Wednesday, October 17, 2018

তিউনিশিয়ায় ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ড. রাশিদ ঘানুসি (২য় পর্ব) ।

[গত সংখ্যার পর]
২০১৩ সালের জুলাই মাসে বিরোধী দলের আরেকজন নেতা মুহাম্মদ ব্রাহিমি আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে আবার অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় দেশটির শক্তিশালী শ্রমিক ইউনিয়ন ইউজিটিটি সঙ্কট নিরসনের উদ্যোগ নেয়। তাদের মধ্যস্থতায় সরকার ও বিরোধী দল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীন সংসদ ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্মত হয়। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে আননাহদা সরকার পদত্যাগ করে এবং তারপর মেহেদি জুমআর নেতৃত্বে টেকনোক্র্যাট সরকার গঠিত হয়।
আননাহদা কর্তৃক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়। এর ফলে দেশে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা অব্যাহত থাকে। FRANCIS GHILÈS আননাহদার ভূমিকার প্রশংসা করে মন্তব্য করেন :
The resignation fosters a promising culture of peaceful transfer of power – a first in the Arab world. Before stepping down, however, Ennahda’s leaders – working with leaders from two secular-leaning political parties, al-Mu’tamar and al-Takattul -managed to reduce the level of violence in the country, stabilize the economy, draft a new constitution, and set the course for a transition to a permanent government though the ballot, not the bullet.
আননাহদা সরকার পরিচালনায় অনেক ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। রাজনৈতিক সংকট নিরসনে তাদের উদার মনোভাব পোষণ এবং সকল রাজনৈতিক দলের সাথে ডায়ালগ এর উদ্যোগ দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ভূমিকা রাখে। এককভাবে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুন সংবিধান প্রণয়নের পরিবর্তে সকল রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে নতুন সংবিধান রচনা করে। এই সম্পর্কে Tunisia’s Higher Political Reform Commission প্রেসিডেন্ট Professor Yadh Ben Achour চমৎকার পর্যালোচনা করেন :
The constitution reflects the compromise that was found through discussion, between principles that include the respect of a nation’s religious identity as well as the implementation of modern democratic rules. It also reflects the sometimes substantial concessions made by both camps, which would not have been possible in a situation of extreme crisis.The Islamists in Tunisia conceded, significantly, the freedom of conscience or religious freedom, which no other Muslim-majority country has yet accepted. They agreed, for example, that Takfir – the accusation of apostasy, which could be interpreted as an invitation to murder – is a crime punishable by law. They also conceded that sovereignty lies with the people, and that politics must be governed by democratic norms.On the other hand, their opponents conceded that there is a sacred realm, which deserves to be protected and respected, which is part of the national identity, and which should not be exposed to hostile assaults.In Tunisia, there was recognition that at decisive moments such as during the design of a new constitution, the principle of majority rule could be divisive, and not allow a real rallying of all political perspectives.For this reason, the idea of building a consensus through dialogue, or ‘Tawafuq’, was seen as a pathway to better outcomes.
সংবিধান রচনায় আননাহদার দূরদর্শী পলিসির কারণে বিরোধী দল এই ইস্যুতে কোন আন্দোলন গড়ে তোলার সুযোগ পায়নি। ফলে সামরিক হস্তক্ষেপ বা বৈদেশিক হস্তক্ষেপের কোনো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। আননাহদা শান্তিপূর্ণভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে প্রেসিডেন্ট এবং সংসদ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। আরব বসন্তের পর মিশরে ইখওয়ান ক্ষমতায় এলেও সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে তারা ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং হাজারো নেতাকর্মী শহীদ হয়। আরব বসন্তের পর লিবিয়ায় সরকার পরিবর্তন হলেও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসেনি। যার ফলে লিবিয়া একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। আর আলজেরিয়া দীর্ঘদিন যাবৎ অস্থিতিশীল। আফ্রিকার ছোট একটি দেশ তিউনিশিয়াতে এই ধরনের কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হউক আননাহদা চায়নি। সাংবাদিক Neil Clarkযথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, Tunisia: Where the Arab Spring has not yet turned to winter ড. রাশিদ ঘানুসির ভাষায় ‘‘আরব বসন্তের পর তিউনিশিয়া একমাত্র দেশ যা এখনো বিপ্লবের আলোক শিখা জ্বালিয়ে রেখেছে।”
এই দিক থেকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে আননাহদা তাদের লক্ষ্য অর্জনে গৃহীত কৌশলে এখন পর্যন্ত সফল। তিউনিশিয়া ভৌগোলিক অবস্থান মিশরের মত গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ তুলনামূলকভাবে কম। আর তিউনিশিয়াতে সিভিল সোসাইটির ভূমিকা বেশ কার্যকর হওয়ায় রাজনৈতিক সংকট সমাধানে বরাবরই কার্যকর ভূমিকা রাখে (Tunisians have succeeded in keeping outside influence to a minimum. They trusted civil society institutions with mediating political dissent)।
২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আননাহদার পরাজয়
২০১১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আননাহদা ৩৭.৪৭% ভোট পেয়ে ৮৯ আসন নিয়ে সরকার গঠন করলেও ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আননাহদা ২৭.৭৯% ভোট পেয়ে ৬৯ আসন পায়। ধর্মনিরপেক্ষ নিদা তিউনিস দল ২১৭ আসনের মধ্যে ৮৬ আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। Popular Front ১৬ আসন , Free Patriotic Union ১৬ আসন ও Prospects for Tunisia ৮ আসন পায়। আননাহদা পরাজয়কে স্বীকার করে বিজয়ী দলকে অভিনন্দন জানায় (We have accepted this result and congratulate the winner)। মূলত দেশের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থার কারণেই নির্বাচনে আননাহদার পরাজয় বরণ করে বলে অনেক পর্যবেক্ষক মতপ্রকাশ করেন। নর্থ আফ্রিকার বিশেষজ্ঞ Michael Willis বলেন, ‘the decline in Ennahda’s electoral popularity reflected public discontent with their handling of the economy. On the doorsteps, the economy was the main issue.”
দেশের অর্থনৈতিক মন্দা অবস্থার কারণে বেকার যুবকদের প্রত্যাশা পূরণ করা কঠিন ছিল। FRANCIS GHILÈS ২১ শে ডিসেম্বর ২০১৪ সালে Tunisia: the Arab exception’s test শিরোনামে লিখিত প্রবন্ধে তা এইভাবে তুলে ধরেন :
During the two years they governed Tunisia in 2012-13, the Islamists demonstrated their lack of interest, or inability, in addressing the economic and social problems of a modernising society. The Islamists favour free-wheeling – nay, crony – capitalism as do all authoritarian Arab regimes. Even more damming was their failure to control the hardline Salafi Islamists who not only resorted to violence in Tunisia but sent an estimated 3,000 of their number to Syria to join the war there. Such insecurity does little to attract domestic or foreign investment.
ANOUAR JAMAOUI Zuvi The decline of political Islam in Tunisia শীর্ষক প্রবন্ধে আননাহদার পরাজয়ের কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেন। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আননাহদা নেতৃবৃন্দের সরকার পরিচালনার কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। তিউনিশিয়ার ইতিহাসে প্রথমবারই ইসলামপন্থীরা ক্ষমতাসীন হয়। ট্রানজিশনাল পিরিয়ডে দেশ পরিচালনা কত কঠিন সে অভিজ্ঞতা তাদের ছিল না। তাই তারা ট্রেড ইউনিয়ন, টেরোরিস্ট হামলা, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও সামাজিক নানামুখী সমস্যা সমাধানে হিমশিম খায়। দল পরিচালনা ও সরকার পরিচালনা এক কথা নয়। আদর্শিক বক্তব্য দেয়া আর ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এক কথা নয়। বেকারত্ব দূর, কালোবাজারি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় জনগণের মধ্যে হতাশা জাগে। মিডিয়ায় অব্যাহতভাবে অপপ্রচার চালায় এবং ইসলামী সমাজব্যবস্থা নিয়ে নানা ধরনের কল্পকাহিনী প্রচার করে। এই ক্ষেত্রে আননাহদার সমর্থনে উল্লেখযোগ্য কোন মিডিয়া ছিল না; তারাও বিকল্প মিডিয়া করতে ব্যর্থ হয়। আননাহদার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সফলতার সাথে প্রচারণা চালায় যে, ইসলামপন্থীরা ক্ষমতাসীন হলে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার হবে। তাই তারা সকলে আননাহদার পরাজয়ের জন্য সকলে ঐক্যবদ্ধ ছিল। দুর্নীতিপরায়ণ সরকারি কর্মকর্তারা আননাহদার প্রতি সন্তুষ্ট ছিল না এবং তারা নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে। বেকার যুবকরা আননাহদার মাঝে তাদের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আশা দেখতে পায়নি।

আননাহদা নেতৃত্ব আশাবাদী ছিল যে জনগণ সাবেক স্বৈরাচারী সরকারের আমলের রাজনৈতিক নেতাদেরকে নির্বাচনে প্রত্যাখ্যান করবে। কিন্তু এটা ছিল তাদের অলীক বাসনা। শরিয়াহ আইন সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত না করায় ইসলামপন্থী একটি অংশ আননাহদার প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে। বিশেষভাবে সালাফি ইসলামপন্থীদের কট্টর ভূমিকাও আননাহদার পরাজয়ের অন্যতম কারণ। আননাহদা স্বৈারাচারী বেনআলি সরকারে সংশ্লিষ্টদের বিচারের পরিবর্তে রাজনৈতিক ঐক্যকে গুরুত্ব দেয়। এর ফলে বিপ্লবের চেতনার সাথে তারা আপস করেছে বলে অনেকই অভিযোগ করে।
আননাহদার নেতৃবৃন্দের সাথে লেখকের আলোচনার সময় তাঁরা বলেন, সাবেক স্বৈরশাসকের সময় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। তাই কোন দেশের অর্থনীতি চরম খারাপ অবস্থায় থাকলে ট্রানজিশনাল সময়ে ইসলামপন্থীরা প্রথম পর্যায়ে সরাসরি ক্ষমতায় না গিয়ে পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় যাওয়ার পরিকল্পনা করা ভালো। একটি বিষয় সকলেই স্বীকার করেন যে, আননাহদা ক্ষমতায় থাকাকালীন বিরোধীদের ওপর কোনো ধরনের দমন পীড়ন চালায়নি। অথচ তারা দীর্ঘদিন দমন পীড়নের শিকার হয়েই ক্ষমতাসীন হয়। তারা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে সংলাপ এর আয়োজন করে। একটি বৈরী পরিবেশে সকলকে সাথে নিয়ে দেশের সংবিধান রচনা করায় তারা কৃতিত্বের দাবিদার। নারী-পুরুষের অধিকার সংরক্ষণ, চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তারা আরব বসন্তের হাওয়া কিছুটা হলেও সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়। এর ফলেই তিউনিশিয়াতে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে। FRANCIS GHILÈS আননহাদার ইতিবাচক ভূমিকার প্রশংসা করে মন্তব্য করেন : It did not control citizens via hellish surveillance machinery, and did not disrupt the political activities of its political rivals. Ennahda indeed encouraged national dialogue between political contenders. It is also true that Ennahda contributed actively to the adoption of the first democratic and consensual Arabconstitution that guarantees equality between men and women, freedom of expression, freedom of conscience, freedom of thought, the right of association, and the right to difference and political pluralism. As an Islamist political party, Ennahda was able to provide an example of a peaceful handover of power।
সমঝোতা ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় আননাহদার ভূমিকার কারণেই Tunisian National Dialogue Quarter শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পায়। নোবেল পুরস্কার কমিটি পোপ ফ্রান্সেস ও জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের পরিবর্তে তিউনিশিয়ার ন্যাশনাল ডায়ালগ কোয়ার্টারকে কী কারণে নোবেল পুরস্কারের জন্য নির্বাচন করে তা এইভাবে উল্লেখ করে : The Nobel Peace Prize Committee confounded expectations Friday — bypassing figures such as Pope Francis and German Chancellor Angela Merkel — and handed the award to the Tunisian National Dialogue Quartet for its decisive contribution to the building of a pluralistic democracy in the country in the wake of the Jasmine Revolution of 2011.
তিউনিশিয়ান ন্যাশনাল ডায়ালগ কোয়াটার ২০১৩ সালে মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, শ্রমিক ইউনিয়ন, ট্রেড ইউনিয়ন, সিভিল সোসাইটির সদস্যদের নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেসময় গুপ্ত হত্যার পর যখন সামাজিক অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয় এবং গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় ডায়ালগ কোয়াটার শান্তি ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। নোবেল কমিটি তাদের স্টেটমেন্টে উল্লেখ করে- It established an alternative, peaceful political process at a time when the country was on the brink of civil war. It was thus instrumental in enabling Tunisia, in the space of a few years, to establish a constitutional system of government guaranteeing fundamental rights for the entire population, irrespective of gender, political conviction or religious belief.”
ক্ষমতাসীন দলে ভাঙন এবং কোয়ালিশন সরকারে আননাহদার যোগদান
প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক মন্ত্রিপরিষদ নিয়োগ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলে বিরোধ দেখা দেয় এবং তাদের কতিপয় সংসদ সদস্য দল থেকে পদত্যাগ করে নতুন দল গঠন করেন। সরকারি দলের সংসদ সদস্য সংখ্যা বর্তমানে ৫৮। আর আননাহদার সংসদ সদস্য সংখ্যা ৬৯ এবং সর্ববৃহৎ দল হিসাবে দেশের সংবিধান অনুযায়ী তারা ইচ্ছা করলে ক্ষমতাসীন সরকারের পতন ঘটিয়ে নিজেরা সরকার গঠন করতে পারে। কিন্তু আননাহদা দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষা করে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়ে সরকারের সাথে সমঝোতায় যায় এবং কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় নিয়ে কোয়ালিশন সরকারে যোগ দেয়। এই প্রসঙ্গে লেখকের সাথে উস্তাদ ঘানুসির ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে তিউনিশিয়ায় তাঁর বাসভবনে সাক্ষাৎকারের সময় তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, ‘‘আপনারা কেন সরকারের নিয়ন্ত্রণ না নিয়ে কমগুরুত্বপূর্ণ একজন মন্ত্রী ও উপদেষ্টা পদ নিয়ে ক্ষমতাসীনদেরকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছেন?” তিনি জবাবে বলেন, ‘‘আননাহদা এককভাবে ক্ষমতায় থাকাকালে নৌকা ডুবানোর জন্য সবাই চেষ্টা করে। বর্তমানে আবারও ক্ষমতাসীন হলে সকলে মিলে চক্রান্ত করবে নৌকাটি ডুবিয়ে দিতে। অপর দিকে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয় এবং আননাহদার বর্তমান সাপোর্ট হচ্ছে জনসংখ্যার প্রায় ৪০%। আননাহদার টার্গেট হচ্ছে এই সমর্থন ৬০% উন্নীত করা এবং তারপর স্থিতিশীল সরকার গঠন করা।” তিনি আরও জানান, ‘‘আননাহদা বর্তমান সরকারের পতন ঘটিয়ে নিজেরা ক্ষমতাসীন হওয়ার পরিকল্পনা নেই বরং কম গুরুত্বপূর্ণ কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নিয়ে কোয়ালিশন সরকারের মাধ্যমে স্থিতিশীল তিউনিশিয়া গড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করবে।” অভ্যন্তরীণ সার্ভ অনুযায়ী আগামী নির্বাচনে আননাহদা সকল আসনে প্রার্থী দিলে তারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু আন্তর্জাতিক বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইসলামপন্থী কোন দল ক্ষমতায় এলে বর্তমান ক্ষমতাসীন ‘‘নিদায়ে তিউনিশিয়া” বৈদিশিক সাহায্য পাওয়ার যত প্রতিশ্রুতি পেয়েছে তা পাওয়া যাবে না। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে ; তাই আননাহদা আগামী নির্বাচনে সকল আসনে প্রার্থী না দেয়ার চিন্তা করছে। তারা ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে আরও কিছুদিন দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বদ্ধপরিকর। ক্ষমতাসীন দলের মাধ্যমেই তারা আরও কিছু সংস্কারকার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে চায়।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আননাহদা সর্বাপেক্ষা বৃহত্তর রাজনৈতিক দল হলেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তারা কোন প্রার্থী দেয়নি। যার কারণে নিদা তিউনিস কর্তৃক মনোনীত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ৮৭ বছর বয়সী Beji Caid Essebisi বিজয়ী হন। তিনি হাবিব বর্গুইবা ও বেনআলি সরকারের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। অবশ্য Essebsi বিজয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে তার পুর্বসূরি প্রেসিডেন্ট মারযুকীর দুর্বলতাও বড় ফ্যাক্টর ছিল। এ ছাড়া মহিলারা এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষ তাকে বেশি ভোট দেয়।
অপর দিকে ২০১৩ সালের ১৫ আগস্ট ড. ঘানুসির সাথে ফ্রান্সে ঐকমত্যের ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আননাহদা সরকার কর্তৃক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া নিয়ে Essebsi গঠনমূলক ভূমিকা পালন করেন। আননাহদা তা ইতিবাচক দৃষ্টিতে স্মরণে রাখে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বৃদ্ধিতেও প্রয়াস চালায়। ড. রাশিদ ঘানুসি ক্ষমতাসীন ধর্মনিরপেক্ষ নিদা তিউনিসের সম্মেলনে অতিথি হিসেবে যান ; একইভাবে তিউনিশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট Essebsi আননাহদার কনফারেন্সে অতিথি হিসেবে যোগদান করে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশগড়ার আহবান জানান। তাঁরা মনে করেন, The sharing power is the safest way for Tunisia to really be sucuessful in this transition.
তাঁরা বিশ্বাস করেন, ডিক্টেটরশিপ থেকে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দেশ শাসনের পরিবর্তে সকল রাজনৈতিক দলের মাঝে বৃহত্তর ঐক্য প্রয়োজন। স্বৈরাচারী সরকারের সময় দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি সকল ক্ষেত্রে যে পচন ধরে দেশকে এই গভীর ক্ষত থেকে নতুন সম্ভাবনার দিকে নিতে হলে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যাপকভিত্তিক সংস্কারের পদক্ষেপ নিতে হবে।
ইসলামপন্থী আননাহদা ও সেক্যুলারিস্ট নিদা তিউনিসের মধ্যে কোয়ালিশন হওয়ার কারণে তিউনিশিয়ায় একদলীয় স্বৈরতন্ত্রের পথ বন্ধ হয়ে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ধারা শুরু হয়। দেশের বুদ্বিজীবী মহল ও মিডিয়া আননাহদার এই উদারতার প্রশংসা করে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, Ennahda’s support of the current Tunisian government in the parliamentary vote of confidence made it appear in the eyes of its supporters and citizens as a responsible political party, which gives priority to national unity over narrow political interests and considerations.The Islamist movement persuaded its partisans of the validity of its strategic political choices, particularly its use of diplomatic flexibility in political negotiations in the transitional phase, and its support for the coalition government.Through its symbolic presence in the government, Ennahda plans to maintain a foothold within the newly formed Council of Ministers, as one of the key centres of decision-making in the new Tunisian state. It is believed that its participation in the current government will inevitably allow it to have first-hand knowledge of political developments, and will preserve its power to influence political projects by acclamation or revocation.Through this presence, Ennahda seeks to avoid the scenario of a monopoly of political authority by leftists and constitutionalists. Such a scenario could lead to the isolation of Ennahda, its exclusion from the political scene, and the prosecution of its adherents and leaders—as happened in the nineties, at the time when the Democratic Constitutional Rally and Ben Ali’s oligarchic regime tolerated no political pluralism.আননাহদা ধর্মনিরপেক্ষ নিদা তিউনিশের সাথে সংঘাত এড়ানোর কৌশল গ্রহণ করার ফলে জনগণের মধ্যে দলের ইমেজ বৃদ্ধি পায়। কারণ মানুষ সংঘাতের রাজনীতি চায় না। তারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন চায়। আননাহদা প্রমাণ করেছে যে তারা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় সংঘাত নয় বরং ডায়ালগে বিশ্বাসী। কোয়ালিশন সরকারে যোগদানের ফলে তারা রাজনীতির মূলধারার ভেতরই থাকে। অপরদিকে আননাহদার সাথে সমঝোতা না করলে সরকার স্থিতিশীলতা অর্জন করতে পারতো না। যেকোনো সময় ছোট দলগুলো আননাহদার সাথে যোগ দিয়ে সরকারের পতন ঘটাতে পারতো। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন দল স্বৈরাচারী বেনআলির সহযোগী হিসেবে যে দুর্নাম ছিল তা কিছুটা হলেও লাঘব হয়। আননাহদার সাথে কোয়ালিশন এর কারণে নিদায়ে তিউনিশ লাভবান হয়।
আননাহদা ও নিদায়ে তিউনিশ দুই দলের ঐক্য নিয়ে উভয় দলের ভেতরে কারো কারো বিপরীত মত থাকলেও উভয় দলের মূল নেতৃত্বের প্রতি দলের অধিকাংশেরই সমর্থন আছে। এই ইস্যুতে আননাহদাতে বাহ্যত তেমন কোন বিভাজন দেখা যায়নি। কিন্তু নিদায়ে তিউনিশের সংসদ সদস্যদের একটি অংশ ইসলামপন্থীদের সাথে ঐকমত্যের সরকার গঠন প্রশ্নে প্রকাশ্যে সমালোচনা করে। ড. ঘানুসির আকাশ ছোঁয়া ব্যক্তিত্বের কারণে তাই আননাহদার কারো কারো মাঝে দ্বিমত থাকলেও দলীয় বিভাজন হয়নি। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হামিদ জাবালিসহ কেউ কেউ চুপচাপ হয়ে পড়লেও প্রকাশ্যে দ্বিমত করেনি। কিন্তু নিদায়ে তিউনিশ এর দলীয় প্রধান ঊংংবনংর’ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য দল থেকে পদত্যাগ করার পর দলে তাঁর মত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতৃত্বের অভাবে তাদের মধ্যকার বিরোধ প্রকাশিত হয়। দলের যারা মন্ত্রিপরিষদে বা প্রেসিডেন্ট এর উপদেষ্টা হিসাবে সরকার পরিচালনায় সম্পৃক্ত তাদের সাথে অন্যদের বড় ধরনের মতপার্থক্য দেখা দেয়। ইসলামপন্থীদের সাথে ঐক্য গড়ার ইস্যুতে ধর্মনিরপেক্ষ নিদায়ে তিউনিশ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। এটা ইসলামপন্থী আননাহদার এক ধরনের সফলতা। কারণ নিদায়ে তিউনিশের ভিতর যারা আননাহদা বিরোধী ছিল তারা সরকার পরিচালনা থেকে ছিটকে পড়ে।
ঘানুসির উদারনীতি ও ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বেনআলির সময়কার মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতাদেরকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে দুর্নীতির দায়ে কারারুদ্ধ করার দাবি জানায়। এই ইস্যু নিয়ে সংসদের তুমুল হট্টগোল হয়। ক্ষমতাসীন দলের কেউ কেউ তাদের সাথে সুর মিলায়। আন-নাহদার কিছু সংসদ সদস্যও উক্ত দাবির সাথে একমত হয়। এমতাবস্থায় উস্তাদ রাশিদ ঘানুসি মনে করেন অতীত নিয়ে দেশকে বিভাজনের দিকে ঠেলে না দিয়ে ঐক্যবদ্ধ ভাবে দেশকে সমৃদ্ধির পথে নেয়া জরুরি। তাই তিনি সংসদ ভবনের দিকে ছুটে যান সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার বিষয়টি বুঝানোর জন্য। তিনি সংসদ ভবনে যাওয়ার পর উক্ত ইস্যুতে সংসদে আর ভোটাভোটি হয়নি।
আমাকে আরেকটি বিষয় বিমোহিত করে যে, কিছুদিন আগে উস্তাদ ঘানুসির সাথে স্বৈরশাসক বেনআলির মেয়ে দেখা করতে তাঁর বাসায় গিয়ে জানায়, ‘‘সরকার তাদের সম্পদ ও বাড়িঘর বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।” সে তাঁর সহযোগিতা চায়। তা শোনার পর উস্তাদ ঘানুসি বেনআলির মেয়েকে বলেন, ‘‘সরকার যদি তোমাদেরকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে এবং তা বাজেয়াপ্ত করে তাহলে তোমার ঠিকানা হচ্ছে আমার বাড়ি।” যেই বেনআলির কারণে তিনি ২২ বছর নির্বাসনে ছিলেন তার মেয়েকে এইভাবে আশস্ত করে উস্তাদ ঘানুসি অতীতমুখী রাজনীতির পরিবর্তে সমৃদ্ধ তিউনিশিয়া গড়ার জন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
২০১৬ সালে আননাহদার দশম কনফারেন্স এবং নয়া কৌশল
আননাহদার প্রথম কনফারেন্স ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত হয় এবং দশম কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয় ২১-২৫ শে মে ২০১৬। এই সম্মেলনে আননাহদা মৌলিক কিছু পলিসির পরিবর্তন সাধন করে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এতে উস্তাদ রাশিদ ঘানুসি এক ঐতিহাসিক বক্তব্য প্রদান করেন। তাঁর উক্ত বক্তব্যের নির্যাস হচ্ছে :
আরব বসন্তের পর তিউনিশিয়া একমাত্র দেশ যা এখনো বিপ্লবের আলোক শিখা জ্বালিয়ে রেখেছে। আননাহদাহ ওঝওঝ ও তাকফিরিদের বিরুদ্ধে সমর্থন পূর্নব্যক্ত করেছে। সন্ত্রাসবাদ এবং ঘৃণা বিদ্বেষের বিরুদ্ধে জনগণ জয়ী হবে। চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইসলাম এক ইতিবাচক শক্তি; এই জন্য আমাদের এমন আলেম দরকার যারা ইসলামের নামে চরম পন্থাকে প্রত্যাখ্যান করবেন। দেশকে বিভক্ত কার চেয়ে ঐক্যই একমাত্র গ্রহণযোগ্য পথ। রাষ্ট্রের কোন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা এবং রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নষ্ট করা এক নয়। আমরা এমন একটা সার্বজনীন জাতীয় ঐক্য, সহযোগিতা ও সংহতি গড়ে তুলতে চাই যেখানে বিপ্লব ও শহীদ বিপ্লবীদের যথাযথ স্বীকৃতি দেয়া হবে ও সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকবে। ইসলামপন্থী, সংবিধানপন্থী, বামপন্থীসহ বিপ্লবকে মূল্যায়ন করে এমন সব বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সকলে মিলে ঘৃণা ও বর্জনের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারি। এটা কোন গোপন সমঝোতা নয় বরং রাষ্ট্র বনাম নাগরিক, সুবিধাপ্রাপ্ত বনাম সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চল এবং অতীত বনাম বর্তমানের বিরোধ মিটিয়ে ফেলার জাতীয় আকাক্সক্ষার বহিঃপ্রকাশ।
বিপ্লবের আগের এবং পরের ত্রুটি থেকে শিক্ষা নিতে আননাহদা আন্তরিক। ভুল-ত্রুটি স্বীকার করার ব্যাপারে আমরা ভীত নই। সত্তরের দশক থেকে আজ পর্যন্ত নিজেদের বিকাশের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়নি। একটি জাতীয় গণতান্ত্রিক দল হিসেবে ইসলামী মূল্যবোধ, দেশের শাসনতন্ত্র এবং যুগের চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে সংস্কারের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সংস্কার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ধর্মকে রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রাম থেকে দূরে রাখতে মসজিদগুলোকে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ থাকার আহবান জানাই। আমরা চাই না মসজিদগুলো রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হউক। মসজিদগুলো দলীয় বিভাজনের পরিবর্তে জাতীয় ঐক্য গঠনে অধিকতর ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে। জনজীবনে ইসলামী মূল্যবাধের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে পরিচালিত সংগ্রামে নেতৃবৃন্দ ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন। বর্তমানে ত্যাগ স্বীকার, সত্যবাদিতা, সততায় উৎসাহ প্রদান এবং উন্নয়নের সহায়ক হিসাবে ইসলামী মূল্যবোধকে কাজে লাগানো যায়। দমননীতি, অপবাদ এবং ভয়ের মাধ্যমে আননাহদার সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য স্বৈরাচারী সরকার চেষ্টা করেছে। আল্লাহর রহমত রাষ্ট্র ও আননাহদার মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা সৃষ্টি করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। আননাহদা সরকার জাতীয় ঐক্যপ্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। ক্ষমতালিপ্সু, কর্তৃত্বপরায়ণ কিংবা ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী হতে ইচ্ছুক নই।
সুষম রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমই আমাদের লক্ষ্য। কোন ধরনের বৈষম্য ব্যতিরেকে সর্বস্তরের নারী-পুরুষকে ধারণ করবে। আইন পরিষদ, আদালত, সিভিল সোসাইটি ও মিডিয়ার পর্যবেক্ষণের মধ্য থেকে আইনের প্রয়োগ ও সংবিধানের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে সক্ষম হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। আননাহদা দুর্নীতি, ঘুষ, কর ফাঁকি এবং জনগণের সম্পদ অপচয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। স্বাধীনতা মানে নৈরাজ্য নয় এবং অপরদিকে রাষ্ট্রক্ষমতা মানে দমন পীড়ন ও কণ্ঠরোধ করা নয়। জনপ্রশাসনের কর্মচারীদের মর্যাদা রাষ্ট্রের মর্যাদারই অংশ। কোনো অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পুনর্জাগরণ সত্যিকার প্রশাসনিক সংস্কার ছাড়া হতে পারে না। এই সংস্কারের মধ্যে রয়েছে প্রশাসনকে পরিপূর্ণ ডিজিটাল প্রশাসনে রূপান্তরিত করা। জীবনযাত্রার ব্যয়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ, দরিদ্র, বঞ্চিত মানুষের সংগ্রাম অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। বড় বড় শ্লোগান এবং রাজনৈতিক বিরোধ দিয়ে কোনো আধুনিক রাষ্ট্র চলতে পারে না। সবার জন্য নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার মতো সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি ও সেসবের বাস্তধায়নের মাধ্যমেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। আদর্শনির্ভর তাত্ত্বিক বিতর্ক থেকে সরিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন আননাহদার বর্তমান প্রাইমারি লক্ষ্য। নারীদের অধিকার ও উন্নতিতে আমরা গর্বিত। তাদের সম্ভাবনার বিকাশ এবং আরো বেশি স্বাধীনতা প্রদানের পক্ষে আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকবে। একই সাথে ঐক্য ও সামাজিক কাঠামোর ভিত্তি হিসেবে পরিবার প্রথার সংরক্ষণকে আমরা সমর্থন করি।
জ্ঞান ও নৈতিকতার ভারসাম্য রক্ষা এবং কর্মসংস্থান উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার জরুরি। বেকারত্বের রাস্তা নয় বরং শিক্ষা হতে হবে কর্মসংস্থানের প্রবেশদ্বার। মাদকতাসহ তরুণদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং সংখ্যাধিক্যকে প্রাধান্য দেয়ার চেয়ে গুণগতমানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দেশের সর্বত্র ক্রীড়া ও সংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে হবে। ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে একটি সুইমিংপুল, একটি ক্রীড়াকেন্দ্র এবং একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র দেখতে চাই। বেকারত্ব দূরীকরণে ভোকেশনাল টেনিং সিস্টেমকে শক্তিশালীকরণ, একে প্রমোট করা এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আঞ্চলিক উন্নয়নে ভারসাম্যতা অর্জন, কর্মোদ্যোগ এবং ব্যক্তি উদ্যোগের প্রতি উৎসাহ প্রদানের মত বিনিয়োগ নির্ভর অর্থনীতি বেকারত্ব দূর করতে পারে। দেশের বঞ্চিত অঞ্চলের উন্নয়নে দেশের অঞ্চলগুলোর স্ব স্ব প্রাকৃতিক সম্পদের অনুপাত অনুসারে আঞ্চলিক উন্নয়নের নীতিমালাকে সমর্থন। আগামী পাঁচ বছরে প্রত্যেক জেলার নিজস্ব অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে একটি করে অর্থনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়ন জরুরি। সমাজকল্যাণ কার্যক্রম বাড়িয়ে দেয়া বিশেষ করে কৃষি শ্রমিকদের জন্য। তাদেরকে প্রয়োজনীয় ভর্তুকি দেয়া জরুরি। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সমাধানের পথ হলো ঐকমত্য গড়ে তোলা এবং সহাবস্থানের ভিত্তি স্থাপন করা। দুর্নীতি, ঘুষ, স্বৈরতন্ত্র, বিশৃঙ্খলা এবং সন্ত্রাসবাদ থেকে মুক্তির সমাধান যে গণতন্ত্র আমরা তা দেখাতে পেরেছি। পশ্চাৎপদ একনায়কতন্ত্রকে সমর্থন করার চেয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা ভালো এবং ফলপ্রসূ।
অসংখ্য ত্যাগ, অশ্রু ও রক্তের বিনিময়ে আননাহদার সদস্যরা শেষ পর্যন্ত ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। আমাদেরকে নিজেদের ভুলগুলো স্বীকার এবং আত্মম্ভরিতা থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের পলিসির পুনর্মূল্যায়ন করার সাহস অর্জন করতে শিখিয়েছে। বর্তমান যুগে এগিয়ে যাবার অন্যতম পূর্বশর্ত হলো আত্মসমালোচনা। ঐক্যবদ্ধ নয়া আননাহদা তিউনিশিয়ার সমস্যাগুলো সমাধানে কাজ করতে সক্ষম। এই দল জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষার দল। এই দলটি জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষার মূল্যায়ন এবং গঠনমূলক সমালোচনা করতে সক্ষম যা দেশে বিকল্প গণতান্ত্রিক শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক। দলটির অভ্যন্তরীণ পরিবেশ স্বচ্ছতার নীতি দ্বারা পরিচালিত এবং এর সকল সামর্থ্য সম্ভাবনা সকলের জন্য উন্মুক্ত। মেজরিটি বা মাইনরিটির ভিত্তিতে নয় বরং ঐকমত্য ও অংশীদারিত্বের ভিত্তিতেই আসন্ন বছরগুলোতে তিউনিশিয়া শাসন করতে হবে।
নতুন আগামী তৈরির স্বপ্ন
ড. ঘানুসি দীর্ঘদিন তিউনিশিয়ায় নিষিদ্ধ ছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘পৃথিবীর যে কোন দেশে আমি তিউনিশিয়ার কোন বিমান দেখতে পেতাম আমি দেশে ফিরার স্বপ্নে বিভোর হতাম। এমন স্বপ্ন যা ছিল বাস্তবতা থেকে বহু দূরে। আমি কি কোন দিন বাড়ি ফিরতে পারবো? আমি কি আরেকটাবার আমাদের পুত্র-কন্যাদেরকে দেখতে পারবো যারা অসংখ্য কারাগার ও নির্বাসনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে? আমার দেশের রাস্তায় চলাফেরা কি আমার আর কোন দিন হবে? ঈদ-উৎসবে পরিবার, সহকর্মী সহযোগীদের শুভেচ্ছা জানানোর সুযোগ কি আর কোন দিন হবে? আল্লাহর রহমতে সেই স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয়েছে। সেই স্বপ্ন এখন দিক পরিবর্তন করে তিউনিশিয়ার জন্য একটি নতুন আগামী তৈরির স্বপ্নের দিকে বাঁক নিয়েছে। স্বপ্নটা আমার ভেতরে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। একটি সুন্দর ও ঐক্যবদ্ধ তিউনিশিয়া গড়ার স্বপ্ন। একটি গণতান্ত্রিক, উন্নত ও সমন্বিত তিউনিশিয়া গড়ার স্বপ্ন। আমাদের অবশ্য দেশবাসীর সাথে এই স্বপ্ন ভাগ করে নিতে হবে। সেই সাথে অতীতকে পেছনে ফেলে ভবিষ্যতের ওপর ভরসা করে আশাবাদী ও সঙ্কল্পবদ্ধ হতে হবে। এটাই হচ্ছে তিউনিশিয়ার স্বপ্ন। বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য এই স্বপ্ন আমাদেরকে কঠোর পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করতে অনুপ্রাণিত করে।
সম্মেলনে তিউনিশিয়ার প্রেসিডেন্টের বক্তব্য
সম্মেলনে তিউনিশিয়ার প্রেসিডেন্ট, জাতীয় সংসদের স্পিকার, প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এবং দেশ-বিদেশের অনেক অতিথি উপস্থিত হন। তিউনিশিয়ার প্রেসিডেন্ট Beji Caid Essebisi সম্মেলনে প্রদত্ত তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে, তিউনিশিয়াতে ২০৪টি রাজনৈতিক দল রয়েছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে সকলের কনফারেন্সে যাওয়া তাঁর পক্ষে কঠিন। কিন্তু তিনি আননাহদার কনফারেন্সে এসেছেন তিউনিশিয়ার জাতীয় ঐক্য, সংহতি ও অগ্রগতি সাধনে আননাহদার গঠনমূলক ভূমিকার কারণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশ অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ থেকে রক্ষা পেয়েছে। তিনি ড. ঘানুসি ও আননাহদাকে জাতীয় সমঝোতার ভিত্তিতে দেশ পরিচালনায় ঐকমত্য পোষণ ও সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে আধুনিক তিউনিশিয়া গঠনে কার্যকর ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ জানান। বিশেষভাবে আননাহদা তাদের অতীত কার্যক্রমের বস্তুনিষ্ঠ যে পর্যালোচনা করেছে তা শুধু দলের জন্য নয় বরং দেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। আননাহদার ভূমিকায় প্রমাণিত হয়েছে যে, Islam does not contradict democracy, as is said by Ennahdha in its international forums; that the Islamic movement in Tunisia does not represent a danger to democracy.পরিশেষে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, আননাহদা সামাজিক ও জাতীয় বাস্তবতার নিরিখে তাদের পলিসি নির্ধারণ করবে এবং তিউনিশিয়ার জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণে সক্ষম হবে। তাঁর ভাষায়:
I also hope that your work emphasizes the peculiarity of the Ennahdha movement derived from the nature of the society it grew up in, Imposing considering the social and political context, not others, when deciding its policies. Finally, I look forward to the political project of Ennahdha after the adoption of the revisions publicized in this Conference, consistent with the overall national context and responsive to the expectations of the Tunisian people.
আননাহদার পরিবর্তিত কৌশল
তিউনিশিয়ায় জেসমিন বিপ্লবের পর এই বাস্তবতা প্রতীয়মান হয় যে, দেশগঠনে সকল দল ও পথের জনগণের মাঝে চিন্তা ও পলিসিগত গুণগত পরিবর্তন সময়ের দাবি। বিপ্লব পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বাস্তবতা অনুধাবন করে আননাহদা তাদের ভিশন, কর্মনীতি ও কর্মসূচি নতুন আঙ্গিকে সাজিয়েছে। বেনআলির রাজত্বকালে চরম যুলুম নির্যাতনের সময় সংগঠন যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে তার আলোকে বিপ্লব-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আননাহদা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। আননাহদা মনে করে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন ভাবে পলিসি নির্ধারণ করা প্রয়োজন। যার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার পরিচালনা, জনসাধারণের সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন বিষয়ে সংগঠন আরও যোগ্যতার সাথে ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। এই জন্য দেশের ভেতর ও বাইরে গঠনমূলক পর্যালোচনা করা হয়। উক্ত পর্যালোচনার মাধ্যমে কতিপয় চিত্র ফুটে উঠেছে।
জনাব আব্দুর রউফ আন নাযযারকে প্রধান করে আননাহদা সম্মেলন কমিটি গঠন করে এবং সম্মেলন উপলক্ষে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়। উক্ত প্রস্তাবনার আলোকেই কৌশলগত পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নিম্নে পরিবর্তিত কৌশলের মৌলিক কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা হলো :
ধর্ম ও রাজনীতি পৃথকীকরণ : রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিষয় পৃথকীকরণে আননাহদার বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে নানা জনে নানা মত পোষণ করেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক Rory McCarthy, এর মতে, It was easier for the party to advance an Islamist message when it was an underground opposition movement, but “now they have to make compromises and reassess what it means to be a political movement”. He sees a potential split in the future between the political wing and others who criticize the concessions and compromises made by the party since 201. ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান- এই কনসেপ্টের সাথে পরিবর্তিত কৌশল কি সাংঘর্ষিক? ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের ধর্ম ও রাজনীতি পৃথকীকরণের সাথে তাহলে পার্থক্য কোথায়? এই ধরনের প্রশ্নের জবাবে ড. রাশিদ ঘানুসি বলেন, ‘‘ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। রাসূলে কারীম হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুকাম্মাল নেয়ামে হায়াতের পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়ে গিয়েছেন। রাসূলে কারীম (সা) রেসালাতের দায়িত্ব পালন করেন; রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। একই সাথে প্রধান বিচারপতি ও প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তাঁর ওফাতের পর খিলাফাতে রাশেদার সময় থেকে আস্তে আস্তে পৃথক বিচার বিভাগ গড়ে ওঠে। খলিফা কর্তৃক প্রধান সেনাপতি নিয়োগ দেয়া হয়। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন বিভাগ ও দফতর সৃষ্টি করা হয়। অতএব, রাজনীতি ও ধর্মকে আলাদা করার অর্থ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের মত ধর্মহীনতা নয়। এই বিভাজন ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখার বিভিন্ন দিক সুন্দরভাবে বাস্তবায়নের জন্য প্রত্যেক ফিল্ডে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের স্ব স্ব ফিল্ডে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে কাজ করতে দেয়া (distinction based on specific field, knowledge and expertise)। যারা রাজনীতিতে দক্ষ তারা রাজনৈতিক ফিল্ডে কাজ করবে। আর যারা শরিয়াহর ওপর দক্ষ তারা শরিয়াহর বিষয়ে আরও একনিষ্ঠতার সাথে কাজ করবে। প্রত্যেক ফিল্ডের সকলেই একে অপরের পরিপূরক হিসাবে কাজ করবেন। যারা ধর্মীয় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে অভিজ্ঞ কিন্তু রাজনৈতিক ফিল্ডে অভিজ্ঞ নন। তাঁরা রাজনীতির পরিবর্তে ইসলামের সার্বজনীন সুমহান বাণী সকলের মাঝেই প্রচার করবেন। আরও যারা দাওয়াত ও নাসিহার কাজ করেন তাদের সাথে উদারভাবে উক্ত কাজে শরিক হবেন। আর রাজনীতি যারা করবেন তারাও ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা করবেন।
ইসলামের মৌলিক নীতিমালায় কারো কোন বিরোধ নেই। কিন্তু রাজনৈতিক পলিসির ব্যাপারে যে কারো দ্বিমত থাকতে পারে। তাই ইসলামের মূল্যবোধ সকলের মাঝে রাজনৈতিক সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠে প্রচার করা প্রয়োজন। বর্তমানে আননাহদা পরিচয় দিচ্ছে ‘‘মুসলিম ডেমোক্রেট” হিসাবে। ড. রাশিদ ঘানুসি সম্প্রতি একটি কনফারেন্সে স্পষ্ট করেন যে যারা পলিটিক্যাল ইসলাম পরিভাষা ব্যবহার করেন এই শব্দটির ওপর আমার নিজের ঘোর আপত্তি রয়েছে। যেহেতু ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান তাই সঙ্গত কারণেই এতে মানবজীবনের প্রতিটি মৌলিক দিকের সুস্পষ্ট বক্তব্য আছে। রাজনীতি সে রকমই একটি অধ্যায়। আমরা ইসলামের অর্থনীতির ব্যাপারে ‘‘ইকোনমিক্যাল ইসলাম” না বলে ‘‘ইকোনোমিকস ইন ইসলাম” বলি। সংস্কৃতির ব্যাপারে কালচারাল ইসলাম না বলে কালচার ইন ইসলাম বা ইসলামিক কালচার বলি। তেমনি রাজনীতির ব্যাপারে ‘‘পলিটিক্যাল ইসলাম” না হয়ে শব্দটি যদি ইসলামি পলিটিক্স বা পলিটিক্স ইন ইসলাম বলি তাহলে যথার্থ হতো। ইসলামকে আমরা যদি পূর্ণ ও সুস্থ মানব শরীরের সাথে তুলনা করি তাহলে মানব শরীরের প্রতিটি সেকশনের গুরুত্ব ও পূর্ণতার সাথে ইসলামের প্রতিটি শাখার গুরুত্ব ও পূর্ণতার বিষয়টি অনুধাবন করতে পারবো। মানব শরীরের একটি শাখা যদি ফরংধনষব হয়ে যায় তাহলে তার প্রভাব যেভাবে গোটা শরীরে disorder সৃষ্টি হয়, তেমনি ইসলামের যে কোন একটি শাখা যদি disable হয়ে যায় বা নিষ্ক্রিয় করে দেয়া হয় তাহলে দ্বীন ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসাবে তার পরিপূর্ণ সৌন্দর্যতা বা কার্যকারিতা হারায়। যেমন শিক্ষানীতির ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেসব মূলনীতির কথা বলা আছে মুসলমানদের কোনো সমাজে যখন সেই নীতি সমূহকে উপেক্ষা করে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয় তখন এটি ঐ সমাজের সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সকল মৌলিক শাখাকেই প্রভাবিত করবে। সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি মৌলিক শাখাসমূহে যতই ইসলাম থাকুক যদি শিক্ষানীতির মতো একটি মৌলিক শাখাতে ইসলাম না থাকে তাহলে সেটি বাদবাকিগুলোকেও প্রভাবিত করবে। এভাবে একটি আরেকটির পূর্ণতার জন্য ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত।
উপরিউক্ত দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করে কেউ কেউ বলেন, ‘‘পরিবর্তিত কৌশলের কারণে আননাহদাকে মুসলিম লীগের মত ভাগ্যবরণ করতে হবে । তাদের মতে ইসলামী মূল্যবোধের কথা বলা হলেও মুসলমানদের একটি রাজনৈতিক দলের সদস্যদের ইসলামকে পরিপূর্ণ জানার, বুঝার ও অনুশীলনের কর্মসূচি না থাকলে আননাহদার বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি সময়ের ব্যবধানের দাঁড়িয়ে যাবে। অবশ্য ড: ঘানুসি এটাকে কৌশল হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি সূরা কাহাফের ১৯-২০ নম্বর আয়াত উদ্ধৃত করে বলেন, আসহাবে কাহাফ গুহার ভেতর জেগে ওঠার পর তাদের একজনকে রূপার মুদ্রাসহ বাজারে পাঠায় তখন নির্দেশিকা দেয়া হয় যেন সব চেয়ে ভালো খাবার কোথায় পাওয়া যায় তা আনে এবং সে যেন সতর্ক থাকে যেন কেউ তাদের এখানে থাকার বিষযটি টের না পায়। আরও স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ‘‘যদি তোমাদের কথা তাদের কাছে প্রকাশ পায় তাহলে অবশ্যই তারা তোমাদেরকে পাথর মেরে শেষ করবে, অথবা তাদের দীনে তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেবে। যদি তা-ই হয় তা হলে তোমরা কখনো সফল হতে পারবে না।” এই দুইটি আয়াতে টার্গেট হাসিলে কৌশলী হওয়ার শিক্ষা রয়েছে। আর কৌশল গোপন রাখার বিষয়েও দীক্ষা আছে।
◊ আননাহদা নিম্নবর্ণিত নীতি ও মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে:
◊ স্বাধীনতা : জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা, চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। সকল নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার সুরক্ষা করা হবে।
◊ মর্যাদা : সকল মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক মর্যাদা সুরক্ষা করা হবে। কেননা আল্লাহ তায়ালা সকল বনি আদমকে সম্মানিত করেছেন। প্রত্যেক নর-নারী, শাসক-শাসিত, ধনী-গরিব, জীবিত-মৃত, ধর্মপরায়ণ-ধর্মহীন, সকল ভাষাভাষী ও বর্ণের মানুষের মানবিক মর্যাদা রক্ষায় আননাহদা বদ্ধপরিকর। কারো প্রতি অন্যায় ও কারো মৌলিক অধিকার হরণ করা হবে না।
◊ কর্মসংস্থান : সকলের জন্য কর্মসৃষ্টি ও সকল ধরনের পেশাকে মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা।
◊ আদল : সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা। যুলুম নয় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
◊ শূরা : পরামর্শভিত্তিক কাজ করা। গণতান্ত্রিক সমাজে বিভিন্ন বিষয়ে নাগরিকদের মতামত নেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
◊ বিরোধ নয় ঐক্য: দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ছোটখাটো বিষয়ে বিরোধিতার পরিবর্তে একতার মনোভাব সৃষ্টি করা।
◊ পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও অপরকে অগ্রাধিকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের মূলভিত্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা। সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক হচ্ছে পরস্পরের সাহায্য ও সহযোগিতার।
◊ মধ্যমপন্থা : আত্মিক ও বস্তুগত, ব্যক্তিগত ও সামাজিক সকল ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থার নীতি অবলম্বন করা। কোন ক্ষেত্রে উগ্রতা প্রদর্শন না করা। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা হচ্ছে ব্যক্তির মালিকানার স্বীকৃতি এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা।
◊ ইসলাহ : চিন্তার পরিশুদ্ধি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার সাধন করা।
◊ আমানত : জবাবদিহিতার অনুভূতি সৃষ্টি।
◊ ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে মানুষের আত্মিক উন্নয়ন, সততা, নিষ্ঠার ভাবধারা জাগ্রত করা। কপটতা, প্রদর্শনেচ্ছামুক্ত হয়ে আত্মশুদ্ধির অনুভূতি জাগ্রত করা।
◊ আননাহদা একটি মুসলিম গণতান্ত্রিক দল হিসাবে ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে দেশে সাংবিধানিক সরকার কাঠামোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখাকে গুরুত্ব দেবে। স্বাধীনতা, শান্তি, অর্থনৈতিক উন্নতি ও মানবিক মর্যাদা সমুন্নত রাখতে ভূমিকা পালন করবে। ন্যায় ও ইনসাফের মূলনীতির ভিত্তিতে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে তিউনিশিয়াকে প্রতিষ্ঠা করা। শান্তি, পারস্পরিক স্বার্থ ও সহযোগিতার মূলনীতির ভিত্তিতে সকল বৈদেশিক রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করবে।
আননাহদার দৃষ্টিতে কতিপয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে

সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় ও আরব বসন্তের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে পূর্ণাঙ্গ সংবিধান রচনা। দেশের স্বার্থে রাজনৈতিক বিভিন্ন মত ও পথের অনুসারীদের মাঝে ঐক্য। অর্থনৈতিক সংস্কার। দেশের উন্নয়নে উৎপাদন বৃদ্ধি, শিল্প প্রতিষ্ঠায় দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা। দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি এবং উগ্রবাদ দমন করা। দ্বীন এর নামে কেউ যেন সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদের মত উগ্রপন্থা অবলম্বন করতে না পারে। হতাশার কারণে কোন যুবক যেন বিপথগামী না হয়। সংকীর্ণ রাজনৈতিক কারণে কেউ যেন সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের পথ বেছে না নেয়। আন্তর্জাতিক কোন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দ্বারা যেন কেউ প্রভাবিত হতে না পারে। সৌদি আরব ও ইরানসহ আন্তর্জাতিক ইস্যুসমূহে কূটনৈতিক কৌশলী ভূমিকা পালন করা। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে একদিকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলছে অপর দিকে রাজতান্ত্রিক বা ডিক্টেটরশিপ চালু রয়েছে। যেভাবে অস্ত্র দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য বা অন্যান্য দেশে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বাধানো হচ্ছে, আননাহদা তা সমর্থন করে না। বরং ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক নীতির মাধ্যমে সন্ধি, সমঝোতা ও শান্তি স্থাপন করতে চায়। বৈদেশিক কূটনৈতিক সম্পর্কের নীতির সাথে দেশের জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থা লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। তবে আননাহদা সর্বাবস্থাই দেশের সাংবিধানিক সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। উগ্রবাদ যেন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করতে না পারে।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে সংস্কার সাধন করা অন্যতম চ্যালেঞ্জ। বিপ্লবের চেতনা বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রের সকল অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠানসমূহে চিন্তার ঐক্য স্থাপন করতে হবে। আননাহদা জনগণের আস্থা ও নির্ভরশীলতা অর্জন করাও একটি চ্যালেঞ্জ। আননাহদার ক্ষমতার অভিজ্ঞতা অর্জন হয়েছে; পরাজয় বরণের অভিজ্ঞতাও হয়েছে। আবার জনগণের আস্থা ও নির্ভরশীলতা অর্জন করতে হবে। এই জন্য সাংগঠনিক দুর্বলতাসমূহ চিহ্নিত করতে হবে। জনগণের সমস্যা সমাধানে নতুন নতুন চিন্তা ভাবনা সুচিন্তিত ভাবে পেশ করতে হবে। জনগণের সমস্যা সমাধানে জাতীয় সংলাপ এর আয়োজন করতে হবে। যুবসমাজ ও নারীদের মাঝে যে নেতিবাচক ধারণা আছে তা দূর করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত মোকাবিলা করে আননাহদা যে শান্তিময়, স্থিতিশীল, অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক তিউনিশিয়া গঠনে সক্ষম সেই বিশ্বাস জনমনে বদ্ধমূল করতে হবে।
আননাহদার অগ্রাধিকার হচ্ছে: অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও উৎপাদনমুখী প্রজেক্ট বাস্তবায়ন। শান্তি প্রতিষ্ঠা ও উগ্রবাদ দমন করা। প্রশাসনিক সংস্কার সাধন ও যুবকদের সমস্যা সমাধান অগ্রাধিকার দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কার সাধন। স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখা। ক্ষমতাভোগের জন্য কোয়ালিশন সরকারে যোগদান নয় বরং দেশ ও জনগণের স্বার্থেই কোয়ালিশন সরকারে অংশগ্রহণ করা। রাজনৈতিক দলসমূহের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক, সৌহার্দ্য স্থাপন এবং দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করা। ইসলামী মূল্যবোধ ও ভারসাম্যমূলক সাংবিধানিক নীতিমালার ভিত্তিতে কাজ করা।

সাংগঠনিক কাঠামো পর্যালোচনা

সাংগঠনিক মজবুতি যে কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত। কিন্তু সংগঠন কতিপয় ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে যদি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্কার সাধনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয় তখন তার ফল অনেক বেশি পাওয়া যায়। অতএব, সাংগঠনিক কাঠামো অপপড়সসড়ফধঃরাব হওয়া দরকার। সংগঠনের অতীত ভূমিকার বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা করা। সংগঠন কতটুকু ভূমিকা রাখার যোগ্যতা ছিল আর কতটুকু রেখেছে? সম্ভাবনা কতটুকু কাজে লাগানো সক্ষম হয়েছে এবং এই ক্ষেত্রে কি ধরনের দুর্বলতা ছিল তা চিহ্নিত করা। সংগঠনের উপায় উপকরণের যথাযথ সঠিক ব্যবহার হয়েছে কি না? নেতৃত্ব ও জনশক্তির মাঝে যোগাযোগ ও সম্পর্কের মূল্যায়ন হওয়া। সংগঠন সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। নারী-পুরুষ, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সংগঠনে সকলে যোগদান করতে পারবে।

নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পন্থায় সাংগঠনিক কর্মতৎপরতা
আননাহদা নিয়মতান্ত্রিকভাবে গণতান্ত্রিক পন্থায় সমাজ পরিবর্তনে বিশ্বাসী। সশস্ত্র বিপ্লব বা গোপন গেরিলা আন্দোলনে বিশ্বাসী নয়। যার কারণে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচনে আননাহদা অংশগ্রহণ করে। আরব বসন্তের পর আননাহদা ক্ষমতায় থাকাকালীন উক্ত মৌলিক নীতিমালার ভিত্তিতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করে। নির্বাচনে পরাজয় বরণ করার পর বিজয়ী দলকে অভিনন্দন জানায়। ক্ষমতাসীন দলে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সরকারের ভিত্তি নড়বড়ে হলে কোয়ালিশন সরকারে যোগদান করে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা স্থিতিশীল রাখতে ভূমিকা পালন করে। আননাহদা প্রধান ড. রাশিদ ঘানুসি বহুদলীয় গণতন্ত্রের সমর্থক। সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, সেক্যুলারিস্ট এবং রেডিকালিস্টরাই আরব বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার। ইসলামিস্টরা যেহেতু পাশ্চাত্যের বিরোধী তাই তারা এ ব্যাপারে এত সোচ্চার নয়। যারা সমালোচনা করে বলেন, Islam and democracy did not work তার জবাবে অুুধস Tamimi Zuvi Rachid Ghannouchi A Democrat Within Islamism গ্রন্থের ভূমিকায় মন্তব্য করেন যে, Rachid Ghannouchi leads a school in modern Islamic political thought that advocates democracy and pluralism. He believes democracy to be a set of mechanisms for guaranteeing the sovereignty of the people and for supplying safety valves against corruption and the hegemonic monopoly of power. While insisting on the compatibility of democracy with Islam, he believes that because of their secular foundations, contemporary forms of liberal democracy may not suit Muslim societies W: Nvbywm Zuvi Al-Hurriyyat al-‘Ammah Fid-Dawlah al-Islamiyyah বইতে পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র ও ইসলামের মাঝে কতটুকু সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য রয়েছে তা সুন্দরভাবে আলোচনা করেন।
আননাহদার পর্যালোচনার প্রস্তাবনা
ইসলামী আন্দোলনগুলোর মধ্যে তিউনিশিয়ার আননাহদা একটা নতুন ধারার প্রবর্তন করেছে। নিজেদের অতীতের বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনার মাধ্যমে নতুন পথ নির্মাণে আননাহদা যে নেতৃত্ব দিতে পেরেছে তা বাদ বাকি মুসলিম বিশ্বের ইসলামী দল ও আন্দোলনগুলোর জন্য একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় কনফারেন্সে আননাহদা ৩২ পৃষ্ঠাব্যাপী এক দীর্ঘ পর্যালোচনার প্রস্তাবনা পেশ করে। নিচে তার সারসংক্ষেপ পেশ করা হলো। সম্মেলনে উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে ৮১৪ জন এই পর্যালোচনা অনুমোদনের পক্ষে, ৩৮ জন বিপক্ষে ভোট দেন এবং ১০০ জন ভোটদানে বিরত থাকেন।
‘‘নিজেদের অর্জন ও অতীতের পর্যালোচনার ব্যাপারে যারা অঙ্গীকারবদ্ধ একমাত্র তারাই সফল দল ও আন্দোলন। আননাহদা এই পর্যালোচনা শুধুমাত্র ঐতিহাসিক দলিল প্রণয়ন বা তাত্ত্বিক আলোচনার জন্য করছে না। এই সবের জন্য ইতিহাসবিদ ও বিশেষজ্ঞরাই যথেষ্ট। বরং নিজেদেরকে নতুনভাবে উজ্জীবিত করে একটা সম্ভাবনাময় নতুন ভবিষ্যৎ নির্মাণ এবং ব্যাপক প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা অর্জন করাই এই পর্যালোচনার লক্ষ্য। আমাদের আন্দোলন স্বেচ্ছায়, সচেতনভাবে একসাথে মিলে যে আত্মসমালোচনা করেছে এই পর্যালোচনা তারই ফলশ্রুতি। এর জন্য একটা সাহসী ও ব্যাপক অভ্যন্তরীণ আলোচনা পরিচালনা করা হয়েছে। এই কাজের কেন্দ্রীয় লক্ষ্য ছিল অতীত থেকে শিক্ষা নেয়া। যাতে করে একটা নির্মোহ পর্যালোচনার মাধ্যমে আল্লাহর মেহেরবানিতে যেসব অর্জন হয়েছে তাকে আরও সামনে এগিয়ে নেয়া এবং যেসব ত্রুটি, ভুল-ভ্রান্তি এবং অবহেলা হয়েছে তা থেকে সবক গ্রহণ করে ভবিষ্যতের কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশনা গ্রহণ করা যায়।
একাধিক কার্যক্রমের মাধ্যমে এই পর্যালোচনা পরিচালনা করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণগুলো হচ্ছে : আমাদের কাজ ও প্রধান প্রধান সিদ্ধান্তসমূহ যেসব মৌলিক নীতিমালার ওপর নির্ভরশীল ছিলো তার পরিপূর্ণ পর্যালোচনা করা। সিদ্ধান্ত ও পলিসি প্রণয়নে এই সব নীতিমালা কতটা অনুসরণ করা হয়েছে তা খতিয়ে দেখা। প্রতিটি পলিসি ও কর্মসূচি প্রণয়নে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী বডিগুলো কতটা ন্যায়নিষ্ঠ ছিল তা পর্যালোচনা করে দেখা। সংগঠনের কার্যকরী বডিগুলো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কতটা প্রয়োজনীয় উপায় উপকরণ ও লজিস্টিক সহায়তা প্রদান করেছে তা পরীক্ষা করে দেখা। প্রশ্ন করে দেখা যে, এক সিদ্ধান্ত থেকে অন্য সিদ্ধান্তে যাওয়ার আগে প্রথমটির যাবতীয় শর্তাবলি পরিপূর্ণ করা হয়েছিলো কিনা? পরিশেষে প্রত্যেক পর্যায়ের সফলতা নির্ণয়ে ভেতর ও বাইরের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট কতটা প্রভাবিত করেছে তা পর্যালোচনা করে দেখা। নেহায়েত সাংগঠনিক অর্থে মূল্যায়ন বা অনুসন্ধানই নয়; দায়িত্ব নির্ণয় শুধুমাত্র আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ পরিবেশের ওপরই প্রভাব ফেলে না বা এর কাজের ক্ষতি করে না বরং দলের জাতীয় ও নাগরিক দায়িত্ব পালনের তাগিদেই এই পর্যালোচনা করা হয়েছে। এই পদক্ষেপ ব্যক্তিগত জবাবদিহিতার চাইতেও সংস্কারের প্রয়োজনেই অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্যসূত্র

Azzam S. Tamimi (2001) Rachid Ghannouchi A Democrat Within Islamism, OXFORD UNIVERSITY PRESS
ড. মোস্তফা মোহাম্মদ তাহান (২০১০) আল হারাকাতুল ইসলামিয়্যা ফি শিমালি আফরিকা, সালমিয়্যা কুয়েত আবদুর রউফ নাজ্জার (২০১৬) লাওয়ায়েহ মুতামার আল আশির, আল হারাকাহ আননাহদাহ

(সমাপ্ত)

Friday, September 28, 2018

কাব্য-সাহিত্য চর্চায় রাসূলের (সা) কালজয়ী দিকনির্দেশনা ও প্রেরণা -মোশাররফ হোসেন খান

রাসূল (সা)। তিনি ছিলেন তুলনারহিত এক অসাধারণ মহামানব। ছিলেন মানুষ ও মানবতার শিক্ষক। তিনি ছিলেন শিক্ষকের শিক্ষক। তাঁর প্রত্যক্ষ প্রয়াসে তৎকালীন সমাজ-সংস্কৃতি, মানুষের মর্যাদা ও মূল্যবোধ এক নতুন আলোকিত মাত্রা পেয়েছিল। তিনি শুধু সমাজ-সংস্কারই করেননি, বরং সমাজজীবনে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন। আমরা বিস্মিত হই, যখন দেখি রাসূল (সা) একই সাথে শাসক, সমরবিদ, সেনাপতি, সমাজ-সংস্কারকসহ সকল দিকে তাঁর ঐতিহাসিক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। এমনই একজন মহামানব তিনি, যিনি শিল্প-সাহিত্য ও আসহাবে রাসূলের (সা) কাব্যচর্চার ক্ষেত্রেও রেখে গেছেন অতুলনীয় ভূমিকা। রাসূলের (সা) প্রত্যক্ষ প্রণোদনায় সাহাবী-কবিগণ তাঁদের কাব্যচর্চার ধারা বেগবান করে তুলেছিলেন। তাঁদের রচিত সেসব কাব্যসাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত বলেই আজও সেসব নিয়ে প্রচুর লেখালেখি, গবেষণা ও আলোচনা-পর্যালোচনা হয়।

রাসূলের (সা) সাহায্য, সহযোগিতা, প্রেরণা ও উৎসাহে যেসকল সাহাবী-কবির উত্থান ঘটেছিল এবং যাঁরা কাব্যসাহিত্যে অমরতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা) অন্যতম। তাঁর কাব্যসাহিত্য নিয়েই আজকের এই যৎকিঞ্চিৎ পর্যালোচনা।
রাহমাতুল্লিল আলামিন সাইয়িদুল মুরসালিন খাতামুন নাবিয়্যিন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)-এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহাবী-হযরত আলী (রা) ইবনে আবু তালিব। সুবিচারের জন্য তিনি ‘শ্রেষ্ঠ ন্যায়বিচারক’ মর্যাদায় ভূষিত ছিলেন। সাহাবীগণের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ ছিলেন তিনি। বিভিন্ন সশস্ত্র জিহাদে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, হুদায়বিয়ার সন্ধিপত্র রচনা, নাজরানের খ্রিস্টান প্রতিনিধিদের সাথে চুক্তিপত্র রচনা, কৃষকদের অধিকার সংরক্ষণে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার প্রচলনে হযরত আলীর প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল। কৃষক-শ্রমিক তথা সকল শোষিত বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের বন্ধু ছিলেন তিনি। অনন্য মগ্নতায় তিনি নামাজ সম্পন্ন করতেন এবং আল্লাহর প্রেমে কখনো কখনো সংজ্ঞা হারাতেন। তিনি নাজিলকৃত আয়াত লিখে রাখতেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাথে আলোচনা করতেন। আল কুরআনের ভাষ্যে তিনি অতুলনীয় ছিলেন। অনন্য জ্ঞান প্রজ্ঞার পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বিশেষ নৈকট্যে থেকে সূরা নাজিলের প্রেক্ষিতসহ আয়াতসমূহের অর্থ ও তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করার সুযোগ লাভ করেন তিনি।
মহান সাহাবী ও খলিফা হযরত আলী (রা) আরবি সাহিত্যেও সুপণ্ডিত ছিলেন। সশস্ত্র জিহাদসমূহে তাঁর ভূমিকা কিংবদন্তিতুল্য। তিরাশিটি সশস্ত্র জিহাদে বিজয়ী হন তিনি। বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা) নবুওয়াত লাভ করেন সোমবারে এবং হযরত আলী (রা) ইসলাম গ্রহণ করেন পরদিন মঙ্গলবার। ইসলাম গ্রহণের পর সত্য অবলম্বন করে থাকা ও প্রচারের কাজে তিনি নানাভাবে নির্যাতিত হন। হিজরতের সময় রাসূলুল্লাহ (সা) প্রতিনিধিরূপে আমানতকারীদের কাছে আমানত ফিরিয়ে দেয়ার দায়িত্ব প্রদান করে তাঁর নিজের বিছানায় তাঁকে রেখে যান। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি সেখানে থেকে মারাত্মক বিরূপ পরিস্থিতি মুকাবিলা করে আমানতকারীদের আমানত ফিরিয়ে দিয়ে সপরিবারে মদিনায় হিজরত করেন।
ইসলামের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ জিহাদ-বদরে তিনি বিপুল সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন। উহুদের যুদ্ধে মহানবীর জীবননাশের আশঙ্কা দেখা দেয়। বিধর্মীরা তাঁকে ঘিরে ফেললো। তিনি নিজ অবস্থান থেকে ছুটে এসে তাদের ব্যূহ ভেদ করে নবীজীকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান। খন্দকের সশস্ত্র জিহাদে আমির ইবন আবদে উদ দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানালে তিনি এগিয়ে যান ও সবাইকে অবাক করে তাঁর জুলফিকারে ইবনে আবদে উদকে হত্যা করেন।
খায়বারের জিহাদে কঠিন ভাগ্য পরীক্ষা। মুসলিম বাহিনীর কোনো সেনাপতি জয়ী হতে পারছিলেন না। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘আগামীকাল এমন এক ব্যক্তির হাতে পতাকা দেবো, যিনি আল্লাহ ও রাসূলকে অত্যধিক ভালোবাসেন এবং আল্লাহ তাঁর দ্বারা বিজয় লাভ করাবেন। তিনি কিছুতেই পশ্চাৎপদ হবেন না।’ হযরত আলীর চোখের রোগ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দোয়ায় মুহূর্তে নিরাময় হলো। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে পতাকা প্রদান করে বললেন, ‘হে আলী! পতাকা গ্রহণ করো এবং তা নিয়ে অগ্রসর হও যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহ তোমাকে জয়যুক্ত করেন।’ যুদ্ধে ঢাল হাতছাড়া হয়ে গেলে তিনি দুর্গের কপাট খুলে ঢালরূপে ব্যবহার করেন এবং যুদ্ধ শেষে তা দূরে নিক্ষেপ করেন। একমাত্র তাবুক অভিযানে তিনি অংশগ্রহণ করতে পারেননি। কারণ, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে মদিনা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত করেন।
তিনি ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে গঠনমূলক ভূমিকা অব্যাহত রাখেন ও প্রথম তিন খলিফার শাসনকালের পঁচিশ বছর সহযোগিতা দান করেন। তিনি হযরত উমর (রা)-কে হিজরত হতে মুসলিম সন গণনার পরামর্শ দান করেন। হযরত উমর (রা) বলেন, ‘আলী না হলে উমর ধ্বংস হতো।’ হিজরির শেষ দিক থেকে ৪০ হিজরির ১৭ রমজান পর্যন্ত খিলাফতের গুরুদায়িত্ব পরিচালনা করেন তিনি। ২১ রমজান রাতে ৬৩ বছর বয়সে তিনি শাহাদাত লাভ করেন। রবিবার রাতে তাঁকে কুফায় দাফন করা হয়।
হযরত আলীর (রা) অসাধারণ সাহিত্যপ্রতিভা ছিল। অধ্যাপক পি.কে হিট্টি হযরত আলীকে (রা) ‘মুসলিম সাহিত্য ও শৌর্যবীর্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলে মূল্যায়ন করেন।’ ঐতিহাসিক গিবন বলেন, ‘জন্ম, আত্মীয়তার বন্ধন এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আলীকে (রা) এত বেশি মহিমান্বিত করেছিল যে, আরবের শূন্য সিংহাসনের দাবি করা তাঁর জন্য অযৌক্তিক ছিল না। একজন কবি, একজন দরবেশ ও একজন সৈনিকের সমন্বিত গুণাবলি তাঁর মাঝে বিদ্যমান ছিল। তাঁর বাগ্মিতা ও সাহসিকতার কাছে সকল প্রতিদ্বন্দ্বীই হার মানতো। মহানবী (সা) তাঁর কর্তব্যের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর এই বন্ধুর কথা মনে রেখেছিলেন। তাঁকে তিনি নিজের ভাই, প্রতিনিধি এবং দ্বিতীয় মূসার বিশ্বস্ত হারুন হিসেবে আখ্যায়িত করে গেছেন।’
অনন্য বাগ্মিতার অধিকারী ছিলেন হযরত আলী (রা)। জনগণের উদ্দেশে বিভিন্ন সময়ে তিনি যে ভাষণ প্রদান করেন, তার সংকলন গ্রন্থ বিখ্যাত ‘নাহযুল বালাগা।’ এতে তাঁর ধর্মীয় বিচার-বুদ্ধি, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, জীবনবোধ ও আল্লাহর কাছে আত্ম-নিবেদনের আকুতির প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর সেই ভাষণাবলি প্রকাশভঙ্গি, শব্দচয়ন ও ভাষার লালিত্যে এক অতুলনীয় সাহিত্য-কর্মে রূপ গ্রহণ করেছে। আরবি ভাষার অমূল্য সম্পদ হিসেবে এ গ্রন্থ স্বীকৃত ও সম্মানিত। আরবি গদ্য ধারায় মাকামা সাহিত্যের স্থান অত্যন্ত উঁচুতে। শাশ্বত সর্বজনীন বাণীর ভিত্তিতে বক্তব্য উপস্থাপন, কালোত্তীর্ণ ভাব ও অলঙ্করণ, গদ্য ধারায় ছান্দিক কুশলতা ও শিল্প-শোভনতা নাহযুল বালাগার মর্যাদাকে সমুন্নত রেখেছে।
হযরত আলী (রা)-কে আরবি ব্যাকরণের জনক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তাঁর তত্ত্বাবধানে আবুল আসওয়াদ দুয়েলি প্রথম আরবি ব্যাকরণ রচনা করেন। হযরত আলী (রা) লিখেছেন অনেক কবিতা। পবিত্র হাদিস ও সাহিত্যের গ্রন্থাবলিতে তাঁর অনেক কবিতা পাওয়া যায়। তাঁর কবিতার বিভিন্ন সংকলনও হয়েছে। দিওয়ান-ই-আলী (রা) তাঁর বিশ্ববিখ্যাত কাব্য সংকলন। মুসলিম বিশ্বে তো বটেই, এর বাইরেও এ গ্রন্থের সমাদর ব্যাপক-বিশাল। সর্বজনীন কালোত্তীর্ণ বাণী ও শিল্প সৌন্দর্যে এ গ্রন্থ কালজয়ীর ভূমিকা পালন করছে। দিওয়ান শব্দের অর্থ কাব্যগ্রন্থ, কবিতা সংকলন। বিচারালয়ও এর অর্থ হয়। এককভাবে কোনো কবির কাব্য-সমষ্টিকে বা একই গোত্রের কয়েকজনের কাব্যসংগ্রহকে দিওয়ান বলা হয়। দিওয়ান-ই-আলী (রা) মানে আলী (রা)-এর কাব্য সংকলন। আল্লামা শিবলী নুমানী এ গ্রন্থের মর্যাদা ও খ্যাতির ওপর মূল্যবান এক অভিমতে বলেন, ‘আরবি কাব্যসাহিত্যে মুআল্লাকা, লামিয়াত ও আধুনিক আরবীয় গদ্য ও কাব্যসাহিত্যের সুবিশাল জগতের মধ্যে দিওয়ান-ই-আলীর তুলনামূলক মূল্যায়নে এটা স্বচ্ছ হয় যে, ইসলামের অনুপম সত্য ও সুন্দরের উপস্থাপনায়, মানবীয় চেতনার উন্মেষ ও বিকাশের সৃজনশীলতায়, নশ্বর পার্থিবতার মোহের বলয় ভেঙে চিরন্তন জীবনের আহ্বান কুশলতায়, সর্বোপরি মাবুদ ও বান্দার সম্পর্ক ও নৈকট্যের জন্য অনুপম আকুতি-সমৃদ্ধ দিওয়ান-ই আলী (রা) একই সাথে তত্ত্বসন্ধানী ও শিল্পান্বেষী মানুষের জন্য এক মূল্যবান উপহার এবং এর গতিময়তা কাল থেকে কালান্তরে, শতকের পর শতক পেরিয়ে বিস্তার লাভ করেছে। দুর্ভাগ্যশত দৃষ্টিকোণগত সংকীর্ণতার যূপকাষ্ঠে দিওয়ান-ই-আলী (রা)-এর মত সর্বজনীন মানবতাবাদী বিশ্বসাহিত্যে যথাযোগ্য মূল্যায়ন ঘটেনি। খিলাফতের প্রতি বৈরী আঘাত থেকে এ সাহিতকর্মও রেহাই পায়নি। কারণ, এর কবি হযরত আলী (রা), খুলাফায়ে রাশেদীনের শেষ খলিফা ও কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব। ফলে, মজলুম মানুষের মুক্তির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্য-কর্ম হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় এর আহ্বান উপস্থাপিত হয়নি। মানবিক মহিমার সর্বোচ্চ ঘোষণায় দিওয়ান-ই-আলী (রা) শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ছিল সেদিন, রয়েছে আজো এবং এর আবেদন আগামীর আবহমান মানুষের মিছিলেও শামিল থাকবে।’
হযরত আলী (রা)-এর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে সুধীমহল কম-বেশি অবহিত আছেন। আরবি কাব্যক্ষেত্রে হযরত আলী (রা)-এর অমর অবদানের মধ্যে রয়েছে আনওয়ার আল-উকূল মিন আশআরী ওয়াসিইয়ী আর-রাসূল (রাসূল প্রতিনিধির কবিতাবলি জ্ঞানপ্রদীপ)। হি. ৮৯৭,/খ্রি. ১৪৯২ সনে সাদী ইবন তাজি সঙ্কলিত এ গ্রন্থ ব্রিটিশ মিউজিয়াম (প্রথম) ৮/৫৭৭; আয়া সুফিয়া ৪২/৩৯৩৭; পাটনা ১: ৭৪৯, ১৯৫; লিডন ৫৮০; প্যারিস (প্রথম) ৩/৩০৮২; ব্রিটিশ মিউজিয়াম (দ্বিতীয়) ২/১২২৪; মিউনিখ (প্রথম) ২/৪৪১; ভ্যাটিক্যান (তৃতীয়) ৩৬৫; আলীগড় ৭,১৩৪ ও অন্যান্য বিখ্যাত গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত রয়েছে। হি. ৮৯০/খ্রি. ১৭৮৫ সনে হুসাইন ইবন মুঈন আল-দীন-আল-মাইবুযী কর্তৃক ফারসি ভাষায়কৃত এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিডন ৫৭৯; ব্রিটিশ মিউজিয়াম (প্রথম) ৫৭৯/১৬৬৫; ব্রিটিশ মিউজিয়াম (দ্বিতীয়) ১: ১৯,২০; তেহরান ২: ৪/৪১৩ ইত্যাদি স্থানে পাওয়া যায়। এ ছাড়াও অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তিত্বকৃত এর ফারসি অনুবাদ হামবুর্গ (১,১৯১)-সংরক্ষিত রয়েছে।
মূলত হযরত আলীর (রা) কাব্য ও সাহিত্যকর্ম বিশ্বসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।

দুই.
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তবুও আবারো স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, হযরত আলী (রা) ছিলেন একজন সুবক্তা ও বিখ্যাত কবি। তাঁর কবিতার একটি ‘দিওয়ান’ আমরা পেয়ে থাকি। তাতে অনেক কবিতায় মোট ১৪০০ শ্লোক আছে। গবেষকদের ধারণা, তাঁর নামে প্রচলিত অনেক কবিতা প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। তবে তিনি যে তৎকালীন আরবি কাব্যজগতের একজন বিশিষ্ট দিকপাল ছিলেন এতে পণ্ডিতগণের কোন সংশয় নেই। ‘নাহজুলবালাগা’ নামে তাঁর বক্তৃতার একটি সংকলন আছে যা তাঁর অতুলনীয় বাগ্মিতার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে।

হযরত আলীর (রা) কবিতার বিষয়বস্তু বিচিত্রধর্মী। বংশ অহমিকা, মূর্খের সাহচর্য, যুগের বিশ্বাস ঘাতকতা, যুগ-যন্ত্রণা, দুনিয়ার মোহ, দুনিয়া থেকে আত্মরক্ষা, সহিষ্ণুতার মর্যাদা, বিপদে ধৈর্য ধারণ, দুঃখের পর সুখ, অল্পে তুষ্টি, দারিদ্র্য ও প্রাচুর্য ইত্যাদি বিষয় যেমন তাঁর কবিতায় স্থান পেয়েছে, তেমনিভাবে সমকালীন ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা, যুদ্ধের বর্ণনা, প্রিয় নবীর (সা) সাহচর্য, তাকদির, আল্লাহর প্রতি অটল বিশ্বাস, খোদাভীতিসহ নানা বিষয় তাতে বাক্সময় হয়ে উঠেছে। তিনি মৃত্যুর অনিবার্যতা, যৌবনের উন্মাদনা, বন্ধুত্বের রীতিনীতি, ভ্রমণের উপকারিতা, জ্ঞানের মহত্ত্ব ও অজ্ঞতার নীচতা, মানুষের অভ্যন্তরের পশুত্ব ইত্যাদি বিষয়ের কথা যেমন বলেছেন, তেমনিভাবে প্রিয় নবীর (সা) ও প্রিয়তমা স্ত্রী ফাতিমার (রা) মৃত্যুতে শোকগাথাও রচনা করেছেন।
বংশ অহমিকা যে অসার ও ভিত্তিহীন সে কথা হযরত আলী (রা) বলেছেন এভাবে :
‘আকার-আকৃতির দিক দিয়ে সকল মানুষ সমান।
তাদের পিতা আদম এবং মা হাওয়া।
মায়েরা ধারণের পাত্রস্বরূপ, আর পিতারা বংশের জন্য।
সুতরাং মানুষের গর্ব ও অহঙ্কারের যদি কিছু থেকে থাকে তাহলো কাদা ও পানি।’
পুত্র হুসায়নকে (রা) তিনি উপদেশ দান করেছেন এভাবে :
‘হে হুসায়ন! আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি,
তোমাকে আদব শিখাচ্ছি; মন দিয়ে শোন।
কারণ, বুদ্ধিমান সেই যে শিষ্টাচারী হয়।
তোমার স্নেহশীল পিতার উপদেশ স্মরণ রাখবে,
যিনি তোমাকে শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন।
যাতে তোমার পদস্খলন না হয়।
আমার প্রিয় ছেলে!
জেনে রাখ, তোমার রুজি-রিজিক নির্ধারিত আছে।
সুতরাং উপার্জন যাই কর, সৎভাবে করবে।
অর্থ-সম্পদ উপার্জনকে তোমার পেশা বানাবে না।
বরং আল্লাহ-ভীতিকেই তোমার উপার্জনের লক্ষ্য বানাবে।’
বুদ্ধি, জ্ঞানের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা তিনি বলেছেন এভাবে :
‘মানুষের জন্য আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ অনুগ্রহ হলো তার বোধ ও বুদ্ধি।
তার সমতুল্য অন্য কোন ভালো জিনিস আর নেই।
দয়াময় আল্লাহ যদি মানুষের বুদ্ধি পূর্ণ করে দেন
তাহলে তার নীতি-নৈতিকতা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূর্ণতা লাভ করে।
একজন যুবক মানুষের মাঝে বুদ্ধির দ্বারাই বেঁচে থাকে।
আর বুদ্ধির ওপরই তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়।
সুস্থ-সঠিক বুদ্ধি যুবককে মানুষের মাঝে সৌন্দর্যময় করে-
যদিও তার আয়-উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়।
আর স্বল্প বুদ্ধি যুবককে মানুষের মাঝে গানিময় করে-
যদিও বংশ মর্যাদায় সে হয় অভিজাত।’
তিনি পৃথিবীর নশ্বরতা ও নিত্যতাকে মাকড়সার জালের সাথে তুলনা করে বলেছেন :
‘নিশ্চয় দুনিয়া নশ্বর।
এর কোনো স্থায়িত্ব নেই।
এ দুনিয়ার উপমা হলো মাকড়সার তৈরি করা ঘর।
হে দুনিয়ার অন্বেষণকারী!
দিনের খোরাকই তোমার জন্য যথেষ্ট।
আর আমার জীবনের শপথ!
খুব শিগগির এ দুনিয়ার বুকে যারা আছে,
সবাই মারা যাবে।’
তিনি দুনিয়াকে সাপের সাথে তুলনা করেছেন এভাবে :
‘দুনিয়া হলো সেই সাপের মত যে বিষ ছড়ায়-
যদিও তার দেহ নরম ও কৃশকায়।’
দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সুখ-দুঃখে ধৈর্যহারা না হবার কথা বলেছেন এভাবে :
‘যুগ বা কাল যদি আমাকে দুঃখ দেয়
তা হলে আমি সংকল্প করেছি ধৈর্য ধরার।
আর যে বিপদ চিরস্থায়ী নয় তা খুবই সহজ ব্যাপার।
আর যুগ যদি আনন্দ দেয় তাহলে উল্লাসে আমি মাতি না।
আর যে আনন্দ ক্ষণস্থায়ী তা একান্ত তুচ্ছ ব্যাপার।’
খায়বার যুদ্ধের দিন মারহাব ইহুদি তরবারি কোষমুক্ত করে নিম্নের এই শ্লোকটি আওড়াতে আওড়াতে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহবান জানায় :
‘খায়বার ময়দান জানে যে, আমি মারহাব।
আমি অস্ত্রধাণকারী,
অভিজ্ঞ বীর-যখন যুদ্ধের দাবানল জ্বলে ওঠে।’
এক পর্যায়ে হযরত আলী (রা) এই শ্লোকটি আবৃত্তি করতে করতে অসীম সাহসিকতার সাথে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন :
‘আমি সেই ব্যক্তি যার মা তাকে ‘হায়দার’ নাম রেখেছে।
আমি জঙ্গলের বীভৎস দৃশ্যরূপী সিংহ।
আমি শত্র“ বাহিনীকে সানদারাড় পরিমাপে পরিমাপ করি।
অর্থাৎ তাদেরকে পূর্ণরূপে হত্যা করি।’
উহুদ যুদ্ধের পর হযরত আলী (রা) হযরত ফাতিমার (রা) কাছে এসে বললেন, ফাতিমা! তরবারিটি রাখ। আজ এটি দিয়ে খুব যুদ্ধ করেছি। তারপর তিনি এই দু’টি শ্লোক আবৃত্তি করলেন:
‘হে ফাতিমা!
এই তরবারিটি রাখ যা কখনো কলঙ্কিত হয়নি।
আর আমিও ভীরু কাপুরুষ নই এবং নই নীচ।
আমার জীবনের কসম!
নবী আহমাদের সাহায্যার্থে এবং বান্দার সবকিছু সম্পর্কে জ্ঞাত
প্রভুর সন্তুষ্টি বিধানে আমি এটাকে ব্যবহার করে
পুরনো করে ফেলেছি।’
কবিতা সম্পর্কে হযরত আলীর (রা) মনোভাব তাঁর একটি মূল্যবান উক্তিতে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি বলেছেন :
‘কবিতা হলো একটি জাতির দাঁড়িপাল্লা (অথবা তিনি বলেছেন) কথার দাঁড়িপাল্লা।’
অর্থাৎ দাঁড়িপাল্লা দিয়ে যেমন জিনিসপত্রের পরিমাপ করা হয় তেমনি কোনো জাতির সাহিত্য-সংস্কৃতি, সভ্যতা, নৈতিকতা ও আদর্শের পরিমাপ করা যায় তাদের কবিতা দ্বারা।
তিনি শুধু নিজে একজন উঁচু মানের কবি ছিলেন শুধু তাই নয়, বরং অন্য কবিদেরকেও তিনি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন। তাদের কবিতার যথাযথ মূল্যায়নও করতেন।
যেমন, একবার এক বেদুঈন তাঁর কাছে এসে কিছু সাহায্য চাইলো। তিনি তাকে একটি চাদর দান করলেন। লোকটি যাওয়ার সময় তার নিজের একটি কবিতা শোনালো। এবার হযরত আলী (রা) তাকে আরো পঞ্চাশটি দিনার দিয়ে বললেন, শোন, চাদর হলো তোমার চাওয়ার জন্য, আর দিনারগুলো হলো তোমার কবিতার জন্য। আমি রাসূলকে (সা) বলতে শুনেছি যে, তোমরা প্রত্যেক লোককে তার যোগ্য আসনে সমাসীন করবে।’

তিন.
রাসূল (সা) কবি ও কবিতাকে ভালোবাসতেন। কবিকে যথাযথ মর্যাদা দিতেন। পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। সহযোগিতা করতেন। অনুপ্রেরণা দান করতেন। রাসূলের (সা) এই কর্মধারায় সাহাবীগণও অভিষিক্ত ছিলেন। হযরত আলীও (রা) কবি ও কবিতাকে যেমন ভালোবাসতেন তেমনি তার পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতাও করতেন। রাসূলের (সা) প্রত্যক্ষ সান্নিধ্য ও শিক্ষায় উদ্ভাসিত ছিলেন তাঁরা। যে কারণে সমরে কিংবা শান্তিতে, শাসকের দায়িত্ব পালন কালে, নেতৃত্ব প্রদান কালেÑ অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে, সর্বাবস্থায় তাঁরা কবি ও কবিতাকে যথাযথ সম্মান, মর্যাদা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে গেছেন। যা আজ এবং আগামীর জন্য এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্তস্বরূপ।

সুতরাং কবি ও কবিতার যথাযোগ্য মূল্য ও মর্যাদা দেয়া সুন্নতেরই একটি বড় অধ্যায়।
বেদনার বিষয় বটে, আজকে যারা নেতৃত্বের আসীনে অধিষ্ঠিত, তাঁদের কাছে কবি ও কবিতার বিশেষ কোনো মূল্য বা মর্যাদা আছে বলে মনে হয় না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে কবিরাই নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, বঞ্চিত এবং লাঞ্ছিত। এটা কোনো ক্রমেই শুভ লক্ষণ নয়। কাম্যতো নয়-ই।
স্মরণ রাখা উচিত যে, বিশ্বাসী কবিদের কবিতা ইসলামী সমাজগঠনে, আদর্শিক সংস্কৃৃতি বিকাশে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে সবিশেষ ভূমিকা পালন করে। সুতরাং যাদের এতটা অবদান সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে, সেই সব কবি-সাহিত্যিকের প্রতিও ইসলামের নেতৃবৃন্দসহ সকলের সুদৃষ্টি রাখা একান্ত প্রয়োজন। প্রয়োজন কবি ও কবিতার যথাযথ মর্যাদা ও মূল্য দেয়ার। তাঁদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা করার। তাহলেই বিশ্বাসী কবিতার ধারা আরও বেগবান হয়ে উঠবে। আর তাতে করে সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সবুজ চত্বর আরও বেশি সম্প্রসারিত হবে।
একটি সবুজ-সুন্দর পৃথিবী ও সমাজ বিনির্মাণের জন্য কবি ও কবিতার ভূমিকা অনিঃশেষ। বিষয়টির প্রতি সবার সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া অত্যন্ত জরুরি।
লেখক : কবি, কথাশিল্পী ও সম্পাদক

Wednesday, September 26, 2018

স্টিফেন হকিংসকে বিজ্ঞানী বলা যাবে না



আবু মহি মুসা : শুরুতেই একটি কথা বলতে হচ্ছে যে, আমাদের এ সভ্যতার দর্শনের শুরু হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব ৬ শতক থেকে। যার সূত্রপাত ঘটিয়েছে গ্রিক। যে কারণে গ্রিককে বলা হয় ‘মাদার অব ফিলোসফি।’ খ্রীস্টপূর্ব ৬ শতক থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়-কাল হচ্ছে ছাব্বিশ শত বছর। যেখনে বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে শত ভাগের কাছাকাছি, সেখানে এই ছাব্বিশ শত বছরে দর্শনের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে মাত্র ১০ ভাগ। এই সময়ে মধ্যে আমরা  দার্শনিক কোনো বিষয়ে সঠিক কোনো ধারণা পাইনি। যেমন প্রেম, দেশপ্রেম,  মানবিক মূল্যবোধ, সততা, দর্শন, দর্শনের উৎপত্তি ইত্যাদি, কোন্ বিষয়ে আমরা ধারণা পেয়েছি?   
উল্লেখিত বিষয়ের মধ্যে  বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কিত একটি বিষয় রয়েছে।  বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কে বহু আলোচিত এবং আলোড়িত যে মতবাদ, তা হচ্ছে স্টিফেন হকিংসের ‘বিগ ব্যাং থিওরী।’ বিগ ব্যাং থিওরী সম্পর্কে আমি বলবো, it is bogus and absolutely bogus. Not only that Stepehen Halkings neither philosopher, nor Scientiest. অর্থাৎ স্টিফেন হকিংস বিজ্ঞানীও ছিলেন না, দার্শনিকও ছিলেন না।  এ বক্তব্যটি শুনে অনেকের বিস্ময়ের অন্ত থাকবে না। সমগ্র বিশ্ব  টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে যেভাবে তাকে সপ্তম আস্মানে নিয়ে গেছে, সেখানে উল্লেখিত বক্তব্য সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য করে তোলা সহজ ব্যাপার নয়। তিনি যে বিজ্ঞানী নন, এখানে তিনটি যুক্তি রয়েছে।
প্রথম যুক্তি : লক্ষ্য করা গেছে,  অনেক সময় অনেকেই নিজেকে দার্শনিক হিসেবে দাবি করে থাকেন। কে দার্শনিক এটা  কেউ নিজে দাবি করলেও হবে না, বা অন্য কেউ বললেও হবে না। কে দার্শনিক এটা বলবে দর্শনের সংজ্ঞা। আমরা কি  দর্শনের সেই সংজ্ঞা পেয়েছি? আমি ‘দেশপ্রেমিক’, দেশপ্রেমের সংজ্ঞা বলবে আমি দেশপ্রেমিক কিনা? ঠিক তেমনি বিজ্ঞানের সংজ্ঞা বলবে কে বিজ্ঞানী। আমরা আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানের সঠিক কোনো সংজ্ঞা পাইনি। বিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে,  বিজ্ঞান হচ্ছে, ‘বিশেষ জ্ঞান’। আমি দর্শনকেও বিশেষ জ্ঞান  বলতে পারি । এ দিয়ে কি বুঝা যাবে বিজ্ঞান কি অথবা কে বিজ্ঞানী? বিজ্ঞানের যে সংজ্ঞা বইর মধ্যে পাওয়া যায় তা হচ্ছে, ‘কোনো বিষয়ের সুসংঘবদ্ধ জ্ঞানই হচ্ছে বিজ্ঞান।’ বিজ্ঞানের এ সংজ্ঞাকে গ্রহণযোগ্য বলে  মনে করা হয় না।
আমরা জানি যে,  বিশ্বজগৎ দুটো ভাগে বিভক্ত। একটি বস্তুজগৎ, অন্যটি ভাবজগৎ। বস্তুজগতের কোনো কিছুর সংজ্ঞার প্রয়োজন হয় না। যেমন, তাল গাছ, নারকেল গাছ। আমরা নামেই তাকে চিনতে পারি। কিন্তু ভাবের ক্ষেত্রে সংজ্ঞার প্রয়োজন হয়। কারণ, শুধু নাম দিয়ে কিছুই বুঝা যায় না। যেমন, প্রেম, মানবিক মূল্যবোধ সততা, ন্যায়পরয়ণতা ইত্যাদি । এ জন্য এর সংজ্ঞার প্রয়োজন। সংজ্ঞারও  একটি সংজ্ঞা আছে। সংজ্ঞার সংজ্ঞা হচ্ছে ‘brief description’ অর্থাৎ যে বিষয়ের সংজ্ঞা দেয়া হবে, তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। এরপর উদঘাটন করতে  হবে ঐ বিষয়ের সাথে আর কি কি বিষয় জড়িত। যেমন, ভালোবাসা, একটি শব্দ। এই একটি শব্দ দিয়ে কিন্তু বুঝা যায় না ভালোবাসা কি। ৭টি বিষয়ের সমষ্টি হচ্ছে  ভালোবাসা (প্রেম-ভালোবাসা অধ্যায় : সৃষ্টি থেকে ধ্বংস)। যেমন, মানসিক আকর্ষণ, কল্যাণ কামনা, স্বার্থ, জ্ঞান, আবেগ, ইচ্ছা এবং অনুভুতি। জ্ঞানটা এর মধ্যে কেন রয়েছে। যেমন, দশটি মেয়ে একই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন কলেজে যায়। এর মধ্যে একটি মেয়েকে আমার ভালো লাগলো, যে মেয়েটি দেখতে কুৎসিৎ। এই কুৎসিৎ মেয়েটিকে ভালো লাগার কারণ হচ্ছে, এ মেয়েটির এমন একটি গুণ আছে, যা আর কারো মধ্যে নেই। এখানে জ্ঞান এনালাইসিস করবে, মেয়ের রূপ সৌন্দর্য ভালো লাগবে না গুণ ভালো লাগবে। উল্লেখিত বিষয়ের  প্রত্যেকটির ভূমিকা রয়েছে। ঠিক তেমনি কি কি বিষয় নিয়ে বিজ্ঞান এটা জানতে হবে। বিজ্ঞান বলতে দুটো বিষয়। একটি জ্ঞান, অন্যটি বস্তু। জ্ঞান ছাড়া বিজ্ঞান হবে না, বস্তু ছাড়াও বিজ্ঞান হবে না। (যদিও অতিন্দ্রি বিজ্ঞানের কথা বলা হয়েছে, সেখানে বস্তুর উপস্থিতি নেই, এটা একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ)। রাইট ব্রাদার্স বিমান সৃষ্টির সূত্রপাত ঘটিয়েছেন গ্লাইডিংয়ের মাধ্যমে। এর জ্ঞান তাঁরা কোথায় পেয়েছেন? আকাশে পাখি উড়তে দেখে। পরবর্তীকালে যান্ত্রিক বিমান আবিস্কৃত হয়েছে। এটা বিজ্ঞানের ব্যাপার। এর জ্ঞান তারা পেয়েছে আকাশে পাখি উড়তে দেখে। এরা যদি কোনো কালেই আকাশে পাখি উড়তে না দেখতেন, তাহলে তাদের পক্ষে বিমান আবিস্কার করা সম্ভব ছিল না। এটাই হচ্ছে ভাব বা জ্ঞান। পাখি দেখে বিমানের নক্সা করলেন। এই নক্সা নিয়ে গেলেন বস্তুর কাছে। বস্তু দিয়ে বিমানের বডি তৈরী করলেন, ডানা দিলেন, লেজ দিলেন। এরপর ইঞ্জিন ফিট করলেন। আকাশে উড়লেন। এবার বিজ্ঞানের সংজ্ঞা হবে এভাবে, ‘ যে জ্ঞান বস্তুর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত অথবা বস্তু মধ্য দিয়ে যে জ্ঞানের বিকাশ ঘটে এটা হচ্ছে বিজ্ঞান। প্রশ্ন হচ্ছে, স্টিফেন হকিংসের কোনো জ্ঞান সরাসরি বস্তুর সাথে সম্পৃক্ত? এটাই যথেষ্ট যে তিনি বিজ্ঞানী নন।  
দ্বিতীয় যুক্তি : দর্শনের উৎপত্তির পর দর্শন দুই ভাগে বিভক্ত। ভাববাদ এবং বস্তুবাদ। তৃতীয় স্তরে দর্শন চারভাগে বিভক্ত । যেমন, ভাববাদী ক্ষেত্র, বস্তুবাদী ক্ষেত্র, ধর্মীয় ক্ষেত্র এবং দার্শনিক সাধারণ ক্ষেত্র।  কিন্তু, মতবাদ দেয়ার ক্ষেত্র হচ্ছে তিনটি। বস্তুবাদী ক্ষেত্র, ভাববাদী ক্ষেত্র এবং মিশ্রক্ষেত্র। বস্তুবাদী ক্ষেত্র বলতে যেমন, একজন ডাক্তার-বিজ্ঞানী একটি রোগের ঔষধ অবিস্কার করেছেন, এটা হচ্ছে বস্তুবাদী ক্ষেত্র। এখানে তার সাথে কোনো দার্শনিকের দ্বিমত পোষণ করার ক্ষমতা নেই। তাদের দুজনের পথ এবং মত ভিন্ন। কিন্তু মিশ্রক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা দেবেন প্রমাণ, দার্শনিকরা দেবেন যুক্তি। প্রমাণ এবং যুক্তি এক হতে হবে।  মিশ্রক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা ৯৯ ভাগ প্রমাণের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন, ডারউইনের বিবর্তনবাদ। অনেক প্রমাণ দেখানো হয়েছে। শেষে বলা হয়েছে মানুষ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। এবং বলা হয়েছে, মানুষের পূর্বপুরুষ ছিল প্রাইমেট। শিক্ষিত সমাজের অনেকে এখনও মনে করেন, মানুষের পূর্বপুরুষ ছিল বানর। এটা সম্পূর্ণ একটি বোগাস মতবাদ। কতগুলো যুক্তি চান মানুষ মানুষ আকৃতিতে সৃষ্টি হয়েছে? বানর যদি মাটি থেকে সৃষ্টি হতে পারে, মানুষর সৃষ্টি মাটি হতে বাধা কোথায়? কাজেই এই মিশ্রক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা যতগুলো বিষয়ে মতবাদ দিয়েছেন, যেমন, বিগ ব্যাং, ব্লাক হোল, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ, বিশ্ব্সৃষ্টি, আকাশ অসীম না সসীম, পৃথিবী ধ্বংস, সবগুলো বোগাস। এর মধ্যে বস্তুগত প্রমাণ, দার্শনিক যুক্তি, বৈজ্ঞানীক ব্যাখ্যা নেই। এর পর টাইম ট্রাভেলের কথা বলা হয়েছে। এলিয়েন নামক প্রাণীরা পৃথিবীতে আসে। অনেকে দেখেছেও। ভন্ডামীর একটা সীমা থাকা উচিৎ।
তৃতীয় যুক্তি : স্টিফেন হকিংস বলেছেন, জমাটবদ্ধ বস্তুতে মহাবিস্ফোরণের ফলে মহাবিশ্বের সৃষ্টি । প্রশ্ন হচ্ছে, জমাটবদ্ধ বস্তু কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে? এর ভর কত? তরল না সলিড? মহাবিস্ফোরণের ফলে যে বস্তুপুঞ্জ ছুটে এসে সূর্যের সৃষ্টি করেছে, বিস্ফোরণ স্থল থেকে এর দূরত্ব কত? এর মাঝে অনেক গ্যালাক্সি এবং সৌরজগৎ রয়েছে। সে সব সৌরজগৎ অতিক্রম করে সূর্যের সৃষ্টি করা কি সম্ভব? বস্তুপুঞ্জ ছুটে আসার শক্তি কোথায় পেয়েছে, নাকি জেট ইঞ্জিল ফিট করা ছিল? ভারতের দুজন বিজ্ঞানী বলেছেন, মহাবিশ্ব এত সুশৃঙ্খলভাবে সৃষ্টি,  বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে এভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টি  সম্ভব নয়। কাজেই তার এ মতবাদ সম্পূর্ণ মনগড়া কল্পকাহিনী।
প্রশ্ন হতে পারে যে, মহাবিশ্ব কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে? জার্মান দার্শনিক ইমনুয়েল কান্ট বলেছেন, ‘বিশ্ব কখনো সৃষ্টি হয়নি, কখনো ধ্বংস হবে না। ছিল, আছে, থাকবে। বিষয়টি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণের সাথে সাংঘর্ষিক। ধর্মের সাথে এর তুলনা করা যাবে না। ধর্ম হচ্ছে সাধারণ মানুষের জন্য । অন্য দিকে জ্ঞানীদের জন্য জ্ঞানের ভান্ডার। জ্ঞানীদের জন্য  সূরা ইমরানের ৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, এই গ্রন্থের কিছু আয়াত আছে সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন, অন্যগুলো রূপক। অর্থৎ কাল্পনিক। পরের আয়াতে বলা হয়েছে, যারা নাস্তিক, তারা এসব নিয়ে ফেতনা সৃষ্টি করে।’ কাজেই এমন কিছু বলা যাবে না যা বললে ধর্মের ভিত দুর্বল হতে পারে।  যেহেতু এ বিষয়টি নিয়ে ধর্মের সাথে একটি সাংঘর্ষিক বক্তব্য দেয়া হয়েছে, এবং বহু আলোচিত। আমরা কখনো ধর্মীয় বিষয়ের সাথে দার্শনিক বিষয়ের তুলনা করবো না। এ ক্ষেত্রে আমরা বলবো, ইমানুয়েল কান্টের এ বক্তব্য যথার্থ। তিনি এতটুকুই বলে থেমে গেছেন। আমরা এখান থেকে আরও সামনের দিকে নিয়ে গেছি। আমরা বলেছি, বিশ্বের অনেক গ্রহের সৃষ্টি হয়েছে, অনেক গ্রহ ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কোন গ্রহ ধ্বংস হয়েছে? এবার আমরা ফর্মুলায় যাবো। বলা হয়েছে, যে গ্রহের সৃষ্টি আছে, কেবল সেই গ্রহের ধ্বংস আছে। যে গ্রহের সৃষ্টি এবং ধ্বংস আছে, সে গ্রহের সময় আছে। যে গ্রহের সময় আছে সে গ্রহটাই ধ্বংস হবে। যেমন, পৃথিবী একটি ধ্বংস হবে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এখানে সকাল, বিকাল, রাত্রি আছে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ‘মহাবিশ্বের বয়স ১৪ শো কোটি বছর। সময় সম্পর্কেই তো তাদের কোনো ধারণা  নেই। পৃথিবীর বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রা- রাসেল প্রেম সম্পর্কে বলেছেন, ‘প্রেম হলো সিগারেটের মতো, যার শুরু অগ্নি দিয়ে, শেষ ছাইয়ে।’ মানুষের জীবনে মানবিক মুল্যবোধের পর যে বিষয়টি মূল্যবান সেটি হচ্ছে প্রেম-ভালোবাসা। মানুষের মধ্যে যেদিন ভালোবাসা থাকবে না, সেদিন সভ্যতাও থাকবে না। আদি রাষ্ট্রের উৎপত্তির একটি কারণ হচ্ছে প্রেম। অথচ বার্ট্রা- রাসেল কি বললেন। ওই সব বিজ্ঞানীরা সময় সম্পর্কে ঠিক তেমনি যুক্তিহীন ভিত্তিহীন কথা বলেছে। সময়ের উৎপত্তি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। সময় হচ্ছে পৃথিবীর ব্যাপার। দুটো কারণে সময়ের উৎপত্তি।  সূর্য আলো দিচ্ছে, পৃথিবী ঘুরছে, ফলে আমরা একটি দিন এবং একটি রাত পাচ্ছি। এই দিন রাত্রিকে যান্ত্রিক উপায়ে ২৪ ভাগে ভাগ করা হয়েছে অর্থাৎ ২৪ ঘন্টায় এক দিন। এটাকে মিনিট, সেকেন্ডে ভাগ করা হয়েছে। কাজেই পৃথিবীর সময় দিয়ে কি বিশ্বের বয়স নির্ণয় করা যাবে?
স্টিফিন হকিংসের বিগ ব্যাং থিওরী যে একটি বোগাস মতবাদ, এর পর আর কোনো যুক্তির প্রয়োজন আছে। তার মতবাদ যদি বোগাস বলা হয়, তাহলে বলতে হবে তিনি বিজ্ঞানী নন। তার এই মতবাদ ডারউইনের বিবর্তনবাদের মতো একদিন কোল্ডস্টোরেজে চলে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : দার্শনিক।

Tuesday, September 25, 2018

মানুষ গুজবে কান দেয় কেন? -মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত



বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বহুল প্রচারিত শব্দটি হচ্ছে ‘গুজব’। সোস্যাল মিডিয়ায় গত কয়েক দিনে ‘গুজব’ শব্দটি যতবার ব্যবহৃত ও উচ্চারিত হয়েছে, তা আর কোনো শব্দের ক্ষেত্রে হয়েছে কি না সন্দেহ। বহুল প্রচারিত ‘গুজব’ শব্দটির ব্যবহার বাড়ে ৪ আগস্টের পর থেকে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজধানীর জিগাতলা-সায়েন্সল্যাবে অবস্থানরত স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা এবং তৎপরবর্তী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। সেদিন নিরাপদ সড়কের দাবিতে সপ্তম দিনের মতো রাজপথে অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা। সেদিন দলীয় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীরা একযোগে হামলে পড়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর। সে সময় ঘটনাস্থলে থাকা আহত শিক্ষার্থীরা ফেসবুক লাইভে এসে তাদের ওপর বর্বরোচিত হামলার বিবরণের পাশাপাশি এটিও বলে যে, তাদের চারজন ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এবং চারজন ছাত্রীকে ধরে নিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে। আরো বহু ছাত্রকে আটকে রেখেছে তারা। ঘটনাস্থলে থাকা ছাত্রছাত্রীদের অসংখ্য লাইভ ভিডিওতে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে তাদের সহপাঠী ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা প্রচ- বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ প্রশাসনের পক্ষ থেকে এটিকে ‘গুজব’ বলে মিডিয়ার সামনে তুলে ধরেন। আর এর পরপরই সোস্যাল মিডিয়ায় ‘গুজব’ শব্দটি একটি ব্যঙ্গাত্মক ও হাস্যরসাত্মক শব্দে পরিণত হয়।

ইদানীং ছাত্রসমাজ ‘গুজব’ শব্দটিকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করছে। সোস্যাল মিডিয়ায় একযোগে প্রচারণার ধরন এমনই যে, শিক্ষার্থীদের কেউ আহত ও রক্তাক্ত কিংবা চোখে ব্যান্ডেজ, গুলিবিদ্ধ অথবা সাংবাদিকদের ওপর হেলমেটধারী আওয়ামী সন্ত্রাসীদের উপর্যুপরি হামলা এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণের ছবি অথবা একেকটি প্রামাণ্য ভিডিওচিত্র পোস্ট করে তার ক্যাপশনে লিখেছেন- ‘গুজবে কান দেবেন না। তবে চোখ দিয়ে দেখুন।’
একজন ছাত্রের চোখ উপড়ে ফেলা, চারজনকে হত্যা করা, চারজন ছাত্রীকে ধর্ষণ করা এবং আরো ছাত্রীকে আটকে রাখার যে খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তার পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের ডেকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ের ভেতরের দৃশ্য দেখানো হয়। এ রকম দু’জন ছাত্রলীগ সমর্থক ছাত্রকে দিয়ে পরিকল্পিতভাবে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়- শিক্ষার্র্থীদের পক্ষ হতে যা বলা হচ্ছে তার সবই গুজব! সেদিনই রাতে এক প্রেসনোটে ডিএমপি থেকে জানানো হয় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে প্রচারিত ঘটনার কোনোটা ঘটেনি। এগুলো সবই গুজব। গুজবে কান না দেয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানানো হয়। সেদিনই মোবাইল অপারেটরদের মাধ্যমে একটি মেসেজ দিয়ে সরকার জানায় এটি গুজব মাত্র। আমার মোবাইলেও সে রকম একটি মেসেজ পেয়েছি। এড়াঃ. রহভড় থেকে পাঠানো মেসেজে লেখা ছিল- ‘রাজধানীর জিগাতলায় ছাত্রহত্যা ও ছাত্রীধর্ষণের ঘটনার কোনো সত্যতা নেই। বিষয়টি পুরোপুরি গুজব। এতে কেউ বিভ্রান্ত হবেন না। পুলিশকে গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করুন : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।’
যদিও আজ পর্যন্ত আসলে সত্যিকারার্থে সেদিন আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর কার্যালয়কেন্দ্রিক কী ঘটেছিল তা জাতির সামনে তুলে ধরা হয়নি।
তথ্য জানার অধিকার একজন নাগরিকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। সেদিন আসলে কী ঘটেছিল এবং কোন ঘটনা থেকে গুজবের সূত্রপাত হয়েছে, কতজন আহত কিংবা কতজন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কতজন শিক্ষার্থী হসপিটালে ভর্তি, কোন পক্ষ কোন পক্ষকে আঘাত করেছে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছিলো। আর এই ঘটনার জন্য কোন তদন্ত কমিটি করা হয়েছে কিনা তা আজ পর্যন্ত জাতির সামনে তুলে ধরা হয়নি। যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নাগরিকদের গুজবে কান না দেয়ার আহবান জানিয়ে মেসেজ দেয়া হয় সে ঘটনার প্রকৃত সত্য যদি জাতির সামনে তুলে ধরা না হয় তাহলে নাগরিকরা গুজবে প্রভাবিত হবেন এটাই তো স্বাভাবিক। মূলধারার গণমাধ্যমকে যখন গলাটিপে ধরা হয় তখন গণমাধ্যমের বদলে সোস্যাল মিডিয়াকেই জনগণ খবর জানার মূল মাধ্যম হিসেবে ধরে নেয়। তখন যদি কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কোন খবর প্রচার করে তখন তা সত্য না মিথ্যা, কে তার প্রমাণ দেবে? ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন নিয়ে মূল ধারার গণমাধ্যমের ওপর সরকার খড়গহস্ত হয়েছে তখনই সেখানে সোস্যাল মিডিয়া শক্তিশালী অবস্থানে চলে গিয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রথম কয়েকদিন সকল টেলিভিশন চ্যানেল লাইভ প্রচার করেছিল কিন্তু তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রেসনোটে সে প্রক্রিয়া থেমে যায়। তথ্য মন্ত্রণালয় সকল টিভি চ্যানেলকে সরকারি নির্দেশনা মেনে চলতে বলে। সরকার সমর্থক চ্যানেল একাত্তর ও যমুনা টিভিকে বিশেষভাবে সতর্ক করে দেয়। ফলে সায়েন্সল্যাব ও জিগাতলায় সেদিন কোনো চ্যানেলই তেমন লাইভ প্রচার করেনি। এমনকি তথ্য মন্ত্রণালয়ের সতর্কবার্তার ফলে বেসরকারি সকল টিভি চ্যানেল কেন যেন বিটিভির মতো আচরণ করতে শুরু করে। সেদিন একটি পোস্ট দেখে খুব হাসি পেয়েছিল। কোন একজন স্কুলছাত্র বিটিভির খবর পড়ার একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছিল- ‘দিনাজপুরে বাতাবিলেবুর বাম্পার ফলন হয়েছে।’ এটি দিয়ে পোস্টকারী বুঝাতে চেয়েছেন হাজার হাজার স্কুলশিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে এলেও বিটিভিতে সেই খবর স্থান পায়নি। এটি বিটিভির প্রতি জনগণের এক ধরনের অনাস্থা। যদিও সংসদে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, বাংলাদেশে ৮০% মানুষ বিটিভি দেখে। সেদিন ধানমন্ডি জিগাতলায় যদি অবাধ তথ্যপ্রবাহের সুযোগ থাকতো সকল মিডিয়াকে স্বাধীনভাবে খবর প্রচারের স্বাধীনতা দেয়া হতো, টিভি চ্যানেলগুলো যদি আগের মতো লাইভ টেলিকাস্ট করার সুযোগ পেত, তাহলে কোনটা সত্য আর কোনটা গুজব তা নাগরিকদের সামনে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যেতো। মূলধারার গণমাধ্যমকে প্রেসনোট জারি করে এবং বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকারই তো গুজব সৃষ্টির সুযোগ করে দিয়েছে।
গুজব মানুষের এক ধরনের বিশ্বাসের প্রতিফলন। মানুষ যা প্রতিনিয়ত দেখে এবং মানুষের অন্তরে যে বিষয় স্থির হয়ে গেছে, সে ধরনের ঘটনার খবর সামনে এলে- সেটা গুজব হোক বা সত্যি হোক, মানুষ তার বিশ্বাসের জায়গা থেকেই সেটিকে সত্য বলে ধরে নেয়। নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা, গুলিবর্ষণ ও ধর্ষণের খবর কেইবা বিশ্বাস করবে না- বলুন দেখি। দেশের নাগরিকদের সামনে তো এমন জলজ্যান্ত উদাহরণ রয়েছেই! ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠা দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা এবং সেই লাশের ওপর পৈশাচিক নৃত্য, বিশ্বজিৎকে দিন-দুপুরে কুপিয়ে হত্যা, কুষ্টিয়ায় আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর নির্লজ্জ হামলা, কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাদের ওপর হামলা, বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে হাতুড়িপেটা- এসবতো সাধারণ নাগরিকদের স্মৃতি থেকে এখনও মুছে যায়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির নেতাদের ওপর ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের প্রকাশ্য গুলির ভিডিও এখনো সোস্যাল মিডিয়া ও ইউটিউবে আছে। এরপরও ছাত্রলীগের হামলার খবর জনগণ কিসের ভিত্তিতে গুজব বলে মনে করবে? আর ধর্ষণের ঘটনা- সেটা তো আরো স্পর্শকাতর। কিন্তু যে ছাত্রসংগঠনের নেতা কাজী নাসির উদ্দিন মানিকের ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদযাপনের রেকর্ড আছে, যে সংগঠনের নেতাকর্মীদের ধর্ষণের খবর প্রতিদিন কোনো না কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়- সেই সংগঠনের লোকজন কাউকে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করেছে- এমন গুজবে কান দেয়ার যৌক্তিক উপকরণতো ছাত্রলীগই তৈরি করে রেখেছে!
বাংলাদেশের মানুষ গুজবে কেন বিশ্বাস করছে? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর যে কেউ একবাক্যে বলে দিতে পারবে- সেটা হলো, এদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই। বাংলাদেশের মানুষ খবর পাওয়ার জন্য এখন আর টিভি চ্যানেল অন করে না। আর সে কারণেই মানুষ ঘটনা জানার জন্য সবার আগে সোস্যাল-মিডিয়ায় প্রবেশ করে এবং সত্যটা জানার চেষ্টা করে। একটা প্রেসনোট জারি করে কিংবা নাগরিকদের মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে গুজবে কান দেয়া থেকে জনগণকে বিরত রাখা আদৌ সম্ভব কি না- বিষয়টি সরকারের কর্তাব্যক্তিরা ভেবে দেখবেন বলে আশা করি। প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করুন। গণমাধ্যমকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দেশে অবাধ তথ্যপ্রবাহের ব্যবস্থা করুন- দেখবেন, কোনটা ‘গুজব’ আর কোনটা ধ্রুব সত্য। তা যদি না হয় তাহলে এইসব চাতুর্যপূর্ণ প্রেসনোটই বরং হয়ে উঠবে অতীব নির্মম একেকটি গুজব।
লেখক : এমফিল গবেষক

Friday, September 21, 2018

শহীদ মাওলানা নিজামী (রহঃ) সম্পর্কে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের কিছু কথা


ভিডিওটি দেখুন, প্রচার করুন। টার্কিশ ভাষাকে মনে হবে বাংলা শুনছেন!
এরদোগান নিজামী শাহাদাতের সময় প্রোগ্রামে শহীদ নিজামীর কথা বলছেন। আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামে যেমন বলেছেন তেমনি বলেছেন একদম নিজেদের ঘরোয়া সমাবেশে। এটি তাদের একান্তই নিজেদের একটি সমাবেশ। সেখানে তিনি বলেন-
"বাংলাদেশের ঘটনা শুনেছেন..? মতিউর রহমান নিজামী, যাকে ৪৫ বছর আগের কাহিনীর কারনে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ওখানে আমাদের ঈঐচ (ধর্মনিরপে- প্রধান বিরোধী দল) এর মত এক রাজনৈতিক দল আছে। যার প্রধান এক মহিলা মতিউর রহমান নিজামীর ফাসিঁ দিয়েছে।
যার বয়স ৭৩, যাকে ৪৫ বছর আগের কাহিনীর কারনে ফাসিঁ দেওয়া হয়েছে। যিনি একজন বিজ্ঞ মানুষ, আলেম ও সাবেক মন্ত্রী....
কী বলতে চাই জানেন..? বেশী কিছু বলতে চাইনা..! শুধু এতটুকুই বলব, জালিমদের জায়গা জাহান্নাম।
কিন্তু এই অন্যায়ের কেউ কী প্রতিবাদ করেছে..? না, করেনী..। গণতন্ত্রকামীরা কী আওয়াজ করেছে..? না, করেনী..। কিন্তু অন্য ধর্মের হলে পশ্চিমাতে এটা নিয়ে কেয়ামত ঘটে যেত। উনি শুধু মুসলমান ও মুসলিম নেতা হওয়ার কারনেই সবাই চুপ.... "
সর্বশেষ বলেছেন.... সকল জুলুমেরই একটা শেষ আছে, সকল খারাপের পরই একটা বসন্ত আসে.... এবং সেই দিন আসবেই ইনশাআল্লাহ....
উনি সর্বশেষ তুরস্কের কিছু কথা বলে একটি হাদীস উল্লেখ করেন, "মান সাবারা..... জাফারা" যে ধৈর্য্য ধরে সে বিজয়ী হয়।

শহীদ মাওলানা নিজামী (রহঃ) সম্পর্কে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের কিছু কথা,
প্রেসিডেন্ট এরদোগান, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান

Popular Posts