেদ বদিউজ্জামান নুরসীকে বললেন যে ইসলাম তোমাকে এতটা নির্ভীক ও আত্মমর্যাদাশীল করেছে, আমি সেই ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
শেষ দিকে অবশ্য নুরসী কারাগার থেকে মুক্ত হন এবং সেইন্ট পিটার্সবার্গ, ওয়ারশ এবং ভিয়েনাকে পাড়ি দিয়ে তিনি ১৯১৮ সালের ২৫ জুন আবারও ইস্তাম্বুলে এসে পৌঁছান। এর পরপরই সেখানকার প্রশাসন তাকে দারুল হিকমাতে ইসলামিয়া নামক একটি প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোম্যান সা¤্রাজ্য পরাজিত হয়। এর পরপরই সা¤্রাজ্যের বিশাল একটি এলাকা ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান এবং গ্রিকদের হাতে চলে যায়। ফলশ্রুতিতে দখলদারদের হাত থেকে তুরস্ককে মুক্ত করার অভিপ্রায়ে দেশজুড়ে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়। সেই যুদ্ধে নুরসী ‘কুভা-ই-মিল্লিয়ে’ বা ন্যাশনাল ফোর্সকে নানাভাবে সহযোগিতা করেন, উৎসাহ প্রদান করেন। আংকারায় থাকা সরকারও নুরসীর এইসব কাজে খুশি হয়ে তাকে আংকারাতে আমন্ত্রণ জানায়। আমন্ত্রণ পেয়ে নুরসী আংকারায় গেলে সেখানে তাকে উষ্ণ সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। তবে নিজে ভালো সংবর্ধনা পেলেও আংকারার প্রশাসনিক ব্যক্তিদেরকে দেখে নুরসী মোটেও সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি লক্ষ্য করেন যে, পার্লামেন্টে যেসব ডেপুটি কাজ করছেন তাদের অধিকাংশই ধর্ম সম্বন্ধে খুবই অসচেতন এবং ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে তাদের তেমন একটা আগ্রহও নেই। এমনকি তাদের অধিকাংশই নিয়মিত নামাজও আদায় করে না।
এই পরিস্থিতি দেখে নুরসী তাদের সামনে একটি ঐতিহাসিক বক্তব্য দেন যাতে তিনি নামাজের গুরুত্ব ও ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে চলার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। এর পর দেখা যায় যে, পার্লামেন্টের অনেক ডেপুটি নামাজ পড়তে শুরু করেছেন। কিন্তু নুরসীর এই কার্যক্রম এবং পার্লামেন্ট ডেপুটিদের ওপর তার এই প্রভাব সেক্যুলার নেতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্ককে অসšুÍষ্ট করে তোলে। নুরসীকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে আতাতুর্ক তাকে প্রথমে পার্লামেন্ট সদস্য হওয়ার এবং গোটা পূর্ব তুরস্কের ধর্মীয় প্রকল্পগুলোর প্রধান হওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু নুরসী সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এর পরই তিনি আধ্যাত্মিক চর্চায় মনোনিবেশ করেন। ১৯২৪ সালে যখন অটোম্যান খেলাফতের পতন হয় তখন কুর্দিস্তান থেকে শায়খ সাইয়্যেদেও বিদ্রোহ নামক একটি বিদ্রোহের উত্থান হয়। যদিও এই বিদ্রোহে তার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না তথাপি এই বিদ্রোহে মদদ দেয়ার অভিযোগেই নুরসীকে ১৯২৫ সালে ইস্তাম্বুলে নির্বাসনে পাঠানো হয়। ইস্তাম্বুল থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বুরদুর নামক একটি এলাকায়। এর পর তাকে নেয়া হয় ইসপার্তায়। একটা পর্যায়ে তাকে জোরপূর্বক ইসপার্তার বারলা নামক একটি গ্রামে গৃহ অন্তরীণ করে রাখা হয়। গৃহবন্দী রাখার কারণে প্রশাসন যেমন তার ওপর নজরদারি করতে সক্ষম হয় এবং একই সঙ্গে সাধারণ মানুষগুলোর সাথেও তার মেলামেশাটি নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়।
১৯২১ সালের আগ পর্যন্ত নুরসীর যেই জীবন, তখন তিনি কিছুটা হলেও বিশ্বরাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। বিশ্লেষকরা এই সময়টাকে ‘সাইয়্যেদের প্রথম অধ্যায়’ নামে অভিহিত করেছেন। আর ১৯২১ সালের পরের থেকে জীবনের বাকি অংশটিকে তারা ‘সাইয়্যেদের দ্বিতীয় অধ্যায়’ নামে সংজ্ঞায়িত করেছেন। জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়টিতেই বদিউজ্জামান নুরসী অন্যসব বৈষয়িক বিষয়াদি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে কুরআনের সাধনায় ব্যস্ত করতে শুরু করেন। এই সময়েই তার অনবদ্য সৃষ্টি রিসালায়ে নুর গ্রন্থটিও তিনি রচনা করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নুরসী আসলে মুসলমানদের ঈমান সুরক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। বিশেষ করে নাস্তিকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রভাবে মুসলমানদের ঈমান যেভাবে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ছিল তাকে প্রতিরোধ করে ঈমানের দৃঢ়তা বৃদ্ধি করার জন্য তিনি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তার এই ধরনের কার্যক্রমের জন্য তিনি বার বার কারাবন্দী হয়েছেন, নির্বাসনে গিয়েছেন। তাকে বিষ খাইয়ে হত্যা করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে কয়েকবার। আর সবশেষে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারণা চালানোর মিথ্যা অভিযোগে তার বইগুলোর ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে প্রশাসন।
বারলাতে সাইয়্যেদ নুরসী দীর্ঘ ৮টি বছর নির্বাসনে ছিলেন। এই সময়ের মধ্যেই তিনি রিসালায়ে নুরের তিন-চতুর্থাংশ রচনা করতে সক্ষম হন। তার এই বইটিতে গোটা তুরস্কে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তিনি একটি নতুন ধরনের কৌশল আবিষ্কার করেন। আজ অবধি এই ধরনের কৌশল দ্বিতীয়টি আর কোথাও দেখা যায়নি। তিনি শর্ত আরোপ করেন যে, যারাই তার ছাত্র হতে চাইবে তাদেরকে তার লেখা এই রিসালায়ে নুরের একটি কপি আরবি অক্ষরে লিখে দিতে হবে। সেই সাথে নতুন আরেকজন লোককেও খুঁজে নিয়ে আসতে হবে যেও কিনা একটি কপি লিখবে। অর্থাৎ একজন ছাত্রকে দিয়ে তিনি দু’টি কপি লিখিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। ইসপার্তা এবং বারলাতে তার যত ছাত্র ছিল, তারা সবাই তার ডাকে সাড়া দিয়ে রিসালায়ে নুরের একটি অনুলিপি লিখে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে রিসালায়ে নুরকে তারা গোপনে বিতরণ করতেও শুরু করেন। এভাবে শুধু বারলা বা ইসপার্তা নয়, একটা সময়ে গোটা তুরস্কেই রিসালায়ে নুর ছড়িয়ে পড়ে।
রিসালায়ে নুরের এই জনপ্রিয়তায় ক্রুদ্ধ হয়ে প্রশাসন সাইয়্যেদ নুরসীকে বারলা থেকে ইসপার্তায় স্থানান্তর করে। এরপরও তারা ক্ষান্ত হয়নি। বরং তাকে আরো ১২০ জন ছাত্রসহ ‘এসকিসেহির’ নামক একটি কারাগারে প্রেরণ করে। তাদের বিরুদ্ধে সরকারের পতন ঘটাতে নতুন সংগঠন তৈরি করার অভিযোগ আনা হয়। লম্বা একটি সময় পর ‘এসকিসেহির’ কারাগার থেকে নুরসী মুক্তি পান। এরপর তাকে আবারও কাস্তামনু প্রদেশে নির্বাসনে পাঠানো হয়। সেখানেও তিনি ৮টি বছর নির্বাসনে পার করেন। নুরসীকে থামানোর এত চেষ্টার পরও তার রিসালায়ে নুরের লেখা এবং বিতরণকে বন্ধ করা যায়নি। প্রতিটি ছাত্র নতুন নতুন ছাত্রকে দিয়ে একটার পর একটা অনুলিপি সৃষ্টি করতে থাকে। ফলে একদিকে যেমন নুরসীর শিষ্য সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে ঠিক তেমনিভাবে গোটা আনাতোলিয়ার প্রতিটি গ্রামে গ্রামে নুরসীর রিসালায়ে নুরও পৌঁছে যায়।
১৯৪৩ সালে সাইয়্যেদ নুরসী এবং তার ১২৬ জন ছাত্রকে ডেনিজলির হাইকোর্টে পাঠানো হয়। আংকারার দক্ষ একদল শিক্ষাবিদ এবং বিচারপতিদেরকে দিয়ে একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয় যারা রিসালায়ে নুরের প্রতিটি তথ্য পর্যালোচনা করেন। তাদের পর্যবেক্ষণে তারা বইটিতে কোনো ক্ষতিকর কিছু পাননি বলে জানান। এর পরই ১৯৪৪ সালে নুরসীকে সকল অভিযোগ থেকে খালাস দেয়া হয়। বিচার চলাকালীন সময়ে নুরসী ৯টা মাস জেলে ছিলেন। এই সময় তাকে তার কোন ছাত্রের সাথে সাক্ষাৎ করতে দেয়া হয়নি। এবারও বেশ কয়েক দফা তার ওপর বিষ প্রয়োগ করা হয়। নুরসীকে আবার নিয়ে যাওয়া হয় এমিরদাগে, সেখান থেকে আফইয়োনে। তবে যতই নির্বাসনে বা কারাবরণে নেয়া হোক, নুরসী এক মুহূর্তের জন্যও তার কাজ বন্ধ করেননি।
পরবর্তী সময়ে অবশ্য প্রশাসন তার বইগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। ১৯৫০ সালে তুরস্কে বহুদলীয় প্রথা চালু হওয়ার পর প্রথম নির্বাচনেই ডেমোক্রেটিক পার্টি বিজয় লাভ করে। এর পরই আসলে নুরসী এবং তার শিষ্যরা কিছুটা হলেও স্বাধীনতা ভোগ করতে শুরু করেন। সারাটি জীবন কুরআনের চর্চায় লিপ্ত থাকার পর ১৯৬০ সালের ২৩ মার্চ ২৫ রমজান উস্তাদ বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসী ইন্তেকাল করেন। পরের দিন উলু মসজিদে লক্ষ লক্ষ মানুষ তার জানাজায় অংশ নেয়। তারপর তাকে হালিলুর রহমান নামক মসজিদ সংলগ্ন গোরস্থানে দাফন করা হয়। এর ঠিক দুই মাস পর তুরস্কে একটি সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় যার পরপরই তুরস্কে নতুন করে এক অন্ধকার অধ্যায়ের সূচনা হয়। একদল পথভ্রষ্ট সেনাকর্মকর্তা ১৯৬০ সালের ১২ জুলাই আবারও উস্তাদ নুরসীর কবরকে আক্রমণ করে। তারা এই মহান কুরআন সাধকের মৃতদেহ সেই গোরস্থান থেকে উঠিয়ে নেয় এবং অজানা একটি জায়গায় নিয়ে যায়- যার পরবর্তী গন্তব্য সম্বন্ধে নিশ্চিতভাবে কিছু আর জানা যায়নি।
মৃত্যুর আগ দিয়ে বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসী তার অন্যতম ঘনিষ্ঠ ছাত্র এবং রিসালায়ে নুর রচনার নেপথ্যের অন্যতম সহযোগী সাইয়্যেদ আহমেদ হুসরেভ এফেন্দিকে তার পরবর্তী দায়িত্বশীল হিসেবে নিয়োগ দিয়ে যান- যার একমাত্র দায়িত্ব হবে নুরসীর মৃত্যুর পর রিসালায়ে নুরের এই প্রকল্পটিকে পূর্বের গতিতেই অব্যাহত রাখা।
নুরসী যতদিন জীবিত ছিলেন, তখনই হুসরেভ এফেন্দি তার ঘনিষ্ঠ মহলে ‘উস্তাদ আল থানি’ বা দ্বিতীয় গুরু হিসেবে পরিচিত ছিলেন। হুসরেভ এফেন্দি ছিলেন খুবই দক্ষ একজন ক্যালিওগ্রাফি শিল্পী। নুরসী জীবিত থাকা অবস্থায় হুসরেভ এফেন্দি ততদিন রিসালায়ে নুর অনুলিপিকরণ এবং বিতরণের মূল দায়িত্বে ছিলেন। সকল ছাত্রের মধ্যে নুরসী একমাত্র তাকেই রিসালায়ে নুরে কোন ধরনের সংযোজন, সংশোধন বা বিয়োজনের অধিকার দিয়েছিলেন। আর তিনি সেই দায়িত্ব অত্যন্ত সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছিলেন। বিশেষ করে নুরসী যতদিন জেলে ছিলেন, তিনি তখন রিসালায়ে নুর নামক প্রকল্পটি যোগ্যতার সাথেই অব্যাহত রাখতে পেরেছিলেন।
উস্তাদ নুরসীর ইন্তেকালের পর হুসরেভ এফেন্দি আগের মতই তার কাজ অব্যাহত রাখেন। তিনি রিসালায়ে নুরের মূল চেতনা রক্ষার ব্যাপারে একটুও আপস করেননি। বরং রিসালায়ে নুরকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে এবং গোটা তুরস্কের মানুষের ঈমান ও আমলকে সুরক্ষা এবং তা আরো মজবুত করার ব্যাপারে তিনি কার্যকর উদ্যেগ গ্রহণ করেন। এ ছাড়াও উস্তাদ নুরসীর দিকনির্দেশনা মুতাবিক তিনি কুরআনের একটি তাফসির কপিও প্রস্তুত করেন। কুরআনের এই নতুন ধারার তাফসিরের নাম দেয়া হয় ‘তেভাফুকলু কুরআনে কারীম বা দ্য কুরআন ইন কনগ্রুয়াস অ্যালাইনমেন্ট’। উল্লেখ্য, কুরআন পড়তে পড়তেই উস্তাদ নুরসী একটা সময় আবিষ্কার করেন যে দুই একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কুরআনে বর্ণিত আল্লাহর সকল নাম, সিফাতি নামগুলো যেমন আল্লাহ, রব এবং কুরআন এবং কুরআনের অন্য সব শব্দ, একে অন্যের সাথে সম্পর্কিত। হয় একই পৃষ্ঠায় একটি শব্দের সাথে সম্পর্কিত শব্দগুলোকে পাওয়া যায় বা অন্য কোনো পৃষ্ঠায়। কুরআনের শব্দগুলোর এহেন মিল ও সাদৃশ্যকে উস্তাদ নুরসী কুরআনের আরেকটি মোজেজা হিসেবে সনাক্ত করেন।
যাহোক, উস্তাদ বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসীর ইন্তেকালের পর হুসরেভ এফেন্দির হাত ধরেই পরবর্তীতে তুরস্কে হায়রাত ফাউন্ডেশনের জন্ম হয় যারা আজ অবধি উস্তাদ বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসীর কার্যক্রম ও সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করছে এবং বিশ্বজুড়ে নুরসীর আবিষ্কার ও চেতনাকে বিশেষ করে রিসালায়ে নুরকে ছড়িয়ে দেয়ার কাজটি করে যাচ্ছে।
এবার আসা যাক, রিসালায়ে নুর প্রসঙ্গে। রিসালায়ে নুর মহাগ্রন্থ আল কুরআনের উপর অনন্যসাধারণ একটি গবেষণাগ্রন্থ হিসেবে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত হয়ে আছে। ইসলামিক ধর্মতত্ত্বের ওপর বিগত ২০০ বছরে যতগুলো পুস্তক রচিত হয়েছে রিসালায়ে নুর তার মধ্যে অন্যতম। এতদিন পশ্চিমের অনেক জায়গাতেই অবশ্য রিসালায়ে নুর তেমন একটা পরিচিত ছিল না। এমনকি অনেক মুসলমানও এই বিষয়ে ততটা অবগত ছিলেন না, তবে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে এখন পাল্টাচ্ছে। মোট ১৩০টি অধ্যায়ে এই বইটি বিভক্ত এবং মোট পাতার সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। ধর্মতত্ত্ব, ধর্মদর্শন এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামের ব্যাপারে যেসব প্রশ্ন তোলা হয় তার অনেকগুলোই পাওয়া যাবে এই বইটিতে। রিসালায়ে নুরটি রচনা করা হয় ১৯২৬ থেকে ১৯৪৯ সালের মধ্যে। রিসালায়ে নুর নিয়মিত অধ্যয়ন করেন এমন পাঠকেরা দাবি করেন যে, রিসালায়ে নুরের অধ্যয়ন তাদের মধ্যকার ঈমানের দৃঢ়তাকে মজবুত করেছে, আধ্যাত্মিক শক্তিকে বলিষ্ঠ করেছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতাকেও শানিত করেছে। রিসালায়ে নুর অধ্যয়নে বিবেকের কাছে তারা আরো পরিষ্কার হয়েছেন, আল্লাহ তায়ালার প্রতি আত্মসমর্পণের মাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ইসলামকে আরো গভীরভাবে জানার আকাক্সক্ষাও তৈরি হয়েছে বলে এই পাঠকেরা জানান।
পাঠকদের মতে রিসালায়ে নুর কোন সাধারণ গ্রন্থ নয় বরং এটি ইসলামের শরিয়তের নির্দেশিত ইবাদতের একটি পদ্ধতি বা মেথোডোলোজি নিরূপণ করেছে। আর রিসালায়ে নুরের বিষয়বস্তু কোনদিনই সেকেলে হবে না, এটা এতটাই প্রাসঙ্গিক যে বর্তমান সামাজিক ও বৈশ্বিক কাঠামোতেও বইটা একই রকম জীবন্ত হয়ে রয়ে গেছে। রিসালায়ে নুরকে আবার গতানুগতিক তাত্ত্বিক কোনো বই হিসেবেও বিবেচনা করা যাবে না বরং এটা ভীষণ রকমের ব্যবহারিক একটি বই। রিসালায়ে নুর গ্রন্থটিতে অনেকগুলো ‘কেন’ এবং ‘কিভাবে’ প্রশ্নের উত্তরও মিলবে। বইটিতে মহাবিশ্বের গঠন ও পরিচালনা নিয়েও ইসলামের ব্যাখ্যাগুলোকে সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। বিশেষ করে অসীমতা বা ইনফিনিটি বা কন্টিজেন্সি বিষয়ে বিজ্ঞান যেসব বিতর্ক উত্থাপন করেছে তারও উত্তর এই বইটিতে পাওয়া যাবে।
কুরআনের বিভিন্ন কালামকে যৌক্তিকভাবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে রিসালায়ে নুর আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও একক নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতাকে প্রমাণ করেছে। শেষ বিচারের দিন এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থান নিয়ে যারা সন্দেহ পোষণ করেন তারাও তাদের কৌতূহল মিটাতে পারবেন এই বইটি থেকে। যারা নবী মোহাম্মাদ (সা.) সত্যিকারভাবেই আল্লাহর রাসূল কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখান তারাও খুব স্পষ্ট উত্তর এই বইটি থেকে পেয়ে যাবেন। একইসঙ্গে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, পৃথিবীর সৃষ্টি, বিবর্তনবাদ প্রভৃতি বিষয়ে ইসলামের অবস্থান ও মূল্যায়নও বইটিতে পাওয়া যাবে।
একই সঙ্গে আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের নানা প্রশ্নের উত্তরও মিলবে রিসালায়ে নুরে। বিশেষত সাধারণ প্রচলিত জ্ঞানের বাইরে ঐশ্বরিক জ্ঞান কিভাবে একজন মানুষকে পরিণত করে কিংবা বৈষয়িক জীবন দর্শন কিংবা অল্পে তুষ্ট হয়ে জীবন ধারণ করার ব্যাপারে অথবা আল্লাহর নেয়ামতকে ব্যবহার করার মাধ্যমে কিভাবে আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করা যায় তার কিছু উপায় এই বইটিতে পাওয়া যাবে। বয়স হয়ে গেলে অনেকেই হীনমন্যতায় ভুগেন, হতাশ হয়ে পড়েন কিন্তু এই বইটিতে প্রবীণদের নিয়ে একটি অধ্যায় রয়েছে যেখানে বলা হয়েছে যে, বয়স্ক হওয়াও আল্লাহ তায়ালার একটি নেয়ামত এবং তাই সেই বয়সে পৌঁছে হতাশা নয় বরং তৃপ্তি নিয়ে বেঁচে থাকা দরকার।
পাশাপাশি, মুসলমানরা কেন সভ্যতার বিনির্মাণে এবং জ্ঞান অর্জনের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়লো, ইসলামে নারীদের কি অবস্থান বা সম্মান নির্ধারণ করা হয়েছে, কিংবা হুদুদের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কি, দাস প্রথা নিয়ে ইসলামের বক্তব্য কি- সেগুলোও জানা যাবে এই রিসালায়ে নুর থেকে। আমরা কিভাবে অন্য ধর্মের মানুষগুলোকে মূল্যায়ন করবো কিংবা কিভাবে তাদের সাথে সহাবস্থান করবো সেই প্রক্রিয়া সম্বন্ধেও এই বইটি থেকে আমরা ধারণা পাবো। এক কথায় বলতে গেলে উস্তাদ বদিউজ্জামান সাইয়্যেদ নুরসী রচিত এই রিসালায়ে নুর বা বুক অব লাইটটি প্রকৃতার্থেই আলোকময় একটি বই, যা আলোর দিশারি হয়ে মুসলমানদেরকে আলোর পথে নির্দেশনা দেবে বহুযুগ।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রার্থনা, যিনি এই বইটি লিখেছেন, যারা এর অনুলিপি রচনা করেছেন কিংবা যারা প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তিগতভাবে বইটিকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি যেন তাদের সবাইকে তাদের পরিশ্রমের এবং আত্মত্যাগের উত্তম জাজা দান করেন। আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক

Tuesday, April 10, 2018

আফগানিস্তানে সোভিয়েত রাশিয়া বিরোধী জিহাদ, তা*লে*বান এবং জামায়াতে ইসলামী

-  শাহাদাতুর   রহমান   সোহেল


আমরা জানি আফগান মুজাহিদ সংগঠনগুলো বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী দীর্ঘ জিহাদের মাধ্যমে সোভিয়েত রাশিয়া পরাশক্তিকে আফগানিস্তানের মাটিতে পরাজিত করেছে। এই পরাজয়ই সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাংগনকে তরান্বিত করেছে। যার ফলে শধ্য এশিয়া ছয়টি মুসলিম রাষ্ট্রের স্বাধীন অভ্যুদয় সম্ভব হয়েছে। আফগানিস্তানের মুজাহিদ সংগঠনগুলোর  মধ্যে সবচেয়ে বড় দু'টি সংগঠন ছিল - (ক) হেজবে ইসলামী এবং (খ) জমিয়তে ইসলামী। এর মধ্যে জমিয়তে ইসলামী গড়ে তুলেছেন প্রফেসর বোরহানুদ্দীন রাব্বানী। তিনি এই সংগঠন গেড় তুলেছেন জামায়াতে ইসলামী রচিত বিপ্লবী ইসলামী সাহিত্য দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে। আর সবচেয়ে বড় মুজাহিদ সংগঠন, আফগান জিহাদের সর্বাধিক ভূমিকা পালনকারী, পশতুনদের সংগঠন এবং গুলবুদ্দীন হেকমতিয়ারের নেতৃত্বাধীন হেজবে ইসলামী জামায়াতে ইসলামীরই তত্ত্বাবধানে পরিচালিত মুজাহিদ সংগঠন ছিল। পরবর্তীকালে তাদের কোন ভুলত্রুটি থাকলে ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাদের জিহাদের গৌরব উজ্জ্বল ভূমিকা অনস্বীকার্য ঐতিহাসিক সত্য। রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগান জিহাদে বিজয়ে ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর অবদানই অবশ্যই অগ্রগামী। এখানে সাইয়েদ মুজতাবা হুসাইনের একটি উক্তি উল্লেখ্য: ‍‘‘বর্তমানে আফগানিস্তানে ইসলামী বিপ্লবের জন্য রুশের ন্যায় শক্তির বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম চলছে তা মওলানা মওদূদী রহ: ইসলামী তাবলীগের ফলশ্রুতি” (দৈনিক জাসারাত, সেপ্টেম্বর, ১৯৭৯, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দৃষ্টিতে জামায়াতে ইসলামী ও মাওলানা মওদূদী, সংগ্রহে: সাইয়েদ রাফে সামনান)

               রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগান জিহাদের পরবর্তীকালে উক্ত জিহাদকারী মুজাহিদ সংগঠনগুলোর ব্যর্থতার পটভূমিতে গড়ে উঠা তালেবান আন্দোলনে সাবেক হেজবে ইসলামীর বেশীর ভাগ মুজাহিদ কমান্ডার ও মুজাহিদ সৈনিকরা রয়েছেন। তারা জামায়াতে ইসলামীর তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছেন। তালেবান হচ্ছে পাকিস্তানের জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের দ্বারা প্রভাবিত সংগঠন। এই জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম দীর্ঘ বহু বৎসর যাবৎ জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের সাথে জোটভুক্ত আছে। অনলাইন মুক্ত বিশ্বকোষ wikipedia.org-তে বলা হয়েছে:  আদর্শিক প্রভাবক: তালেবানের ধর্মীয়/রাজনৈতিক দর্শন, বিশেষ করে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তার প্রথম শাসনামলে, প্রধান মুফতি রশিদ আহমদ লুধিয়ানভি এবং তার কাজ দ্বারা ব্যাপকভাবে উপদেশ ও প্রভাবিত হয়েছিল। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংগঠনের পরিচালিত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নীতিগুলি অবশ্য আবুল আ'লা মওদুদী ও জামায়াত-ই-ইসলামী আন্দোলনের অনুকরণে তৈরি করা হয়েছিল

                তালেবান নেতা আব্দুল হাকিম মুজাহিদ ১৯৯৮ সালে আগষ্ট নয়াদিল্লীর দাওয়াত পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন। সেখানে তাকে প্রশ্ন করা হয়। ‘‘কিন্তু হেকমাতিয়ারের বিরুদ্ধে জিহাদী পদক্ষেপের দরুন আপনাদের অন্তরে কি কেবল কোমল অনুভূতি সৃষ্টি হতে পারে না? এ প্রশ্নের জবাবে উক্ত তালেবানের নেতা বলেন: ওদের সংগে আমাদের কিসের বিবাদ?........আমরা আফগানিস্তানে শরীয়ত চালু করেছি। রাব্বানী-হেমতিয়ার-মাসুদ আমাদের সহযোগিতা করুন, আমরা ওদেরকে বুকে তুলে নেবো” ( দৈনিক সংগ্রাম, ৩০শে অক্টোবর ১৯৯৮ইং)।

                আফগানিস্তানের তালেবানদের বিরুদ্ধে ইহুদীবাদী আন্তর্জাতিক সংবাদে মাধ্যমগুলো জোরালো অপপ্রচার রয়েছে। এ প্রসঙ্গে কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও সামগ্রিক প্রয়োজনে উক্ত তালেবান নেতার নারী শিক্ষার বিষয়ে একটি বক্তব্য উল্লেখ্য: ‘‘আমরা নবী করিম সা: এর এই বাণীকে উপেক্ষা  করতে পারি করে যাতে বলা হয়েছে শিক্ষা অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ বা আবশ্যক। আমি তো আগোই বলেছি, আফগানিস্তানে এখন মেয়েদের শিক্ষা অর্জন ও চাকরী গ্রহণের অধিকার রয়েছে কিন্তু সীমা ও শর্তের মধ্যে। আমাদের কাছে আসলে কি চাওয়া হচ্ছে? আমর কি হেজা বিরোধিতার সূত্রপাত ঘটাব? এমনটা কেমন করে সম্ভব? (সূত্র পূর্বোক্ত) উক্ত তালেবান নেতার অপর একটি বক্তব্য এখানে উল্লেখ্য যে: ‘‘মক্কা বিজয়ের পর নবী করিম (সা:) কাবাঘরে গমন করেন এবং মকামে ইব্রাহীম এর আসল ভিত্তি ঠিক রেখে মুশরিকদের নির্মিত বাহুল্য ও সীমালংঘিত অংশগুলোকে অপসারনের ব্যাপারে বিবেচনা করেন। অতএব তিনি আপন সিদ্ধান্ত বদলে দেন এবং বাড়ী ফিরে উম্মৎ জননী হযরত আয়েশা (রা:) কে সম্বোধন করে বলেন,  হে হুমাইরাহ! আমি চাই মাকামে ইব্রাহীমকে কায়েম রেখে গোটা কাবাঘর পূণর্নির্মান করতে, কিন্তু আমার আশংকা হচ্ছে, এমন করলে লোকেরা অসন্তোষ ছড়াবে। এঘটনা থেকে আপনি অনুমান করতে পারেন যে, ইসলাম প্রাচীন ঐতিহ্য বা সংস্কারকে শ্রদ্ধা জানায় এবং সে মানব সমাজের ধ্যান-ধারনাকে সামনে রেখে তাদের প্রতি মনোযোগ দেয় (সুত্র: পূর্বোক্ত)। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ছোটখাট ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিয়েও যারা বিবাদ বা বিতর্ক সৃষ্টি করে এমন বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের জন্য উক্ত তালেবান নেতার উদার বক্তব্য অবশ্যই শিক্ষণীয়।

                  এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ২০০১ সালের  নাইন - ইলেভেন-এর পর ন্যাটো জোটের সহায়তায় আফগানিস্তানে আমেরিকার আগ্রাসনের সময় গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার তালেবানকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। তার অনুগত হেজবে ইসলামীর মুজাহিদদেরকে তালেবানের সহায়তায় যুদ্ধের আহ্বান জানান। পরে আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের পতন হয়। এরপর তালেবানরা আমেরিকা সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদ অব্যাহত রাখে। এদিকে ইসলামপন্থী নেতা ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার বেশ কয়েক  মাস ধরে আলোচনা শেষে প্রায় ২০ বছর পর ২০১৭ সালে কাবুলে ফিরেন গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার। এখানে উল্লেখ্য, তালেবানদের মতই গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার একই পশতুন গোষ্ঠীতুক্ত। পশতুনরা আফগানিস্তানের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। 

পূর্ববর্তী তালেবান সরকারের প্রতি 
বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন
            বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর, মোমতাজুল মোহাদ্দেসীন মাওলানা আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ পূর্ববর্তী তালেবান শাসনাধীন আফগানিস্তান সফরের  বর্ণনা দিতে যেয়ে বলেন: “আমরা প্রবেশ পথ দিয়ে আফগানিস্তানের উপজাতীয় এলাকায় প্রবেশ করে আফগানিস্তানস্থ সীমান্তের কাস্টমস অফিস থেকে যাবতীয় অনুস্ঠানাদি সেরে সোজা আফগানিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী জালালাবাদের দিকে রওয়ানা হই। রাত আটটা নাগাদ জালালাবাদ উপস্থিত হয়ে প্রটোকল অফিসারের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি আমাদেরকে সরকারী গেস্ট হাউসে পৌছিয়ে দেন। এখানেই আমাদের থাকার ও খানাপিনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমরা এশার নামায আদায় করে রাতের খানা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আমি জালালাবাদ পৌঁছেই প্রটোকল অফিসারের কাছে কাবুল যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করি। তিনি বললেন, জালালাবাদ হতে সপ্তাহে মাত্র ১ দিন বিমান সার্ভিস চালু আছে। সুতরাং ৫/৬ দিনের আগে আপনি কোন বিমান পাচ্ছেন না। একথা শুনে আমি কাবুল সফরের পরিকল্পনা বাদ দেই এবং জালালাবাদের গভর্ণেরর সাথে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার জন্য তাকে অনুরোধ করি। ডেপুটি গভর্ণরের সাক্ষাৎ: পরের দিন ভোরে নামায, পায়চারী ও গোসল শেষ করে নাস্তা করে নেই। নাস্তার সময় প্রটোকল অফিসরা খবর দেন যে, আজই অর্থাৎ ২রা নভেম্বর বেলা ১১টায় গভর্ণর হাউসে ডেপুটি গভর্ণর জনাব মোল্লা সাদরে আমল আমাকে সাক্ষাতের সময় দিয়েছেন। কেননা গভর্ণর ঐদিন জালালাবাদে ছিলেন না। আমি আমার সাথী সীমান্ত প্রদেশের আমীর এডভোকেট ইব্রাহীম সাহেবকে নিয়ে ১১টা বাজার সামান্য পূর্বে গভর্ণর হাউজে হাজির হই। ওয়েটিং রুমে কিছুক্ষণ অবস্থান করার পরেই ডেপুটি গভর্ণর আমাদেরকে সাক্ষাৎকার দেন। পারস্পরিক সালাম, মোসাফাহা, কোলাকুলি ও কুশল বিনিময়ের পরে ডেপুটি গভর্নরের সাথে আমার আলোচনা শুরু হয়। আমি আমীরে জামায়াতে জনাব গোলাম আযম সাহেব ও জামায়াত নেতৃবৃন্দের সালাম তাকে পৌঁছাই এবং অনুরোধ করি তিনি যেন আমার এবং আমীরে জামায়াতের সালাম আফগানিস্তানের আমীরুল মোমেনীন মোল্লা মোহাম্মদ ওমর আল মুজাহিদকে পৌঁছান। আমি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর এ পরিচয় তার কাছে থাকলেও ১৯৬২ সনের পাক পার্লামেন্টে আমি ও সীমান্ত প্রদেশের মুফতি মাহমুদ এক সঙ্গে সদস্য ছিলাম একথা তাকে অবহিত করি। আফগানিস্তানে মুফতি মাহমুদ এক সর্বজন পরিচিত ব্যক্তিত্ব। তিনি এক সময় সীমান্ত প্রদেশের চীফ মিনিস্টারও ছিলেন। ১৯৮৯ সনে আফগানিস্তান থেকে রাশিয়ার বের হয়ে যাওয়ার পর মুজহেদীনদের পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধে আমরা যে খুবই মর্মাহত ছিলাম একথা তাকে বলি। অত:পর বর্তমান তালেবান সরকার কাবুলসহ দেশের প্রায় ৯৫% ভাগ ভূ-ভাগ দখল করে দেশে শান্তি ও নিরাপত্তা বহাল করায় জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ তালেবান সরকারের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন দান করেছে সে কথাও তাকে অবহিত করি। আমি আরবী ভাষায় তার সাথে কথা বলছিলাম এবং তিনি আমার কথা বুঝতে ছিলেন।  অত:পর তিনি কথা শুরু করেন। তিনি প্রথমেই বলেন যে, অবশ্যই জামায়াতে ইসলাামী আফগান জিহাদে দেশকে রুশ কবল মুক্ত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে আমাদের বিশ্বাস জামায়াতের এই ভূমিকা কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠির জন্য ছিল না। ছিল নীতি ও আদর্শের জন্য ।  তালেবান সরকার গৃহযুদ্ধের অবসান করে ঐ নীতি ও আদর্শ অর্থাৎ শরিয়তের আইন সারাদেশে চালু করেছে যার জন্য জামায়াতে ইসলামীসহ দুনিয়ার ইসলামী আন্দোলনসমূহ আফগান জিহাদে সাহায্য ও সমর্থন দিয়েছিল(`আফগানিস্তানে যা দেখেছিগ্রন্থ)

                   ইতিপূর্বে উল্লেখিত তালেবানদের সাথে আলোচনার প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে আমেরিকার সাথে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সমঝোতাকারী হিসাবে উপস্থিত ছিলেন তুর্কি প্রতিনিধিদল। আর বর্তমান তুরস্ক সম্পর্কে অন্যত্র বলা হয়েছে।  আর তালেবানদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগের কেন্দ্র কাতার।  কাতার হলো বর্তমানে জামায়াত-ইখওয়ানীদের সমাবেশস্থল। এখানে একটি কথা উল্লেখ্য যে, প্রথম তালেবান নেতা মোল্লা ওমর আল্লামা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীকে উস্তাদ সম্মোধন করতেন। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির বিরুদ্ধে আফগান ও পাকিস্তান তালেবান তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। 

Edited time: july-2020


আফগানিস্তানে তালিবান বিজয়ের পর নীচের অংশটুকু এড করলাম:

আমি ২০২১ সালের ১৬ই আগষ্ট এই পোস্টটি ফেইসবুকের অনেক ইসলামী গ্রুপে শেয়ার করি। এরপর বিভিন্নজনে বিভিন্ন মন্তব্য করে, সেসবের জবাবও দিয়েছি । সেসব পরে দিচ্ছি। এখন পাকিস্তান জামায়াতের আমির মৌলানা সিরাজুল হক--এর প্রতিক্রিয়া এখানে দিচ্ছি। 

পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর আমীর সিরাজুল হক বলেছেন: 
Jamaat-e-Islami Ameer Sirajul Haq has said the "peaceful taking over" of Kabul by Taliban insurgents was actually a defeat of the US and a victory of Afghan people and the Islamic world.
It is hoped that after the humiliating defeat, the US would not invade any more countries, he was quoted as saying by The News International while addressing the central training workshop for the JI leaders and workers at Mansoorah here.
He lauded the Taliban for declaring peace, non-retaliation against opponents, protection of diplomats and foreigners, and amnesty for rivals which, he said, was unprecedented in the modern civilized world.
Siraj was quoted as saying by the newspaper that the defeat of the Western colonist powers for the third time in history by Afghanistan has further strengthened the dream of the liberation of Kashmir and Palestine, hoping that the day was not far when the sun of freedom would rise there.
অর্থাৎ: জামায়াতে ইসলামীর আমীর সিরাজুল হক বলেছেন, তালেবান বিদ্রোহীদের দ্বারা কাবুলের "শান্তিপূর্ণ দখল" আসলে আমেরিকার পরাজয় আর আফগান জনগণ এবং ইসলামী বিশ্বের জয়। আশা করা যায় যে, লজ্জাজনক পরাজয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র আর কোনো দেশে আক্রমণ করবে না। তিনি এখানে মনসুরায় জেআই নেতা ও কর্মীদের কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ কর্মশালায় ভাষণ দেওয়ার সময় বলেছিলেন।
তিনি শান্তি ঘোষণা, বিরোধীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ না নেওয়া, কূটনীতিক এবং বিদেশীদের সুরক্ষা এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার জন্য তালেবানের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, এটা আধুনিক সভ্য বিশ্বে নজিরবিহীন।
আমীর সিরাজুল হক সংবাদপত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে, আফগানিস্তানের কাছে ইতিহাসে তৃতীয়বারের মতো পশ্চিমা উপনিবেশিক শক্তির পরাজয় কাশ্মীর ও ফিলিস্তিনের মুক্তির স্বপ্নকে আরও শক্তিশালী করেছে, আশা করে যে সেদিন বেশি দূরে নয় যখন স্বাধীনতার সূর্য উঠবে সেখানে। 
Source: www.indiablooms.com

এই পোস্টটি ফেইসবুকের অনেক ইসলামী গ্রুপে শেয়ার করার পর একটি গ্রুপে একজন কমেন্ট করে বলেন: সোভিয়েত হঠাও এর পরবর্তী ইতিহাসে জমিয়তে ইসলামী খারাপ পথ বেছে নিয়েছিল। এর পরিণতিতে আহমাদ শাহ মাসুদ এবং রব্বানী দুইজনকেই জীবন দিতে হয়েছে। এর জবাবে আমি জানাই: “গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের হেজবে ইসলামীর সাথেই জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্ক । সে সম্পর্কে এই পোস্টে লেখা হয়েছে।” নামের সাদৃশ্যের বা অন্য কোন কারণে অনেকের এই বিষয়ে ভুল ধারনা আছে। জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্কযুক্ত গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের হেজবে ইসলামী আমেরিকাবিরোধী জিহাদে তালেবানের পক্ষে ছিল। আরো উল্লেখ্য যে, গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার বর্তমান বিজয়ী তালেবান সরকারে অন্যতম মুখ্য সমন্বয়ক হিসাবে অংশ নিয়েছেন।
গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের ইমামতিতে নামাজরত তালেবান নেতৃবৃন্দ

গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির সিরাজল হকের সাথে সাক্ষাতের ভিডিও:

আরেকজন পোস্টের শেষে আমার এই বক্তব্যের রেফারেন্স চেয়েছেন - "জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির বিরুদ্ধে আফগান ও পাকিস্তান তালেবান তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল।" আমি একটা লিংক দিয়েছি। তারা আসলে মৌখিক তীব্র প্রতিবাদের চেয়ে বেশী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। যে কেউ Bangladesh mission under Taliban threat - এই লংটেইল কীওয়ার্ড দিয়ে গুগুলে সার্চ করে দেখতে পারেন। ২০১৩ সালের অনেকগুলো লিংকে এসম্পর্কে জানতে পারবেন। আমি আরো জানাই - আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ হলে পাকিস্তান পার্লামেন্টসহ বিশ্বের বহু দেশের বহু ইসলামী সংগঠনই প্রতিবাদ জানিয়েছিল। এর মধ্যে সর্বাধিক শক্ত প্রতিবাদ যারা জানিয়েছিল তাদের মধ্যে বর্তমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান অন্যতম। আমি এই লিংকটা শেয়ার করেছি: Resolution passed: Abdul Quader Molla was innocent, Imran Khan claims

বিশ্বখ্যাত ইসলামিক স্কলার, শায়খ আল্লামা ডঃ ইউসুফ আল কারযাভী (হাফিঃ) -এর সাথে কাতারে তালেবান নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎ।

নীচে একজন তালেবান নেতার বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে সাক্ষাৎকার দেয়া হয়েছে। এটা তালেবান বিজয়ের আগের। তিনি সাতক্ষীয়া জেলায় জামায়াতের উপরে ভয়ংকর নির্যাতনের কথাও উল্লেখ করেন। 
(একবার ক্লিক করে ভিডিও চালু না হলে ২য় বার ক্লিক করুন)

বিঃদ্রঃ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনুসারে দাওয়াত, সংগঠন ও ইসলামের আলোকে গঠন এবং মানবসেবার মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম (জিহাদ) অব্যাহত রেখেছে। মূলতঃ আফগান, ইরান, তুরান কেউই ইসলামের মডেল নয়, কোরআন ও সুন্নাহ’র আলোকে নিজ দেশের অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে হবে।

Please browse these links:




সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ’র। মহান আল্লাহ অধিকতর সাফল্য অর্জনের তৌফিক দান করুন, আমিন

Friday, April 6, 2018

সময়ের কসম, নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত -মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত


মহাগ্রন্থ আল কুরআনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা হচ্ছে আল আসর। এই সূরাটির আয়াত তিনটি। এটি কুরআনের ছোট সূরাগুলোর অন্যতম। এই সূরাটি ছোট হলেও এর তাৎপর্য ব্যাপকতর। লেখার শিরোনামটি এই সূরারই প্রথম অংশের অর্থ। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালা এই সূরাতে সময়ের শপথ নিয়ে মানুষ যে ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত তা তুলে ধরেছেন, তার পাশাপাশি কারা ক্ষতির কবল থেকে মুক্ত থাকবে সে কথাও গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছেন। সূরাটির পুরো অর্থ নিম্নে তুলে ধরা হলো- সময়ের কসম। নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত। তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করতে থেকেছে এবং পরস্পরকে হক কথা ও সবর করার উপদেশ দিতে থেকেছে। (আল কুরআন : সূরা আসর)

ছোট্ট এই মাক্কি সূরাটিতে মহান আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট ভাষায়, মানুষের সাফল্য-ব্যর্থতা, কল্যাণ-অকল্যাণ এবং ধ্বংসের পথ বর্ণনা করেছেন। মানুষের জীবনের প্রতিটি সময়কে গুরুত্ব দিয়ে কাজে লাগিয়ে জীবনটাকে বদলে দেয়ার জন্য এই সূরার অনুসরণই যথেষ্ট। এই সূরার তাৎপর্য উপলব্ধি করে কাজ করতে পারলে সাফল্য অনিবার্য। ইমাম শাফেয়ি (রহ:) বলেন, মানুষ যদি এই একটি সূরা অর্থাৎ সূরা আসর নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে এটিই তাদের হেদায়েত তথা সফলতার জন্য যথেষ্ট। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত ওবাইদুল্লাহ বিন হিসন (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সাহাবিদের মধ্য থেকে যখন দুই ব্যক্তি মিলিত হতেন তখন তারা একজন অপরজনকে সূরা আসর না শোনানো পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হতেন না।’ (তাবারানি)
মহান আল্লাহর এখানে সময়ের কসম করার যথার্থ যুক্তি আছে। আল্লাহ সৃষ্টিকুলের কোনো বস্তুর শ্রেষ্ঠত্ব, অভিনবত্ব প্রকাশের জন্য কখনও কসম বা শপথ করেননি বরং যে বিষয়টি অকাট্যভাবে প্রমাণ করতে চেয়েছেন তার ক্ষেত্রেই তিনি সত্যতা প্রমাণ করতেই কসম খেয়েছেন। সময় অতি মূল্যবান একটি বিষয়। সময় বলতে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে বোঝায়। এটি কোনো দীর্ঘ সময়ের অর্থে নয়। ভবিষ্যতের গর্ভ থেকে বের হয়ে আসা বর্তমান অতীতে নিপতিত সময়কে বোঝানো হয়েছে। অতীতের কসম হলো ইতিহাসের সাক্ষ্য। বর্তমানের কসম হলো বর্তমানের অতিবাহিত সময়। মানুষকে কাজের জন্য সময় দেয়া হচ্ছে। সময় এক ধরনের মূলধন। মূলধন নামক মানুষের এই সময় দ্রুতই অতিবাহিত হচ্ছে। এর উদাহরণ দিতে গিয়ে ইমাম রাযি (রহ:) একজন মনীষীর উক্তি উল্লেখ করে বলেছেন- তাহলো, একজন বরফ বিক্রেতার কথা থেকেই আমি সূরা আল আসরের অর্থ বুঝতে পেরেছি যে বাজারে জোর গলায় চিৎকার করে বলছিল, দয়া করো এমন এক ব্যক্তির প্রতি যার পুঁজি (বরফ) গলে যাচ্ছে। তার এ কথা শুনে আমি বললাম, এইটিই হচ্ছে আসলে ‘নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত’ বাক্যের প্রকৃত অর্থ।
মানুষকে যে সময় (আয়ুষ্কাল) দেয়া হয়েছে তা বরফ গলে যাওয়ার মতো দ্রুত অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে। একে যদি নষ্ট করে দেয়া হয় অথবা ভুল কাজে ব্যয় করা হয় তাহলে সেটিই মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতি। কাজেই চলমান সময়ের কসম খেয়ে এই সূরায় যা বলা হয়েছে তার অর্থ এই যে, এই দ্রুত গতিশীল সময় সাক্ষ্য দিচ্ছে, সূরা আসরে বর্ণিত চারটি গুণাবলিশূন্য হয়ে যে মানুষ যে কাজেই নিজের জীবনকাল অতিবাহিত করে- তার সবটুকুই ক্ষতির সওদা ছাড়া কিছুই নয়। পরীক্ষার হলে যে ছাত্র প্রশ্নপত্রের উত্তর দেয়ার পরিবর্তে অন্য কাজে সময় নষ্ট করেছে, তাকে পরীক্ষার হলে টাঙানো ঘড়ির কাঁটা বলে দিচ্ছে তুমি নিজের ক্ষতি করছো। যে ছাত্র এই সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত নিজের প্রশ্নপত্রের জবাব দেয়ার কাজে ব্যয় করেছে একমাত্র সে-ই লাভবান হচ্ছে। আর রেজাল্টের দিন সেই ছেলেটিই সফলতা অর্জন করবে।

এ সূরায় চারটি গুণাবলির অধিকারী ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে যারা সময়ের বহমান ¯্রােতে ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা পাবে : ১. যারা ঈমান এনেছে ২. যারা সৎকাজ করতে থেকেছে ৩. যারা পরস্পরকে হকের উপদেশ দিতে থেকেছে এবং ৪. যারা পরস্পরকে সবর বা ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিতে থেকেছে। প্রথম কাজ হলো ঈমান আনা। শুধুমাত্র মুখে স্বীকার করলেই তাকে ঈমান আনা বলা হয় না বা ঈমানের দাবি পূরণ হয় না। বরং ঈমানের তিনটি ধাপ রয়েছে। তা হলো অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা, তারপর মুখে স্বীকৃতি তথা বিশ্বাস অনুযায়ী মুখে প্রকাশ করা, তৃতীয়ত বাস্তবে কাজে পরিণত করা। আল্লাহ বলেন, আসলে তারাই প্রকৃত মুমিন যারা আল্লাহ ও রাসূল (সা:)-এর প্রতি ঈমান এনেছে এরপর কোনরূপ সন্দেহে পতিত হয়নি। (সূরা হুজুরাত : আয়াত ১৫)

দ্বিতীয়ত, ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা পাবে তারা যারা আমলে সালেহ তথা সৎকাজ করতে থেকেছে। কুরআনের পরিভাষায় সালেহাত সমস্ত সৎকাজ এর অন্তর্ভুক্ত। কুরআনের দৃষ্টিতে, যে কাজের মূলে ঈমান আছে এবং যা আল্লাহ ও তার রাসূল (সা:) প্রদত্ত হেদায়েতের ভিত্তিতে সম্পাদিত হয়েছে তা সৎকাজ। ঈমানের পর সৎকাজের বর্ণনার অর্থ হলো ঈমানবিহীন কোনো সৎকাজের পুরস্কার পাওয়ার সুযোগ নেই। সৎকাজবিহীন ঈমান একটি দাবি ছাড়া আর কিছুই নয়। ঈমান ও সৎকাজ বীজ আর বৃক্ষের মতো। আল্লাহ এবং বান্দার হক আদায়, মা-বাবার খেদমত করা, বড়দের সম্মান করা, ছোটদের স্নেহ করা, আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীর হক আদায় করা, অপরকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকাও গুরুত্বপূর্ণ সৎকাজ।
ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার পরবর্তী দু’টি গুণ হলো- যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তারা পরস্পরকে হক কথা বলা, হক কাজ করা এবং ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিতে হবে। এর প্রাথমিক অর্থ হচ্ছে ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদের পৃথক না থেকে সম্মিলিতভাবে একটি সৎ সমাজ গড়ে তুলতে হবে। যেখানে নিজে হকের ওপর অবিচল থাকার পাশাপাশি অন্যকেও এ পথে আহ্বান করতে হবে। মনে রাখতে হবে সমাজে একা একা ভালো থাকা যায় না। কেউ যদি মনে করেন তিনি ভালো থাকবেন ঘরে কিংবা মসজিদের কোণে বসে তার পক্ষে তা সম্ভব হবে না। কারণ সমাজের ক্ষতির প্রভাব তার ওপরও কোনো না কোনো ভাবে পড়বে। ফলে একা একা হকের পথে থেকেও তিনি আসলেই ভালো থাকতে পারবেন না। সবাইকে ভালো পথে হকের পথে সত্যের পথে নিয়ে আসার মাধ্যমেই ভালো থাকা সম্ভব।
চতুর্থ গুণটি হলো সবর বা ধৈর্য। হকের নসিহত করতে গিয়ে বা হকের সমর্থন করতে গিয়ে যে সব সমস্যা ও বাধার মুখে নিপতিত হতে হয় তার মোকাবেলায় তারা পরস্পরকে অবিচল ও দৃঢ় থাকার উপদেশ দিতে থাকবে। হক এবং বাতিলের দ্বন্দ্ব চিরন্তন। যেখানেই হক সেখানেই বাতিল আঘাত হানার চেষ্টা করে। হক তথা সত্য পথে থেকে সফলতা অর্জন করতে গেলে বাধা-বিপত্তি আসবেই। ধৈর্যের সাথে তার মোকাবেলা করতে হবে। আর ধৈর্যশীলদের জন্যই আল্লাহর পুরস্কার নির্ধারিত।

লেখক : এমফিল গবেষক

Friday, March 23, 2018

মতিউর রহমান মল্লিকের হামদ গানের নতুন জগৎ -ড. নঈম আহমেদ


শিল্পী গায়ক নয়তো মোদের আসল পরিচয়
আল কুরআনের কর্মী মোরা বিপ্লবী নির্ভয়
শিল্পী থেকে কর্মী বড়
সুর ছড়িয়ে যাই ॥

বাংলা গানের জগতে মতিউর রহমান মল্লিক একজন সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীতসাধক। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী। তিনি ১৯৭৬ সালে ‘সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী’ প্রতিষ্ঠা করেন সে-সময় গণমাধ্যমে ইসলামী গান অবহেলিত ছিলো। বিশেষভাবে খালি কণ্ঠে বাজনা ছাড়া গান কল্পনাই করা হতো না। সময়ের দাবি অনুযায়ী এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামী গানের নতুন দিগন্ত তিনি সৃষ্টি করেন। [দ্র. আহমদ বাসির সম্পাদিত মতিউর রহমান মল্লিকের সাক্ষাৎকার, ঢাকা: মর্নিং ব্রিজ, ২০১৭, পৃ. ১৯] স্বকণ্ঠে স্বরচিত ও নিজের সুরারোপিত গানের অ্যালবাম প্রতীতি: এক (১৯৯৩) প্রকাশের মাধ্যমে তিনি সঙ্গীত প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। প্রতীতি: দুই (১৯৯৪) এই পরিচয়কে আরো বেশি প্রতিষ্ঠা দান করে। গীতিকার হিসেবেও তিনি সফলতার পরিচয় দেন। ঝংকার (১৯৭৮), যত গান গেয়েছি (১৯৮৭), প্রাণের ভেতরে প্রাণ (২০১০) এবং অপ্রকাশিত গীতিকাব্য চিরকালের গান তাঁর গানের সঙ্কলন একজন গীতিকার ও সঙ্গীত সাধকরূপে নিজেকে প্রকাশ করেন। এ ছাড়া সম্পাদনা করেছেন একাধিক গানের সঙ্কলন।
মতিউর রহমান মল্লিক কিভাবে ইসলামী সাংস্কৃতিক জগতে আসেন এবং গানের প্রতি অনুরাগী হলেন সে বিষয়ে নিজের মন্তব্য : ‘আমি একটি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। আমাদের পরিবারে আগে থেকেই একটি জারির দল ছিলো। আমার আব্বা ঐ জারি দলের জন্য বিশাল বিশাল জারি গান লিখে দিতেন। আর এই গান আমার ছোট চাচা আমাদের এলাকায় গেয়ে বেড়াতেন। দলের অন্যান্য সদস্যরা আমাদের আত্মীয়স্বজন ছিলো। আমার আব্বা কবিতা লিখতেন এবং সেই ব্রিটিশ আমলে আমার আব্বা ২-৩ মাইল দূরে গিয়ে পত্রিকা পড়ে আসতেন। রেডিওতে কবি ফররুখ আহমদ যে সাহিত্য আসর পরিচালনা করতেন কবিতা পাঠের ব্যবস্থা করতেন, সেই আসরে আমার বড় ভাই কবিতা পড়েছেন। যে কবিতা ফররুখ আহমদ নিজে অনুমোদন করেছেন। ছোটবেলা থেকে রেডিওতে গান শুনে শুনে গান লেখায় আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। এবং অনেক গান লিখেও ফেলেছিলাম। যার সবগুলোই ছিলো প্রেমের গান। আমি যখন ছাত্র ইসলামী আন্দোলনে যোগদান করেছিলাম, তখন আমার গান লেখার মোড় ঘুরে যায়। দেশ, মুসলমান, ইসলামী আন্দোলনের জয়গান লেখা শুরু করলাম। প্রেমের গানের লেখার পর্ব ছুটে গেল।’ [আবিদ আজমের নেয়া মতিউর রহমান মল্লিকের সাক্ষাৎকার, রহমান তাওহীদ সম্পাদিত রিদম, ঢাকা: ২০০৯, পৃ. ৭]
মতিউর রহমান মল্লিকের জীবনকালেই ‘কবি’ অভিধা তার নামের সাথে অবিভাজ্য হয়ে পড়ে। তিনি প্রধানত কবি, যদিও এ যাবৎ প্রকাশিত তার কবিতার সংখ্যা তার রচিত গানের তুলনায় কম। তবে এ কথা স্বীকার্য যে, কবি না হলে কেউ গান লিখতে পারে না। পৃথিবীর সকল গীতিকারই মূলত কবি। অনেক খ্যাতনামা কবির প্রখ্যাত অনেক কবিতাও গান আকারে গীত হয়ে থাকে। কবিতার মধ্যে যেমন মিল, ছন্দ, ধ্বনি, ব্যঞ্জনা ইত্যাদি রয়েছে, গানের মধ্যেও তার উপস্থিতি অপরিহার্য। তবে গানের মধ্যে গীতলতার দিকটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া, গান একটি নির্দিষ্ট সুর, তাল-লয় ও আকারে সীমাবদ্ধ থাকে, কবিতার ক্ষেত্রে অতটা বাধ্যবাধকতা নেই। তাই গান রচনার সময় কবিকে অধিকতর সচেতনতা ও শিল্পবোধের পরিচয় দিতে হয়। সেজন্য গীতিকার যখন শব্দ নিয়ে খেলা করেন, তখন তাকে সুর-তাল-লয় ও রাগ-রাগিণী সম্পর্কে সজাগ-সতর্ক থাকতে হয়। গানের সফলতা অনেকটা এর ওপর নির্ভরশীল। মতিউর রহমান মল্লিকের কবি-স্বভাবের মধ্যে গীতিধর্মিতার প্রাবল্য তাকে একজন সার্থক এবং বহুলপ্রজ গীতিকার হিসেবে সাফল্য ও খ্যাতি এনে দিয়েছে। মল্লিক নিজে একজন সুগায়ক ছিলেন। গান রচনার সাথে সাথে তিনি তাতে সুরারোপ করতেন ও গাইতেন। [মুহম্মদ মতিউর রহমান, মতিউর রহমান মল্লিকের কাব্যকর্ম, পৃ. ১৬১] সার্থক গীতিকার হওয়ার জন্য এটা এক অপরিহার্য গুণ। যিনি গায়ক তিনি গানের সুর, তাল, লয় ও রাগ-রাগিণী সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত। সার্থক গান রচনার জন্য এটা খুবই প্রয়োজন। তাঁর মধ্যে সে গুণের কমতি ছিল না। তাই তার রচিত গান সার্থক বলা যায়। তাঁর বহুমাত্রিক প্রতিভার মধ্যে গীতিকার হিসেবে তার সাফল্য তুলনামূলকভাবে অধিক।
তারুণ্য-যৌবনের কবি পরবর্তী কালে হয়ে ওঠেন বাংলা গানের সুরেলা পাখি। মতিউর রহমান মল্লিকের গানের বাণী ও সুরের মৌলিকতা ও বৈচিত্র্য বিশেষত্বপূর্ণ। উত্তরাধিকারের পথে নতুন বাঁক-বদল। তাঁর গানের কথার বিষয় নানা মাত্রিক, নানা সময়ের প্রয়োজনে সৃষ্টি। ইসলামী আন্দোলনের পথপরিক্রমায় জীবনাভিজ্ঞতার আলোকে তিনি গানের সম্ভার রচনা করেন। তাঁর গানের বিষয়বৈচিত্র্যকে নি¤েœাক্ত শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যথা: ক. হামদ, খ. নাতে রাসূল সা., গ. ইসলামী আন্দোলন, ঘ. দেশপ্রেম, ঙ. প্রকৃতি, চ. আধুনিক জীবনমুখী, ছ. আধ্যাত্মিক/ মৃত্যুচেতনা, জ. ইসলামী সংস্কৃতি, ঝ. বিবিধ।
তোমার সৃষ্টি যদি হয় এত সুন্দর
না জানি তাহলে তুমি কত সুন্দর
সেই কথা ভেবে ভেবে কেটে যায় লগ্ন
ভরে যায় তৃষিত এ অন্তর।
আল্লাহর প্রশংসামূলক বা তাঁর গুণের কথামালাসম্পন্ন সুরারোপিত গানকে হামদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পৃথিবীতে মানুষ প্রেরিত হয়েছে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে। আর প্রতিনিধির কাজ হলো আল্লাহর ইবাদত করা। সেই দিক বিবেচনায় প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব আল্লাহর প্রশংসা করা ও তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী জীবন অতিবাহিত করা। সৃষ্টিশীল মানুষ যারা হেদায়াত প্রাপ্ত তারা এ ক্ষেত্রে অগ্রগামী। বিশেষভাবে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী সমাজ আল্লাহর গুণ, কার্যাবলি ও মহিমা নিয়ে সৃজনশীল কাজ করে থাকেন। রাসূল সা:-এর সময়ে যে সমস্ত সাহাবী কবিতা লিখতেন তারা প্রধানত আল্লাহ ও রাসূলের জন্যই লিখতেন। হাসসান ইবনে সাবিত রা., আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়া রা., হযরত আলী রা. প্রমুখ সাহাবী আল্লাহর প্রশংসা, গুণাবলি ও শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে উৎকৃষ্ট কবিতা লিখেছেন। মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমী, শেখ সাদী, ফেরদৌসী প্রমুখ সাহিত্যিক হামদ রচনায় বিশ^সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। এই ধারা পরবর্তীকালে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আধুনিককালেও কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী সমাজ আল্লাহর মহিমা কীর্তনে সৃষ্টিশীল। আল্লামা ইকবাল এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকায় স্মরণীয়, বরণীয় ও প্রভাবশালী। বাংলা ভাষায় মধ্যযুগে অসংখ্য কবি আল্লাহর প্রশংসামূলক কবিতা লিখেছেন। আধুনিককালে কায়কোবাদ, মীর মশাররফ হোসন, গোলাম মোস্তফা, কাজী নজরুল ইসলাম ও ফররুখ আহমদ বিপুল পরিমাণে হামদ রচনা করেছেন।
এই ধারায় মতিউর রহমান মল্লিক বাংলা গানের ভুবনে হামদকে আরো এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহর একজন কৃতজ্ঞ বান্দা, কবি-সাহিত্যিক ও সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে তিনি বাংলা গানে নতুন সুর, ছন্দ, কথা, আবহ ও বাঁক এনেছেন। গোলাম মোস্তফা, কাজী নজরুল ইসলাম ও ফররুখ আহমদের মতো একই মতাদর্শের পথিক হয়েও একক গানের জগৎ নির্মাণ করেন। ‘প্রতীতি’ কণ্ঠসঙ্গীত পর্বের কিছু দৃষ্টান্ত :
দৃষ্টি তোমার খুলে রাখো দীপ্ত সৃষ্টির জন্য
দেখবে স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ কত না অনন্য ॥

বিহঙ্গ তার পক্ষ দোলায়
দূর বিমানে শূন্য কোলায়
কে রাখে ভাসিয়ে তারে ভাবনা সামান্য॥

সমতল আর পর্বতমালা
এই কোলাহল ঐ নিরালা
কার মহিমা জড়িয়ে রাখে গহনও অরণ্য॥
[প্রতীতি]

মাঠ ভরা ওই সবুজ দেখে
নীল আকাশে স্বপ্ন এঁকে
যার কথা মনে পড়ে
সে যে আমার পালনেওয়ালা॥
[প্রতীতি]

এসো গাই আল্লাহ নামের গান
এসো গাই গানের সেরা গান
তনুমনে তুলবো তুমুল
তূর্য তাল ও তান॥
[প্রতীতি]

বিশ্বজগতের বিশাল ও বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ, সৌন্দর্য ও নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলি যে কোন মানুষকে বিস্মিত ও ভাবুক করে তোলে। সৃষ্টিশীল কবি মতিউর রহমান মল্লিক গানের খাতায় এই পৃথিবীর রূপে-রসে-রঙে-রেখায় মনোযোগ দিয়ে আবেগে আপ্লুত এই ভেবে যে, আল্লাহ কিভাবে কী অসীম নির্মাণশৈলীতে এসব কিছু সৃষ্টি করেছেন। মানুষ ও প্রাণিকুলের রহস্য, চারপাশের পরিবেশ, চাঁদ-সূর্য-তারা-আলোকমালা, নদী-সমুদ্র-পর্বত-অরণ্য-জলাশয় এবং এই সবের মাঝে সুন্দরের সন্ধানে কবি আল্লাহর মহত্ত্ব ও অসীম কুদরত অনুভব করেছেন ও দেখেছেন। সৃষ্টির মাঝেই ¯্রষ্টার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ যে অনন্য সে অনুভব করার জন্যও শ্রোতাকে আহ্বান করেছেন। আল্লাহ যে পালনকর্তা ও রিজিকদাতা সে কথাও গভীরভাবে গানে ব্যক্ত করেন।
‘প্রতীতি’ প্রথম গানের সংকলনে এই হামদগুলো স্থান পায়। সৃষ্টির মাঝে ¯্রষ্টার ছায়া ও সৌন্দর্য উপলব্ধি করেন গীতিকার। কিছু কিছু গানে সুফি মতের প্রভাব লক্ষণীয়। সুফি মতের কেন্দ্রে আছে আল্লাহর ধারণা। বিভিন্ন সুফি মতবাদে আল্লাহর ধারণা তিন প্রকার: আত্মসচেতন ইচ্ছাশক্তি, সৌন্দর্যস্বরূপ এবং ভাব, আলো কিংবা জ্ঞান স্বরূপ। শকিক বলখি, ইব্রাহীম আদম, রাবিয়া বসরী প্রভৃতির ধারণায় আল্লাহ ইচ্ছাশক্তি স্বরূপ। সৃষ্টিলীলায় সেই ইচ্ছাশক্তিরই প্রকাশ। একত্ববাদ এর প্রাণ, তাই এটি আরবীয় বা শামীয় (Semitic)। পবিত্রতা, সংসার ধর্মে অনাসক্তি, আল্লাহ্ প্রেম ও পাপভীতিই এই মতের সুফিদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহকে রূপময়-লীলাময় প্রেমকামীরূপে কল্পনা করেছেন যাঁরা তাঁদের মতে, আল্লাহ নিজের মহিমার মুকুররূপে সৃষ্টি করেছেন জগৎ। তিনি এই সৃষ্টির মুকুরে নিজের রূপ নিজেই প্রত্যক্ষ করেছেন নার্সিসাসের মতো। এ তত্ত্বের প্রেক্ষিতে এ মতবাদী সুফিরা সৃষ্টিকে মনে করে রূপময়-লীলাময় আল্লাহর Manifestation বলে। এবং এর ভিত্তি হলো প্রেম। যেখানে রূপ, সেখানেই প্রেম, অথবা প্রেমই দান করে রূপদৃষ্টি। কাজেই এই তত্ত্বে বিশ্বাসী সুফিরা প্রেমবাদী, বিশ্বপ্রেম তাদের সাধনার লক্ষ্য ও পাথেয়। সব রিপু ও বিষয়-চিন্তা পুড়ে ছাই হয়ে উড়ে যায় এই প্রেমানলেÑ হৃদয় জুড়ে থাকে কেবল আল্লাহ। এই বোধের পরিণামে পাই অদ্বৈততত্ত্বÑ যার পরিণতি হচ্ছে ‘আনলহক’ বা ‘সোহম’ বোধে। এই মতের সুফিদের মধ্যে বায়জিদ বোস্তামি, মনসুর প্রমুখ প্রখ্যাত। [আহমদ শরীফ, বাংলার সুফি সাহিত্য, ঢাকা: সময় প্রকাশন, ২০০৩, পৃ. ২৪] অসীম, অনন্ত ও গুণাতীত অনাদি চিরন্তন সত্তার বোধ জন্মায় এই অভেদতত্ত্ব। সৃষ্টি মাত্রই ব্রহ্ম থেকে উৎপন্ন এবং ব্রহ্মেতে লীন। সুফি মতে, আল্লাহ হচ্ছেন ‘স্বয়ম্ভূ জ্যোতি’। Manifestation তথা মহিমার অভিব্যক্তি দানই এ জ্যোতির স্বভাব। এতেই তাঁর স্বতো প্রকাশ। নিজের মধ্যে ও বিশ্বে পরিব্যাপ্ত এই আলো দেখার আকুলতা মানবে সহজাত। আলোর স্বরূপ উপলব্ধির ও হৃদয়ে প্রতিষ্ঠার সাধনাই সুফিব্রত। এই সিদ্ধির ফলে মানুষ হয় ‘ইনসানুল কামেল’। প্রথমটি অধ্যাত্ম সাধনার ক্ষেত্রে আর শেষোক্তটি পার্থিব সমাজের। মতিউর রহমান মল্লিক উভয় ক্ষেত্রেই মনোযোগী।
লাইলাহা ইল্লাল্লাহ
নেই কেহ নেই আল্লাহ ছাড়া
পাখির গানে গানে
হাওয়ার তানে তানে
ঐ নামেরই পাই মহিমা
হলে আপনহারা ॥
আল্লাহ নামের গান গেয়ে দেখ
কেমন লাগে নামের সুর
ঐ নামে যে যাদু রাখা
ঐ নামে যে শহদ মাখা
পান করে দেখো কী মধুর ॥
[ঝংকার]

আজকে আমার প্রাণ-সাগরে
আল্লাহ নামের নুর
উথাল পাথাল ঢেউ তুলেছে
যেনো পাহাড় তুর ॥
[ঝংকার]

হাত পেতেছে এই গোনাহগার
তোমারি দরগায় খোদা তোমারি দরগায়
শূন্য হাতে ওগো তুমি
ফিরাইও না হায়, মোরে ফিরাইও না হায় ॥
আমার কণ্ঠে এমন সুধা
দাও ঢেলে দাও হে পরোয়ার
যদি পিয়ে এই ঘুমন্ত জাত
ভাঙে যেনো রুদ্ধ দ্বার।
[ঝংকার]
‘প্রতীতি’ কণ্ঠসঙ্গীতের পর ‘ঝংকার’ গীতিকাব্যে মতিউর রহমান মল্লিক হামদে আরো বৈচিত্র্য আনেন। আল্লাহ নামের উচ্চারণে, রূপে ও মহিমায় কবি দিশেহারা। তাঁর নামের গুণের মুগ্ধতায় কবি নূরের উজ্জ্বলতায় পাখিদের গানে, ঝরনার সুরে, সবুজে ও রোদে আল্লাহ নামের মহিমা অনুভব করেছেন। প্রাকৃতিক সবকিছুতেই তিনি ¯্রষ্টার সৃজনশৈলী লক্ষ করেছেন। সেই পর্যবেক্ষণ গানের কথায় শিল্পসম্মত রূপে প্রকাশ করেন।
তুমি দয়ার অথৈ পারাবার
দুঃখের সাগর তুমি কর পার
পাপী তাপি সব গোনাহগার
চাহি তোমার করুণা।-
[যত গান গেয়েছি]

আমাকে দাও সে ঈমান
আল্লাহ মেহেরবান
যে ঈমান ফাঁসির মঞ্চে
অসংকোচে
গায় জীবনের গান।
[যত গান গেয়েছি]

কথায় কাজে মিল দাও আমার
রাব্বুল আলামিন
আল জিহাদ ফি সাবিলিল্লায়
রাখো বিরামহীন।
[যত গান গেয়েছি]

ঈমানের দাবি যদি কোরবানি হয়
সে দাবি পূরণে আমি তৈরি থাকি যেন
ওগো দয়াময় আমার
প্রভু দয়াময়।
[যত গান গেয়েছি]

আমি পাখির কাছে বললাম
নদীর কাছে শুধালাম
তোমাদের গান তোমাদের সুর
কেন এমন মনোহর
কেন এমন সুন্দর
ওরা বললো শুধু বললো:
আমাদের কণ্ঠে ¯্রষ্টার নাম
অঙ্গে অঙ্গে তার সৃষ্টি দাম
আমাদের গান আমাদের সুর
তাই তো এমন মনোহর
তাই তো এমন সুন্দর।
[যত গান গেয়েছি]

যখন পথের দিশা দিয়েছো খোদা
তখন বিপথে তুমি নিও না
যেই পথ কোরানের
যেই পথ রসূলের
সেই পথ ছেড়ে যেতে দিও না।
[যত গান গেয়েছি]
‘যত গান গেয়েছি’ পর্বের হামদে মতিউর রহমান মল্লিক বাস্তব জীবন সংগ্রাম-আন্দোলনের দুর্গম পথে এবং ব্যক্তিগত মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন-নিবেদন করেছেন, করুণা ও সাহায্য চেয়েছেন এবং তাকেই সহায়-সম্বল ভেবেছেন। নিজেকে গোনাহগার-পাপী হিসেবে উপস্থাপন করে পরকালের অথৈ সাগর পারাপারের জন্য আকুল আবেদন করেছেন। সেই সাথে সেই ঈমানের জন্য দরখাস্ত করেছেন যে ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে স্বেচ্ছায় ফাঁসির মঞ্চে নির্ভীকভাবে দাঁড়াতে পারেন; আল্লাহর রাজ কায়েমের জন্য জিহাদে প্রাণ বিসর্জন দিতে পারেন। পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদের ময়দানে লড়াকু হতে ঈমানের জোর চাই, ঈমানের দাবি যে কোরবানি সেই কোরবানির জন্য সেই শক্তি কামনা করেছেন কবি আল্লাহর কাছে। যে পথ কোরআনের ও রাসূলের সেই পথের ঠিকানা যেহেতু একবার আল্লাহ দয়া করে দিয়েছেন সেই পথে যেন চলতে শক্তি দেন, সেই দোয়া করেছেন। আল্লাহর মহিমা ও গুণের কথা কবি ফুল-পাখি-নদীসহ প্রকৃতির কাছে জিজ্ঞাসা করে উত্তর পেয়েছেন এক আল্লাহর অসীম অনন্ত মহিমা। পরবর্তী গীতিকাব্য ‘প্রাণের ভেতরে প্রাণ’-এ হামদ নেই। অন্যান্য বিষয়ে গান আছে।
মতিউর রহমান মল্লিকের হামদের বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করা যায় এভাবে-
ক. আল্লাহর গুণাগুণ, রূপ-অরূপ, শক্তি-মহিমা-শ্রেষ্ঠত্ব, সর্বাত্মক সত্তার প্রশংসা তাঁর হামদে প্রকাশিত;
খ. জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর উপস্থিতি অনুভব করেছেন ও করুণা চেয়েছেন;
গ. বিশেষভাবে জীবন সংগ্রামে, ত্যাগে, লড়াইয়ে, কঠিন বিপদে ও দুঃখে জয়ী হতে আল্লাহর কাছে সাহায্য-সহযোগিতা ও শক্তি প্রার্থনা করেছেন;
ঘ. মহান রবের প্রতি গভীর বিশ্বাস, আস্থা, ভালোবাসা-প্রেমের পরিচয় হামদের মাঝে প্রতিফলিত;
ঙ. আল্লাহর মহত্ত্বের সাথে সাথে পৃথিবীতে তাঁর রাজত্ব কায়েমের কথাও নানাভাবে ব্যক্ত করেছেন;
চ. ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের উজ্জীবনে এই হামদগুলো অত্যন্ত প্রভাববিস্তারী;
ছ. সুর সংযেজনের দিক থেকে মৌলিকত্ব ও নতুনত্ব লক্ষণীয়।

মতিউর রহমান মল্লিকের হামদের সুর কবি নিজেই করেছেন নিজ সঙ্গীত প্রতিভায়। একদম নতুন সুর সংযোজন ঘটিয়েছেন এইসব হামদে যা বাংলা গানে অভিনব। নজরুলের গানের বা হামদের দূরগত প্রভাব থাকলেও প্রত্যক্ষ কোনো প্রভাব নেই এতে। শেষের দিকে কিছু গানে অন্যরাও সুর দিয়েছেন।
লেখক : কবি ও গবেষক

Popular Posts