আখতার হামিদ খান: চর্যাপদ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কালের বাংলা গান রচয়িতাদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের গানে বিষয়ের যে বৈচিত্র্য, অন্য কারও গানে তা নেই। যুগের প্রয়োজনে এক এক কালে এক এক বিষয় প্রাধান্য বিস্তার করে। চর্যাগানের মূল বিষয় ছিল আধ্যাত্মিকতা। বৈষ্ণব পদাবলীতে পৌরাণিক বিষয় স্থান পেয়েছে। তার সঙ্গে কোথাও কোথাও প্রেমরস মিশ্রিত হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ের গানে লৌকিক ধ্যান ধারণা প্রবেশ করেছে। পরাধীনতার যুগে এসে গানের বিষয় হয়েছে দেশাত্মবোধ ও বিদ্রোহ চেতনা। এসব ছাপিয়ে সাম্প্রতিককালে প্রাধান্য বিস্তার করেছে মানবীয় প্রেম।
বাংলা গানের বিকাশ ও সমৃদ্ধির ধারায় অন্যতম প্রধান হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন এবং কাজী নজরুল ইসলাম। এছাড়াও বাংলা গানকে যাঁরা সমৃদ্ধ করেছেন, নতুন সুর ও রীতির প্রবর্তন করেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রামপ্রসাদ সেন, রামনিধি গুপ্ত, দাশরথি রায়, হাসন রাজা, লালন ফকির, বিজয় সরকার প্রমুখ। এঁদের প্রত্যেকের গানেই রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। গানের বিষয়, সুর, আবদনে রয়েছে স্বকীয়তা। কিন্তু অনেকের গানেই বিষয়-বৈচিত্র্য নেই। কেউ শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন তো অন্য কোন বিষয়ে লেখেননি। কেউ শুধু অধ্যাত্মিক ভাবের গান রচনা করেছেন। কেউ বাউল বা কেউ আধুনিক প্রেমমূলক গান। আবার কেউ কেউ নানা বিষয় নিয়ে গান লিখেছেন। কিন্তু এত ব্যাপক বিষয়ের অবতারণা নজরুল ছাড়া শ্যামাসঙ্গীতও রচনা করেছেন। রামনিধি গুপ্ত টপ্পা অঙ্গের গান। দাশরথি রায় পাঁচালি গান রচনা করেছেন। হাসন রাজা-লালন ফকির লোকসঙ্গীত, বাউল গান রচনা করেছেন। বিজয় সরকারের গানের বিষয় আধ্যাত্মিকতা। এঁদের প্রত্যেকের গানেই যে কোন একটি বিষয় নির্ভর করেছে। একই বিষয় ও ভাবের গান রচনা করেছেন সারা জীবন ধরে। ব্যতিক্রম রবীন্দ্র, নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ ও রজনীকান্ত,। দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ এবং রজনীকান্ত মূলত ভক্তিমূলক, দেশাত্মকবোধক এবং প্রেম বিষয়ক গান রচনা করেছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল অবশ্য হাস্যরস বিষয়ে কিছু গান রচনা করেছেন। কিন্তু এ তিন জনের গানেই খুব বেশি বিষয় বৈচিত্র্য নেই। বিষয় বৈচিত্র্য রয়েছে রবীন্দ্র-নজরুলের গানে বেশি। এত বিচিত্র বিষয় নিয়ে বাংলার আর কোন গীতিকার সঙ্গীত রচনা করেননি। নানা বিষয় সঙ্গীত লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। নজরুল লিখেছেন তারও বেশি বিষয় নিয়ে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, গানের বিষয় বলতে আমি গানের মর্মবাণীকে যেমন বুঝাচ্ছি, তেমনি বুঝাচ্ছি সঙ্গীতের ধারা বা শ্রেণীকে। অর্থাৎ কথার অন্তর্নিহিত ভাব কোন আবেদন প্রকাশ করছে, সে অনুসারেই সঙ্গীতের শ্রেণীকরণ করছি। যেমন ভক্তিমূলক, আধ্যাত্মিক, বৈষ্ণব, পদাবলী, কীর্তন, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি, গজল, প্রেমসঙ্গীত ইত্যাদি। সঙ্গীতের এই নানা শাখায় বিচরণ করেছেন নজরুল। রবীন্দ্রনাথও বিভিন্ন, বহু বিষয়ে গান লিখেছেন। যেমনস ব্রহ্মসঙ্গীত, দেশাত্মবোধক, ভক্তিমূলক, কীর্তন, পদাবলী, প্রেম, প্রকৃতি, সম্প্রীতি, সমাজসচেতনা, আধ্যাত্মিকতা, বাউল ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গান রচনা করেছেন। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সুরের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন সুরে। রামপ্রসাদী, কীর্তন, বাউল সুরের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন তাঁর গানে। কিন্তু নজরুল আর একটু এগিয়ে বাংলায় গজল রচনা করেছেন। মধ্যপ্রাচ্য অর্থাৎ আরবীয় সুরে সঙ্গীত রচনা করেছেন। জারি, সারি, মুর্শিদি, মারফতি, ভাটিয়ালি, গান যেমন লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন, শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন, ভজন ইত্যাদি গান; আবার আধুনিক মানবীয় প্রেমসঙ্গীত, রাগসঙ্গীত, বিদ্রোহ ও দেশাত্মকবোধক গানও লিখেছেন নজরুল।
গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকে নজরুল অজ¯্রভারে গান লিখে যাচ্ছিলেন। সেই গানের ভা-ার পরিমাণে যেমন বিপুল, শ্রেণী বিভাগেও তেমনি বিচিত্র। লঘু বাংলা গান থেকেও গুরুগম্ভীর ধ্রুপদ পর্যন্ত বাংলা গানের হেন শাখা নেই যাতে তিনি গান রচনা করেননি। বিদেশি গানের অনুকরণে বিদেশি সুর বসিয়েও অনেক গান রচনা করেছেন তিনি। বৈচিত্র্য ও বিপুলতা এ দুইই নজরুলের সঙ্গীত প্রতিভার প্রাচুর্যের স্বাক্ষর বহন করে।’
প্রায় চার হাজার গান রচনা করেছেন নজরুল। এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। আর নজরুলের গানের কথা, সুর ও বিষয়-বৈচিত্র্য সকলকে বিস্ময়াভিভূত করে। বৈষ্ণব যারা তাঁরা রাধাকৃষ্ণের বাল্যলীলা, প্রেমলীলা ও গোষ্ঠিলীলায় সুর-চিত্র দর্শনের দুর্লভ সুযোগ লাভ করবেন নজরুলের রচনায়। শাক্ত যিনি, তিনি শ্যামামায়ের পায়ের তলায় নিজের মনটিকেও একটি রাঙা জবা করে ধরে দিতে পারেন নজরুলের শ্যামসঙ্গীতের খেয়ায় ভেসে। মুসলমান যিনি, তিনি ঈদের বাঁকা চাঁদ প্রথম দেখার আনন্দে আত্মহারা হবার ভাষা খুঁজে পাবেন এই নজরুল গীতির ভা-ার থেকেই। প্রেমিক যিনি, তিনি প্রেমের বিভিন্ন স্তরের সুখের ও শোকের সাড়া পাবেন নজরুলের গানে। তাঁর হাসির গানের সংখ্যাও কম নয়। তাঁর দেশাত্মবোধক গান সারা বাংলা তথা ভারতের নিপীড়িত জনগণের অন্তর মথিত বাণী।
সারা জীবন নজরুল নানা জায়গা ঘুরছেন, বিচিত্র পেশা গ্রহণ করেছেন, বহু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। নিজে ছিলেন শিল্পী এবং সুর¯্রষ্টা। আর তাই অভিজ্ঞতালব্ধ বিষয়ই তার সঙ্গীতের বিষয় হয়ে উঠেছে। তাঁর কর্ম এবং অভিজ্ঞতা যেমন বিচিত্র ছিল; তেমনি তাঁর গানের বিষয়ও বিচিত্র ছিল। সঙ্গীত ছিল তাঁর একান্ত ব্যক্তিক অনুভূতির পরিম-ল। সঙ্গীত রচনাতেই সম্ভবত তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন বেশি। আর এ কারণেই তার সঙ্গীত এত বিপুল ও বৈচিত্র্যময়। জাত-পাতে তাঁর বিশ^াস ছিল না। তিনি মানুষ। তিনি সর্ব জাতির, সর্ব ধর্মের। আর এ বোধেরই প্রকাশ দেখা যায় তাঁর বিচিত্র বিষয়ের গানে। এদিকে যেমন লিখেছেন ভজন, কীর্তন, শ্যামসঙ্গীত, অন্যদিকে তেমনি লিখেছেন ইসলামি ভক্তিমূলক গান, জারি, সারি, মুর্শিদি মারফতি।
লেটোর দলকে কেন্দ্র করেই কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গীত ও কাব্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে। এখানেই একই সঙ্গে বহু বিচিত্র বিষয়ে গান রচনায় তাঁর হাতে খড়ি হয়। লেটোর দলের জন্য পালা রচনা করতে গিয়ে মুসলিম ও হিন্দু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় ঘটে। তিনি একদিকে যেমন মুসলিম জীবনধারা থেকে কাহিনী ও গীত রচনার উপাদান সংগ্রহ করেন, অপরদিকে হিন্দু পৌরাণিক উপাখ্যানের পটভূমিতেও পালাগান রচনা করেন। তাঁর সে সময়কার রচনাতেই এই দুই ঐতিহ্য¯্রােতের সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়। নজরুলের পরবর্তীকালের বহু রচনায় মুসলিম ও হিন্দু ঐতিহ্যের যে অসামান্য সহাবস্থিত রূপটি প্রকাশ পেয়েছিল, তার সূচনা ঘটে এই পর্বে। তাছাড়া লেটোর দলের সঙ্গে যুক্ত হবার ফলে তিনি বর্ধমান অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়েও সুযোগ পেয়েছিলেন। সে অঞ্চলে বিশেষভাবে প্রচলিত ঝুমুর গানের সঙ্গে সে সময়ই নজরুলের পরিচয় ঘটে। পরবর্তীকালে ঝুমুর অঙ্গে বহু গান রচনা করেছিলেন তিনি। এই বিচিত্র অভিজ্ঞতার প্রকাশই তাঁর নানা গানে। এমন কোন বিষয় নেই, যে বিষয় নিয়ে তিনি গান রচনা করেননি।
নজরুলের এই ব্যাপক কর্মযজ্ঞ, বিশাল বিষয়-বৈচিত্র্যময় সঙ্গীত ভা-ার পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বাংলা গানে যে সব ধারা প্রচলিত রয়েছে, নজরুলের গানেও সে সব ধারা রয়েছে। নজরুলের গানের উল্লেখযোগ্য ধারাগুলো হচ্ছে- ভজন, কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি, মুর্শিদি, মারফতি, হামদ, নাত, আধুনিক প্রেমসঙ্গীত, গজল, রাগসঙ্গীত, দেশাত্মবোধক, বাউল সঙ্গীত, ঝুমুর, বিদ্রোহমূলক, হাসির গান ইত্যাদি। বাংলার আর কোন সঙ্গীত রচয়িতা এত বিচিত্র বিষয় নিয়ে গান রচনা করেননি। নজরুল গানের এই প্রত্যেকটি শাখায় সফলতা লাভ করেছেন। এখানেই নজরুলের শ্রেষ্ঠত্ব।
নজরুলের গানে এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে ভজন গান। ভজন এক জাতীয় আরাধনা সঙ্গীত বা ভক্তিগীতি। ঈশ্বর বন্দনাই এ গানের উদ্দেশ্য। অন্য কোন বাংলা গান রচয়িতা নজরুলের মত এত উৎকৃষ্ট, সমৃদ্ধ এবং বিপুল ভজন রচনা করতে সক্ষম হননি। তাঁর ভজন তথা হিন্দুধর্মীয় সঙ্গীত যেমন বিপুল, তেমনি বিস্ময়কর সঙ্গীত যেমন বিপুল, তেমনি বিস্ময়কর রকম বৈচিত্র্যপূর্ণ। ‘হে গোবিন্দ রাখো চরণে’, ‘সখি সে হরি কেমন বল,’ ‘খেলছি এ বিশ্ব লয়ে,’ ‘অনাদি কাল হতে অনন্ত লোক গাহে তোমারি জয়’, ‘আহার দিবেন তিনি রে মন, জিভ দিয়াছেন যিনি,’ ‘অঞ্জলি লহৈা মোর সঙ্গীতে’, ‘কোথা তুই খুঁজিস ভগবান’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য গানসহ বহু ভজন লিখেছেন নজরুল।
বুলবুলের মৃত্যু নজরুলের জীবনে এক গভীর পরিবর্তনের বীজ বপন করে। অগ্নিগর্ভ কবিতা ও গীত রচয়িতা বিদ্রোহী নজরুল এই শোকের আঘাতে অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়েন। এক প্রকার আধ্যাত্মিকতা তাঁকে গভীরভাবে পেয়ে বসে। অন্তর্গত বিষাদ ও আধ্যাত্মিকতাই যেন ছিল তার চৈতন্যের বাদীস্বর। সেই সময় থেকেই নজরুলের ভেতরে ভক্তিমূলক গান লেখার প্রবণতা দানা বাঁধতে থাকে। এবং পরবর্তী সময়ে তিনি ইসলাম ও হিন্দু ধর্মীয় আবেগের পটভূমিতে প্রচুর গান রচনা করেন। ভজনগুলো সেই অনুভূতিরই বহিঃপ্রকাশ। নজরুলের গানের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে এই ভজন জাতীয় গানগুলো। কোন কোন ভজন গানে শিবের আরাধনা ব্যক্ত হয়েছে। কোনটায় কৃষ্ণের কথা। পদাবলী কীর্তনের ঢঙে নজরুল প্রচুর কীর্তন রচনা করেছেন। কথা ও সুরে পুরোপুরি কীর্তন। কিছু গান ভজনও বলা চলে, আবার কীর্তনও বলা চলে; দুইয়েরই প্রভাব রয়েছে। যেমন: ‘হৃদি পদ্মে চরণ রাখো, বাঁকা ঘনশ্যাম; গোষ্ঠের রাখাল বলে দেরে কোথায় বৃন্দাবন ইত্যাদি।
পদাবলী কীর্তন বা কীর্তন গান বাঙালির বহু কালের ঐতিহ্যের ধারক। এগুলো বাঙালির অন্তর-সম্পদে পূর্ণ। বাংলার নিজস্ব ঢঙ, চিরায়ত সুর এ গানে বিধৃত। রবীন্দ্রনাথও বহু কীর্তনাঙ্গের গান রচনা করেছেন। নজরুলের কীর্তন খুবই ঋদ্ধ। কথা ও সুরের সার্থক সমন্বয় ঘটেছে নজরুলের কীর্তনে। আধুনিককালে যাঁরা কীর্তন গান রচনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে নজরুলের কীর্তনই শ্রেষ্ঠ এবং সংখ্যায়ও প্রচুর। উল্লেখযোগ্য কীর্তনগুলো হচ্ছে- ‘বাজে মঞ্জুল মঞ্জীর’, ‘সখি আমিই না হয় মান করেছিনু; ‘ওরে নীল যমুনার জল, আমি সুখে লো গৃহে রব, ‘না মিটিতে মনোসাধ, ‘মন মানস মাধবী ফুটিল কুঞ্জে, মণি মঞ্জীর বাজে অরুণিত চরণে, ‘এলো নন্দের নন্দন নবঘনশ্যাম। মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলীর চেয়ে নজরুলের এ কীর্তনগুলো শিল্প সফরতায় কোন অংশেই কম নয়।
নজরুলের গানের একটা বিশাল অংশ জুড়ে যেমন রয়েছে ভজন এবং কীর্তন গান; তেমিন ব্যাপক অংশ জুড়ে রয়েছে শ্যামাসঙ্গীত। এত বিপুল পরিমাণ শ্যামাসঙ্গীত নজরুল ছাড়া আর কেউই লেখেননি। নজরুল ইসলামি ভাবধারার গানের থেকে অনেক অনেক বেশি তাঁর শ্যামাসঙ্গীত। রামপ্রসাদ শ্যামাসঙ্গীত রচনার সূত্রপাত করেন। নজরুল শ্যামাসঙ্গীতে কোথাও শ্যামা মাতৃরূপিণী, কোথাও কালীর রৌদ্রী রূপের ভয়ঙ্কর বর্ণনা, আবার কোথাও দেশাত্মবোধের প্রেরণা প্রকাশিত। অন্যান্য গানের চেয়ে নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং পরিমাণের প্রচুর বেশি। তাঁর উল্লেখযোগ্য শ্যামাসঙ্গীত হচ্ছে- ‘বলরে জবা বল;’ ‘শ্যামা নামের লাগলো আগুন, আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়, শ্মশানকালীর রূপ দেখে যা; শ্মশানে জাগিছে শ্যামা, ‘থির হয়ে তুই বস দেখি মা; ‘ভারত শ্মশান হলো মা তুই; আয় মা চঞ্চলা মুক্তকেশি শ্যামা কালী; শ্যামা তোর নাম যার জপমালা; ওমা খড়গ নিয়ে মাতিস রণে।
নজরুল প্রচুর পরিমাণে জারি, সারি, ভাটিয়ালি এবং পল্লীগীতি রচনা করেছেন। এসব গানেও বাঙালির, আবহমান বাংলার ঐতিহ্য ধরা পড়েছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আবেগ যেন এসব গানে স্থির হয়ে রয়েছে। ‘পদ্মার ঢেউরে, মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে, যা যারে, এ বিখ্যাত গানটি ভাটিয়ালি গানের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এছাড়াও রয়েছে- ‘নদীর এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে, এইতো নদীর খেলা; আমার গহীন জলের নদী; নদীর নাম সই অঞ্জনা; বাঁশি বাজায় কে কদম তলায়, ওগো ললিতে, পথভোলা কোন রাখাল ছেলে’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য গান।
ভক্তিমূলক গান রচনায় নজরুল অদ্বিতীয়। নজরুলের ইসলামি ভাবধারায় গানগুলোতে মুসলিম ঐতিহ্য ধরা পড়েছে। মুর্শিদি মারফতি হামদ নাত প্রভৃতি বিষয়ে নজরুল ইসলামি ভাবধারায় প্রচুর গান লিখেছেন। ভক্তি, শরণাগতি ও মাহাত্মবোধের প্রেরণা থেকে নজরুল ইসলাম ধর্ম সম্পৃক্ত বিভিন্ন বিষয় অবলম্বনে ুদই শতাধিক গান রচনা করেছেন। এই সব গান নজরুলের ইসলামি গান রূপে খ্যাত। বাংলায় ইসলামি ভক্তিগীতির প্রবর্তন নজরুলই প্রথম করেন। তাঁর রচিত ইসলামি গান বাংলা গানের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। বাংলায় ইসলামি গানের সর্বশ্রেষ্ঠ রূপকারও নজরুল। আল্লাহর প্রশস্তি, রসূল প্রশস্তি, ধর্মীয় বিধান, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, উপাসনা, উপাসনালয় প্রভৃতি নানা বিষয় অবলম্বনে নজরুলের ইসলামি গানগুলো রচিত। নজরুলের উল্লেখযোগ্য ইসলামি গানগুলো হচ্ছে- ‘মহম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে, রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ, এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল, তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে; খোদার প্রেমেরর শরাব পিয়ে; শোনো শোনো ইয়া ইলাহী আমার মোনাজাত; মওলা আমার সালাম লহ; ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়; মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই; মরু সাহারা আজ মাতোয়ারা; মোহাম্মদ মোর নয়ন-মণি; তোমার নুরের রোশনী মাখা; রোজ হাশরে আল্লাহ আমার করো না বিচার।’
আধুনিক বাংলা প্রেমগানের বিশিষ্ট রূপকার নজরুল। তৎকালীন ছায়াছবির একটা প্রধান অংশ জুড়ে ছিল নজরুলের গান। আধুনিক গানকে নজরুলই জনপ্রিয়তা দান করেছেন। তাঁর আধুনিক গানের আবেদন আজকে এতটুকু হ্রাস পায়নি। আধুনিক গানের পরিমাণও নজরুলের কম নয়। নজরুলের আধুনিক গানের সুর বৈচিত্র্য আশ্চর্যভাবে বিস্ময়কর। কালজয়ী কিছু গান গভীর নিশীতে ঘুম ভেঙ্গে যায়; তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি, প্রিয়, জনম জনম গেল আশা পথ চাহি; মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম; আজো মধুর বাঁশরী বাজে; আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো; তবু আমারে দেবো না ভুলিতে; যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই, কেন মনে রাখো তারে; আমি চাঁদ নহি অভিশাপ; মনে পড়ে আজ সে কোন জনমে, বিদায় সন্ধ্যা আসিল; মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী; ভীরু এ মনের কলি; মোর না মিটিতে আশা ভাঙিল খেলা ইত্যাদি।
বাংলায় গজল গানের প্রচলন মূলত নজরুলই করেন। গজল মূলত পারস্য প্রেম সঙ্গীত। ফার্সি কবিরা গজল রচনা করতেন। এ প্রেম ঐশী প্রেমপ্রার্থী। অন্য সকল প্রকার কাব্যগীতির মত জগলেরও সঙ্গীতাদর্শ হচ্ছে সুরের সাহায্যে গানের বাণীকে ধ্বনিত করে তোলা, যেন পদবাহিত ব্যঞ্চনা সুরের স্পর্শে প্রমূর্ত হয়ে উঠতে পারে।