পাঠকের দৃষ্টিগ্রাহ্যের জন্য সৈয়দ আলী আহসানকে নিয়ে লেখা কবি গোলাম মোহাম্মদের ‘আলোকদিয়ার আলোর ছেলে’ কবিতাটি এখানে উদ্ধৃত করা হলো।
আলোকদিয়ার আলোর ছেলে কোথায় চলে যায়,
সেই বেদনা বুকের ভেতর কেবল মোচড় খায়।
আলোকদিয়ার সবুজ জুড়ে কিসের বিষাদ নামে
নবগঙ্গা ব্যথায় কাঁপে বরুনাতৈল গ্রামে
পাখিগুলোর কণ্ঠে করুণ সুর
কোথায় গেল সেই ছেলেটি সে আজ কত দূর
নীল আকাশে কাঁপন জাগে সেই ছেলেটি কই
আকাশ নীলে ব্যথার প্রলেপ কষ্টে ফোটে খই
গ্রামে গ্রামে বৃক্ষলতায় কান্না ঝরে পড়ে
সেই ছেলেটির জন্য কাঁদে মানুষ ঘরে ঘরে
মাঠে মাঠে বাতাস কাঁদে ফসল ওঠে কেঁদে
সেই ছেলেটির জন্য কত ব্যথার গাঁথা বেঁধে
মানুষ তারে ভালোবাসে ফেলে চোখের পানি
মাগফেরাতের দোয়া করে স্মৃতির আঁচল টানি।
কবি গোলাম মোহাম্মদকে আমি পুরোপুরি পাঠ করেছি। কবি গোলাম মোহাম্মদ রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড প্রস্তুত করেছিলাম প্রায় দুই বছর ধরে। সে সময় কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ সার্বক্ষণিক পাশে থেকে আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন আর আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তা পালন করেছি। তখন দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা গোলাম মোহাম্মদকে নিয়ে, তার কাব্য নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা হয়েছে। তখনই আমরা বুঝেছি যে গোলাম মোহাম্মদ একজন বড় মাপের কবি। তার সমগ্র রচনা জাতির সামনে উপস্থাপিত করার দায়িত্বটা আমাদেরই ছিল, কিন্তু আমরা তা পারিনি। আমাদেরও অনেক সীমাবদ্ধতা, প্রতিকূলতা ছিল, আছে। তা আমরা আজও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সম্প্রতি কবি গোলাম মোহাম্মদের সঙ্গীত সমগ্র পুরোটা সম্পাদনা করেছি। সাধারণ ভাষায় লেখা অতি অসাধারণ অসংখ্য গান মুগ্ধ করার মতো। রচনা সমগ্র প্রথম খণ্ডের কাজ করার সময় আবদুল মান্নান সৈয়দের কাছ থেকে যে দিকনির্দেশনা পেয়েছিলাম তা এখন পাথেয় হিসেবে কাজে দিচ্ছে। আমি জীবনের দীর্ঘ সময় জুড়ে দেশের প্রথিতযশা লেখক, কবি, সাহিত্যিক সাংবাদিকের সাথে কাজ করেছি। সর্বজন শ্রদ্ধেয় আল্লামা আবদুল মান্নান তালিবের কাছ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর ধরে শিখেছি। বর্তমান বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আল মাহমুদের সাথে এক বছর ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। বিশিষ্ট নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদের সাথে অনেকগুলো বইয়ের কাজ করেছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কবি বেনজীর আহমদের ‘হেমন্তিকা’ ও ‘জিন্দেগী’ কাব্যগ্রন্থ এবং শাহাবুদ্দীন আহমদের ‘চতুর্দশ শতাব্দীর বাংলা কবিতা’। বিভিন্ন লেখকের অন্তত দুই হাজারের অধিক গ্রন্থ সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বে সম্পাদনা, সংশোধন, পরিমার্জন করেছি। কাজ করতে গিয়ে ভুল হয়েছে, ভুল হলে অগ্রজদের কাছ থেকে শিখেছি। এখনো প্রতিনিয়ত শিখছি অনেকের কাছ থেকে। এই সব উঁচুস্তরের মানুষের সাথে কাজ করতে গিয়ে মণি-মাণিক্য সঞ্চয় হয়েছে অনেক। যা মনের মণিকোঠায় তুলে রেখেছি সযতনে। আজ আমাদের মাথা আছে কিন্তু সেই মাথার উপরে আচ্ছাদন নেই। কাজ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়লে সহসা মনের পর্দায় ভেসে ওঠে কয়েকটি জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের নাম। আল্লামা আবদুল মান্নান তালিব, একেএম নাজির আহমদ, অধ্যক্ষ আব্দুর রব, কথাশিল্পী জামেদ আলী, নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদ, সব্যসাচী লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দ, কবি মতিউর রহমান মল্লিক, কবি গোলাম মোহাম্মদ প্রমুখ ছিলেন এক একটি নক্ষত্র। কথাশিল্পী জামেদ আলী ছাড়া খুব কাছাকাছি সময়ের মধ্যে অন্যদেরকে আমরা হারিয়েছি। তাদের অভাব এখন আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আজ আল্লামা আবদুল মান্নান তালিবের মতো বহুভাষাবিদ একই সাথে কুরআন-হাদিস, বিজ্ঞান, ইতিহাস-ঐতিহ্য, ফেকাহ, কবিতা, ছন্দ, অর্থনীতি, দর্শন ইত্যাদি সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখে এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। তাই বলছিলাম যে, আজ আর আমাদের মাথার উপরে ছাতা নেই। আমরা যে হাজার হাজার কাজ করেছি কিন্তু কোথাও নিজের নামটা পর্যন্ত ব্যবহার করিনি। আমরা নাম-জসের পাগল ছিলাম না, ছিলাম কাজের পাগল। আবদুল মান্নান তালিব প্রায়ই বলতেন, মুসলমানরা দুনিয়াতে এমন বড় বড় কাজ করেছেন অথচ নিজের নামটা পর্যন্ত প্রকাশ করেননি। না জানি আত্মপ্রচারের দায়ে দণ্ডিত হয়ে পরকালে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় কিনা। কিন্তু আজ পরিস্থিতি পাল্টেছে অন্যের ওপরে নিজের নামটা না দেখলে অনেকে মনোক্ষুণœ হয়, কাজ করা ছেড়ে দেয়, এমনকি সংগঠন ত্যাগ করে। নিজের গলা থেকে আল্লাহর রজ্জু পর্যন্ত খুলে ফেলে।
কবি গোলাম মোহাম্মদ ছিলেন এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত। এই কবি ছিলেন কাজপাগল একজন মহৎ মনের মানুষ। কাজের গন্ধ পেলে তিনি আদেশের অপেক্ষা করতেন না। ঝাঁপিয়ে পড়তেন কাজে। নীরবে নিভৃতে অসংখ্য গান কবিতা লিখে গেছেন কবি গোলাম মোহাম্মদ। তিনি শুধু লিখেই গেছেন কিন্তু তা প্রকাশের কোনো পেরেশানি তার মধ্যে লক্ষ করিনি। আমাদের উচিত তার সমগ্র কর্মকাণ্ড জাতির সামনে উপস্থাপিত করা, তুলে ধরা।
কবি গোলাম মোহাম্মদের প্রত্যেকটি কাব্যগ্রন্থ ভিন্ন ভিন্ন আমেজের। তার প্রতিটি কবিতা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ভিন্ন। তবে আশর্দিক দিক দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে মনে হবে তা অভিন্ন। তার কবিতার অন্তর্গত ভাব একগুচ্ছে জমা করলে বুঝা যায় তা এক একটি তসবিদানার মতো, কিন্তু অবিচ্ছন্ন সূত্রে একত্র করলে দেখা যাবে তা জমাট ঈমানী শক্তিতে একতাবদ্ধ। তার প্রতিটা কবিতার আলাদা স্বাদ স্বতন্ত্রভাবে গ্রহণ করা খুবই সহজ। তার এক একটি কবিতা পাঠ করে, তার গান শুনে মুগ্ধ হতে হয়। তাকে পাঠ করে ও শুনে কাটিয়ে দেয়া যায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কিংবা বছর। পাঠক শ্রোতাকে বিমুগ্ধ করার বিমোহিত করার ক্ষমতা যে লেখক বা কবির যত বেশি সেই লেখক বা কবির কালোত্তীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। কবি গোলাম মোহাম্মদ এক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সফল বলে আমরা মনে করি।
উপমা, অলঙ্কার, ভাববিন্দু মিলে সৃষ্টি হয়েছে তার কবিতার শরীর। তার কবিতা বিভিন্ন মাত্রায়, বিভিন্ন ভাব অলঙ্কারে প্রকাশিত হলেও তার যোগফল কিন্তু একটাই। আর তা হলো আদর্শ। এই আদর্শিক বুনন সহজে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। তার মতো অধিক সহজ সরল সাবলীল ভাষায় কবিতার জমিন এত নিখুঁতভাবে ভরাট করতে ইতঃপূর্বে অন্য কোনো কবিকে দেখা যায়নি। সুচ সুতা, সেলাই বুনন, কারুকাজ সবই কবির একান্ত নিজের। সবক্ষেত্রেই কবির নিজের নিপুণতা নিজেই ধরে রেখেছেন।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইসলামি গানের স্বতন্ত্র একটা ধারা তৈরি করেছেন, যা কালজয়ী। কবি মতিউর রহমান মল্লিক সেখান থেকে কিছুটা হলেও সরে এসে আদর্শিক ও বৈপ্লবিক নতুন একটা ধারা সৃষ্টি করেছেন। মল্লিক থেকে আরো কিছুটা সামনে এগিয়ে এসে কবি গোলাম মোহাম্মদ অতি সহজ সরল ও মোলায়েম ভাব-ভাষায় সৃষ্টি করেছেন তার গীতিকাব্য। যা পাঠক-শ্রোতাকে আবিষ্ট করে। ধরে রাখে। সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। কবি গোলাম মোহাম্মদের বিশেষ কৃতিত্ব এইখানে যে তিনি সব সময় একদম পরিচিত শব্দে তার কাব্য-গানের ক্ষেত্র তৈরি করেছেন। চেনা শব্দে এভাবে কাব্য ভাষা ও বিষয় অাকর্ষণ করতে ইতঃপূর্বে খুব কম কবিকেই দেখা গেছে। এ ক্ষেত্রে তিনি বিরল। তার প্রতিটা কবিতা গান পরস্পর থেকে আলাদা তবে তা নতুন আঙ্গিকে নতুন কাব্যভাবনায় সৃষ্টি হয়েছে। এই কারণে পাঠকের আকর্ষণ তার প্রতি।
পথহারা জনগণকে জাগিয়ে তোলার সেরা হাতিয়ার হচ্ছে কবিতা। সেই আদিকাল থেকে তাই সবচেয়ে আকর্ষণীয় মাধ্যম হিসেবে কবিতাই সব সময় আদৃত হয়ে আসছে। কবিতা মানুষকে সুন্দরের স্বপ্ন দেখায়। মনকে করে তোলে সতেজ। কবিতার মাধ্যমে খুব সহজে মানুষের মনে আদর্শের বীজ বুনে দেয়া যায়।
গত শতাব্দী থেকে বলা যায় দুনিয়া জুড়ে মানুষের মধ্যে আত্মোপলব্ধি ও আত্মানুসন্ধানের ঢেউ জেগে উঠেছে। মানুষ খুঁজতে শুরু করেছে আপন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আদর্শিক ঠিকানা। নিজের যা আছে তাই নিয়ে সে জেগে উঠতে চাই। বেঁচে থাকতে চাই আপন ঐতিহ্য নিয়ে। আমরা জানি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আদর্শিক রাস্তা ধরেই এগিয়ে চলে মানব সভ্যতা। আর সে কারণেই আজ মুসলিম জাতিও সামনে এগিয়ে যেতে চায় তার স্বর্ণখচিত দ্যুতিময় অতীত ঐতিহ্যের পথ ধরে। মুসলমানদের আছে দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ। আছে দেড় হাজার বছরের গৌরবময় সোনালি ইতিহাস। এরই ধারাবাহিকতায় যেসব মনীষী আদর্শিক সাহিত্যের ক্ষেত্রে স্বাক্ষর রেখে গেছেন কবি গোলাম মোহাম্মদ তাদের অনেকের মধ্যে একজন। আমাদের পূর্বসূরি কবি গোলাম মোস্তফা, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি শাহাদাৎ হোসেন, কবি ফররুখ আহমদ প্রমুখ হচ্ছেন সেই আদর্শের একেকজন সিপাহসালার।
আশির দশকের গোড়ার দিকে বাংলা কবিতাকে নাস্তিক্যবাদ ও আদর্শহীনতার কবল থেকে মুক্ত করার একটা প্রয়াস শুরু হয়েছিল। এ প্রচেষ্টার অনেকখানিই সফল হয়েছে নব্বই দশকে এসে। একঝাঁক বিশ্বাসী কবি এই প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, কবি মতিউর রহমান মল্লিক, কবি সোলায়মান আহসান, কবি আসাদ বিন হাফিজ, কবি মুকুল চৌধুরী, কবি হাসান আলীম, কবি মোশাররফ হোসেন খান, কবি গোলাম মোহাম্মদ, কবি গাজী এনামুল হক প্রমুখ। এরা বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে একটা ভিন্ন ধারা সৃষ্টি করতে অনেকটাই সফল হয়েছেন। আশির দশক থেকে শুরু হওয়া এই ধারা আজ অবধি সামনে এগিয়ে যাচ্ছে এটা দৃঢ়তার সাথে বলা যায়।
আদর্শবাদী কবিদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন কবি গোলাম মোহাম্মদ। তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন আশির দশক থেকেই। কিন্তু তার প্রায় সব কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে নব্বই দশকে এসে, কোন কোনটা তারও পরে। নব্বই দশকের শেষে কবি গোলাম মোহাম্মদের সাতটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো হচ্ছেÑঅদৃশ্যের চিল (১৯৯৭), ফিরে চলা এক নদী (১৯৯৮), হিজল বনের পাখি (১৯৯৯), ঘাসফুল বেদনা (২০০০) হে সুসূর হে নৈকট্য (২০০২), এছাড়া ছড়াগ্রন্থ ছড়ায় ছড়ায় সুরের মিনার (২০০১) এবং নানুর বাড়ী (২০০২)। কবির প্রকাশিত প্রতিটি গ্রন্থই নন্দিত এবং ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে, যা সচরাচর হয় না।
বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও ইসলামী সাহিত্যের দিকনির্দেশক আবদুল মান্নান তালিব, বিদগ্ধ আলোচক নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদ, বর্তমান বাংলাসাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম কবি আল মাহমুদ, বাংলাসাহিত্যের অন্যতম প্রধান সাহিত্য সমালোচক কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ কবি, লেখক ও সাহিত্য সমালোচক গোলাম মোহাম্মদকে যখন কবি হিসেবে গ্রাহ্যের মধ্যে নিয়ে আসেন এবং বিশেষভাবে তার কবিতাকে উচ্চকিত করেন তখন সাহিত্যাঙ্গনের অনেকেই এই কবিকে সমীহ না করে পারেন না। এ দিক দিয়ে কবি গোলাম মোহাম্মদ সৌভাগ্যবান এবং সার্থক।
আল্লামা আবদুল মান্নান তালিব বলেন, ‘ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ ও জীবনব্যবস্থা হিসেবে তিনি গ্রহণ করেছিলেন। নিজের জীবন ও সাহিত্য কর্মকে এজন্য উৎসর্গিত করেছিলেন। এ ব্যাপারে তার সমগ্র কাব্যকর্মে কোনো জড়তা অস্পষ্টতা নেই। আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক বিশ্বে আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের তিনি ছিলেন একজন বলিষ্ঠ কবিকণ্ঠ।’ (ভূমিকা, কবি গোলাম মোহাম্মদ রচনাসমগ্র)
আবদুল মান্নান সৈয়দ বলেন, ‘কবিতা লিখতেন গোলাম মোহাম্মদ (১৯৫৯-২০০২), গান লিখতেন, ছবি আঁকতেন। তাঁর ছোট প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছিলেন শিল্পকোণ। মানুষটি ছিলেন যেন একটি বিজনতার অধিবাসী, স্মিতহাস্যময়, স্বল্পভাষী। ছন্দোবদ্ধ পদ লেখেন যাঁরা, তারা সবসময় পদ্যে পড়ে থাকে, কবিতায় উত্তীর্ণ হয় না। গোলাম মোহাম্মদের কবিতায় পেতাম কবিতারই আস্বাদ। আমার স্বভাব হচ্ছে, ভালো-লাগাটুকু অনেক সময় লিখে, অন্তত মুখে, জানানো। গোলাম মোহাম্মদকে একাধিকবার আমি জানিয়েছি, তাঁর কবিতা আমার ভালো লাগছে।’ (হিজল বনের পাখি, কবি গোলাম মোহাম্মদ স্মারক, পৃষ্ঠা ৭)
এরপর তার সমসাময়িক প্রায় সকলেই কবিকে নিয়ে লিখেছেন। তরুণ প্রজন্মের প্রায় সব কবি, লেখক, সাহিত্যিক, সংগঠক তাকে পাঠ করেন, তাকে নিয়ে ভাবেন। তাকে নিয়ে লিখেছেন অনেকেই। এটা তার অনেক বড় পাওয়া। তার গানের ভক্ত শিশু, ছেলে, বুড়ো, যুবা সকলেই।
‘সেই সংগ্রামী মানুষের সারিতে
আমাকেই রাখিও রহমান
যারা কোরআনের আহ্বানে নির্ভীক
নির্ভয়ে সব করে দান।’
(কবি গোলাম মোহাম্মদ রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা ২১৩)
‘কাশেমের মায়ের কোল হয়নি খালি
খালি হলো কোটি কোটি মায়েদের কোল,
কোটি কোটি বুকে জ্বলে ব্যথার আগুন
শাহাদাত ভাঙছে সকল আগল।’
(ঐ, পৃষ্ঠা ২১২)
‘হলদে ডানার সেই পাখিটি
এখন ডালে ডাকে না
মনের কোণে রঙিন ছবি
এখন সে আর আঁকে না।
এখন কেন হচ্ছে মানুষ খুন
দুঃখের আগুন জ্বলছে অনেক গুণ…।’
(ঐ, পৃষ্ঠা ২১৪)
‘হিজল বনে পালিয়ে গেছে পাখি
যতই তারে করুণ কেঁদে ডাকি
দেয় না সাড়া নীরব গহিন বন
বাতাসে তার ব্যথার গুঞ্জরণ।’
(ঐ, পৃষ্ঠা ২১৫)
কবি গোলাম মোহাম্মদ এ ধরনের অজস্র গানের জনক। আসলে গানের মাধ্যমেই তার পরিচিতিটা সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। হিজল বনে পালিয়ে গেছে পাখি- এই পঙ্ক্তি উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথেই মনের মাঝে ভেসে উঠে একটি নাম একটি ছবি, তা হলো কবি গোলাম মোহাম্মদ। ‘পাঞ্জেরি’ শব্দটি শুনলেই যেমন মনের মাঝে ভেসে ওঠে কবি ফররুখ আহমদের কথা। ‘বিদ্রোহী’ শব্দটি শুনলেই ভাবতে থাকি নজরুলের কথা। সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে- শুনলেই মন ছুটে যায় সাগর দাড়িতে- কবি মাইকেল মধুসূদনকে মনে পড়ে যায়। ইয়া নবী সালাম আলাইকা, ইয়া রাসূল সালাম আলাইকা, ইয়া হাবিব সালাম আলাইকা- শুনলেই চিন্তা করি কবি গোলাম মোস্তফার কথা। এই খানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে শুনলেই পল্লীকবি জসিম উদ্দীন সামনে এসে হাজির হয়। এমনিভাবে কে ঐ শুনালো মোরে আজানের ধ্বনি- শোনামাত্রই কায়কোবাদকে আর নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না। আরো অনেক কবিই আমাদের অন্তরকে নাড়া দেয় গভীরভাবে। প্রত্যেক কবির একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে যা তাকে আলাদা করে চিনতে আমাদের সাহায্য করে। তেমনি কবি গোলাম মোহাম্মদের অনেক গান কবিতা মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে, সেসব চরণগুলো শুনলেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে কবি গোলাম মোহাম্মদের নাম। লক্ষ বছর ঝরনায় ডুবে রস পায় নাকো নুড়ি-(নজরুল) তেমনি লক্ষ লক্ষ পৃষ্ঠা লিখেও অনেকেই পাননি কবি খ্যাতি। কবি গোলাম মোহাম্মদ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।
মানুষের হৃদয়ে নাড়া দেয়ার মতো অসংখ্য গানের স্রষ্টা কবি গোলাম মোহাম্মদ। সুর যত সহজে মানুষের মনে ঝংকার তোলে সাহিত্যের অন্য কোন মাধ্যমে অত সহজে মানুষের মনে স্থান করে নেয়া যায় না। এদিক দিয়ে গোলাম মোহাম্মদ এগিয়ে গেছেন নিঃসন্দেহে। আমার মনে হয় গান না লিখলে গোলাম মোহাম্মদ কখনো এতটা জনপ্রিয় ও কালজয়ী হতে পারতেন না।
কবি গোলাম মোহাম্মদ একটা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন- যেখানে থাকবে না ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বঞ্চনা, লাঞ্ছনা। স্বপ্ন দেখতেন মানবতার জয়গানের, স্বপ্ন দেখতেন কালজয়ী এক শ্রেষ্ঠ সভ্যতার। যে সভ্যতা ধারণ করেছিলেন সর্বযুগের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা হযরত মুহাম্মদ সা:। সুন্দর সেই জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি লিখেছেন অসংখ্য গান কবিতা। যা অনেক দিক থেকেই সাহিত্য আকাশে শুকতারার মতো জ্বলজ্বল করছে। যা প্রতিনিয়ত অনেক আদর্শবাদী মানুষের মনে অনুরণিত হয়, হচ্ছে।
গানের মতো তার কবিতাও পাঠকমহলে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। যা শিল্পবিচারে উত্তীর্ণ হয়েছে বলে মনে করেন সুপণ্ডিত সাহিত্য সমালোচকরা। তার কবিতার কিছু উদাহরণ পেশ করা হলো-
‘পাখি
পাখিরে তোর ঈমান বড়ই পাকা
আহা!
তোর গানে যে মনের বিনয় মাখা।
(পাখিরে তোর, হিজল বনের পাখি)
‘হাতটারে সাফ কর সাফ কর দিল
মুছে যাবে যন্ত্রণা সব মুশকিল
তাল তাল আন্ধার পাপ কর দূর
পুষ্পিত দিন পাবে ঘ্রাণ সুমধুর।’
(হাসতো নিখিল, অদৃশ্যের চিল)
‘তৃতীয় বিশ্বের যুবক মাত্রই বিষণ্ণতার রোগী
তার সামনে অন্ধকার, মহানগরীর ডাস্টবিনের মতো
পচা রাজনীতির আস্ফালন!’
(ফসলহীন সময়ের কথা, ফিরে চলা এক নদী)
‘সেও তো ধ্বনির কাজ
তোমার প্রভুর নামে পড়
অনন্ত ভাবের ফুল ফুটে হলো
ভাষার বাগান।’
(হরফের সাঁকো, ঘাস ফুল বেদনা)
শব্দে-ছন্দে, ভাব-কল্পনায়, আদর্শ-উদ্দীপনায়, আশা-ভালোবাসায় গোলাম মোহাম্মদের অনেক কবিতা অতুলনীয়, অসাধারণ ও অনন্য। পাঠক পুলকিত, শিহরিত ও চমকিত হয় তা পাঠ করে। তার কবিতা পাঠক সহজেই হৃদয়ে ধারণ করতে পারে। তার কবিতা মনকে আন্দোলিত করে, উদ্দীপিত করে, বিমোহিত করে। তার কবিতায় ছন্দের অপূর্ব দোলা আছে। তার কবিতায় কোথাও ছন্দের ভুল পরিলক্ষিত হয় না। পাঠক মাত্রেই মোহনীয় সেই ছন্দ দোলায় দুলতে থাকে এবং একজন আদর্শবান, বড় ও ভালো মানুষ হবার স্বপ্ন জাগে মনে। দায়িত্বশীল, ন্যায়নিষ্ঠ, কর্তব্যপরায়ণ মানুষ গড়তে সহায়তা করে তার লেখা। স্বপ্ন ভরা উদ্দীপনাময় তার কবিতা নতুন প্রজন্মের পাথেয় হতে পারে।
আমি মনে করি গোলাম মোহাম্মদ একটি কালজয়ী প্রতিভা। বিশেষ করে গানের মাধ্যমে তিনি সুদীর্ঘকাল মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন। তার গান আবেদন ছড়াবে যুগ যুগ ধরে। তার সৃষ্টিসম্ভার প্রকাশিত হলে পাঠক, সাহিত্যালোচক তাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারবে। তিনি শুধু একজন কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন উঁচুমাপের চিত্রশিল্পী। ছিলেন সংগঠক। সর্বোপরি ব্যক্তি হিসেবে তিনি ছিলেন একজন বড় মনের মানুষ, বড় মাপের মানুষ। কবি, শিল্পী, সংগঠক হিসেবে তিনি যতটা পরিচিতি লাভ করেছেন, তার থেকে অধিক পরিচিতি পেয়েছেন গীতিকার হিসেবে। তার গান কালোত্তীর্ণ হতে পেরেছে বলে আমাদের বিশ্বাস। তার আজন্ম স্বপ্ন ছিল এদেশে আল্লাহ প্রদত্ত জীবনবিধান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবতার মুক্তি। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক কবি। তিনি ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ মানবতাবাদী কবি।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক