মহাগ্রন্থ আল কুরআনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা হচ্ছে আল আসর। এই সূরাটির আয়াত তিনটি। এটি কুরআনের ছোট সূরাগুলোর অন্যতম। এই সূরাটি ছোট হলেও এর তাৎপর্য ব্যাপকতর। লেখার শিরোনামটি এই সূরারই প্রথম অংশের অর্থ। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালা এই সূরাতে সময়ের শপথ নিয়ে মানুষ যে ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত তা তুলে ধরেছেন, তার পাশাপাশি কারা ক্ষতির কবল থেকে মুক্ত থাকবে সে কথাও গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছেন। সূরাটির পুরো অর্থ নিম্নে তুলে ধরা হলো- সময়ের কসম। নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত। তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করতে থেকেছে এবং পরস্পরকে হক কথা ও সবর করার উপদেশ দিতে থেকেছে। (আল কুরআন : সূরা আসর)
ছোট্ট এই মাক্কি সূরাটিতে মহান আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট ভাষায়, মানুষের সাফল্য-ব্যর্থতা, কল্যাণ-অকল্যাণ এবং ধ্বংসের পথ বর্ণনা করেছেন। মানুষের জীবনের প্রতিটি সময়কে গুরুত্ব দিয়ে কাজে লাগিয়ে জীবনটাকে বদলে দেয়ার জন্য এই সূরার অনুসরণই যথেষ্ট। এই সূরার তাৎপর্য উপলব্ধি করে কাজ করতে পারলে সাফল্য অনিবার্য। ইমাম শাফেয়ি (রহ:) বলেন, মানুষ যদি এই একটি সূরা অর্থাৎ সূরা আসর নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে তাহলে এটিই তাদের হেদায়েত তথা সফলতার জন্য যথেষ্ট। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত ওবাইদুল্লাহ বিন হিসন (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সাহাবিদের মধ্য থেকে যখন দুই ব্যক্তি মিলিত হতেন তখন তারা একজন অপরজনকে সূরা আসর না শোনানো পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হতেন না।’ (তাবারানি)
মহান আল্লাহর এখানে সময়ের কসম করার যথার্থ যুক্তি আছে। আল্লাহ সৃষ্টিকুলের কোনো বস্তুর শ্রেষ্ঠত্ব, অভিনবত্ব প্রকাশের জন্য কখনও কসম বা শপথ করেননি বরং যে বিষয়টি অকাট্যভাবে প্রমাণ করতে চেয়েছেন তার ক্ষেত্রেই তিনি সত্যতা প্রমাণ করতেই কসম খেয়েছেন। সময় অতি মূল্যবান একটি বিষয়। সময় বলতে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে বোঝায়। এটি কোনো দীর্ঘ সময়ের অর্থে নয়। ভবিষ্যতের গর্ভ থেকে বের হয়ে আসা বর্তমান অতীতে নিপতিত সময়কে বোঝানো হয়েছে। অতীতের কসম হলো ইতিহাসের সাক্ষ্য। বর্তমানের কসম হলো বর্তমানের অতিবাহিত সময়। মানুষকে কাজের জন্য সময় দেয়া হচ্ছে। সময় এক ধরনের মূলধন। মূলধন নামক মানুষের এই সময় দ্রুতই অতিবাহিত হচ্ছে। এর উদাহরণ দিতে গিয়ে ইমাম রাযি (রহ:) একজন মনীষীর উক্তি উল্লেখ করে বলেছেন- তাহলো, একজন বরফ বিক্রেতার কথা থেকেই আমি সূরা আল আসরের অর্থ বুঝতে পেরেছি যে বাজারে জোর গলায় চিৎকার করে বলছিল, দয়া করো এমন এক ব্যক্তির প্রতি যার পুঁজি (বরফ) গলে যাচ্ছে। তার এ কথা শুনে আমি বললাম, এইটিই হচ্ছে আসলে ‘নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত’ বাক্যের প্রকৃত অর্থ।
মানুষকে যে সময় (আয়ুষ্কাল) দেয়া হয়েছে তা বরফ গলে যাওয়ার মতো দ্রুত অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে। একে যদি নষ্ট করে দেয়া হয় অথবা ভুল কাজে ব্যয় করা হয় তাহলে সেটিই মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতি। কাজেই চলমান সময়ের কসম খেয়ে এই সূরায় যা বলা হয়েছে তার অর্থ এই যে, এই দ্রুত গতিশীল সময় সাক্ষ্য দিচ্ছে, সূরা আসরে বর্ণিত চারটি গুণাবলিশূন্য হয়ে যে মানুষ যে কাজেই নিজের জীবনকাল অতিবাহিত করে- তার সবটুকুই ক্ষতির সওদা ছাড়া কিছুই নয়। পরীক্ষার হলে যে ছাত্র প্রশ্নপত্রের উত্তর দেয়ার পরিবর্তে অন্য কাজে সময় নষ্ট করেছে, তাকে পরীক্ষার হলে টাঙানো ঘড়ির কাঁটা বলে দিচ্ছে তুমি নিজের ক্ষতি করছো। যে ছাত্র এই সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত নিজের প্রশ্নপত্রের জবাব দেয়ার কাজে ব্যয় করেছে একমাত্র সে-ই লাভবান হচ্ছে। আর রেজাল্টের দিন সেই ছেলেটিই সফলতা অর্জন করবে।
এ সূরায় চারটি গুণাবলির অধিকারী ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে যারা সময়ের বহমান ¯্রােতে ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা পাবে : ১. যারা ঈমান এনেছে ২. যারা সৎকাজ করতে থেকেছে ৩. যারা পরস্পরকে হকের উপদেশ দিতে থেকেছে এবং ৪. যারা পরস্পরকে সবর বা ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিতে থেকেছে। প্রথম কাজ হলো ঈমান আনা। শুধুমাত্র মুখে স্বীকার করলেই তাকে ঈমান আনা বলা হয় না বা ঈমানের দাবি পূরণ হয় না। বরং ঈমানের তিনটি ধাপ রয়েছে। তা হলো অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা, তারপর মুখে স্বীকৃতি তথা বিশ্বাস অনুযায়ী মুখে প্রকাশ করা, তৃতীয়ত বাস্তবে কাজে পরিণত করা। আল্লাহ বলেন, আসলে তারাই প্রকৃত মুমিন যারা আল্লাহ ও রাসূল (সা:)-এর প্রতি ঈমান এনেছে এরপর কোনরূপ সন্দেহে পতিত হয়নি। (সূরা হুজুরাত : আয়াত ১৫)
দ্বিতীয়ত, ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা পাবে তারা যারা আমলে সালেহ তথা সৎকাজ করতে থেকেছে। কুরআনের পরিভাষায় সালেহাত সমস্ত সৎকাজ এর অন্তর্ভুক্ত। কুরআনের দৃষ্টিতে, যে কাজের মূলে ঈমান আছে এবং যা আল্লাহ ও তার রাসূল (সা:) প্রদত্ত হেদায়েতের ভিত্তিতে সম্পাদিত হয়েছে তা সৎকাজ। ঈমানের পর সৎকাজের বর্ণনার অর্থ হলো ঈমানবিহীন কোনো সৎকাজের পুরস্কার পাওয়ার সুযোগ নেই। সৎকাজবিহীন ঈমান একটি দাবি ছাড়া আর কিছুই নয়। ঈমান ও সৎকাজ বীজ আর বৃক্ষের মতো। আল্লাহ এবং বান্দার হক আদায়, মা-বাবার খেদমত করা, বড়দের সম্মান করা, ছোটদের স্নেহ করা, আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীর হক আদায় করা, অপরকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকাও গুরুত্বপূর্ণ সৎকাজ।
ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার পরবর্তী দু’টি গুণ হলো- যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তারা পরস্পরকে হক কথা বলা, হক কাজ করা এবং ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিতে হবে। এর প্রাথমিক অর্থ হচ্ছে ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদের পৃথক না থেকে সম্মিলিতভাবে একটি সৎ সমাজ গড়ে তুলতে হবে। যেখানে নিজে হকের ওপর অবিচল থাকার পাশাপাশি অন্যকেও এ পথে আহ্বান করতে হবে। মনে রাখতে হবে সমাজে একা একা ভালো থাকা যায় না। কেউ যদি মনে করেন তিনি ভালো থাকবেন ঘরে কিংবা মসজিদের কোণে বসে তার পক্ষে তা সম্ভব হবে না। কারণ সমাজের ক্ষতির প্রভাব তার ওপরও কোনো না কোনো ভাবে পড়বে। ফলে একা একা হকের পথে থেকেও তিনি আসলেই ভালো থাকতে পারবেন না। সবাইকে ভালো পথে হকের পথে সত্যের পথে নিয়ে আসার মাধ্যমেই ভালো থাকা সম্ভব।
চতুর্থ গুণটি হলো সবর বা ধৈর্য। হকের নসিহত করতে গিয়ে বা হকের সমর্থন করতে গিয়ে যে সব সমস্যা ও বাধার মুখে নিপতিত হতে হয় তার মোকাবেলায় তারা পরস্পরকে অবিচল ও দৃঢ় থাকার উপদেশ দিতে থাকবে। হক এবং বাতিলের দ্বন্দ্ব চিরন্তন। যেখানেই হক সেখানেই বাতিল আঘাত হানার চেষ্টা করে। হক তথা সত্য পথে থেকে সফলতা অর্জন করতে গেলে বাধা-বিপত্তি আসবেই। ধৈর্যের সাথে তার মোকাবেলা করতে হবে। আর ধৈর্যশীলদের জন্যই আল্লাহর পুরস্কার নির্ধারিত।
লেখক : এমফিল গবেষক