মানব সভ্যতার ইতিহাস বড়ই বৈচিত্র্যময়। প্রকৃতির পালাবদলের মতো মানুষের মনও বদলায়। দূর অতীত থেকে মানবজীবনের কর্মচঞ্চল অঙ্গনে পদে পদে এর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। শরতের প্রকৃতি যেমন সবদিক সবুজ শ্যামল দেখা যায় এবং মন নেচে উঠে সবুজের সমারোহে কিন্তু সে তখন ভুলে যায় যে, সবুজের এই সমারোহ একদিন তিরোহিত হয়ে পাতা ঝরার মওসুমও আসতে পারে। মানুষের প্রকৃতি অনেকটা এ রকমই। কখনো সে সচ্ছলতা ও প্রাচুর্যের অধিকারী হলে এবং শক্তি-সামর্থ্য লাভ করলে সে তখন অহংকার করে বেড়ায়। তার মনের কোণে এ কথা একবারও উঁকি দেয় না যে, এই শক্তি-সামর্থ্য ও সম্পদের পাহাড় বা প্রভাব-প্রতিপত্তি পাতা ঝরা মওসুমের মতো যে কোন সময় চলে যেতে পারে। আল্লাহর রাসূল একবার নয় বেশ বার বলেছেন অহংকার করো না।
আবার এই মানুষটিই কোন বিপদে পড়লে আবেগে উত্তেজনায় কেঁদে ফেলে, বেদনা ও হতাশায় ডুবে যায়, তার সারা মন-মস্তিষ্ক এতটা বেসামাল হয়ে পড়ে যে, আল্লাহকে পর্যন্ত গালমন্দ করে বসে এবং তাঁর সার্বভৌম শাসন কর্তৃত্বকে অভিসম্পাত করে নিজের দুঃখ- বেদনা লাঘব করতে চেষ্টা করে। তারপর যখন দুঃসময় পার হয়ে গিয়ে সুসময় এসে যায় তখন আবার সেই আগের মতই দম্ভ ও অহংকারে ধরাকে সরা জ্ঞান করে এবং সুখ-ঐশ্বর্যের নেশায় মত্ত হয়। এ হচ্ছে মানুষের নিচতা, স্থুলদৃষ্টি ও অপরিণামদর্শিতার বাস্তব চিত্র।
মানুষের এ নিচপ্রকৃতি সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে আমাদের ক্ষমতাসীনদের মাঝেও পরিলক্ষিত হয়। পৃথিবীর শাসকেরা যখন পরিপূর্ণরূপে ক্ষমতা পায় তখন তার অতীতের হীন অবস্থার কথা ভুলে যায়, ভুলে যায় ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য হীনতর অবস্থার কথা। ফলে তারা সারা রাজ্যে ফাসাদ সৃষ্টি করে, জনগণের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালায় এবং তারা আল্লাহর নাফরমানিতে লিপ্ত হয়। তারা আল্লাহর আজাবের ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে ও বলতে থাকে। যারা এগুলো বলে, তাদেরকে তারা ‘পাগল’ বলে আখ্যায়িত করে। তাদের আত্মম্ভরিতার মাত্রা এতটুকুই বেড়ে যায় যে, ‘কই তোদের রব? কই তোদের রবের আজাব? তোদের প্রভু তো রক্ষা করতে আসে না? (নাউজুবিল্লাহ) বরং উল্টো আমরাই সুখ-ঐশ্বর্যের সাগরে ভাসছি, চারদিকে আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের ঝাণ্ডা উড়ছে। প্রকৃতপক্ষে এরা নিজেরাই পাগল হয়ে পড়েছে। শয়তান ওদের সামনে রঙিন পৃথিবীর স্বপ্ন বার বার উপস্থাপন করে মোহাবিত করে তুলে। আল্লাহ তা’আলাও তাদের কৃতকর্মকে সুদৃশ্য করে দেন। ফলে তারা আরো দিশেহারা হয়ে পড়ে। তার মধ্যে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশ লাভ করে। তার কাছে সত্য মিথ্যা, শিরকও তাওহিদ, পাপ ও পুণ্য এবং সচ্চরিত্র ও অসচ্চরিত্র অর্থহীন মনে হয়। তার কাছে এখানকার ভোগ বিলাস, আরাম আয়েশ, বস্তুগত উন্নতি, সমৃদ্ধি এবং শক্তি ও কর্তৃত্বই মনে হবে কল্যাণকর। প্রকৃত তত্ত্ব ও সত্যের ব্যাপারে মাথা ব্যথাই থাকবে না।
প্রথমে বলেছিলাম এ ধরনের ব্যক্তিদের কার্যাবলিকে শোভন বা সুদৃশ্য বানিয়ে দেয়া হয়। আল কুরআনে কখনো আল্লাহর কাজ কখনো শয়তানের কাজ বলা হয়েছে। যখন বলা হয়, আল্লাহ তার কাজগুলো আরো শোভন করে দেন তখন এর অর্থ দাঁড়ায়, এ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারীদের কাছে স্বভাবতই জীবনের এ সমতল পথই সুদৃশ্য অনুভূত হতে থাকে। আর যখন বলা হয় শয়তান তার কার্যাবলি শোভন করে দেয়, তখন এর অর্থ দাঁড়ায়, এ চিন্তা ও কর্মপদ্ধতি অবলম্বনকারীদের সামনে শয়তান সব সময় একটি কাল্পনিক জান্নাত পেশ করে থাকে এবং বলে আশ্বাস দিতে থাকে শাবাশ বেটারা এগিয়ে যাও।
এগুলো তাদের নিচ সহজাত প্রবৃত্তির একটি নিকৃষ্টতর প্রদর্শনী ছাড়া আর কিছু নয়। মহান করুণাময় আল্লাহ তা’আলা তাদের দুঃসাহসিক ভ্রষ্টতা ও অসৎকার্যাবলি সত্ত্বেও নিছক তাঁর অনুগ্রহ ও করুণার কারণে তাদের শাস্তি বিলম্বিত করছেন। তাদের সংশোধিত হবার সুযোগ দেয়াই উদ্দেশ্য। কিন্তু তারা এ অবকাশ কালে ভাবছে, আমাদের সচ্ছলতা ও প্রাচুর্য কেমন স্থায়ী বুনিয়াদের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং আমাদের এ বাগানে কেমন চিরবসন্তের আমেজ লেগেছে, যেন এখানে শীতের পাতা ঝরার মওসুমের আগমনের কোন আশঙ্কাই নেই।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, “এমন এক সময় আসা বিচিত্র নয় যখন আজ যারা অস্বীকার করছে, তারা অনুশোচনা করে বলবে, হায়, যদি আমরা আনুগত্যের শির নত করে দিতাম! ছেড়ে দাও এদেরকে, খানাপিনা করুক, আমোদ ফুর্তি করুক এবং মিথ্যা প্রত্যাশা এদেরকে ভুলিয়ে রাখুক। শিগগির এরা জানতে পারবে। ইতঃপূর্বে আমি যে জনবসতিই ধ্বংস করেছি তার জন্য একটি বিশেষ কর্ম-অবকাশ লেখা হয়ে গিয়েছিল। কোন জাতি তার নিজের নির্ধারিত সময়ের পূর্বে ধ্বংস হতে পারে না, তেমনি সময় এসে যাওয়ার পরে অব্যাহতিও পেতে পারে না।” (সূরা হিজর : ২-৫)
অপরাধ করার সাথে সাথে আল্লাহ কাউকে গ্রেফতার করেন না। আর এই জন্য নির্বোধরা ধারণা করে নিয়েছে যে, ইসলাম, ইসলামী হুকুম-আহকাম ও ইসলামী ব্যক্তিত্বের সাথে অসদাচরণ করা হলেও কিছু হয় না। অথচ আল্লাহর নিয়ম হচ্ছে, প্রত্যেক জাতিকে শুনবার, বুঝবার নিজেকে শুধরে নেবার জন্য কী পরিমাণ অবকাশ দেয়া হবে এবং তার যাবতীয় দুষ্কৃতি ও অনাচার সত্ত্বেও পূর্ণ ধৈর্য সহকারে তাকে নিজের ইচ্ছামত কাজ করার কতটুকু সুযোগ দেয়া হবে তা আল্লাহ পূর্বাহ্নেই স্থির করে নেন। যতক্ষণ এ অবকাশ থাকে এবং আল্লাহর নির্ধারিত শেষ সীমা না আসে ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ ঢিল দিতে থাকেন। এই নির্ধারিত সময়সীমা কিয়ামত পর্যন্ত হতে পারে। আবার এমনটিও হতে পারে যে, তাদের কর্মকাণ্ড যদি বিকৃতির চরম পর্যায় ধারণ করে তাহলে তার কর্মের অবকাশ কমিয়ে দেয়া হয় এবং তাকে ধ্বংস করে ফেলা হয়। যার নজির আমাদের সামনে অনেক রয়েছে।
ঢিল দেয়া বা ধ্বংস করে দেয়ার অর্থ এই নয় যে, এখানেই সব শেষ। বরং আখিরাতে তাদের কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। আল্লাহ বলেন, যারা নিজেদের রবের দাওয়াত গ্রহণ করেছে তাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে আর যারা তা গ্রহণ করেনি তারা যদি পৃথিবীর সমস্ত সম্পদের মালিক হয়ে যায় এবং এ পরিমাণ আরো সংগ্রহ করে নেয় তাহলেও তারা আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচার জন্য এ সমস্তকে মুক্তিপণ হিসেবে দিয়ে তৈরি হয়ে যাবে। এদের হিসেব নেয়া হবে নিকৃষ্টভাবে এবং এদের আবাস হবে জাহান্নাম, বড়ই নিকৃষ্ট আবাস। (সূরা রাদ : ১৮)
এই দুই প্রকারের মাঝে সফলকামী আরো কিছু মানুষ ও দল আছে যারা উভয় অবস্থায় ভারসাম্যনীতি অবলম্বন করে। সুখ এলে আল্লাহর শোকরিয়ার মাত্রা বেড়ে যায় আর দুঃখ যাতনা ও বেদনা এলে ধৈর্যধারণ করে। সবরকারি ব্যক্তি বা দল কালের পরিবর্তনশীল অবস্থায় নিজের মানসিক ভারসাম্য অটুট রাখে। সময়ের প্রত্যেকটি পরিবর্তনের প্রভাব গ্রহণ করে তারা নিজেদের রঙ বদলাতে থাকে না। বরং সব অবস্থায় একটি যুক্তিসঙ্গত ও সঠিক মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে চলে। যদি কখনো অবস্থা অনুকূলে এসে যায় এবং সে ধনাঢ্যতা, কর্তৃত্ব ও খ্যাতির উচ্চাসনে চড়তে থাকে তাহলে শ্রেষ্ঠত্ব ও অহংকারের নেশায় মত্ত হয়ে বিপথে পরিচালিত হয় না। আর কখনো বিপদ-আপদ ও সমস্যা-সঙ্কটের করাল আঘাত তাকে ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকে তাহলে এহেন অবস্থায়ও সে নিজের মানবিক চরিত্র বিনষ্ট করে না। আল্লাহর পক্ষ থেকে সুখৈশ্বর্য বা বিপদ-মুসিবত যে কোন আকারেই তাকে পরীক্ষায় ফেলা হোক না কেন উভয় অবস্থায়ই তার ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা অপরিবর্তিত ও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকে। তার হৃদয়পাত্র কখনো কোন ছোট বা বড় জিনিসের আধিক্যে উপচে পড়ে না।
লেখক : প্রাবন্ধিক