Sunday, June 24, 2018

মালয়েশিয়ার ইসলামী আন্দোলন, আনোয়ার ইব্রাহীম এবং জামায়াতে ইসলামী

-  শাহাদাতুর   রহমান   সোহেল

            মালয়েশিয়ার ইসলামী আন্দোলনের নেতা আনোয়ার ইব্রাহীম জামায়াতে ইসলামী ও ইখওয়ানুল মুসলেমীনের সাহিত্য ও আন্দোলন দ্বারা উজ্জ্বীবিত হয়েই মালয়েশিয়ার যুব আন্দোলন আবিম(Angkatan Belia Islam Malaysia (ABIM): www.abim.org.my ) গঠন করেন এবং এক সময় যুব সম্প্রদায়ের একচ্ছত্র নেতায় পরিনত হন। দীর্ঘ ঘাত প্রতিঘাতের পর দাতুক সেরি মাহাথির মোহাম্মদের সাথে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। মন্ত্রী থেকে ক্রমান্বয়ে উপ-প্রধানমন্ত্রী পদ পর্যন্ত ক্ষমতা লাভ করেন। বিভিন্ন সরকারী কাজ পরিচালনায় ব্যাপক দক্ষতা ও সাফল্যের জন্য বিশ্বব্যাপি খ্যাতি অর্জন করেন। বিশ্বসম্রাজ্যবাদী ও ইহুদীবাদী শক্তির কৌশলী চক্রান্তের ফলে প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের সাথে বিবাদের সম্মুখিন হয়ে ক্ষমতাচ্যুত ও কারারুদ্ধ হন। আনোয়ার ইব্রাহীম ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর একটি জাতীয় নির্বাচনে মালয়েশিয়ার অপর ইসলামী আন্দোলন পাসসহ গঠিত এক ইসলামী জোট পূর্ব থেকেও অধিকতর ভালো ফলাফল লাভ করে। মালয়েশিয়ার কালানতান ও তেরেংগুনা দুটি প্রদেশে পাস এর সরকার প্রথিষ্ঠিত হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, আনোয়ার ইব্রাহীম ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের প্রথম কেন্দ্রীয় সাথী সম্মেলনে অতিথি হিসাবে যোগদান করেছিলেন। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের প্রাক্তন সিনিয়র নায়েবে আমির মরহুম আব্বাস আলী খান (রহ:) মালয়েশিয়ার আবিম ও পাস উভয় ইসলামী আন্দোলনের কার্যক্রমই পরিদর্শন করেন। মালয়েশিয়ার কুয়াল তেরেংগুনায় অনুষ্ঠিত জুন ২০০০ ইং তারিখে পার্টি ইসলাম মালয়েশিয়া- পাসের ৪৬ তম সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী যোগদান করেন। তার সফরসঙ্গী ছিলেন অন্যতম সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল মুহাম্মদ কামরুজ্জামান। এভাবে মালয়েশিয়ার ইসলামী আন্দোলনের সাথে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের যোগাযোগ রয়েছে।


           প্রধানমন্ত্রী মাহাথির বিন মোহাম্মদ আনোয়ারকে উপ -প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করলে, আনোয়ার ও তার সমর্থকরা "সংস্কার আন্দোলন"(ইংরেজিrefomasi movement) শুরু করে। এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা বারিসন ন্যাশনাল সরকারের নীতি বহির্ভূত কর্মকান্ড বিলোপ করা। সংস্কার আন্দোলনের নেতা কর্মীদের নিয়ে ১৯৯৯ সালে আনোয়ার ন্যাশনাল জাস্টিস পার্টি গঠন করে। এবং ৯৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্যে parti Islam se Malaysia, ডেমোক্রেটিক এ্যাকশন পার্টি ও নব গঠিত ন্যাশনাল জাস্টিস পার্টি নিয়ে "বারিসন অল্টারনেটিভ" নামে বিরোধী জোট গঠন করেন। ২০০৩ সালের আগস্টে আনোয়ারের পরামর্শে তার স্ত্রী ওয়ান আজিজাহ ন্যাশনাল জাস্টিস পার্টি ও মালয়েশিয়ান পিপলস্ পার্টি একীভূত করে পিপলস্ জাস্টিস পার্টি গঠন করে। ২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে PKRPAS এবং DAP মিলে পাকাতান রাকাত নামে জোট গঠন করেন। যা ২০০৮ সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং ৩১টি আসন জয়লাভ করে বিরোধী দলে পরিণত হয়। এর মধ্যে মাহাথির মোহাম্মদ ২০০৩ সালের ওআইসি সম্মেলনের সফল সমাপ্তির পর ৩০শে অক্টোবর তিনি তার শিষ্যদের হাতে স্বেচ্ছায় দায়িত্ব হস্তান্তর করেন।  মালয়েশিয়ায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে মাহাথির মোহাম্মদ তার একসময়ের শিষ্য নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে আবার রাজনীতিতে আগমণ করেন।  শত্রুতে পরিণত হওয়া একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র আনোয়ার ইব্রাহিমের সাথে রাজনৈতিক জোট গঠন করে নির্বাচনে বিজয়ী হন। ২০১৮ সালের ৯ মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মাহাথিরের নেতৃত্বাধীন পাকাতান হারাপান জোট ২২২ আসনের পার্লামেন্টে ১১২ আসনে বিজয়ী হয়। এর মধ্যে আনোয়ারের পিকেআর পায় ৪৮ আসন। 

               আজকে মালয়েশিয়াতে ইসলামের যে  কিছু কালচার বিদ্যমান: অলি গলিতে ইসলামী স্কুল, নামকরা ইন্টারন্যাশনাল ইসলামী ইউনিভার্সিটি IIU (www.iium.edu.my), ইসলামী ব্যাংক, হজ্ব ফাউন্ডেশন, ইয়ং জেনারেশনকে ইসলামের পথে নিয়ে আসতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে আনোয়ার ইব্রাহীমের আবিম ও  ইখওয়ানুল মুসলেমিন প্রভাবিত ওলামায়ে আল-আজহার এবং পাস ইসলামিক পার্টি। সেখানে ঐক্যবদ্ধভাবে ওলামায়ে দেওবন্দও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। মালয়েশিয়ার ইসলামের দিকে অগ্রযাত্রা অব্যহত রাখুন, আমীন। এখানে উল্লেখ্য, আনোয়ার ইব্রাহিম ব্যক্তিগতভাবে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পাকাতান ক্ষমতায় আসার পর থেকে সৌদি-আমিরাত বলয়ের চেয়েও তুরস্ক-ইরানের সাথে মালয়েশিয়ার সম্পর্ক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়। দেশটি এর মধ্যে সৌদি নেতৃত্বাধীন প্রতিরক্ষা জোট থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আর তুরস্ক, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ইরানের সাথে মিলে ওআইসি দেশগুলোর মধ্যে একটি শক্তিমান বলয় তৈরির লক্ষ্যে মাহাথির সম্প্রতি কুয়ালালামপুরে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করেন।  


         ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের প্রথম কেন্দ্রীয় সাথী সম্মেলনে অতিথি হিসাবে যোগদান করেছিলেন আনোয়ার ইব্রাহীম। সেই সম্মেলনে তিনি বাংলা শব্দে বলেছিলেন "আমি বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরকে ভালবাসি"


        ২০১৩ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের চলমান বিচারকে 'রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ' আখ্যায়িত করে বিচার বন্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন  আনোয়ার ইব্রাহিম। এক বিবৃতিতে তিনি জামায়াতের সাত নেতার সংবিধানস্বীকৃত অধিকার রক্ষার আহ্বানও জানান। মালয়েশিয়া ক্রনিকল পত্রিকায় ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ তারিখে তাঁর বিবৃতিটি প্রকাশিত হয়। এর শিরোনাম ছিল 'ট্রায়াল অব জামায়াতে ইসলামী লিডারস ইন বাংলাদেশ : স্টপ দ্য পার্সিকিউশন' (বাংলাদেশে জামায়াত নেতাদের বিচার : নিগ্রহ বন্ধ করুন)।
Post edited in Feb, 2020

নীচের ভিডিওটি যোগ করা হলো এই পোস্টে ২৬/১১/২২ তারিখে:  

Thursday, June 21, 2018

জামায়াত ইসলামীকে নিয়ে লেখা অনেক সুন্দর একটি গান || শিল্পী নজরুল ইসলাম আমিনী ||

তুরস্কে ইসলামী শক্তির বিজয়, ড: নাজমুদ্দীন আরবাকান এবং জামায়াত ইসলামী

-  শাহাদাতুর   রহমান   সোহেল

তুরস্কের ইসলামী সংগঠ ড: নাজমুদ্দীন আরবাকান পরিচালিত ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টি নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় অদিষ্ঠিত হয়েছিল গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে। পরে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী সেনাবাহিনীর দ্বারা অন্যায়ভাবে ক্ষমতাচ্যুত হন। এই ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টির ক্ষমতায় থাকাকালে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী ড: নাজমুদ্দীন আরবাকান ১৯৯৬ সালের আগষ্ট মাসে পাকিস্তান সফরে এসে পাকিস্তানের দুজন নেতার সাথে বিশেষভাবে সাক্ষাৎ করেন। একজন হলেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভূট্রো এবং অপরজন জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের আমীর কাজী হোসাইন আহমদ। এই সংবাদ পরিবেশন করে তখন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম থেকে জামায়াতে ইসলামীর সাথে ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টির ঐতিহ্যবাহী সম্পর্কের কথা প্রচার করা হয়। উক্ত পার্টি ক্ষমতায় থাকাকালে তুরস্কের একটি আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনে জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম বিশেষ অতিথি হিসাবে যোগদান করেছিলেন। সে সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন ড: নাজমুদ্দীন আরবাকান। 
যে স্মৃতি প্রেরণা যোগায়ঃ তুরষ্কের ইসলামী আন্দোলনের অগ্রদূত নাজিমুদ্দিন এরবাকানের সাথে জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম স্যারের একটি ছবি। আল্লাহ তাঁদের উভয়কে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুক।


নাজমুদ্দিন আরবাকান ও শহীদ আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ (রঃ)
ঐতিহাসিক একটি ছবি...ছবিটি দেখলেই প্রশান্তিতে মন ভরে যায়। বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব, তুরস্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী উস্তাদ প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন আরবাকানের সাথে শহীদ আলী আহসান মো: মুজাহিদ। ডি-৮ ভুক্ত দেশগুলোকে নিয়ে আয়োজিত ESAM সম্মেলনে এই দুই নেতার দেখা হয়। ড. আরবাকানের আমন্ত্রনেই শহীদ আলী আহসান মো: মুজাহিদ এই সম্মেলনে যোগ দান করেন। উস্তাদ আরবাকান এই সময় শহীদ মুজাহিদের হাতে সম্মেলনের ক্রেস্টও তুলে দেন। আল্লাহ তাঁর এই দুই প্রিয় বান্দাকে কবুল করে নিন। আমিন।

২৭শে ফেব্রুয়ারী ২০১১-এ নাজমুদ্দীন আরবাকান এন্তেকাল করেন। এই মহান নেতাকে আল্লাহ জান্নাতুল ফিরেদৌসের উচ্চ মাকাম দান করুন, আমীন 
তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান নামাজে জানাজায় নাজমুদ্দীন আরবাকানের কফিনটি বহন করছেন


ড: নাজমুদ্দীন আরবাকান  সম্পর্কে জানার জন্য এই লিংকটি ব্রাউজ করুন প্লীজ: নাজমুদ্দিন এরবাকান | এক ঘুমভাঙ্গা সিংহের উপাখ্যান


তুরস্ক সম্পর্কিত এই ওয়েবসাইটের অন্যান্য পোষ্টগুলো দেখুন: 1) তুরস্কে মাওলানা মওদুদী ও তাফহীমুল কুরআনের প্রভাব 2) জানেন - ফাঁসিরকাষ্ঠে ঝুলন্ত কে এই মহানব্যক্তি ? তিনি হচ্ছেন আদনান মেন্ডারিস, তুরস্ক

একে পার্টির হেড কোযার্টারে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সাথে শিবির নেতা হাফিজুর রহমান

তুরষ্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোয়ানের সাথে শহীদ আলী আহসান মুহাম্মাদ মুজাহিদ।
সময়কাল :২০০৩ সাল।


Friday, June 15, 2018

মালয়েশিয়ার নির্বাচন বিশ্বরাজনীতিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত -মতিউর রহমান আকন্দ


মালয়েশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি অন্যতম প্রধান মুসলিম দেশ। তিনটি সালতানাত ও ১৩টি রাজ্যের সমন্বয় গঠিত মালয়েশিয়া। এর আয়তন ৩ লাখ ২৯ হাজার ৮৪৫ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ৩ কোটি ২০ লাখ। রাজা হলেন রাষ্ট্রপ্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকারপ্রধান। দীর্ঘ দিন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে থাকার পর ১৯৫৭ সালের ৩১ আগস্ট রক্তপাতহীন প্রক্রিয়ায় মালয় স্বাধীনতা লাভ করে। তখন থেকে মালয়েশিয়ার সরকার ও রাজনীতিতে ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। মালয়েশিয়ার অর্থনীতি হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতি। মালয়েশিয়ার সরকারি ভাষা হচ্ছে মালয়। এ ছাড়াও ১৩০টি ভাষা প্রচলিত আছে। মালয়েশিয়াতে শরিয়াহ আইনের পাশাপাশি সিভিল কোর্টও রয়েছে। সাধারণত মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য শরিয়াহ আইনের প্রচলন। যদি কেউ চায় সাধারণ আইনের আশ্রয়ও নিতে পারে। মালয়েশিয়া সাংবিধানিকভাবে প্রত্যেক ধর্মের সমঅধিকার নিশ্চিত করেছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী মালয়েশিয়ার জনসংখ্যা আনুপাতিক হার হচ্ছেÑ মুসলিম ৬১.৩%, বৌদ্ধ ১৯.৮%, খ্রিষ্টান ৯.২%, হিন্দু ৬.৩%, কনফুসিয়াস ১.৩% এবং অন্যান্য ধর্মের অনুসারী ১.২%।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশ থেকে মুক্তি লাভের পর ১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বরে স্বাধীন মালয় যুক্তরাষ্ট্র, স্বশাসিত সিঙ্গাপুর, পূর্বতন ব্রিটিশ উপনিবেশ সারাওয়াক ও সাবা (উত্তর বোর্নিও) একত্রিত হয়ে মালয়েশিয়া যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসে সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া যুক্তরাষ্ট্র পরিত্যাগ করে।
মালয়েশিয়ার ইতিহাস খুবই প্রাচীন। সুদূর অতীতে এ অঞ্চলে হিন্দু-বৌদ্ধ শাসকদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এখানে ইসলামের আগমনের পূর্বে বৌদ্ধ রাজত্ব লাংকাসকা ও পরে বৌদ্ধ রাজত্ব শ্রীবিদয়ার নিয়ন্ত্রণ ছিলো। ১৪১৪ খ্রিষ্টাব্দে মালাক্কার রাজবংশ কর্তৃক ইসলাম গ্রহণের পর মালাক্কা এলাকায় ইসলাম তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ‘আরব বণিকদের মারফত মালয়ে প্রথম ইসলামের আগমন ঘটে। সিঙ্গাপুরের তেমানিক রাজা পরমেশ্বর (১৩৯৬-১৪১৪) প্রথমে মজাপাহিত ও পরে পাই সেনাবাহিনী দ্বারা বিতাড়িত হয়ে মালাক্কায় পালিয়ে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন (নাম ইস্কান্দার শাহ) এবং এক নতুন রাজবংশ স্থাপন করেন। এই বংশ ১৫১১ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজদের কর্তৃক উৎখাত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এখানে ক্ষমতায় ছিলো। এ সময়ে মালয়বাসীদের সাহিত্য, আইন এবং সামাজিক সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামের আদর্শ প্রতিফলিত হয়। পরবর্তীকালে পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ওলন্দাজ, পর্তুগিজ এবং ব্রিটিশরা মালাক্কা সালতানাত এবং মালয় এলাকা দখল করে নিলে তারা তাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা এদেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দেয়।
মুসলমান শাসকদের পরিবর্তে খ্রিষ্টান শাসকদের আগমনের ফলে স্বাভাবিকভাবেই ইসলামের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। উপরন্তু মুসলমানদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে তাদের প্রভাব বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। উপনিবেশ যুগে সবচেয়ে ক্ষতিকর যে দিকটির সূচনা হয়, তা হলো মালয়াতে ব্যাপক সংখ্যক অমুসলমানের বাহির থেকে আগমন। চীন এবং ভারত থেকে অসংখ্য বহিরাগতকে সাম্রজ্যবাদীরা মালয়ানে স্থান দেয়। ফলে সেখানে মুসলমানরা তাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে ফেলে। ১৯৫৭ সালের ৩১ আগস্ট স্বাধীনতা লাভের পর দেখা গেল যে, বহিরাগতদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে শতকরা ৫০-এ। স্বাভাবিক কারণেই তারা তখন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটা বিরাট শক্তিশালী গ্রুপ হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে মালয়েশিয়া একটি বহুজাতিক দেশে পরিণত হয়।
এক সময় মালয়েশিয়ার রাজনীতি ছিল সম্প্রদায়ভিত্তিক। সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-বিরোধ মালয়েশিয়াতে জাতীয় সংহতির পথে যেমন বাধা হয়ে দাঁড়ায় তেমনি ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথেও অন্তরায় সৃষ্টি করে রাখে। জাতীয় সংহতি অর্জনের লক্ষ্যে সেখানে United Malays National Organization (UMNO), Malays Chinese Association I Malayan Indian Congress মিলে ঐক্যজোট গড়ে তোলা হয় এবং ‘রুকনেগার ঘোষণা’ নামে পঞ্চশীলা নীতির ভিত্তিতে জাতীয় আদর্শবাদের কথা ঘোষণা করা হয়। জাতীয় আদর্শবাদের এই পঞ্চশীলা নীতি হচ্ছে : স্রষ্ঠার প্রতি বিশ্বাস, সুলতান ও দেশের প্রতি আনুগত্য, সংবিধানের প্রতি সমর্থন, আইনের শাসন এবং সদাচরণ ও নৈতিকতা। এ সকল মূলনীতির অর্থ ব্যাখ্যা করার জন্য ঐ ঘোষণার সাথে কতকগুলো ভাষ্যও জুড়ে দেয়া হয়। যেমন, ইসলামকেই মালয়েশীয় যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ধর্ম বলে ঘোষণা করা হয়। অন্যান্য ধর্মের কোন ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য করা হবে না বলে প্রতিশ্রুতিও দান করা হয়। দ্বিতীয়ত, প্রত্যেক নাগরিকই ‘মহানুভব রাজা’র প্রতি সত্যিকারভাবে অনুগত থাকবে বলে প্রত্যাশা করা হয়। তৃতীয়ত, প্রত্যেক নাগরিকই সংবিধান সংরক্ষণ ও সমর্থন করবে। এ তৃতীয় সর্বাপেক্ষা বিতর্কিত সম্প্রদায়গত প্রশ্নাদিতে মালয়েশীয় সরকারের নীতির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো বিবৃত হয়, যেমন- ইসলাম ধর্মের বিশেষ মর্যাদা, মালয়ীদের বিশেষ অধিকার ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের নাগরিকত্ব অর্জনের অধিকার। অ-মালয়ীদের ওপর মালয়ীদের বিশেষ আইনগত ও রাজনৈতিক মর্যাদাদানের উদ্দেশ্যে এ সকল নীতি নির্দেশিত হয়। চতুর্থ ভাষ্যে আইনের চোখে সমান নীতি নির্দেশিত হয় এবং আরোপিত বিধি-নিষেধ সাপেক্ষে বিভিন্ন দিকের স্বাধীনতার কথা ঘোষিত হয়। পঞ্চম ভাষ্যে কোন গোষ্ঠীর অনুভূতিতে আঘাত দিতে পারে, এমন কোন আচরণে লিপ্ত না হওয়ার জন্য ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে সাধারণভাবে আহ্বান জানানো হয়।
মালয়েশিয়াতে বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা ইসলামের দাওয়াতি কাজ করে যাচ্ছে। জনগণের মধ্যে ইসলামের প্রতি মনোযোগ ও আকর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ছাত্র, তরুণ ও যুবসমাজের মাঝে ইসলামের চেতনা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের সচেতন ও বুদ্ধিজীবীদের আচার-আচরণ এবং দৃষ্টিভঙ্গিতেও বেশ পরিবর্তন হয়েছে। তারা ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও সক্রিয় হয়েছে। মালয়েশিয়াতে রাজনৈতিক ময়দানে সাধারণভাবে ইসলামী আন্দোলন যতটা শক্তিশালী, যুব ইসলামী আন্দোলন তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। সেখানে প্রধানত দুটো সংগঠন ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। তার একটি হলো Ankatan Belia Islamia Malayasia সংক্ষেপেABIM অর্থাৎ মালয়েশীয় ইসলামী যুব আন্দোলন এবং অন্যটি হলো Partia Islam Malaysia সংক্ষেপে PAS বলে অভিহিত করা হয়।
১৯৬৯ সালে National Union of Malayasian Muslim Students (PKPIM) এর বার্ষিক সাধারণ সভায় ‘আবিম’ গঠিত হয়। তিনটি লক্ষ্যের ভিত্তিতে এ সংস্থাটি গড়ে ওঠে। প্রথমত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজসমূহ থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত ছাত্রদের দ্বীনি দাওয়াতি কাজে তৎপরতা অব্যাহত রাখার সুযোগ দেয়া, দ্বিতীয়ত মালয়েশীয় সমাজের সর্বস্তরের মুসলিম যুবকদের স্বার্থকে সংরক্ষণের জন্য একটি যুব সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করা এবং তৃতীয়ত মালয়েশীয়ার ইসলামী বিপ্লবের জন্য ইসলামী পুনর্জাগরণের পথ রচনা করা। এসব উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার জন্য ‘আবিম’ বিভিন্ন কর্মসূচির ভিত্তিতে কাজ করে। এর মধ্যে জনসাধারণের মধ্যে ইসলামী চেতনা জাগ্রত করার জন্য বই-পুস্তক প্রকাশ, বক্তৃতা ফোরাম, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ইত্যাদির আয়োজন করা; আন্দোলন ও সংগঠনের কর্মীদের নিয়ে ইসলাম সম্পর্কে অধিকতর জানার জন্য ‘স্টাডি গ্রুপ’-এর ব্যবস্থা করা; ইসলামের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ঘটনা ও বিষয়ের ওপর গবেষণা ও অধ্যয়নে উৎসাহ প্রদান করা; ইসলামী আন্দোলনের জন্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া; সংগঠনের ভেতর ও বাইরের- এমনকি দেশ ও বিদেশের মুসলিম ভাইদের মধ্যকার ভ্রাতৃত্বকে শক্তিশালী ও সুসংহত করা এবং যে সমস্ত ইসলামী সংগঠন সত্যিকার অর্থে ইসলামের জন্য কাজ করে যাচ্ছে, তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সহযেগিতা করা।
যে কোন যুবক বা ‘যুবমনা’ ব্যক্তি ইসলামী আদর্শের জন্য কাজ করার প্রতিশ্রুতিতে ‘আবিম’-এর সদস্য হতে পারে। শিক্ষাবিদ, পেশাদার কৃষক, শ্রমিকসহ সমাজের সর্বস্তরের লোক এর সদস্য হতে পারে। আবিম মালয়েশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে।
মালয়েশিয়া স্বাধীনতা লাভের ৭ বছর পর ১৯৬৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মাহাথির মোহাম্মদ। এর মাধ্যমে তার রাজনীতিতে প্রবেশ। এর ১৭ বছর পর ১৯৮১ সালে তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন। প্রধানমন্ত্রিত্বের পদে অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় ডা: মাহাথির মোহাম্মদ ইসলামী ব্যবস্থা কায়েমের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আবিমের প্রেসিডেন্ট তরুণ জনপ্রিয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমকে নিজের সমর্থনে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। আনোয়ার ইব্রাহিম নেতৃত্বের অসাধারণ গুণাবলিসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। অনায়াসেই তিনি যে কোন ব্যক্তিকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করতে পারতেন। আনোয়ার ইব্রাহিম মাহাথিরের নেতৃত্বাধীন UMNO-এর প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন এবং মাহাথিরের মন্ত্রিসভায় যোগদান করেন। প্রথমে সাংস্কৃতিক মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে তার যাত্রা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালে যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী, ১৯৮৪ সালে কৃষিমন্ত্রী এবং ১৯৮৬ সালে শিক্ষামন্ত্রী হন। ১৯৯৩ সালে তিনি ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ পান। ১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সময়ে ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আনোয়ার ইব্রাহিম মালয়েশিয়ার উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন এবং বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এরপর মাহাথিরের সাথে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে। যার ফলে আনোয়ার ইব্রাহিমকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এক সময় তাকে দুর্নীতির মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়। ২০০৪ সালে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত সব অভিযোগ থেকে আনোয়ার ইব্রাহিমকে খালাস দিলে তিনি মুক্তি লাভ করেন। মুক্তির পর বিরোধী দলগুলো নিয়ে জোট করে তিনি ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে রীতিমত হইচই ফেলে দেন। তখন তিনি ৩১টি আসনে বিজয় লাভ করে বিরোধী দলের নেতায় পরিণত হন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের নির্বাচনে ভাল ফলাফল করেন। এক কথায় ২০০৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। ২০০৮ সালের এসে তিনি নতুন ষড়যন্ত্রের শিকার হন। কথিত সমকামিতার মিথ্যা অভিযোগে তাকে আবারো কারাগারে যেতে হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন নাজিব রাজাক।
নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়। বিনিয়োগ তহবিল থেকে ৭০ কোটি ডলার আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে। ক্রমেই নাজিব ও তার পরিবার বিভিন্ন অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির সাথে জড়িয়ে পড়ে। মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পতন হতে থাকে। জীবন ধারণের ব্যয় অত্যধিক বেড়ে যায়। জিনিসপত্র ও বিভিন্ন সেবার ওপর সরকার নতুন নতুন কর আরোপ করে। ফলে নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এ পরিস্থিতিতে ২০১৫ সালে ডা: মাহাথির মোহাম্মদ নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তিনি আবারো রাজনীতির মাঠে আসেন। আনোয়ার ইব্রাহিমের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে নিজের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেন। এমনকি আনোয়ার ইব্রাহিমকে আদালতে হাজির করা হলে মাহাথির মোহাম্মদ আদালত কক্ষে আনোয়ার ইব্রাহিমের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে অনুতপ্ত হওয়ার কথা জানান আনোয়ার ইব্রাহিমকে। তাকে কারাগারে পাঠানো ছিল একটি মস্তবড় রাজনৈতিক ভুল তাও তিনি আনোয়ার ইব্রাহিমের নিকট স্বীকার করেন। তখন থেকেই মাহাথির মোহাম্মদ ও আনোয়ার ইব্রাহিমের মধ্যে সমঝোতা গড়ে ওঠে। বেছে নেয়া হয় ২০১৮ সালের নির্বাচনকে।
২০১৮ সালের ৯ মে নির্বাচনে মাহাথিরের নেতৃত্বাধীন পাকাতান হারাপান জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ২২২টি আসনের মধ্যে ১১৩টি আসনে তারা বিজয় লাভ করে। তন্মধ্যে আনোয়ার ইব্রাহিমের প্রতিষ্ঠিত পিকেআর পায় ৪৯টি আসন, ডিএপি (চাইনিজদের দ্বারা গঠিত দল) পায় ৪২টি আসন, পিপিবিএম (মাহাথিরের গড়া নতুন দল) পায় ১২টি আসন, আমানাহ (পাস ভেঙে গড়া নতুন দল) পায় ১০টি আসন। এর বাইরে সেবাহ হেরিটেজ পায় ৮টি আসন। এই দলটির সঙ্গে পাকাতান হারাপানের অনানুষ্ঠানিক জোট ছিল। ফলে আসন দাঁড়িয়েছে ১২১টিতে।
নির্বাচনের পর প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে মালয়েশিয়ার রাজা ইয়াং দি পারতুয়ান এগং আনোয়ার ইব্রাহিমকে নিঃশর্ত ক্ষমা ঘোষণা করেন। ১৬ মে ২০১৮ সালের দুপুর ১২টায় আনোয়ার ইব্রাহিম কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। মাহাথির ও আনোয়ার ইব্রাহিমের চুক্তি অনুযায়ী পরবর্তীতে আনোয়ার ইব্রাহিমের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে আনোয়ার ইব্রাহিম শিগগিরই রাজনীতিতে ফিরছেন বলে জানিয়েছেন। বাস্তবতা হলো তিনিই হতে যাচ্ছেন মালয়েশিয়ার পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।
মালয়েশিয়ার রাজনীতির এ ঘটনা বিশ্বরাজনীতির পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে। আমরা যদি বিগত ১০০ বছরের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহলে দেখতে পাই সারা পৃথিবীতে গত ১০০ বছরে নানান পরিবর্তন সংঘটিত হয়ে বিশ্ব আজ এক নতুন ধারার রাজনীতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর পূর্ব ইউরোপে তা ছড়িয়ে পড়ে। সমাজতন্ত্রের জয়জয়কার পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিশাল জনগোষ্ঠী সমাজতন্ত্রের রঙে নিজেদের রঙিন করতে সচেষ্ট হয়। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে মুসলমানদের জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্দিন। ইসলামী আদর্শের অনুসারী হওয়ার কারণে মুসলমানদেরকে নানানভাবে নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়। গণহারে হত্যা করা হয় মুসলমানদের। সমাজতন্ত্রের ৭০ বছরের ইতিহাসে মুসলমানরা নানাভাবে আক্রান্ত হয়। অবশেষে এ মতবাদ বিলুপ্ত হয়।
সমাজতন্ত্রের উত্থানের মুহূর্তে ১৯২৪ সালে তুর্কি খেলাফতের পতনের পর মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ শক্তি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সারা দুনিয়ায় মুসলমানদের আশ্রয় নেয়ার স্থানসমূহ বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বরাজনীতিতে কিছুটা হলেও পরিবর্তনের সূচনা হয়। মুসলমানরা স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে পৃথিবীর দিকে দিকে স্বাধীন সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটতে থাকে। এর মাঝে ঘটে আরেকটি স্পর্শকাতর ঘটনা যা মুসলমানদের অনুভূতিতে ব্যাপকভাবে নাড়া দেয়। ১৯৬৭ সালে ইহুদিরা মুসলমানদের প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাসে অগ্নিসংযোগ করে। এর প্রতিক্রিয়া হয় মুসলমানদের মধ্যে। মুসলমানরা বুঝতে সক্ষম হয় ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম গড়ে তোলা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই। এ চেতনা থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয় ওআইসি। ওআইসি-এর মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গড়ে ওঠে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ।
১৯৭৯ সালে সংঘটিত হয় ইরান বিপ্লব। বিগত ৩৯ বছর যাবৎ ইরান পৃথিবীর পরাশক্তি আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করে টিকে আছে। ইরান আজ মুসলিম বিশ্বের এক প্রতিষ্ঠিত সম্ভাবনাময় শক্তি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে তুরস্কে। ক্ষমতায় আসেন ইসলামী আন্দোলনের নেতা নাজিমুদ্দিন আরবাকান। এরপর থেকে তুরস্কে ক্ষমতার পালাবদলে এরদোগান প্রথমে প্রধানমন্ত্রী পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। ১৯৯০ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রথম পর্যায়ে আলজেরিয়ায় জাতীয় পরিষদের ২৩১টি আসনের নির্বাচনে ইসলামী সালভেশন ফ্রন্ট ১৮৮টি আসনে বিজয় লাভ করে। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অবশিষ্ট আসনের নির্বাচন বানচাল করে দেয়া হয়। ইসলামী নেতৃবৃন্দের ওপর চালানো হয় নির্যাতন। হাজার হাজার মুসলমানকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। ২৭ বছর পর সে দেশে পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
মিসরে ইখওয়ানুল মুসলিমিন জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পর অত্যন্ত ষড়যন্ত্র করে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। সামরিক জান্তা মিসরের জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে সেখানে পরিবর্তনের লক্ষণ দৃশ্যমান। মাধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম বিশ্ব পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর এ পরিবর্তনের মূল শক্তি হচ্ছে ইসলাম। ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইসলামের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করার জন্য যারা ভূমিকা পালন করছে তাদের বিদায় ঘণ্টা বেজে উঠছে।
যে ওআইসি গড়ে উঠেছিল মুসলমানদের ঐক্যের প্লাটফর্ম হিসেবে সেখানে কার্যকর ভূমিকা পালনের লোক ছিল সীমিত। বলতে গেলে এরদোগান ব্যতীত কেউ অর্থবহ ভূমিকা পালন করেননি। সেখানে মালয়েশিয়ার নির্বাচন আরেকজন উদীয়মান বিশ্ব নেতৃত্বকে ওআইসির প্লাটফর্মে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। পাশাপাশি ইরান, পাকিস্তান, আলজেরিয়া, মিসর, তিউনিসিয়াসহ মুসলিম বিশ্বের ইসলামী চেতনায় সমৃদ্ধ প্রতিনিধিগণ ওআইসিতে কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ পেয়েছে। মুসলিম বিশ্বের এ সংগঠিত প্লাটফর্ম দিকে দিকে ইসলামের গতি সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে অন্যান্য ভূমিকা পালন করবে। সেই সাথে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা পিছু হটতে বাধ্য হবে। মালয়েশিয়ার নির্বাচন বিশ্বরাজনীতির সেই পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটকে দ্রুত সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Wednesday, June 13, 2018

আওয়ামীলীগ নয় বরং জামায়াতে ইসলামীরাই প্রকৃত দেশ প্রেমিক – রাকেশ রহমান



আমি একজন সুপরিচিত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। শুধু মুক্তিযোদ্ধা পরিবারই নয় বরং রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। যে পরিবারের সৎ, আদর্শ ও প্রতিবাদের জন্য শুধু বাংলাদেশেই নয় পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোতেও পরিচিতি রয়েছে। যাক আমি আমার ব্যাপক পরিচিতি উল্লেখ করতে আগ্রহী নই।

উপরের এই উক্তি গুলো আমার জীবনে বাস্তব পরীক্ষিত। যেহেতু আমি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান তাই ছেলে বেলা থেকেই বেরে উঠার পাশাপাশি বাবা চাচাদের যুদ্ধের সময়কার গল্প বেশি বেশি শুনতাম। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা, ছবি সংগ্রহ করা ও দেশাত্ববধক গান প্রচুর পরিমাণে শুনতাম। ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা, বিভিন্ন লেখকের বই পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে পড়তাম। মনে প্রানে হ্বদয়ে জায়গা দিয়েছিলাম একটি নাম ‘ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান’ । ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণটা মুখস্থ ছিল। যেহেতু আমার পরিবারের সাথে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার সাথে একটা সুমুধুর সম্পর্ক ছিল সেই সুবাদে সুযোগ পেলেই যেতাম তাঁর বাসায়।
একবার তো এক মজার ঘটনা ঘটলো, তখন আমি ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে স্কুলের হাফ টাইম-এ পেট খারাপের কথা বলে হেড মাষ্টারের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় গিয়ে ছোট ফুফির সাথে ধানমন্ডী ৩২ নাম্বারে বঙ্গবন্ধু যাদুঘরে গেলাম, গিয়েই তো খেলাম ধরা দেখি আমার হেড মাষ্টার ( অধ্যক্ষ মৃত কামরুজ্জামান, সাবেক আওয়ামীলীগ এম পি ও প্রেসিডিয়াম সদস্য ) ঐখানে বসা। স্যার আমাকে দেখা মাত্র মৃদু হাসলেন এবং বুঝে গেলেন আমার ছোট হ্বদয়ে শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি কতটুকু ভালোবাসা।
আমাদের বাসায় শেখ মুজিবর রহমানের যে বিশাল বিশাল ছবি ছিল তা আমার মনে হয় সারা বাংলাদেশে এত বড় এবং এতো ছবি কারো বাসায় ছিল না। যার কারণে শুধু মাত্র শেখ হাসিনার মিশিলে এই ছবিগুলো নিয়ে যাওয়া হতো, আমরাও শেখ হাসিনার পাশেই থাকতাম। মুক্তিযুদ্ধের একটি সর্ট ফিল্ম আছে নাম ৭১’এর যীশু। এই ছবিটি অতুলনীয়।
আমার ধারনা আমার মত খুব কম যুবকই আছে যারা ৭১’এর ইতিহাস এতো বেশি পড়েছে বা জেনেছ । এখনকার তরুণ সমাজ ইতিহাস সঠিক ভাবে না পড়ে না জেনে, শুনে শুনে তর্ক করে যুক্তি, ভিত্তি জ্ঞান ছাড়া।
মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস আমি আমার মাথায় রাখি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অনুভূতি আমি আমার হ্বদয়ে রাখি ঠিক যেন ৭১’এর একজন মুক্তিসেনার মত। শেখ মুজিবরের প্রতি অন্ধের মত পাগল ছিলাম যে , শেখ মুজিবরের কণ্ঠের সাথে ঢাকার সাবেক মেয়র ও সাবেক ঢাকা মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি মৃত মেয়র হানিফের কণ্ঠের সাথে খুব মিল ছিল। তাই মেয়র হানিফের কণ্ঠের ভাষণ শুনার জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে থাকতাম।
..............................................................................................
জামায়াতে ইসলামীকে আমি চরম পরম ঘৃণা করতাম। দেশে থাকতে একবার আমার এলাকায় আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী সাহেব এসেছিলেন ওয়াজ করতে। কিন্তু আমি তার কথা না শুনে বাড়িতে বসে সারা রাত হেডফোন কানে লাগিয়ে গান শুনেছিলাম যাতে মাইকের শব্দ আমার কানে না আসে। যাইহোক আমি উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া কোন নাস্তিক বুদ্ধিজীবী নয়। কিন্তু
ন্যূনতম জ্ঞান চিন্তা চেতনায় সুদূর প্রসারিত আমার মন মানসিকতা।
২০০৬-এর পরে ইতালিতে এসে আমি ইসলামিক ফরাম অফ ইউরোপের একজন দায়িত্বশীল ভাই মির্জা জামাল বেগ সাহেবের কাছ থেকে আমি দ্বীন ইসলামের দাওয়াত পাই। ধীরে ধীরে তার মাধ্যমে আমি ডঃ জাকির নায়েকের ওয়াজ শুনা শুরু করি এবং দরসে কোরআন ও ইসলামী ইতিহাস পড়া শুরু করি। তারপরে তার দেশের বাড়ি পিরোজপুর (সাইদী সাহেবের এলাকা) হওয়ায় সে এবং আরেক দায়িত্বশীল জনাব এমদাদুল হক সাহেবের প্রচেষ্টায় আমি বিরক্ত হওয়া স্বত্তেও আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী সাহেবের জীবনী জানতে সক্ষম হই। এরপরও আমি ব্যাক্তিগত উদ্যোগে দেশে পিরোজপুরে লোক পাঠিয়ে খোঁজ খবর নিলাম। কি আশ্চর্য ! একেবারে নিরপরাধ একজন এলেমকে শুধু মাত্র রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার জন্য এই ভাবে যুদ্ধ অপরাধী রাজাকার নারী ধর্ষণকারী হিসেবে সাজানো হয়েছে। ভাবতেই অবাক লাগে; এ আমরা কোন সমাজে বসবাস করছি।
এ আমরা কোন জাতি যারা শুধু মাত্র হলুদ মিডিয়া প্রচার মাধ্যম দ্বারা একজনকে দেবতা বানিয়ে পূজা দিচ্ছি আর এলেম লোকদেরকে বানাচ্ছি যুদ্ধ অপরাধী ,রাজকার, নারী ধর্ষণকারী , জঙ্গি ইত্যাদি। তারপর থেকে আমি দেলোয়ার হোসেন সাঈদী সাহেবের প্রত্যেকটি ওয়াজ দেখেছি, শুনেছি, কেঁদেছি, শিখেছি এবং জেনেছি ইসলাম কি। হাতে গুনা দুই একটা ছাড়া কোথাও কোন জায়গায় রাজনৈতিক বক্তব্য উনি দেননি । আমি একজন ঈমানদার মুসলমান। তাই আল্লাহ্‌র উপর রয়েছে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। সে বিশ্বাসেই বলতে পারি যে দেলোয়ার হোসেন সাঈদী যদি মন্দ লোক হতেন তাহলে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিন তাঁকে এতো বড় ক্ষমতা তথা তাঁর কণ্ঠে যে ম্যাজিক পাওয়ার আছে সেটা দিতেন না। সাঈদী সাহেব সৌদি সরকারের আমন্ত্রণে ক্বাবা শরীফের ভিতরে ঢুকার সুযোগ পান, সেই ওয়াজও আমি দেখেছি। ক্বাবা শরীফের ভিতরে ঢুকার অনুভূতিতে সাঈদী সাহেব সারা রাত ঘুমাতে পারেন নি আল্লাহ্‌র শুকুরে সেজদায় পড়েছিলেন। তাঁর হাতে দেশ বিদেশে বহু বিধর্মী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। আল্লাহ্‌র প্রতি আমার ঈমানী দাবীতে বলতে পারি রাব্বুল আলামিন কোন দিন মন্দ মানুষকে এতো বড় সম্মানে সম্মানিত করবেন না ।
আর বিধর্মী , নাস্তিকদের বলতে চাই সঠিক সাক্ষী প্রমাণ আইনের ভিক্তিতে আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী সাহেবের নিরপেক্ষ বিচারের ব্যবস্থা করা হোক। না হলে কোটি জনতা তোমাদের ছাড়বে না।
জামায়াতে ইসলামীরা বাংলাদেশে মঙ্গল কামনার রাজনীতি করে তা দেশ স্বাধীনের পর থেকে এখন পর্যন্ত তাদের কার্যক্রমের দিকে লক্ষ করলে আমরা উপলব্ধি করতে পারবো যে তারাই প্রকৃত শিক্ষিত, মার্জিত , সৎ , আদর্শবান দেশ প্রেমিক ; শুধু মাত্র হলুদ মিডিয়ার মিথ্যা প্রচার ছাড়া।

Popular Posts