Friday, September 28, 2018

কাব্য-সাহিত্য চর্চায় রাসূলের (সা) কালজয়ী দিকনির্দেশনা ও প্রেরণা -মোশাররফ হোসেন খান

রাসূল (সা)। তিনি ছিলেন তুলনারহিত এক অসাধারণ মহামানব। ছিলেন মানুষ ও মানবতার শিক্ষক। তিনি ছিলেন শিক্ষকের শিক্ষক। তাঁর প্রত্যক্ষ প্রয়াসে তৎকালীন সমাজ-সংস্কৃতি, মানুষের মর্যাদা ও মূল্যবোধ এক নতুন আলোকিত মাত্রা পেয়েছিল। তিনি শুধু সমাজ-সংস্কারই করেননি, বরং সমাজজীবনে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন। আমরা বিস্মিত হই, যখন দেখি রাসূল (সা) একই সাথে শাসক, সমরবিদ, সেনাপতি, সমাজ-সংস্কারকসহ সকল দিকে তাঁর ঐতিহাসিক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। এমনই একজন মহামানব তিনি, যিনি শিল্প-সাহিত্য ও আসহাবে রাসূলের (সা) কাব্যচর্চার ক্ষেত্রেও রেখে গেছেন অতুলনীয় ভূমিকা। রাসূলের (সা) প্রত্যক্ষ প্রণোদনায় সাহাবী-কবিগণ তাঁদের কাব্যচর্চার ধারা বেগবান করে তুলেছিলেন। তাঁদের রচিত সেসব কাব্যসাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত বলেই আজও সেসব নিয়ে প্রচুর লেখালেখি, গবেষণা ও আলোচনা-পর্যালোচনা হয়।

রাসূলের (সা) সাহায্য, সহযোগিতা, প্রেরণা ও উৎসাহে যেসকল সাহাবী-কবির উত্থান ঘটেছিল এবং যাঁরা কাব্যসাহিত্যে অমরতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা) অন্যতম। তাঁর কাব্যসাহিত্য নিয়েই আজকের এই যৎকিঞ্চিৎ পর্যালোচনা।
রাহমাতুল্লিল আলামিন সাইয়িদুল মুরসালিন খাতামুন নাবিয়্যিন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)-এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহাবী-হযরত আলী (রা) ইবনে আবু তালিব। সুবিচারের জন্য তিনি ‘শ্রেষ্ঠ ন্যায়বিচারক’ মর্যাদায় ভূষিত ছিলেন। সাহাবীগণের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ ছিলেন তিনি। বিভিন্ন সশস্ত্র জিহাদে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, হুদায়বিয়ার সন্ধিপত্র রচনা, নাজরানের খ্রিস্টান প্রতিনিধিদের সাথে চুক্তিপত্র রচনা, কৃষকদের অধিকার সংরক্ষণে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার প্রচলনে হযরত আলীর প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল। কৃষক-শ্রমিক তথা সকল শোষিত বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের বন্ধু ছিলেন তিনি। অনন্য মগ্নতায় তিনি নামাজ সম্পন্ন করতেন এবং আল্লাহর প্রেমে কখনো কখনো সংজ্ঞা হারাতেন। তিনি নাজিলকৃত আয়াত লিখে রাখতেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে আলোচনা করতেন। আল কুরআনের ভাষ্যে তিনি অতুলনীয় ছিলেন। অনন্য জ্ঞান প্রজ্ঞার পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বিশেষ নৈকট্যে থেকে সূরা নাজিলের প্রেক্ষিতসহ আয়াতসমূহের অর্থ ও তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করার সুযোগ লাভ করেন তিনি।
মহান সাহাবী ও খলিফা হযরত আলী (রা) আরবি সাহিত্যেও সুপণ্ডিত ছিলেন। সশস্ত্র জিহাদসমূহে তাঁর ভূমিকা কিংবদন্তিতুল্য। তিরাশিটি সশস্ত্র জিহাদে বিজয়ী হন তিনি। বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা) নবুওয়াত লাভ করেন সোমবারে এবং হযরত আলী (রা) ইসলাম গ্রহণ করেন পরদিন মঙ্গলবার। ইসলাম গ্রহণের পর সত্য অবলম্বন করে থাকা ও প্রচারের কাজে তিনি নানাভাবে নির্যাতিত হন। হিজরতের সময় রাসূলুল্লাহ (সা) প্রতিনিধিরূপে আমানতকারীদের কাছে আমানত ফিরিয়ে দেয়ার দায়িত্ব প্রদান করে তাঁর নিজের বিছানায় তাঁকে রেখে যান। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি সেখানে থেকে মারাত্মক বিরূপ পরিস্থিতি মুকাবিলা করে আমানতকারীদের আমানত ফিরিয়ে দিয়ে সপরিবারে মদিনায় হিজরত করেন।
ইসলামের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ জিহাদ-বদরে তিনি বিপুল সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। উহুদের যুদ্ধে মহানবীর জীবননাশের আশঙ্কা দেখা দেয়। বিধর্মীরা তাঁকে ঘিরে ফেললো। তিনি নিজ অবস্থান থেকে ছুটে এসে তাদের ব্যূহ ভেদ করে নবীজীকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান। খন্দকের সশস্ত্র জিহাদে আমির ইবন আবদে উদ দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানালে তিনি এগিয়ে যান ও সবাইকে অবাক করে তাঁর জুলফিকারে ইবনে আবদে উদকে হত্যা করেন।
খায়বারের জিহাদে কঠিন ভাগ্য পরীক্ষা। মুসলিম বাহিনীর কোনো সেনাপতি জয়ী হতে পারছিলেন না। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘আগামীকাল এমন এক ব্যক্তির হাতে পতাকা দেবো, যিনি আল্লাহ ও রাসূলকে অত্যধিক ভালোবাসেন এবং আল্লাহ তাঁর দ্বারা বিজয় লাভ করাবেন। তিনি কিছুতেই পশ্চাৎপদ হবেন না।’ হযরত আলীর চোখের রোগ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দোয়ায় মুহূর্তে নিরাময় হলো। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে পতাকা প্রদান করে বললেন, ‘হে আলী! পতাকা গ্রহণ করো এবং তা নিয়ে অগ্রসর হও যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহ তোমাকে জয়যুক্ত করেন।’ যুদ্ধে ঢাল হাতছাড়া হয়ে গেলে তিনি দুর্গের কপাট খুলে ঢালরূপে ব্যবহার করেন এবং যুদ্ধ শেষে তা দূরে নিক্ষেপ করেন। একমাত্র তাবুক অভিযানে তিনি অংশগ্রহণ করতে পারেননি। কারণ, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে মদিনা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত করেন।
তিনি ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে গঠনমূলক ভূমিকা অব্যাহত রাখেন ও প্রথম তিন খলিফার শাসনকালের পঁচিশ বছর সহযোগিতা দান করেন। তিনি হযরত উমর (রা)-কে হিজরত হতে মুসলিম সন গণনার পরামর্শ দান করেন। হযরত উমর (রা) বলেন, ‘আলী না হলে উমর ধ্বংস হতো।’ হিজরির শেষ দিক থেকে ৪০ হিজরির ১৭ রমজান পর্যন্ত খিলাফতের গুরুদায়িত্ব পরিচালনা করেন তিনি। ২১ রমজান রাতে ৬৩ বছর বয়সে তিনি শাহাদাত লাভ করেন। রবিবার রাতে তাঁকে কুফায় দাফন করা হয়।
হযরত আলীর (রা) অসাধারণ সাহিত্যপ্রতিভা ছিল। অধ্যাপক পি.কে হিট্টি হযরত আলীকে (রা) ‘মুসলিম সাহিত্য ও শৌর্যবীর্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলে মূল্যায়ন করেন।’ ঐতিহাসিক গিবন বলেন, ‘জন্ম, আত্মীয়তার বন্ধন এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আলীকে (রা) এত বেশি মহিমান্বিত করেছিল যে, আরবের শূন্য সিংহাসনের দাবি করা তাঁর জন্য অযৌক্তিক ছিল না। একজন কবি, একজন দরবেশ ও একজন সৈনিকের সমন্বিত গুণাবলি তাঁর মাঝে বিদ্যমান ছিল। তাঁর বাগ্মিতা ও সাহসিকতার কাছে সকল প্রতিদ্বন্দ্বীই হার মানতো। মহানবী (সা) তাঁর কর্তব্যের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর এই বন্ধুর কথা মনে রেখেছিলেন। তাঁকে তিনি নিজের ভাই, প্রতিনিধি এবং দ্বিতীয় মূসার বিশ্বস্ত হারুন হিসেবে আখ্যায়িত করে গেছেন।’
অনন্য বাগ্মিতার অধিকারী ছিলেন হযরত আলী (রা)। জনগণের উদ্দেশে বিভিন্ন সময়ে তিনি যে ভাষণ প্রদান করেন, তার সংকলন গ্রন্থ বিখ্যাত ‘নাহযুল বালাগা।’ এতে তাঁর ধর্মীয় বিচার-বুদ্ধি, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, জীবনবোধ ও আল্লাহর কাছে আত্ম-নিবেদনের আকুতির প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর সেই ভাষণাবলি প্রকাশভঙ্গি, শব্দচয়ন ও ভাষার লালিত্যে এক অতুলনীয় সাহিত্য-কর্মে রূপ গ্রহণ করেছে। আরবি ভাষার অমূল্য সম্পদ হিসেবে এ গ্রন্থ স্বীকৃত ও সম্মানিত। আরবি গদ্য ধারায় মাকামা সাহিত্যের স্থান অত্যন্ত উঁচুতে। শাশ্বত সর্বজনীন বাণীর ভিত্তিতে বক্তব্য উপস্থাপন, কালোত্তীর্ণ ভাব ও অলঙ্করণ, গদ্য ধারায় ছান্দিক কুশলতা ও শিল্প-শোভনতা নাহযুল বালাগার মর্যাদাকে সমুন্নত রেখেছে।
হযরত আলী (রা)-কে আরবি ব্যাকরণের জনক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তাঁর তত্ত্বাবধানে আবুল আসওয়াদ দুয়েলি প্রথম আরবি ব্যাকরণ রচনা করেন। হযরত আলী (রা) লিখেছেন অনেক কবিতা। পবিত্র হাদিস ও সাহিত্যের গ্রন্থাবলিতে তাঁর অনেক কবিতা পাওয়া যায়। তাঁর কবিতার বিভিন্ন সংকলনও হয়েছে। দিওয়ান-ই-আলী (রা) তাঁর বিশ্ববিখ্যাত কাব্য সংকলন। মুসলিম বিশ্বে তো বটেই, এর বাইরেও এ গ্রন্থের সমাদর ব্যাপক-বিশাল। সর্বজনীন কালোত্তীর্ণ বাণী ও শিল্প সৌন্দর্যে এ গ্রন্থ কালজয়ীর ভূমিকা পালন করছে। দিওয়ান শব্দের অর্থ কাব্যগ্রন্থ, কবিতা সংকলন। বিচারালয়ও এর অর্থ হয়। এককভাবে কোনো কবির কাব্য-সমষ্টিকে বা একই গোত্রের কয়েকজনের কাব্যসংগ্রহকে দিওয়ান বলা হয়। দিওয়ান-ই-আলী (রা) মানে আলী (রা)-এর কাব্য সংকলন। আল্লামা শিবলী নুমানী এ গ্রন্থের মর্যাদা ও খ্যাতির ওপর মূল্যবান এক অভিমতে বলেন, ‘আরবি কাব্যসাহিত্যে মুআল্লাকা, লামিয়াত ও আধুনিক আরবীয় গদ্য ও কাব্যসাহিত্যের সুবিশাল জগতের মধ্যে দিওয়ান-ই-আলীর তুলনামূলক মূল্যায়নে এটা স্বচ্ছ হয় যে, ইসলামের অনুপম সত্য ও সুন্দরের উপস্থাপনায়, মানবীয় চেতনার উন্মেষ ও বিকাশের সৃজনশীলতায়, নশ্বর পার্থিবতার মোহের বলয় ভেঙে চিরন্তন জীবনের আহ্বান কুশলতায়, সর্বোপরি মাবুদ ও বান্দার সম্পর্ক ও নৈকট্যের জন্য অনুপম আকুতি-সমৃদ্ধ দিওয়ান-ই আলী (রা) একই সাথে তত্ত্বসন্ধানী ও শিল্পান্বেষী মানুষের জন্য এক মূল্যবান উপহার এবং এর গতিময়তা কাল থেকে কালান্তরে, শতকের পর শতক পেরিয়ে বিস্তার লাভ করেছে। দুর্ভাগ্যশত দৃষ্টিকোণগত সংকীর্ণতার যূপকাষ্ঠে দিওয়ান-ই-আলী (রা)-এর মত সর্বজনীন মানবতাবাদী বিশ্বসাহিত্যে যথাযোগ্য মূল্যায়ন ঘটেনি। খিলাফতের প্রতি বৈরী আঘাত থেকে এ সাহিতকর্মও রেহাই পায়নি। কারণ, এর কবি হযরত আলী (রা), খুলাফায়ে রাশেদীনের শেষ খলিফা ও কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব। ফলে, মজলুম মানুষের মুক্তির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্য-কর্ম হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় এর আহ্বান উপস্থাপিত হয়নি। মানবিক মহিমার সর্বোচ্চ ঘোষণায় দিওয়ান-ই-আলী (রা) শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ছিল সেদিন, রয়েছে আজো এবং এর আবেদন আগামীর আবহমান মানুষের মিছিলেও শামিল থাকবে।’
হযরত আলী (রা)-এর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে সুধীমহল কম-বেশি অবহিত আছেন। আরবি কাব্যক্ষেত্রে হযরত আলী (রা)-এর অমর অবদানের মধ্যে রয়েছে আনওয়ার আল-উকূল মিন আশআরী ওয়াসিইয়ী আর-রাসূল (রাসূল প্রতিনিধির কবিতাবলি জ্ঞানপ্রদীপ)। হি. ৮৯৭,/খ্রি. ১৪৯২ সনে সাদী ইবন তাজি সঙ্কলিত এ গ্রন্থ ব্রিটিশ মিউজিয়াম (প্রথম) ৮/৫৭৭; আয়া সুফিয়া ৪২/৩৯৩৭; পাটনা ১: ৭৪৯, ১৯৫; লিডন ৫৮০; প্যারিস (প্রথম) ৩/৩০৮২; ব্রিটিশ মিউজিয়াম (দ্বিতীয়) ২/১২২৪; মিউনিখ (প্রথম) ২/৪৪১; ভ্যাটিক্যান (তৃতীয়) ৩৬৫; আলীগড় ৭,১৩৪ ও অন্যান্য বিখ্যাত গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত রয়েছে। হি. ৮৯০/খ্রি. ১৭৮৫ সনে হুসাইন ইবন মুঈন আল-দীন-আল-মাইবুযী কর্তৃক ফারসি ভাষায়কৃত এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিডন ৫৭৯; ব্রিটিশ মিউজিয়াম (প্রথম) ৫৭৯/১৬৬৫; ব্রিটিশ মিউজিয়াম (দ্বিতীয়) ১: ১৯,২০; তেহরান ২: ৪/৪১৩ ইত্যাদি স্থানে পাওয়া যায়। এ ছাড়াও অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তিত্বকৃত এর ফারসি অনুবাদ হামবুর্গ (১,১৯১)-সংরক্ষিত রয়েছে।
মূলত হযরত আলীর (রা) কাব্য ও সাহিত্যকর্ম বিশ্বসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।

দুই.
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তবুও আবারো স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, হযরত আলী (রা) ছিলেন একজন সুবক্তা ও বিখ্যাত কবি। তাঁর কবিতার একটি ‘দিওয়ান’ আমরা পেয়ে থাকি। তাতে অনেক কবিতায় মোট ১৪০০ শ্লোক আছে। গবেষকদের ধারণা, তাঁর নামে প্রচলিত অনেক কবিতা প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। তবে তিনি যে তৎকালীন আরবি কাব্যজগতের একজন বিশিষ্ট দিকপাল ছিলেন এতে পণ্ডিতগণের কোন সংশয় নেই। ‘নাহজুলবালাগা’ নামে তাঁর বক্তৃতার একটি সংকলন আছে যা তাঁর অতুলনীয় বাগ্মিতার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে।

হযরত আলীর (রা) কবিতার বিষয়বস্তু বিচিত্রধর্মী। বংশ অহমিকা, মূর্খের সাহচর্য, যুগের বিশ্বাস ঘাতকতা, যুগ-যন্ত্রণা, দুনিয়ার মোহ, দুনিয়া থেকে আত্মরক্ষা, সহিষ্ণুতার মর্যাদা, বিপদে ধৈর্য ধারণ, দুঃখের পর সুখ, অল্পে তুষ্টি, দারিদ্র্য ও প্রাচুর্য ইত্যাদি বিষয় যেমন তাঁর কবিতায় স্থান পেয়েছে, তেমনিভাবে সমকালীন ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা, যুদ্ধের বর্ণনা, প্রিয় নবীর (সা) সাহচর্য, তাকদির, আল্লাহর প্রতি অটল বিশ্বাস, খোদাভীতিসহ নানা বিষয় তাতে বাক্সময় হয়ে উঠেছে। তিনি মৃত্যুর অনিবার্যতা, যৌবনের উন্মাদনা, বন্ধুত্বের রীতিনীতি, ভ্রমণের উপকারিতা, জ্ঞানের মহত্ত্ব ও অজ্ঞতার নীচতা, মানুষের অভ্যন্তরের পশুত্ব ইত্যাদি বিষয়ের কথা যেমন বলেছেন, তেমনিভাবে প্রিয় নবীর (সা) ও প্রিয়তমা স্ত্রী ফাতিমার (রা) মৃত্যুতে শোকগাথাও রচনা করেছেন।
বংশ অহমিকা যে অসার ও ভিত্তিহীন সে কথা হযরত আলী (রা) বলেছেন এভাবে :
‘আকার-আকৃতির দিক দিয়ে সকল মানুষ সমান।
তাদের পিতা আদম এবং মা হাওয়া।
মায়েরা ধারণের পাত্রস্বরূপ, আর পিতারা বংশের জন্য।
সুতরাং মানুষের গর্ব ও অহঙ্কারের যদি কিছু থেকে থাকে তাহলো কাদা ও পানি।’
পুত্র হুসায়নকে (রা) তিনি উপদেশ দান করেছেন এভাবে :
‘হে হুসায়ন! আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি,
তোমাকে আদব শিখাচ্ছি; মন দিয়ে শোন।
কারণ, বুদ্ধিমান সেই যে শিষ্টাচারী হয়।
তোমার স্নেহশীল পিতার উপদেশ স্মরণ রাখবে,
যিনি তোমাকে শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন।
যাতে তোমার পদস্খলন না হয়।
আমার প্রিয় ছেলে!
জেনে রাখ, তোমার রুজি-রিজিক নির্ধারিত আছে।
সুতরাং উপার্জন যাই কর, সৎভাবে করবে।
অর্থ-সম্পদ উপার্জনকে তোমার পেশা বানাবে না।
বরং আল্লাহ-ভীতিকেই তোমার উপার্জনের লক্ষ্য বানাবে।’
বুদ্ধি, জ্ঞানের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা তিনি বলেছেন এভাবে :
‘মানুষের জন্য আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ অনুগ্রহ হলো তার বোধ ও বুদ্ধি।
তার সমতুল্য অন্য কোন ভালো জিনিস আর নেই।
দয়াময় আল্লাহ যদি মানুষের বুদ্ধি পূর্ণ করে দেন
তাহলে তার নীতি-নৈতিকতা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূর্ণতা লাভ করে।
একজন যুবক মানুষের মাঝে বুদ্ধির দ্বারাই বেঁচে থাকে।
আর বুদ্ধির ওপরই তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়।
সুস্থ-সঠিক বুদ্ধি যুবককে মানুষের মাঝে সৌন্দর্যময় করে-
যদিও তার আয়-উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়।
আর স্বল্প বুদ্ধি যুবককে মানুষের মাঝে গানিময় করে-
যদিও বংশ মর্যাদায় সে হয় অভিজাত।’
তিনি পৃথিবীর নশ্বরতা ও নিত্যতাকে মাকড়সার জালের সাথে তুলনা করে বলেছেন :
‘নিশ্চয় দুনিয়া নশ্বর।
এর কোনো স্থায়িত্ব নেই।
এ দুনিয়ার উপমা হলো মাকড়সার তৈরি করা ঘর।
হে দুনিয়ার অন্বেষণকারী!
দিনের খোরাকই তোমার জন্য যথেষ্ট।
আর আমার জীবনের শপথ!
খুব শিগগির এ দুনিয়ার বুকে যারা আছে,
সবাই মারা যাবে।’
তিনি দুনিয়াকে সাপের সাথে তুলনা করেছেন এভাবে :
‘দুনিয়া হলো সেই সাপের মত যে বিষ ছড়ায়-
যদিও তার দেহ নরম ও কৃশকায়।’
দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সুখ-দুঃখে ধৈর্যহারা না হবার কথা বলেছেন এভাবে :
‘যুগ বা কাল যদি আমাকে দুঃখ দেয়
তা হলে আমি সংকল্প করেছি ধৈর্য ধরার।
আর যে বিপদ চিরস্থায়ী নয় তা খুবই সহজ ব্যাপার।
আর যুগ যদি আনন্দ দেয় তাহলে উল্লাসে আমি মাতি না।
আর যে আনন্দ ক্ষণস্থায়ী তা একান্ত তুচ্ছ ব্যাপার।’
খায়বার যুদ্ধের দিন মারহাব ইহুদি তরবারি কোষমুক্ত করে নিম্নের এই শ্লোকটি আওড়াতে আওড়াতে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহবান জানায় :
‘খায়বার ময়দান জানে যে, আমি মারহাব।
আমি অস্ত্রধাণকারী,
অভিজ্ঞ বীর-যখন যুদ্ধের দাবানল জ্বলে ওঠে।’
এক পর্যায়ে হযরত আলী (রা) এই শ্লোকটি আবৃত্তি করতে করতে অসীম সাহসিকতার সাথে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন :
‘আমি সেই ব্যক্তি যার মা তাকে ‘হায়দার’ নাম রেখেছে।
আমি জঙ্গলের বীভৎস দৃশ্যরূপী সিংহ।
আমি শত্র“ বাহিনীকে সানদারাড় পরিমাপে পরিমাপ করি।
অর্থাৎ তাদেরকে পূর্ণরূপে হত্যা করি।’
উহুদ যুদ্ধের পর হযরত আলী (রা) হযরত ফাতিমার (রা) কাছে এসে বললেন, ফাতিমা! তরবারিটি রাখ। আজ এটি দিয়ে খুব যুদ্ধ করেছি। তারপর তিনি এই দু’টি শ্লোক আবৃত্তি করলেন:
‘হে ফাতিমা!
এই তরবারিটি রাখ যা কখনো কলঙ্কিত হয়নি।
আর আমিও ভীরু কাপুরুষ নই এবং নই নীচ।
আমার জীবনের কসম!
নবী আহমাদের সাহায্যার্থে এবং বান্দার সবকিছু সম্পর্কে জ্ঞাত
প্রভুর সন্তুষ্টি বিধানে আমি এটাকে ব্যবহার করে
পুরনো করে ফেলেছি।’
কবিতা সম্পর্কে হযরত আলীর (রা) মনোভাব তাঁর একটি মূল্যবান উক্তিতে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি বলেছেন :
‘কবিতা হলো একটি জাতির দাঁড়িপাল্লা (অথবা তিনি বলেছেন) কথার দাঁড়িপাল্লা।’
অর্থাৎ দাঁড়িপাল্লা দিয়ে যেমন জিনিসপত্রের পরিমাপ করা হয় তেমনি কোনো জাতির সাহিত্য-সংস্কৃতি, সভ্যতা, নৈতিকতা ও আদর্শের পরিমাপ করা যায় তাদের কবিতা দ্বারা।
তিনি শুধু নিজে একজন উঁচু মানের কবি ছিলেন শুধু তাই নয়, বরং অন্য কবিদেরকেও তিনি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন। তাদের কবিতার যথাযথ মূল্যায়নও করতেন।
যেমন, একবার এক বেদুঈন তাঁর কাছে এসে কিছু সাহায্য চাইলো। তিনি তাকে একটি চাদর দান করলেন। লোকটি যাওয়ার সময় তার নিজের একটি কবিতা শোনালো। এবার হযরত আলী (রা) তাকে আরো পঞ্চাশটি দিনার দিয়ে বললেন, শোন, চাদর হলো তোমার চাওয়ার জন্য, আর দিনারগুলো হলো তোমার কবিতার জন্য। আমি রাসূলকে (সা) বলতে শুনেছি যে, তোমরা প্রত্যেক লোককে তার যোগ্য আসনে সমাসীন করবে।’

তিন.
রাসূল (সা) কবি ও কবিতাকে ভালোবাসতেন। কবিকে যথাযথ মর্যাদা দিতেন। পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। সহযোগিতা করতেন। অনুপ্রেরণা দান করতেন। রাসূলের (সা) এই কর্মধারায় সাহাবীগণও অভিষিক্ত ছিলেন। হযরত আলীও (রা) কবি ও কবিতাকে যেমন ভালোবাসতেন তেমনি তার পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতাও করতেন। রাসূলের (সা) প্রত্যক্ষ সান্নিধ্য ও শিক্ষায় উদ্ভাসিত ছিলেন তাঁরা। যে কারণে সমরে কিংবা শান্তিতে, শাসকের দায়িত্ব পালন কালে, নেতৃত্ব প্রদান কালেÑ অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে, সর্বাবস্থায় তাঁরা কবি ও কবিতাকে যথাযথ সম্মান, মর্যাদা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে গেছেন। যা আজ এবং আগামীর জন্য এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্তস্বরূপ।

সুতরাং কবি ও কবিতার যথাযোগ্য মূল্য ও মর্যাদা দেয়া সুন্নতেরই একটি বড় অধ্যায়।
বেদনার বিষয় বটে, আজকে যারা নেতৃত্বের আসীনে অধিষ্ঠিত, তাঁদের কাছে কবি ও কবিতার বিশেষ কোনো মূল্য বা মর্যাদা আছে বলে মনে হয় না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে কবিরাই নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, বঞ্চিত এবং লাঞ্ছিত। এটা কোনো ক্রমেই শুভ লক্ষণ নয়। কাম্যতো নয়-ই।
স্মরণ রাখা উচিত যে, বিশ্বাসী কবিদের কবিতা ইসলামী সমাজগঠনে, আদর্শিক সংস্কৃৃতি বিকাশে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে সবিশেষ ভূমিকা পালন করে। সুতরাং যাদের এতটা অবদান সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে, সেই সব কবি-সাহিত্যিকের প্রতিও ইসলামের নেতৃবৃন্দসহ সকলের সুদৃষ্টি রাখা একান্ত প্রয়োজন। প্রয়োজন কবি ও কবিতার যথাযথ মর্যাদা ও মূল্য দেয়ার। তাঁদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা করার। তাহলেই বিশ্বাসী কবিতার ধারা আরও বেগবান হয়ে উঠবে। আর তাতে করে সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সবুজ চত্বর আরও বেশি সম্প্রসারিত হবে।
একটি সবুজ-সুন্দর পৃথিবী ও সমাজ বিনির্মাণের জন্য কবি ও কবিতার ভূমিকা অনিঃশেষ। বিষয়টির প্রতি সবার সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া অত্যন্ত জরুরি।
লেখক : কবি, কথাশিল্পী ও সম্পাদক

Wednesday, September 26, 2018

স্টিফেন হকিংসকে বিজ্ঞানী বলা যাবে না



আবু মহি মুসা : শুরুতেই একটি কথা বলতে হচ্ছে যে, আমাদের এ সভ্যতার দর্শনের শুরু হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব ৬ শতক থেকে। যার সূত্রপাত ঘটিয়েছে গ্রিক। যে কারণে গ্রিককে বলা হয় ‘মাদার অব ফিলোসফি।’ খ্রীস্টপূর্ব ৬ শতক থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়-কাল হচ্ছে ছাব্বিশ শত বছর। যেখনে বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে শত ভাগের কাছাকাছি, সেখানে এই ছাব্বিশ শত বছরে দর্শনের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে মাত্র ১০ ভাগ। এই সময়ে মধ্যে আমরা  দার্শনিক কোনো বিষয়ে সঠিক কোনো ধারণা পাইনি। যেমন প্রেম, দেশপ্রেম,  মানবিক মূল্যবোধ, সততা, দর্শন, দর্শনের উৎপত্তি ইত্যাদি, কোন্ বিষয়ে আমরা ধারণা পেয়েছি?   
উল্লেখিত বিষয়ের মধ্যে  বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কিত একটি বিষয় রয়েছে।  বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কে বহু আলোচিত এবং আলোড়িত যে মতবাদ, তা হচ্ছে স্টিফেন হকিংসের ‘বিগ ব্যাং থিওরী।’ বিগ ব্যাং থিওরী সম্পর্কে আমি বলবো, it is bogus and absolutely bogus. Not only that Stepehen Halkings neither philosopher, nor Scientiest. অর্থাৎ স্টিফেন হকিংস বিজ্ঞানীও ছিলেন না, দার্শনিকও ছিলেন না।  এ বক্তব্যটি শুনে অনেকের বিস্ময়ের অন্ত থাকবে না। সমগ্র বিশ্ব  টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে যেভাবে তাকে সপ্তম আস্মানে নিয়ে গেছে, সেখানে উল্লেখিত বক্তব্য সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য করে তোলা সহজ ব্যাপার নয়। তিনি যে বিজ্ঞানী নন, এখানে তিনটি যুক্তি রয়েছে।
প্রথম যুক্তি : লক্ষ্য করা গেছে,  অনেক সময় অনেকেই নিজেকে দার্শনিক হিসেবে দাবি করে থাকেন। কে দার্শনিক এটা  কেউ নিজে দাবি করলেও হবে না, বা অন্য কেউ বললেও হবে না। কে দার্শনিক এটা বলবে দর্শনের সংজ্ঞা। আমরা কি  দর্শনের সেই সংজ্ঞা পেয়েছি? আমি ‘দেশপ্রেমিক’, দেশপ্রেমের সংজ্ঞা বলবে আমি দেশপ্রেমিক কিনা? ঠিক তেমনি বিজ্ঞানের সংজ্ঞা বলবে কে বিজ্ঞানী। আমরা আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানের সঠিক কোনো সংজ্ঞা পাইনি। বিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে,  বিজ্ঞান হচ্ছে, ‘বিশেষ জ্ঞান’। আমি দর্শনকেও বিশেষ জ্ঞান  বলতে পারি । এ দিয়ে কি বুঝা যাবে বিজ্ঞান কি অথবা কে বিজ্ঞানী? বিজ্ঞানের যে সংজ্ঞা বইর মধ্যে পাওয়া যায় তা হচ্ছে, ‘কোনো বিষয়ের সুসংঘবদ্ধ জ্ঞানই হচ্ছে বিজ্ঞান।’ বিজ্ঞানের এ সংজ্ঞাকে গ্রহণযোগ্য বলে  মনে করা হয় না।
আমরা জানি যে,  বিশ্বজগৎ দুটো ভাগে বিভক্ত। একটি বস্তুজগৎ, অন্যটি ভাবজগৎ। বস্তুজগতের কোনো কিছুর সংজ্ঞার প্রয়োজন হয় না। যেমন, তাল গাছ, নারকেল গাছ। আমরা নামেই তাকে চিনতে পারি। কিন্তু ভাবের ক্ষেত্রে সংজ্ঞার প্রয়োজন হয়। কারণ, শুধু নাম দিয়ে কিছুই বুঝা যায় না। যেমন, প্রেম, মানবিক মূল্যবোধ সততা, ন্যায়পরয়ণতা ইত্যাদি । এ জন্য এর সংজ্ঞার প্রয়োজন। সংজ্ঞারও  একটি সংজ্ঞা আছে। সংজ্ঞার সংজ্ঞা হচ্ছে ‘brief description’ অর্থাৎ যে বিষয়ের সংজ্ঞা দেয়া হবে, তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। এরপর উদঘাটন করতে  হবে ঐ বিষয়ের সাথে আর কি কি বিষয় জড়িত। যেমন, ভালোবাসা, একটি শব্দ। এই একটি শব্দ দিয়ে কিন্তু বুঝা যায় না ভালোবাসা কি। ৭টি বিষয়ের সমষ্টি হচ্ছে  ভালোবাসা (প্রেম-ভালোবাসা অধ্যায় : সৃষ্টি থেকে ধ্বংস)। যেমন, মানসিক আকর্ষণ, কল্যাণ কামনা, স্বার্থ, জ্ঞান, আবেগ, ইচ্ছা এবং অনুভুতি। জ্ঞানটা এর মধ্যে কেন রয়েছে। যেমন, দশটি মেয়ে একই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন কলেজে যায়। এর মধ্যে একটি মেয়েকে আমার ভালো লাগলো, যে মেয়েটি দেখতে কুৎসিৎ। এই কুৎসিৎ মেয়েটিকে ভালো লাগার কারণ হচ্ছে, এ মেয়েটির এমন একটি গুণ আছে, যা আর কারো মধ্যে নেই। এখানে জ্ঞান এনালাইসিস করবে, মেয়ের রূপ সৌন্দর্য ভালো লাগবে না গুণ ভালো লাগবে। উল্লেখিত বিষয়ের  প্রত্যেকটির ভূমিকা রয়েছে। ঠিক তেমনি কি কি বিষয় নিয়ে বিজ্ঞান এটা জানতে হবে। বিজ্ঞান বলতে দুটো বিষয়। একটি জ্ঞান, অন্যটি বস্তু। জ্ঞান ছাড়া বিজ্ঞান হবে না, বস্তু ছাড়াও বিজ্ঞান হবে না। (যদিও অতিন্দ্রি বিজ্ঞানের কথা বলা হয়েছে, সেখানে বস্তুর উপস্থিতি নেই, এটা একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ)। রাইট ব্রাদার্স বিমান সৃষ্টির সূত্রপাত ঘটিয়েছেন গ্লাইডিংয়ের মাধ্যমে। এর জ্ঞান তাঁরা কোথায় পেয়েছেন? আকাশে পাখি উড়তে দেখে। পরবর্তীকালে যান্ত্রিক বিমান আবিস্কৃত হয়েছে। এটা বিজ্ঞানের ব্যাপার। এর জ্ঞান তারা পেয়েছে আকাশে পাখি উড়তে দেখে। এরা যদি কোনো কালেই আকাশে পাখি উড়তে না দেখতেন, তাহলে তাদের পক্ষে বিমান আবিস্কার করা সম্ভব ছিল না। এটাই হচ্ছে ভাব বা জ্ঞান। পাখি দেখে বিমানের নক্সা করলেন। এই নক্সা নিয়ে গেলেন বস্তুর কাছে। বস্তু দিয়ে বিমানের বডি তৈরী করলেন, ডানা দিলেন, লেজ দিলেন। এরপর ইঞ্জিন ফিট করলেন। আকাশে উড়লেন। এবার বিজ্ঞানের সংজ্ঞা হবে এভাবে, ‘ যে জ্ঞান বস্তুর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত অথবা বস্তু মধ্য দিয়ে যে জ্ঞানের বিকাশ ঘটে এটা হচ্ছে বিজ্ঞান। প্রশ্ন হচ্ছে, স্টিফেন হকিংসের কোনো জ্ঞান সরাসরি বস্তুর সাথে সম্পৃক্ত? এটাই যথেষ্ট যে তিনি বিজ্ঞানী নন।  
দ্বিতীয় যুক্তি : দর্শনের উৎপত্তির পর দর্শন দুই ভাগে বিভক্ত। ভাববাদ এবং বস্তুবাদ। তৃতীয় স্তরে দর্শন চারভাগে বিভক্ত । যেমন, ভাববাদী ক্ষেত্র, বস্তুবাদী ক্ষেত্র, ধর্মীয় ক্ষেত্র এবং দার্শনিক সাধারণ ক্ষেত্র।  কিন্তু, মতবাদ দেয়ার ক্ষেত্র হচ্ছে তিনটি। বস্তুবাদী ক্ষেত্র, ভাববাদী ক্ষেত্র এবং মিশ্রক্ষেত্র। বস্তুবাদী ক্ষেত্র বলতে যেমন, একজন ডাক্তার-বিজ্ঞানী একটি রোগের ঔষধ অবিস্কার করেছেন, এটা হচ্ছে বস্তুবাদী ক্ষেত্র। এখানে তার সাথে কোনো দার্শনিকের দ্বিমত পোষণ করার ক্ষমতা নেই। তাদের দুজনের পথ এবং মত ভিন্ন। কিন্তু মিশ্রক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা দেবেন প্রমাণ, দার্শনিকরা দেবেন যুক্তি। প্রমাণ এবং যুক্তি এক হতে হবে।  মিশ্রক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা ৯৯ ভাগ প্রমাণের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন, ডারউইনের বিবর্তনবাদ। অনেক প্রমাণ দেখানো হয়েছে। শেষে বলা হয়েছে মানুষ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। এবং বলা হয়েছে, মানুষের পূর্বপুরুষ ছিল প্রাইমেট। শিক্ষিত সমাজের অনেকে এখনও মনে করেন, মানুষের পূর্বপুরুষ ছিল বানর। এটা সম্পূর্ণ একটি বোগাস মতবাদ। কতগুলো যুক্তি চান মানুষ মানুষ আকৃতিতে সৃষ্টি হয়েছে? বানর যদি মাটি থেকে সৃষ্টি হতে পারে, মানুষর সৃষ্টি মাটি হতে বাধা কোথায়? কাজেই এই মিশ্রক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা যতগুলো বিষয়ে মতবাদ দিয়েছেন, যেমন, বিগ ব্যাং, ব্লাক হোল, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ, বিশ্ব্সৃষ্টি, আকাশ অসীম না সসীম, পৃথিবী ধ্বংস, সবগুলো বোগাস। এর মধ্যে বস্তুগত প্রমাণ, দার্শনিক যুক্তি, বৈজ্ঞানীক ব্যাখ্যা নেই। এর পর টাইম ট্রাভেলের কথা বলা হয়েছে। এলিয়েন নামক প্রাণীরা পৃথিবীতে আসে। অনেকে দেখেছেও। ভন্ডামীর একটা সীমা থাকা উচিৎ।
তৃতীয় যুক্তি : স্টিফেন হকিংস বলেছেন, জমাটবদ্ধ বস্তুতে মহাবিস্ফোরণের ফলে মহাবিশ্বের সৃষ্টি । প্রশ্ন হচ্ছে, জমাটবদ্ধ বস্তু কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে? এর ভর কত? তরল না সলিড? মহাবিস্ফোরণের ফলে যে বস্তুপুঞ্জ ছুটে এসে সূর্যের সৃষ্টি করেছে, বিস্ফোরণ স্থল থেকে এর দূরত্ব কত? এর মাঝে অনেক গ্যালাক্সি এবং সৌরজগৎ রয়েছে। সে সব সৌরজগৎ অতিক্রম করে সূর্যের সৃষ্টি করা কি সম্ভব? বস্তুপুঞ্জ ছুটে আসার শক্তি কোথায় পেয়েছে, নাকি জেট ইঞ্জিল ফিট করা ছিল? ভারতের দুজন বিজ্ঞানী বলেছেন, মহাবিশ্ব এত সুশৃঙ্খলভাবে সৃষ্টি,  বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে এভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টি  সম্ভব নয়। কাজেই তার এ মতবাদ সম্পূর্ণ মনগড়া কল্পকাহিনী।
প্রশ্ন হতে পারে যে, মহাবিশ্ব কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে? জার্মান দার্শনিক ইমনুয়েল কান্ট বলেছেন, ‘বিশ্ব কখনো সৃষ্টি হয়নি, কখনো ধ্বংস হবে না। ছিল, আছে, থাকবে। বিষয়টি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণের সাথে সাংঘর্ষিক। ধর্মের সাথে এর তুলনা করা যাবে না। ধর্ম হচ্ছে সাধারণ মানুষের জন্য । অন্য দিকে জ্ঞানীদের জন্য জ্ঞানের ভান্ডার। জ্ঞানীদের জন্য  সূরা ইমরানের ৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, এই গ্রন্থের কিছু আয়াত আছে সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন, অন্যগুলো রূপক। অর্থৎ কাল্পনিক। পরের আয়াতে বলা হয়েছে, যারা নাস্তিক, তারা এসব নিয়ে ফেতনা সৃষ্টি করে।’ কাজেই এমন কিছু বলা যাবে না যা বললে ধর্মের ভিত দুর্বল হতে পারে।  যেহেতু এ বিষয়টি নিয়ে ধর্মের সাথে একটি সাংঘর্ষিক বক্তব্য দেয়া হয়েছে, এবং বহু আলোচিত। আমরা কখনো ধর্মীয় বিষয়ের সাথে দার্শনিক বিষয়ের তুলনা করবো না। এ ক্ষেত্রে আমরা বলবো, ইমানুয়েল কান্টের এ বক্তব্য যথার্থ। তিনি এতটুকুই বলে থেমে গেছেন। আমরা এখান থেকে আরও সামনের দিকে নিয়ে গেছি। আমরা বলেছি, বিশ্বের অনেক গ্রহের সৃষ্টি হয়েছে, অনেক গ্রহ ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কোন গ্রহ ধ্বংস হয়েছে? এবার আমরা ফর্মুলায় যাবো। বলা হয়েছে, যে গ্রহের সৃষ্টি আছে, কেবল সেই গ্রহের ধ্বংস আছে। যে গ্রহের সৃষ্টি এবং ধ্বংস আছে, সে গ্রহের সময় আছে। যে গ্রহের সময় আছে সে গ্রহটাই ধ্বংস হবে। যেমন, পৃথিবী একটি ধ্বংস হবে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এখানে সকাল, বিকাল, রাত্রি আছে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ‘মহাবিশ্বের বয়স ১৪ শো কোটি বছর। সময় সম্পর্কেই তো তাদের কোনো ধারণা  নেই। পৃথিবীর বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রা- রাসেল প্রেম সম্পর্কে বলেছেন, ‘প্রেম হলো সিগারেটের মতো, যার শুরু অগ্নি দিয়ে, শেষ ছাইয়ে।’ মানুষের জীবনে মানবিক মুল্যবোধের পর যে বিষয়টি মূল্যবান সেটি হচ্ছে প্রেম-ভালোবাসা। মানুষের মধ্যে যেদিন ভালোবাসা থাকবে না, সেদিন সভ্যতাও থাকবে না। আদি রাষ্ট্রের উৎপত্তির একটি কারণ হচ্ছে প্রেম। অথচ বার্ট্রা- রাসেল কি বললেন। ওই সব বিজ্ঞানীরা সময় সম্পর্কে ঠিক তেমনি যুক্তিহীন ভিত্তিহীন কথা বলেছে। সময়ের উৎপত্তি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। সময় হচ্ছে পৃথিবীর ব্যাপার। দুটো কারণে সময়ের উৎপত্তি।  সূর্য আলো দিচ্ছে, পৃথিবী ঘুরছে, ফলে আমরা একটি দিন এবং একটি রাত পাচ্ছি। এই দিন রাত্রিকে যান্ত্রিক উপায়ে ২৪ ভাগে ভাগ করা হয়েছে অর্থাৎ ২৪ ঘন্টায় এক দিন। এটাকে মিনিট, সেকেন্ডে ভাগ করা হয়েছে। কাজেই পৃথিবীর সময় দিয়ে কি বিশ্বের বয়স নির্ণয় করা যাবে?
স্টিফিন হকিংসের বিগ ব্যাং থিওরী যে একটি বোগাস মতবাদ, এর পর আর কোনো যুক্তির প্রয়োজন আছে। তার মতবাদ যদি বোগাস বলা হয়, তাহলে বলতে হবে তিনি বিজ্ঞানী নন। তার এই মতবাদ ডারউইনের বিবর্তনবাদের মতো একদিন কোল্ডস্টোরেজে চলে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : দার্শনিক।

Tuesday, September 25, 2018

মানুষ গুজবে কান দেয় কেন? -মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত



বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বহুল প্রচারিত শব্দটি হচ্ছে ‘গুজব’। সোস্যাল মিডিয়ায় গত কয়েক দিনে ‘গুজব’ শব্দটি যতবার ব্যবহৃত ও উচ্চারিত হয়েছে, তা আর কোনো শব্দের ক্ষেত্রে হয়েছে কি না সন্দেহ। বহুল প্রচারিত ‘গুজব’ শব্দটির ব্যবহার বাড়ে ৪ আগস্টের পর থেকে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজধানীর জিগাতলা-সায়েন্সল্যাবে অবস্থানরত স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা এবং তৎপরবর্তী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। সেদিন নিরাপদ সড়কের দাবিতে সপ্তম দিনের মতো রাজপথে অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা। সেদিন দলীয় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীরা একযোগে হামলে পড়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর। সে সময় ঘটনাস্থলে থাকা আহত শিক্ষার্থীরা ফেসবুক লাইভে এসে তাদের ওপর বর্বরোচিত হামলার বিবরণের পাশাপাশি এটিও বলে যে, তাদের চারজন ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এবং চারজন ছাত্রীকে ধরে নিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে। আরো বহু ছাত্রকে আটকে রেখেছে তারা। ঘটনাস্থলে থাকা ছাত্রছাত্রীদের অসংখ্য লাইভ ভিডিওতে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে তাদের সহপাঠী ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা প্রচ- বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ প্রশাসনের পক্ষ থেকে এটিকে ‘গুজব’ বলে মিডিয়ার সামনে তুলে ধরেন। আর এর পরপরই সোস্যাল মিডিয়ায় ‘গুজব’ শব্দটি একটি ব্যঙ্গাত্মক ও হাস্যরসাত্মক শব্দে পরিণত হয়।

ইদানীং ছাত্রসমাজ ‘গুজব’ শব্দটিকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করছে। সোস্যাল মিডিয়ায় একযোগে প্রচারণার ধরন এমনই যে, শিক্ষার্থীদের কেউ আহত ও রক্তাক্ত কিংবা চোখে ব্যান্ডেজ, গুলিবিদ্ধ অথবা সাংবাদিকদের ওপর হেলমেটধারী আওয়ামী সন্ত্রাসীদের উপর্যুপরি হামলা এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণের ছবি অথবা একেকটি প্রামাণ্য ভিডিওচিত্র পোস্ট করে তার ক্যাপশনে লিখেছেন- ‘গুজবে কান দেবেন না। তবে চোখ দিয়ে দেখুন।’
একজন ছাত্রের চোখ উপড়ে ফেলা, চারজনকে হত্যা করা, চারজন ছাত্রীকে ধর্ষণ করা এবং আরো ছাত্রীকে আটকে রাখার যে খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তার পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের ডেকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ের ভেতরের দৃশ্য দেখানো হয়। এ রকম দু’জন ছাত্রলীগ সমর্থক ছাত্রকে দিয়ে পরিকল্পিতভাবে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়- শিক্ষার্র্থীদের পক্ষ হতে যা বলা হচ্ছে তার সবই গুজব! সেদিনই রাতে এক প্রেসনোটে ডিএমপি থেকে জানানো হয় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে প্রচারিত ঘটনার কোনোটা ঘটেনি। এগুলো সবই গুজব। গুজবে কান না দেয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানানো হয়। সেদিনই মোবাইল অপারেটরদের মাধ্যমে একটি মেসেজ দিয়ে সরকার জানায় এটি গুজব মাত্র। আমার মোবাইলেও সে রকম একটি মেসেজ পেয়েছি। এড়াঃ. রহভড় থেকে পাঠানো মেসেজে লেখা ছিল- ‘রাজধানীর জিগাতলায় ছাত্রহত্যা ও ছাত্রীধর্ষণের ঘটনার কোনো সত্যতা নেই। বিষয়টি পুরোপুরি গুজব। এতে কেউ বিভ্রান্ত হবেন না। পুলিশকে গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করুন : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।’
যদিও আজ পর্যন্ত আসলে সত্যিকারার্থে সেদিন আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর কার্যালয়কেন্দ্রিক কী ঘটেছিল তা জাতির সামনে তুলে ধরা হয়নি।
তথ্য জানার অধিকার একজন নাগরিকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। সেদিন আসলে কী ঘটেছিল এবং কোন ঘটনা থেকে গুজবের সূত্রপাত হয়েছে, কতজন আহত কিংবা কতজন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কতজন শিক্ষার্থী হসপিটালে ভর্তি, কোন পক্ষ কোন পক্ষকে আঘাত করেছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছিলো। আর এই ঘটনার জন্য কোন তদন্ত কমিটি করা হয়েছে কিনা তা আজ পর্যন্ত জাতির সামনে তুলে ধরা হয়নি। যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নাগরিকদের গুজবে কান না দেয়ার আহবান জানিয়ে মেসেজ দেয়া হয় সে ঘটনার প্রকৃত সত্য যদি জাতির সামনে তুলে ধরা না হয় তাহলে নাগরিকরা গুজবে প্রভাবিত হবেন এটাই তো স্বাভাবিক। মূলধারার গণমাধ্যমকে যখন গলাটিপে ধরা হয় তখন গণমাধ্যমের বদলে সোস্যাল মিডিয়াকেই জনগণ খবর জানার মূল মাধ্যম হিসেবে ধরে নেয়। তখন যদি কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কোন খবর প্রচার করে তখন তা সত্য না মিথ্যা, কে তার প্রমাণ দেবে? ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন নিয়ে মূল ধারার গণমাধ্যমের ওপর সরকার খড়গহস্ত হয়েছে তখনই সেখানে সোস্যাল মিডিয়া শক্তিশালী অবস্থানে চলে গিয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রথম কয়েকদিন সকল টেলিভিশন চ্যানেল লাইভ প্রচার করেছিল কিন্তু তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রেসনোটে সে প্রক্রিয়া থেমে যায়। তথ্য মন্ত্রণালয় সকল টিভি চ্যানেলকে সরকারি নির্দেশনা মেনে চলতে বলে। সরকার সমর্থক চ্যানেল একাত্তর ও যমুনা টিভিকে বিশেষভাবে সতর্ক করে দেয়। ফলে সায়েন্সল্যাব ও জিগাতলায় সেদিন কোনো চ্যানেলই তেমন লাইভ প্রচার করেনি। এমনকি তথ্য মন্ত্রণালয়ের সতর্কবার্তার ফলে বেসরকারি সকল টিভি চ্যানেল কেন যেন বিটিভির মতো আচরণ করতে শুরু করে। সেদিন একটি পোস্ট দেখে খুব হাসি পেয়েছিল। কোন একজন স্কুলছাত্র বিটিভির খবর পড়ার একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছিল- ‘দিনাজপুরে বাতাবিলেবুর বাম্পার ফলন হয়েছে।’ এটি দিয়ে পোস্টকারী বুঝাতে চেয়েছেন হাজার হাজার স্কুলশিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে এলেও বিটিভিতে সেই খবর স্থান পায়নি। এটি বিটিভির প্রতি জনগণের এক ধরনের অনাস্থা। যদিও সংসদে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, বাংলাদেশে ৮০% মানুষ বিটিভি দেখে। সেদিন ধানমন্ডি জিগাতলায় যদি অবাধ তথ্যপ্রবাহের সুযোগ থাকতো সকল মিডিয়াকে স্বাধীনভাবে খবর প্রচারের স্বাধীনতা দেয়া হতো, টিভি চ্যানেলগুলো যদি আগের মতো লাইভ টেলিকাস্ট করার সুযোগ পেত, তাহলে কোনটা সত্য আর কোনটা গুজব তা নাগরিকদের সামনে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যেতো। মূলধারার গণমাধ্যমকে প্রেসনোট জারি করে এবং বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকারই তো গুজব সৃষ্টির সুযোগ করে দিয়েছে।
গুজব মানুষের এক ধরনের বিশ্বাসের প্রতিফলন। মানুষ যা প্রতিনিয়ত দেখে এবং মানুষের অন্তরে যে বিষয় স্থির হয়ে গেছে, সে ধরনের ঘটনার খবর সামনে এলে- সেটা গুজব হোক বা সত্যি হোক, মানুষ তার বিশ্বাসের জায়গা থেকেই সেটিকে সত্য বলে ধরে নেয়। নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা, গুলিবর্ষণ ও ধর্ষণের খবর কেইবা বিশ্বাস করবে না- বলুন দেখি। দেশের নাগরিকদের সামনে তো এমন জলজ্যান্ত উদাহরণ রয়েছেই! ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠা দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা এবং সেই লাশের ওপর পৈশাচিক নৃত্য, বিশ্বজিৎকে দিন-দুপুরে কুপিয়ে হত্যা, কুষ্টিয়ায় আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর নির্লজ্জ হামলা, কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাদের ওপর হামলা, বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে হাতুড়িপেটা- এসবতো সাধারণ নাগরিকদের স্মৃতি থেকে এখনও মুছে যায়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির নেতাদের ওপর ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের প্রকাশ্য গুলির ভিডিও এখনো সোস্যাল মিডিয়া ও ইউটিউবে আছে। এরপরও ছাত্রলীগের হামলার খবর জনগণ কিসের ভিত্তিতে গুজব বলে মনে করবে? আর ধর্ষণের ঘটনা- সেটা তো আরো স্পর্শকাতর। কিন্তু যে ছাত্রসংগঠনের নেতা কাজী নাসির উদ্দিন মানিকের ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদযাপনের রেকর্ড আছে, যে সংগঠনের নেতাকর্মীদের ধর্ষণের খবর প্রতিদিন কোনো না কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়- সেই সংগঠনের লোকজন কাউকে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করেছে- এমন গুজবে কান দেয়ার যৌক্তিক উপকরণতো ছাত্রলীগই তৈরি করে রেখেছে!
বাংলাদেশের মানুষ গুজবে কেন বিশ্বাস করছে? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর যে কেউ একবাক্যে বলে দিতে পারবে- সেটা হলো, এদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই। বাংলাদেশের মানুষ খবর পাওয়ার জন্য এখন আর টিভি চ্যানেল অন করে না। আর সে কারণেই মানুষ ঘটনা জানার জন্য সবার আগে সোস্যাল-মিডিয়ায় প্রবেশ করে এবং সত্যটা জানার চেষ্টা করে। একটা প্রেসনোট জারি করে কিংবা নাগরিকদের মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে গুজবে কান দেয়া থেকে জনগণকে বিরত রাখা আদৌ সম্ভব কি না- বিষয়টি সরকারের কর্তাব্যক্তিরা ভেবে দেখবেন বলে আশা করি। প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করুন। গণমাধ্যমকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দেশে অবাধ তথ্যপ্রবাহের ব্যবস্থা করুন- দেখবেন, কোনটা ‘গুজব’ আর কোনটা ধ্রুব সত্য। তা যদি না হয় তাহলে এইসব চাতুর্যপূর্ণ প্রেসনোটই বরং হয়ে উঠবে অতীব নির্মম একেকটি গুজব।
লেখক : এমফিল গবেষক

Friday, September 21, 2018

শহীদ মাওলানা নিজামী (রহঃ) সম্পর্কে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের কিছু কথা


ভিডিওটি দেখুন, প্রচার করুন। টার্কিশ ভাষাকে মনে হবে বাংলা শুনছেন!
এরদোগান নিজামী শাহাদাতের সময় প্রোগ্রামে শহীদ নিজামীর কথা বলছেন। আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামে যেমন বলেছেন তেমনি বলেছেন একদম নিজেদের ঘরোয়া সমাবেশে। এটি তাদের একান্তই নিজেদের একটি সমাবেশ। সেখানে তিনি বলেন-
"বাংলাদেশের ঘটনা শুনেছেন..? মতিউর রহমান নিজামী, যাকে ৪৫ বছর আগের কাহিনীর কারনে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ওখানে আমাদের ঈঐচ (ধর্মনিরপে- প্রধান বিরোধী দল) এর মত এক রাজনৈতিক দল আছে। যার প্রধান এক মহিলা মতিউর রহমান নিজামীর ফাসিঁ দিয়েছে।
যার বয়স ৭৩, যাকে ৪৫ বছর আগের কাহিনীর কারনে ফাসিঁ দেওয়া হয়েছে। যিনি একজন বিজ্ঞ মানুষ, আলেম ও সাবেক মন্ত্রী....
কী বলতে চাই জানেন..? বেশী কিছু বলতে চাইনা..! শুধু এতটুকুই বলব, জালিমদের জায়গা জাহান্নাম।
কিন্তু এই অন্যায়ের কেউ কী প্রতিবাদ করেছে..? না, করেনী..। গণতন্ত্রকামীরা কী আওয়াজ করেছে..? না, করেনী..। কিন্তু অন্য ধর্মের হলে পশ্চিমাতে এটা নিয়ে কেয়ামত ঘটে যেত। উনি শুধু মুসলমান ও মুসলিম নেতা হওয়ার কারনেই সবাই চুপ.... "
সর্বশেষ বলেছেন.... সকল জুলুমেরই একটা শেষ আছে, সকল খারাপের পরই একটা বসন্ত আসে.... এবং সেই দিন আসবেই ইনশাআল্লাহ....
উনি সর্বশেষ তুরস্কের কিছু কথা বলে একটি হাদীস উল্লেখ করেন, "মান সাবারা..... জাফারা" যে ধৈর্য্য ধরে সে বিজয়ী হয়।

শহীদ মাওলানা নিজামী (রহঃ) সম্পর্কে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের কিছু কথা,
প্রেসিডেন্ট এরদোগান, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান

Thursday, September 20, 2018

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সাথে স্বরণীয় একটি বিকেল! - শিবির নেতা হাফিজুর রহমান


এরদোয়ান : দ্যা চেঞ্জ মেকার লিখতে গিয়ে বেশ কয়েকবারই একে পার্টির হেড কোযার্টারে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে কিংবা প্রয়োজন হয়েছে। নয় তলা বিশিষ্ট এই কার্যালয়ের নবম তলায় দলীয় চেয়ারম্যানের অফিস। নিচ থেকে উপরে উঠতে চারটি লিফট রয়েছে, যেগুলো আটতলা পর্যন্ত যায়। স্বভাবতই নয় তলায় উঠতে আলাদা সিড়ি/লিফট ব্যবহার করতে হয় এবং দরকার হয় স্পেশাল এপয়েন্টমেন্টের। বই লিখতে গিয়ে আটতলা পর্যন্তই উঠেছি। আটতলায় দলের সাংগঠনিক সভাপতি এবং সেক্রেটারী জেনারেলের অফিস। সাংগঠনিক সভাপতির সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম গত বইতে। সবমিলে নয়তলা নিয়ে রহস্যের কোন শেষ ছিলনা!!
সেদিন ছিল প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের প্রধান উপদেষ্টার সাথে এপয়েন্টমেন্ট, উনাকে বই উপহার দেওয়ার জন্য। প্রধান উপদেষ্টার অফিসটি দলীয় চেয়ারম্যানের রুমের পাশেই। উনি আবার একজন একাডেমিশিয়ান এবং ইসলামী আন্দোলনগুলো উনার গবেষণার অন্যতম বিষয়। তাই উনার সাথে একাডেমিক কিছু আলোচনাও জমে ছিল। আমরা উনার সাথে দেখা করে বই তুলে দেওয়ার পর গল্প করছি এবং তুর্কি চায়ে চুমুক দিচ্ছি।
হঠাৎ প্রেসিডেন্ট উনাকে ডাকলেন। উনি দেখা করে ফিরে আসার পর আবারো আড্ডা শুরু হলো। বিদায় নিতে যাবো এমন সময় আবারো প্রেসিডেন্ট উনাকে ডাকলেন। এবার আমরা একটু সুযোগ নিতে চাইলাম। যদিও প্রথমে বলতে কিছুটা ইত:স্তত বোধ করছিলাম তারপরও বলেই ফেললাম, আমরা কি একটু সালাম দেওয়ার সুযোগ পাবো?
বলার পর নিজের কাছে আরো লজ্জিত হলাম। কারণ কোন প্রস্তুতি এমনকি চিন্তাও ছিলনা। ড্রেসআপও অফিসিয়াল না। উনি বললেন: "দেখি, উনাকে বলবো তোমাদের কথা। যদিও সিডিউল খুব ব্যস্ত।"
উনি গিয়ে আর ফিরছেন না। আমাদের আরেকটি এপয়েন্টমেন্ট ছিল, তাই উনার পিএসকে (প্রধান উপদেষ্টার) বলে বের হয়ে গেলাম। ষষ্ট তলায় আসার পর পিএস ফোন দিলো, আপনাদের ডাকছে। দৌড়িয়ে গেলাম, প্রধান উপদেষ্টা প্রেসিডেন্টের দরজায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
উনি আমাদের নিয়ে উনার রুমে নিয়ে গেলেন। প্রেসিডেন্ট দরজার কাছে এসে আমাদের স্বাগতম জানালেন। তুরস্কের সংস্কৃতিতে স্বাগতম জানানো ও বিদায় দিতে দরজা পর্যন্ত আসার এই বিষয়টি আমাকে খুব অবাক করে। আপনি যেই হোন না কেন, আপনার পজিশন যাই হোক না কেন... তাদের মেহমান হিসেবে গেলে তারা আপনাকে দরজায় এসে স্বাগতম জানাবে এবং বিদায় দিবে।
আমরা সালাম দিলাম, প্রেসিডেন্টের হাতে চুমু খেতে গেলাম। উল্লেখ্য, তুরস্কে বয়োজেষ্ট ও সম্মানিত ব্যক্তিদের হাতে চুমু খাওয়া হয়। উনি হাত সরিয়ে নিলেন এবং আমাদেরকে বুকে জড়িয়ে কপালে চুমু খেলেন।
আমি পরিচয় দিলাম; হাফিজুর রহমান, বাংলাদেশী, গাজী ইউনির্ভিসিটিতে পিএইচডি করছি আর আপনার জীবনী গ্রন্থের লেখক।
উনি হেসে বললেন: Yes, I Know (আমার মনে পড়েছে/ আমি জানি)।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সাধারণত ইংরেজী খুবই কমই বলেন। উনার মুখ থেকে ইংরেজী শুনে বেশ অবাকই হলাম।
এরপর আমাদের সাথে কিছুক্ষণ গল্প করলেন। পরিবারে কে কে আছে, কোথায় থাকি, ওয়াইফ কি করে, বাচ্চা কয়জন, কতবড় হইছে, একাডেমিক কি অবস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি। বাচ্চা একটা শুনেই বললেন; "নো নো, হবে না। কমপক্ষে পাঁচটা নিতে হতে হবে।" আমি হেসে ইনশাআল্লাহ বললাম। উনি খুব সিরিয়াসভাবে বললেন: "শুধু ইনশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ বললেই হবে না। পদক্ষেপ নিতে হবে"। এভাবে সবাইকে জিজ্ঞাসা করলেন। উল্লেখ্য, আমাদের সাথে আরো কয়েকটি দেশের আন্তর্জাতিক ছাত্ররা ছিল। অবশেষে কিছুক্ষণ খোসগল্প করে বিদায় নেওয়ার পালা। উনি সবাইকে আবারো বুকে জড়িয়ে আদর করে বিদায় দিলেন।
সত্যিই স্বরণীয় মুহুর্তু। অনেকটা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি!! মাশাআল্লাহ। উনার মুখ থেকে বইয়ের ব্যাপারে "Yes I know" বাক্যটি আমার চিরকাল মনে থাকবে এবং আজীবন লেখালেখীর উৎসাহ হবে।
শেষ করছি লেখালেখি নিয়ে দুটি ঘোষণার মাধ্যমে;
১. আলহামদুলিল্লাহ, আমার দ্বিতীয় বই "আমার দেখা তুরস্ক (বিশ্ব ব্যবস্থার নতুন শক্তি তুর্কি জাতির ভেতর-বাহির)" বইমেলাতে আসছে ইনশাআল্লাহ। (পরবর্তী পোস্টে বইয়ের আলোচ্যসূচি সম্পর্কে বিস্তারিত লিখবো)।
২. এরদোয়ান : দ্যা চেঞ্জ মেকার বইয়ের পঞ্চম সংস্করণ বই মেলায় আসবে। লেখার পর প্রথমবারের মতো বর্ধিতরুপে আসছে এই সংস্করণটি। যাতে ২০১৮ সালের নির্বাচনসহ সমসাময়িক তুরস্কের আলোচিত কয়েকটি ঘটনা যোগ হবে।

Popular Posts