Monday, January 21, 2019

জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ইসলামী দলঃ একটি তুলনামূলক র্পযালোচনা



শাহাদাতুর রহমান সোহেল

পবিত্র কোরআনের র্নিদেশ হচ্ছেতোমার সংঘবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জু (অর্থাৎ ইসলাম বা কোরআন) আকড়ে ধর এবং পরষ্পর বিচ্ছিন্ন হইও না।(সুরা আল-ইমরান-১০৩আ) আর হাদীসে আছে, হযরত হোযায়ফা (রা) বর্ণনা করেন, লোকেরা সাধারণতঃ ভবিষ্যতের নানা কল্যাণকর বিষয়ে প্রিয় নবীজির নিকট প্রশ্ন করতেন। আমি প্রশ্ন করতাম যেসবে অকল্যানের আশংকা রয়েছে সেই সব বিষয়। একদা আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাছুলুল্লাহ। আমরা জাহেলিয়াতের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিলাম আল্লাহপাক আমাদেরকে ইসলামের আলোতে উদ্ভাসিত করে সে অন্ধকারের অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছেন। এ কল্যাণকর অবস্থার পর কি কোন খারাপ দিন আবার আসবে? জবাব দিলেন, অবশ্যই আসবে। আমি আরজ করলাম, সে মন্দ দিনের পরও কি কোন কল্যাণকর সময়ের সাক্ষাত আমরা লাভ করতে পারব? বললেন, হ্যা, কল্যাণকর দিন আসবে, তবে সেটা নির্ভেজাল কল্যাণ হবে না, কিছু অকল্যাণের মিশ্রণ ও তাতে থাকবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম: সে কল্যাণের স্বরূপ কি হবে? বললেন, এমন লোকের আবির্ভাব ঘটবে যারা (শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে) আমার তরিকা ত্যাগ করে অন্যদের তরিকা অনুসরণ করে চলবে। আমার প্রদর্শিত পথ ত্যাগ করে অন্য পথে লোকদের পরিচালিত করতে সচেষ্ট হবে। এরা ভাল কাজ করবে, তেমনি মন্দ কাজেও অভ্যস্ত হতে থাকবে। আবারও জিজ্ঞেস করলাম, এই মিশ্র কল্যাণকর অবস্থার পর আবারও কি কোন অকল্যাণ আসবে? এরশাদ করলেন, একশ্রণীর লোক জাহান্নামের দ্বারদেশে দাঁড়িয়ে লোকদেরকে তাতে প্রবেশ করার আহবান জানাতে থাকবে অর্থাৎ এমন সব ক্রিয়া কর্মের প্রতি লোকদেরকে প্ররোচিত করতে থাকবে যার পরিণতি হবে অনিবার্য জাহান্নামে বাস। যারা ঐ সব লোকদের দাওয়াতে সাড়া দেবে ওরা নিশ্চিতভাবেই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। আমি আরজ করলামইয়া রাছুলুল্লাহএ সম্পর্কে আমাদেরকে আরো কিছু বলুন এরশাদ করলেনএরা আমার উম্মতের পরিচয়ে পরিচিত হবে এবং আমাদের ভাষাতেই কথা বলবে আমি আরজ করলামযদি আমার জীবদ্দশাতেই সেই দুর্দিন এসে যায় তবে আমরা কি করবোএরশাদ করলেনইসলামী জামায়াত এবং তাদের আমীরের  নেতৃত্বকে আকড়ে থাকবে আরজ করলামযদি মুসলমানদের সুসংঘবদ্ধ কোন জামায়াত ও সঠিক নেতৃত্ব দানকারী আমীর না থাকেতবে আমাদের করণীয় কি হবেএরশাদ করলেন: তখন ঐ সমস্ত নতুন মত-পথ থেকে নিজেকে পৃথক করে প্রয়োজনে জনপদের বাইরে কোন বৃক্ষমূল কামড়ে হলেও ঈমান রক্ষার চেষ্টা করবে অর্থাৎ  গাছের পাতা ও মূল কামড়ে থেকেই তোমার ঈমান রক্ষার প্রয়াস পাবে" (বুখারী-মুসলিম শরীফ) অপর একটি হাদীসে রযেছেহযরত হারেসুল আশআরী(রাথেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনহযরত নবী করিম সাইরশাদ করেছেন: আমি তোমাদিগকে পাঁচটি বিষয়ের আদেশ করছিতা এই - জামায়াতবদ্ধ জীবনআদেশ শ্রবণে প্রস্তুত থাকা ও নিয়ম-কানুন মেনে চলাহিজরত করা ও আল্লাহর পথে জিহাদ করা (মুসনাদে আহমাদতিরমিযি) উক্ত কোরআন-হাদীসের নির্দেশনার আলোকে বর্তমান জাহেলিয়াতের সামাজে মুসলমানদের উচিত কোন না কোন ইসলামী সংগঠন দ্বারা সংঘবদ্ধ হয়ে দ্বীন ইসলামকে মজবুতভাবে ধারণ করে ইসলামী জিহাদে (আন্দোলনেসক্রিয় থাকা এক্ষেত্রে বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের মধ্যে তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাছাই করে ইসলামী সংগঠন গ্রহণ করা উচিত এখানে জামায়াতে ইসলামীর সাথে বাংলাদেশের অন্যান্য ইসলামী সংগঠনের তুলনামূলক পার্থক্য তুলে ধরা হচ্ছেঃ

০১জামায়াতে ইসলামী ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট আরবের ইখওয়ানুল মুসলেমীন বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ইসলাম পূন:প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের আগ্রগামী সংগঠনকিন্তু অন্যান্য ইসলামী সংগঠন এক্ষেত্রে তার অনুসারী মাত্র পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে:- অগ্রবর্তীগণ তো অগ্রবর্তীই (সুরা ওয়াকিয়া১০ আয়াত) রাসুলুল্লাহ (সা:) এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে বিশ্বব্যাপী ইসলামের বিজয় হলে তখনকার নিরপেক্ষ ইতিহাস এক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীকে অগ্রগামী সংগঠন হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করবে আর বর্তমান যুগের ইসলামী আন্দোলনের কাফেলায় পবিত্র কোরআনের ঘোষণা অনুসারে আখেরাতের ময়দানেও জামায়াতে ইসলামী অগ্রগামী থাকবে ইনশা-আল্লাহ। এসম্পর্কিত এই লিংকটি ব্রাউজ করুন প্লীজ: বিশ্বব্যাপী দ্বীন ইসলামের পূনরুত্থানে জামায়াতে ইসলামীর অবিস্মরণীয় সাফল্য 

০২অন্যান্য ইসলামী দল কোনটি ব্যক্তিভিত্তিককোনটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীভিত্তিককিন্তু জামায়াতে ইসলামী তা নয়ইহা এক সার্বজনীন ইসলামী আন্দোলন

০৩অন্যান্য বহু ইসলামী দলে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ ও সর্বমূখী তৎপরতা নাইকিন্তু জামায়াতে ইসলামীতে তা রয়েছে

০৪জামায়াতে ইসলামী একই সাথে এককভাবে ধর্মীয়শিক্ষা-প্রশিক্ষণমূলকসামাজিকসাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সংগঠনকিন্তু অন্যান্য ইসলামী দল তদ্রুপ নয়

০৫সকল নবী-রাসুলকে প্রেরণ করা হয়েছে সমস্ত বাতিল জীবনবিধানকে উৎখাত করে দ্বীন ইসলাম কায়েম করার লক্ষ্যে (দেখুন- সুরা আশশুরা১৩ আয়াত)কিন্তু অন্যান্য ইসলামী সংগঠনে এব্যাপারে অটল দৃঢ়তা (এস্তেকামাতনাইকিন্তু জামায়াতে ইসলামী একামতে দ্বীনের সংগ্রাম প্রত্যক্ষভাবে এবং এস্তেকামাতের সাথে অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে আপোষহীন

০৬দ্বীনে হক কায়েমের সর্বোচ্চ লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামী একনিষ্ঠ আপোষহীনভাবে নিয়োজিত এজন্য সকল বাতিল শক্তিসমূহ জামায়াতে ইসলামীকে শত্রুই গণ্য করে থাকেকিন্তু অন্যান্য ইসলামী দল অনেক সময় অসংগত আপোষকামী অথবা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে সেজন্য বর্তমানে তাদের সেই পরিমাণ শত্রু গণ্য করে না 

০৭জামায়াতে ইসলামীতে অন্তুর্ভুক্ত হয়ে কোন মুসলিম অন্য কোন বাতিলপন্থী অনৈসলামিক দল বা সংগঠনের সাথে সম্পর্ক রাখতে পারে না অর্থাৎ  অনৈসলামিক দল বা সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে না।  জামায়াতে ইসলামী আল্লাহকে খুশী করার এবং শয়তানকেও নারাজ না করার ঈমানবিরোধী মোনাফেকী নীতিতে বিশ্বাসী নয় কিন্তু এমন জামায়াত বা গ্রুপ রয়েছে যাদের কার্যক্রমের সাথে পুরোপুরি থেকেও অনৈসলামিক দলের আন্দোলনেসংগ্রামে বা প্রচেষ্টায় পূর্ণরূপে থাকে যায়। এটা সুস্পষ্ট মোনাফেকী । কোরআনের ঘোষণা অনুসারে মোনাফেকের স্থান জাহান্নামের সবচেয়ে নীচে।  

০৮জামায়াতে ইসলামীতে সুসংহত বিজ্ঞানসম্মত কর্মসূচী রয়েছেকিন্তু অন্যান্য ইসলামী দলে তদ্রুপ নাই

০৯জামায়াতে ইসলামী ক্যাডার(মানগত স্তরবিন্যাস)ভিত্তিক সংগঠনকিন্তু অন্যান্য ইসলামী দল তা নয় প্রধানতক্যাডার(মানগত স্তরবিন্যাস)ভিত্তিক হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীতে যে পরিমাণ ঐক্য ও শৃংখলা রায়েছে অন্যান্য ইসলামী সংগঠনে তা নেই

১০অন্যান্য বহু ইসলামী সংগঠনে নেতৃত্ব ও আনুগত্যের সুষম শৃংখলা নেই সহজে গ্রুপিং সৃষ্টি হয়ে ভাংগন ধরে ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বকর্ম-কৌশলগত মতভেদ ইত্যাদিকে প্রাধান্য দেয়া হয় কিন্তু জামায়াতে ইসলামীতে নেতৃত্ব ও আনুগত্যের যথাযথ নিয়মানুবর্তীতা রয়েছে এবং এখানে যেকোন দ্বন্দ্বের কারণে সহজে গ্রুপিং সৃষ্টি বা ভাঙ্গন ধরে না


১১অন্যান্য বহু ইসলামী সংগঠনেই ইসলামী গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাব রয়েছেকিন্তু জামায়াতে ইসলামীতে তূলনামূলকভাবে উত্তম ইসলামী গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিদ্যমান পরামর্শের ভিত্তিতে সংগঠন পরিচালনাযথানিয়মে সমালোচনা ও সংশোধনইসলামী নীতির আওতায় স্বাধীন মতামত প্রদান বা ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নেতা নির্বাচন ইত্যাদি ইসলামী গণতান্ত্রিক উপাদান জামায়াতে ইসলামীতে রয়েছে


১২জামায়াতে ইসলামী গণ-মানুষের আধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেকিন্তু অন্যান্য ইসলামী দল অনেক সময় একে বস্তুবাদী আন্দোলন বলে নিন্দা প্রকাশ করে ও তা থেকে বিরত থাকে। রাসুলুল্লাহ(সা:) মাত্র সতের বছর বয়সে গণ-মানুষের অধিকার এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে "হিলফুল ফুযুলগঠন করেছিলেন আর তখনই দ্বীপ্ত ঘোষণা প্রদান করেন- তায়াকাদু ওয়াতায়াহাদু বিল্লাহি লায়াকুনান্না মায়াল মাজলুমি হাত্তা ইয়ুয়াদ্দি ইলাইহি হাক্কাহু মায়াবাল্লাহ বাহরা সুফাতিনঅর্থাৎ আল্লাহর কসমসাগরে লোম ভেজানোর পরিমাণ পানি থাকা পর্যন্ত মজলুমের সাথে থেকে তার অধিকার আদায় করব হাদীসে বলা হচ্ছেসাইয়িদুল ক্বাউমি খাদেমুহুম. ফামান সাবাক্বাহুম বিল খিদমাতি লাম ইয়াসবিকুহু বিআমলিন ইল্লাশ শাহাদাতঅর্থাৎ জাতির নেতা তারাই যারা তাদের খেদমত করে কোন ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ ছাড়া হওয়া ছাড়া অন্য কোন আমল ‌দিয়ে জাতির খেদমতে নিয়োজিত ব্যক্তির চেয়েে উচ্চ র্মযাদা লাভ করতে পারবে না " (বায়হাকীমেশকাত শরীফ)

১৩কোরআন-হাদীস বর্ণিত তাযকিয়ায়ে নফস তথা ইসলামী তাসাউফের লক্ষ্যে হলো মানুষকে ইসলামী খেলাফতের যোগ্য মোমেনীন সালেহীন রূপে গড়ে তোলা জামায়াতে ইসলামীর লোক গঠনের উদ্দেশ্যেও উহাই কাজেই এক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী নীতিগতভাবে সঠিক অবস্থানে রয়েছে কোন কোন ইসলামী গ্রুপ তাযকিয়ার ক্ষেত্রে লক্ষ্যহীন আবার কোন কোন ইসলামী দলে লক্ষ্য থাকলেও সঠিক লক্ষ্যে সম্পূর্ণরূপে উপনীত নয়

১৪জামায়াতে ইসলামী গায়রে ইসলামী তাসাউফের উচ্ছেদনিম ইসলামী তাসাউফের সংশোধন এবং খালেছ ইসলামী তাসাউফের প্রতিষ্ঠাকামী জামায়াতে ইসলামী হকপন্থী সুফীদেরকে সমর্থন-সহযোগিতা করেবিশেষ করে হকের পথে সংগ্রামী সুফী-সাধকদেরকে সম্মান-শ্রদ্ধার চোখে দেখে আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদী (রহ: )-এর ইসলামের শক্তির উৎসসহ আরো বিভিন্ন বইয়ে ইসলামের ইতিহাসে সুফীদের অবদানের স্বীকৃতি আছে এই সুফীদের মধ্যে বহু তরিকা চালু আছে জামায়াতে ইসলামী কোন সুফী তরিকার অনুসারী নয় তবে কোরআন-হাদীসসম্মত সকল তরিকা সমর্থনযোগ্য মনে করে বিভিন্ন তরিকার বহুসংখ্যক পীরমাশায়েখ বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে অথবা অনুকুলে রয়েছে কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ময়দানে এমন একাধিক ইসলামী দল রয়েছে যারা সুফীবাদী নির্দিষ্ট তরিকার বাস্তবায়নে নিয়োজিত বা সমর্থক এক্ষেত্রেও জামায়াতে ইসলামী সার্বজনীন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী

১৫জামায়াতে ইসলামীতে ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক কাজের রিপোর্টিংয়ের ব্যবস্থা আছে একে যথাযথভাবে কাজে লাগানো হলে তা সুচিন্তিত রুটিন হিসাবে কাজকে সুশৃংখল ও সহজ করে, এতে সংগঠনের উন্নতি  অবনতির যথার্থ পরিচয় পেয়ে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া যায় এবং আপন জনশক্তির নিকট কর্মসূচী সম্পর্কে ধারণা পরিস্কার থাকে অন্যান্য ইসলামী সংগঠনে এই রিপোর্টিংয়ের ব্যবস্থা নাই

১৬সুফীবাদী ইসলামী দলগুলো বিভিন্ন নফল কাজকে অজীফা হিসাবে আদায় করতে দেয় কিন্তু জামায়াতে ইসলামী নিজের কর্মীদেরকে ব্যক্তিগত রিপোর্ট বইয়ের মাধ্যমে কুরআন অধ্যয়নহাদীস অধ্যয়নইসলামী সাহিত্য অধ্যয়নজামায়াতে নামাজদাওয়াতী কাজকর্মী যোগাযোগআত্মসমালোচনাসামাজিক কাজ ইত্যাদি কাজের নির্দেশ দেয় যা বিভিন্ন কারণে অপেক্ষাকৃত বেশী গুরুত্বপূর্ণ

১৭ছাত্রশিক্ষককৃষকশ্রমিকপেশজীবিবুদ্ধিজীবিসাহিত্য-সংস্কৃতি ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর মজবুত অংগ সংগঠন বা সহযোগী সংগঠন রয়েছে কিন্তু অন্যান্য ইসলামী দলে তদ্রুপ নাই

১৮জামায়াতে ইসলামীর সহযোগী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির বিপুল পরিমাণে আধুনিক শিক্ষিত ছাত্রসমাজকে ইসলামী আন্দোলনে শরীক করতে পেরেছে কিন্তু অন্যান্য ইসলামী দলের ছাত্র সংগঠনের অবদান এক্ষেত্রে নিতান্তই নগণ্য

১৯দ্বীন ইসলাম বিশ্বজনীন জীবন-বিধান জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের কল্যাণকামী জামায়াতে ইসলামীতে অমুসলিমদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তকর্মসূচী ও কার্যক্রম রয়েছেকিন্তু অন্যান্য অনেক ইসলামী দলে তা নেই

২০জামায়াতে ইসলামী সর্ব সাধারণ নেতা-কর্মীকে কোরআন-হাদীস বুঝে পড়তে হয় কোরআন-হাদীসের সহজবোধ্য অনুবাদ ও ব্যাখ্যাগ্রন্থ জামায়াতে ইসলামী চালু করেছে কিন্তু অন্যান্য অনেক ইসলামী সংগঠনেই সাংগঠনিক পরিসরে এধরণের ব্যাপক চর্চার নির্দেশনা নাই। অধিকন্তু কিছু ইসলামী দল বা জামায়াত কোরআন-হাদীস সকলে বুঝে পড়াকে আপত্তিকর বিবেচনা করে কিছু ইসলামী ব্যক্তিত্ব বা সংগঠন জামায়াতে ইসলামীকে অনুসরণ করে বর্তমানে কোরআন-হাদীসের সহজ ব্যাখ্যাগ্রন্থ চালু করেছে মাত্র

২১জামায়াতে ইসলামী শিরক-বিদায়াত বিরোধীকিন্তু বাংলাদেশে কিছু ইসলামী গ্রুপ আছে যাদের মধ্যে শিরক-বিদায়াতের প্রাধান্য রয়েছে

২২জামায়াতে ইসলামী সিরাতুন্নবী (সা:) মাহফিল করে থাকে এবং শিরকী-বিদয়াতী আকিদা ও আমল থেকে মুক্ত অবস্থায় মিলাদুন্নবী(সা:) উৎযাপনকেও সমর্থন করে কিন্তু একদিকে মিলদুন্নবী(সা:) উৎযাপনের বিরোধীতাঅন্যদিকে মিলাদুন্নবী(সা:)কে ইসলামের প্রধানতম আমল ও ধর্মীয় উৎসব (ঈদেপরিণত করার প্রচেষ্টা - এই উভয় বাড়াবাড়ির মাঝখানে জামায়াতে ইসলামী সঠিক অবস্থানে রয়েছে

২৩আদালতে সাহাবার বিষয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকায়েদের কিতাব বর্ণিত আকীদায় জামায়াতে ইসলামী বিশ্বাসী। জামায়াতে ইসলামী দ্ব্যর্থহীনভাবে বিশ্বাস করে যেসাহাবায়ে কেরাম (রা:) নবী করিম (সা: )-এর আনুগত্যের একমাত্র আদর্শ নমুনা এবং ইজমায়ে সাহাবা শরীয়তের অকাট্য দলিল জামায়তে ইসলামীর বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে সাহাবায়ে কেরামের সত্যনিষ্ঠ ও সংগ্রামী জীবনধারা দৃষ্টান্ত হিসাবে তুলে ধরে তার আলোকে কর্মীদের গড়ে তোলা হয় সাহাবায়ে কেরামের জীবনী জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের অবশ্য পাঠ্যযেমন-আবদুল মাবুদের লিখিত কয়েক খন্ডে বিভক্ত `সহাবে রাছুলের জীবনকথা' গ্রন্থ এভাবে জামায়াতে ইসলামীর সামগ্রিক কর্মকান্ডে সাহাবায়ে কেরামের জীবনাদর্শের ব্যাপকচর্চা ও অনুশীলন রয়েছে কিন্তু অন্যান্য ইসলামী সংগঠনে সাহাবায়ে কেরামের জীবনাদর্শের এ ধরণের ব্যাপক চর্চা নাই। অনেক ইসলামী সংগঠনে পরবর্তী কালের কোন কোন ইসলামী ব্যক্তিত্ব বা পীর-অলির জীবনীচর্চাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। সাহাবাদের অতিভক্তি শুধু তাদের মুখে মুখেই, বাস্তবে খুঁজে পাওয়া দুরূহ। সাহাবাদের মত ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গ করার আকীদা ও আমল জামাযাতে ইসলামী ও এর সহযোগী সকল সংগঠনেই ব্যাপক দেখা যায়। 


২৪. একজন কওমী আলেম মাওলানা মাসউদুর রহমানের ভাষায়: “জামায়াতে ইসলামী পুরোপুরি নবী-আসহাবদের নকশায়ে কদম অনুসরণ করে চলেছেন অর্থাৎ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের স্ট্রাকচারে গড়া উঠা একটি বিজ্ঞানভিত্তিক দল, এখানে আকিদাগত কোন খোরাফাত বা ভেজাল নেই। আপনি যদি অন্যান্য ইসলামী দল গুলো নিয়ে তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ করেন, তাহলে দেখবেন কিছু না কিছু আকিদা ও কর্মগত দিক থেকে ঝামেলা রয়েছে, কিন্তু জামায়াত সম্পূর্ণ আকিদা শুদ্ধ একটি দল।” অন্য কিছু ইসলামী দলের আকীদা ও আমলের মধ্যে প্রচুর শিরক, কুফর ও মোনাফেকী দেখা যায়। তারা যখন জামায়াতের আকীদা খারাপের কথা বলে তখন এই প্রবাদটা মনে আসে: চালুনী বলে সূচেরে, তোর গায়ে ছেদা। 

২৫বৃহত্তর ইসলামী ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী সবসময় অগ্রগামী সংগঠন,  কিন্তু অন্যান্য ইসলামী দলের ভূমিকা এক্ষেত্রে অনেক সময় আপত্তিজনক

২৬ইসলামী জাতীয়তা ভ্রাতৃত্বের চেতনা বিশ্ব মুসলিম ঐক্যের এবং শক্তিমত্তার অন্যতম প্রধান উৎস বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মুসলিম জাতীয়তার চেতনা এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রধানতম অবলম্বন এবং হাতিয়ার জামায়াতে ইসলামীর দলীয় আদর্শ ও তৎপরতায় এবং নেতা-কর্মীদের মধ্যে ইসলামী জাতীয়তা-ভ্রাতৃত্বের চেতনায় উজ্জীবন অন্যান্য ইসলামী সংগঠনের তুলনায় উত্তমভাবে প্রকাশিত হয় এক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী ঐতিহাসিক প্রমাণ রেখেছে

২৭জামায়াতে ইসলামীতে আধুনিক শিক্ষিত ও ধর্মীয় শিক্ষিতদের সুষম সমন্বয় রয়েছেকিন্তু অন্যান্য ইসলামী সংগঠনের সেরূপ নাই

২৮আধুনিক যুগে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতা সৃষ্টির কার্যক্রম জামায়াতে ইসলামীতে যথেষ্ঠ রয়েছেকিন্তু অন্যান্য ইসলামী দলে তা কমই রয়েছে

২৯জাতীয় সংসদের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হয় কাজেই ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্য লোকদেরকেই কোন ইসলামী দলের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী করা উচিত এক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী আপন সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় গড়ে তোলা যোগ্যলোকদের মধ্য থেকে বাছাই করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী করে থাকে যে কেউ প্রার্থিতা চেয়ে প্রার্থী হতে পারেনা কিন্তু অন্যান্য ইসলামী দলগুলো বাতিল দলগুলোর মত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য দরখাস্তের আহবান করে যেকোন ব্যক্তিকেই প্রার্থী করে দেয় অথবা যেকোন ব্যক্তি প্রার্থিতা চেয়ে প্রার্থী হয়ে যেতে পারে এক্ষেত্রে সে ব্যাক্তি ইসলামী চিন্তাচেতনা ও আমলের হতেও পারে অথবা না ও হতে পারে

৩০. রাছুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: “অচিরেই তোমরা নেতৃত্ব পদের অভিলাষী হয়ে পড়বে। আর কিয়ামতের দিন এটা তোমাদের জন্য লজ্জ্বা ও দুঃখের কারণ হবে” (আবু হুরাইরা -রাঃ  বর্ণিত, বুখারী শরীফ) নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইসলামের সাধারণ নীতি হলযে ব্যক্তি কোন পদের জন্য প্রার্থী হয় সে ব্যক্তি সে পদের অযোগ্য সাব্যস্ত হয় জামায়াতে ইসলামী এ নীতি অনুসরণ করে থাকে কিন্তু অন্যান্য ইসলামী দল এ নীতি মোটেও গুরুত্ব দেয়না অথবা যথাযথভাবে  পালন করে না

৩১জামায়াতে ইসলামী নীতিগতভাবে ব্যক্তি পূজায় বিশ্বাসী নয়,  কিন্তু অন্যান্য কিছু ইসলামী দল আছে যারা জাহেলিয়াত প্রভাবিত পীরবাদ অথবা অন্যকিছু সূত্রে ব্যক্তিপূজায় নিয়োজিত

৩২. জামায়াতে ইসলামী আন্তুর্জাতিক,  কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ময়দানে কার্যরত অন্যান্য ইসলামী দল পুরোপুরি তা নয়

 অতএব তুলনামুলক বিচারে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ উত্তম বিবেচিত হওয়ায় অধিকতর গ্রহণযোগ্য ইসলামী সংগঠন যেকোন আদর্শবাদী সংগঠনেই প্রতিকুল দোষত্রুটি অনুপ্রবেশ করতে পারে সুস্থ শরীরে রোগ হতে পারেসেজন্য প্রয়োজন যথোপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা অতএব গঠনমূলক ও নির্দেশমূলক সমালোচনার মাধ্যমে নিয়মিত দোষত্রুটি সংশোধনের প্রক্রিয়া বজায় রাখা এবং বিদ্যমান গুণাবলীর বিকাশ সাধন ও উন্নততর গুণাবলীর সমন্বয় সাধন করার প্রয়াস চালু রাখা উচিত এর পাশাপাশি দাওয়াত, সংগঠন ও প্রশিক্ষণশিক্ষা, মানবসেবা ও আয়-উন্নতিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে ব্যাপক শক্তি সঞ্চয় এবং গণমুখী তৎপরতার মাধ্যমে অগ্রসর হলে জামায়াতে ইসলামী আগামী দিনের ইসলামী আন্দোলনে অধিকতর অবদান রাখতে সক্ষম হবে ইনশাআল্লাহ  এখানে উল্লেখ্য যেযথার্থ আত্মমূল্যায়নের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীর মত আদর্শবাদী আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করা এবং বিরোধী ইসলামী দলের লোকদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার হ্রাস করা এই নিবন্ধের প্রধান উদ্দেশ্য

             বিশেষ দ্রষ্টব্যজামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে  বহু পূর্ব থেকে ভ্রান্ত প্রচারণা রয়েছে বাংলাদেশে একজন পীর বলছেনজামায়াতে ইসলামী ইসলামী দল নয়একটি রাজনৈতিক দল মাত্র এই আলোচনায় প্রতীয়মান হয়েছে যে,  জামায়াতে ইসলামী উত্তম ইসলামী সংগঠন অধিকন্তু গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণ করে সংশোধিত হওয়ার মতো উদারতা জামায়াতে ইসলামীর রয়েছে এবং জামায়াতে ইসলামী একটি জিহাদী-শহীদি কাফেলা অতএব ইসলামের পক্ষে কোন ক্ষতিকর কাজে জামায়াতে ইসলামী লিপ্ত থাকতে পারেনা জামায়াতে ইসলামী দ্বারা অতীতে বিশ্বব্যাপী ইসলামের বহুমূখী কল্যাণ সাধিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবেইনশাআল্লাহ অতএব যে সকল ইসলামী মহল কোন না  কোন কোন কারণে ইসলামের কোন ক্ষতির আশংকায় খুলুছিয়তের সাথে জামায়াতে ইসলামের বিরোধিতা করেন তারা নিঃসন্দেহে আশংকামুক্ত হয়ে এদলের সাথে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে পারেন এধরণের ঐক্য গঠনে রয়েছে অফুরন্ত কল্যাণ অন্যথায় জাতিকে ক্ষতির মুখে নিক্ষেপ করার ঐতিহাসিক দায় গ্রহণ করতে হবে এবং আলমে আখেরাতে কঠিন জবাবদিহি করতে হবে


Saturday, January 19, 2019

মুসলমানদের অবদান মাইনাস করলে ইউরোপীয় রেনেসাঁ থাকে না


আবুল আসাদ : সেই ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ক্লাসে প্রথম শুনি যে, ধর্ম আসলে জ্ঞান, গবেষণা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিরোধী। তারপর এই কথা নানাভাবে আরও অনেকের কাছে শুনেছি। লেখাপড়া যাদের মূর্খ বানিয়েছে, তারা সুযোগ পেলেই এখনও এসব কথা বলে থাকেন সুযোগ পেলেই। এদের রাগ ইসলামের উপরই বেশি। খ্রিস্টধর্ম প্রধানত পাশ্চাত্যের এবং হিন্দুধর্ম পশ্চিম থেকে আসা আর্যদের, তাই এসব ধর্ম তাদের কাছে প্রগতিশীল। কিন্তু মুসলিম দেশগুলো অনুন্নত ও দরিদ্র বলে ইসলামকেও ওরা জ্ঞান-বিজ্ঞান বিমুখ ও অনুন্নয়নের প্রতীক বলে চলছে। ইতিহাসের সাক্ষ্যও এটাই।  Prof. Joseph Hell বলেন, “মানব জাতির ইতিহাসে স্বীয় ছাপ মুদ্রিত করা সব ধর্মেরই প্রধান বৈশিষ্ট্য। .... কিন্তু ইসলাম যতটা দ্রুতবেগে ও অকপটভাবে বিশ্ব মানবের হৃদয় স্পর্শকারী মহা পরিবর্তন সাধন করেছে, জগতের অন্য কোন ধর্ম তা পারেনি।”১ এই কথায় আরও স্পষ্ট করে বলেছেন ঐতিহাসিক O.J.Thatcher Ph. D Ges F.Schwill Ph. D তাদের ইতিহাস গ্রন্থে, “পয়গম্বর মোহাম্মদের মৃত্যুর পর পাঁচশ বছর তাঁর অনুগামিরা এমন এক সভ্যতার পত্তন ঘটায় যা ইউরোপের সবকিছু থেকে বহুগুণ অগ্রগামী।২ আর Mayers তার Mediaeval and Modern History-তে বলেন, “সেখানে এমন এক সভ্যতার উত্থান ঘটে, দুনিয়া যা দেখেছে এমন সব কিছুকেই তা অতিক্রম করে যায়।”৩
সত্যই ইসলামের উত্থানের সাথে সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে এবং সভ্যতার গতিধারায় এক বিস্ময়কর পরিবর্তন সূচিত হয়। ইউরোপ যখন অজ্ঞতা, অশিক্ষা, কুসংস্কার ও স্বৈরাচারের গভীর ঘুমে অচেতন তখন এশিয়া আফ্রিকায় ইসলামের আলোকধারা জ্ঞান ও সভ্যতামন্ডিত নতুন এক বিশ্বের জন্ম দেয়। মানবাধিকার, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক সুবিচার ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়ন সবদিক থেকেই মানব জাতিকে ইসলাম এক অনন্য সভ্যতা দান করে। পাশ্চাত্যের ওরা এখন গণতন্ত্রের সাংঘাতিক প্রবক্তা সেজেছেন। আর ইসলামকে বলা হচ্ছে মানবতা বিরোধী, অসহিষ্ণু ইত্যাদি। এসব কথা বলার সময় তারা অতীতের দিকে তাকায় না এবং নিজের চেহারার উপর একবারও নজর ফেলে না। যে গ্রীক ও রোমান সভ্যতা আজকের পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি, সে সভ্যতায় গণতন্ত্রতো দূরের কথা কোনপ্রকার সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের কোন স্থান নেই। অভ্যন্তরীণভাবে তাদের নীতি ছিল ‘সারভাইভেল অব দ্য ফিটেস্ট’ এবং আন্তর্জাতিকভাবে তারা অনুসারী ছিল ‘মাইট ইজ রাইট’ এর। গ্রীকরা বলতো ‘যারা গ্রীক নয় তারা গ্রীকদের ক্রীতদাস হবে এটা প্রকৃতির ইচ্ছা।’ আর রোমানরা মনে করতো, তারাই পৃথিবীর মালিক, পৃথিবীর সব সম্পদ তাদের জন্যই। ইউরোপের এই অন্ধকার যুগে মানবাধিকার বলতে কোন ধারণার অস্তিত্ব ছিল না। পরাজিত ও ভাগ্যাহতদের নিহত হওয়া অথবা চিরতরে দাসত্বের নিগড়ে বন্দী হওয়াই ছিল ভবিতব্য। নারীদের অর্থনৈতিক ও অন্যবিধ অধিকার থাকা দূরের কথা তারা পূর্ণ মানুষ কিনা তাই নিয়ে ছিল বিতর্ক। শত্রু ও বাদী জাতীয় লোকদের কোন মানবিক অধিকার স্বীকৃত ছিল না। এই দুঃসহ অন্ধকার হতে ইসলাম মানুষকে মুক্ত করে, পৃথিবীকে নিয়ে আসে আইনের শাসনের আলোকে।
চৌদ্দশ বছর আগে ইসলাম ঘোষণা করে বংশ, বর্ণ, জাতি, দেশ নির্বিশেষে সব মানুষ সমান। এই নীতি হিসেবে ইসলাম সব মানুষকেই আইনের অধীনে নিয়ে এসেছে এবং মানুষকে রক্ষা করেছে যথেচ্ছার থেকে। শত্রু ও পরাজিত বন্দীদেরও ইসলাম মানুষ হিসেবে দেখতে বলে। কোন যুদ্ধবন্দীকে হত্যা করা ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে এবং তাদের সাথে মানবতাসুলভ মেহমানসুলভ ব্যবহার করতে বলেছে। নির্দেশ দেয়া হয়েছে বন্দীদের সুখাদ্য দিতে হবে, বন্দীদের উত্তাপ ও শৈত্য হতে রক্ষা করতে হবে, কোন কষ্ট অনুভব করলে তা দ্রুত দূর করতে হবে, বন্দীদের মধ্যে কোন মাতাকে তার সন্তান হতে, কোন আত্মীয়কে অন্য আত্মীয় হতে আলাদা করা যাবে না। বন্দীদের মান মর্যাদা রক্ষাসহ তাদের কাছ হতে জবরদস্তী কোন কাজ নেয়া যাবে না। যুদ্ধবন্দী সংক্রান্ত এই নীতিমালা ইসলাম দেয় ১৪শ বছর আগে, পাশ্চাত্য এই শিক্ষা আংশিকভাবে গ্রহণ করে মাত্র ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের এক প্রস্তাব আকারে। ইসলাম চৌদ্দশ’ বছর আগে বিধান দেয় যে, চিকিৎসা পুরোপুরি মানবীয় সেবা। চিকিৎসক ও সেবাদানকারীদের কোন অনিষ্ট করা যাবে না। ইসলামের এই শিক্ষা গ্রহণ করেই মাত্র ১৮৬৪ সালে রেডক্রস গঠনের মাধ্যমে চিকিৎসা সুযোগকে শত্রু মিত্র বিবেচনার উর্ধ্বে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। মানবতাবিরোধী দাস প্রথা বিলোপের ব্যবস্থা ইসলাম চৌদ্দশ’ বছর আগে করে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয় ১৮৬৩ সালে। ইসলামে পুরুষের মতই নারীশিক্ষা বাধ্যতামূলক। ইসলামের এই শিক্ষার পরও ১১শ’ বছর পর্যন্ত পাশ্চাত্য নারীদের শিক্ষার উপযুক্ত ভাবেনি। অবশেষে ১৮৩৫ সালে মার্কিন মেয়েরা প্রথম স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায়। আর নিজ নামে সম্পত্তি ভোগের অধিকার পায় ১৮৪৮ সালে। অথচ ইসলাম নারীদের এ অধিকার দেয় চৌদ্দশ’ বছর আগে। পাশ্চাত্য যেখানে ১৯৪৮ সালের জেনেভা কনভেনশনের আগ পর্যন্ত বিজিত দেশের মানুষকে দাস মনে করতো এবং এখনও লুটতরাজের যোগ্য মনে করে, সেখানে ইসলাম বিজিত দেশের মানুষকে সম্মানিত নাগরিক হিসেবে দেখে। খিলাফতে রাশেদার যুগে কোন নতুন ভূখন্ড মুসলমানদের দখলে এলে সেখানকার মানুষকে আর শত্রুর দৃষ্টিতে দেখা হতো না। মুক্ত মানুষ হিসেবে তাদের এ অধিকার দেয়া হতো যে, তারা একবছর সময়কালের মধ্যে যেন সিদ্ধান্ত নেয় যে. তারা পছন্দের কোন দেশে চলে যাবে, না মুসলিম দেশের নাগরিক হিসেবে বসবাস করবে।
মানবতাকে ইসলাম সম্মান করে বলেই ইসলাম ও মুসলমানরা সহিষ্ণুতার প্রতীক। একটা উদাহরণ এখানে যথেষ্ট। ক্রুসেডের যুদ্ধে খ্রিস্টানরা যখন মুসলমানদের হাত হতে জেরুজালেম দখল করে, তখন তারা ৭০ হাজার নাগরিককে হত্যা করে। আর মুসলমানরা যখন খ্রিস্টানদের হাত হতে জেরুজালেম উদ্ধার করে, তখন একজন খ্রিস্টানের গায়েও হাত দেয়া হয়নি। চৌদ্দশ’ বছর আগে ইসলাম যে বিচার ব্যবস্থা পত্তন করে, বিশ্ব সভ্যতায় তা অনন্য সংযোজন। ইসলামের বিচার ব্যবস্থায় মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য করা হয়নি। শুরু থেকেই ইসলাম শাসন ব্যবস্থা হতে বিচার বিভাগকে আলাদা করেছে। ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতিদের নিয়োগ করতেন, কিন্তু বিচারপতিরা শাসন কর্তৃত্বের অধিকারী হতেন না। ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধান কিংবা শাসনকর্তারা অভিযুক্ত হলে তারা সাধারণ আসামীদের মতই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচারের সম্মুখীন হতেন। অনেক মামলায় নিরপেক্ষ সাক্ষীর অভাবে খলিফারা হেরেছেন। এবং এই হেরে যাওয়াকে তারা মাথা পেতে নিয়েছেন।
মানবাধিকারের মত সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ইসলাম বিশ্ব সভ্যতায় এক অনন্য কল্যাণ ধারার সৃষ্টি করে। পাশ্চাত্য ব্যবস্থায় তখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ব্যক্তিস্বার্থ সমূহের পদতলে সামষ্টিক স্বার্থ নিক্ষেপ হতো। ইসলাম ব্যক্তি স্বার্থ ও সামষ্টিক স্বার্থ উভয়কেই সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করে এবং উভয়ের মধ্যে কল্যাণকর এক ভারসাম্য বিধান করে। সমাজের একক ইউনিট হিসেবে ইসলাম পরিবার ব্যবস্থাকে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। তারপর পরিচয় ও সহযোগিতার জন্য বংশ ও সামাজিকতাকে এবং শাসন ব্যবস্থার জন্য রাষ্ট্রকে গুরুত্বপূর্ণ আখ্যায়িত করেছে। আর অর্থনীতির ক্ষেত্রে অর্থনীতির বিতরণধর্মীতা ও পুঁজিগঠন উভয়কেই সমান গুরুত্ব দিয়েছে। তবে ইসলামে ম্যাক্রো অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মাইক্রো অর্থনীতি। ব্যক্তিগত বৈধ সম্পত্তির ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ ইসলাম করেনি, কিন্তু শর্ত দিয়েছে প্রতিবেশি কেউ যেন না খেয়ে না থাকে এবং সঞ্চয়ের বদলে সম্পদ যেন বিনিয়োগমুখী হয়। চৌদ্দশত বছর আগের ইসলামের এই অর্থনীতি আজকের আধুনিক অর্থনীতির চেয়েও আধুনিক ও কল্যাণকর।
সবশেষে আগে জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশ্ব সভ্যতায় ইসলামের অবদানের কথা। ইসলাম জ্ঞান ও যুক্তি নির্ভর ধর্ম বলেই জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইসলাম বিশ্বসভ্যতাকে নতুন সাজে সজ্জিত করেছে। খ্রিষ্টীয় এগার শতক হতে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত বিজ্ঞান চর্চার অপরাধে পাশ্চাত্য যেখানে ৩৫ হাজার মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, সেখানে অষ্টম শতক হতে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত কাল ছিল মুসলমানদের বিজ্ঞান চর্চা ও আবিষ্কারের স্বর্ণযুগ। বিজ্ঞানের ইতিহাসকার জর্জ মার্টন তাঁর পাঁচ খন্ডে সমাপ্ত বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিজ্ঞান ও আবিষ্কার ইসলামের অবদানকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন।৪ তাঁর এই ইতিহাস বলে, ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ হতে ১১০০ খ্রিস্টাব্দ-নিরবচ্ছিন্ন এই ৩৫০ বছর জ্ঞান বিজ্ঞানে মুসলমানদের চূড়ান্ত আধিপত্যের যুগ। এই সময় যেসব মুসলিম বিজ্ঞানী পৃথিবীকে আলোকিত করেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন জারীর, খাওয়ারিজম, রাজী, মাসুদী, ওয়াফা, বিরুনী, ইবনে সিনা, ইবনে আল হাইয়াম এবং ওমর খৈয়াম। এই বিজ্ঞানীরা যখন পৃথিবীকে আলো ছড়াচ্ছিল, তখন সে আলোতে স্নাত হচ্ছিল অন্ধকার ও ঘুমন্ত ইউরোপ। ইউরোপীয় ছাত্ররা তখন স্পেন ও বাগদাদের মুসলিম বিশ্ববিদ্যালগুলিতে মুসলিম বিজ্ঞানীদের পদতলে বসে জ্ঞান আহরণ করছিল। মুসলিম বিজ্ঞানীদের এই ইউরোপীয় ছাত্ররাই জ্ঞানের আলোক নিয়ে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এরই ফল হিসেবে ১১০০ খ্রিস্টাব্দের পর ইউরোপে ক্রিমোনার জেরার্ড, রজার বেকন এর মত বিজ্ঞানীদের নাম সামনে আসতে থাকে। বিজ্ঞানের ইতিহাসকার জর্জ মাটনের মতে ১১০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দুশ’ পঞ্চাশ বছরের এ সময়ে বিজ্ঞানে অবদান রাখার সম্মানটা মুসলমানরা ও ইউরোপ ভাগাভাগি করে নেয়। এই সময়ের মুসলিম বিজ্ঞানীদের মধ্যে রয়েছে নাসিরউদ্দীন তুসি, ইবনে রুশদ এবং ইবনে নাফিস এর মত বিজ্ঞানীরা। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দের পর মুসলমানদের বিজ্ঞান চর্চায় গৌরবময় সূর্য অস্তমিত হয় এবং পাশ্চাত্যের কাছে হারতে শুরু করে মুসলমানরা। অবশ্য এর পরেও মুসলমানদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক চমক কখনও কখনও দেখা গেলেও (যেমন ১৪৩৭ সালে সমরখন্দে আমির তাইমুর পৌত্র উলুগ বেগের দরবার এবং ১৭২০ সালে মোগল স¤্রাটের দরবারে জীজ মোহাম্মদ শাহীর সংকলন) তা ছিল খুবই ক্ষণস্থায়ী।
তবে বিজ্ঞানে ছয়শ’ বছরের যে মুসলিম অবদান তা ছিল আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি এবং বিজ্ঞান রেনেসাঁর জনক। মুসলমানরা ছিল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষারও জনক। ‘ইউরোপ যখন গির্জা ও মঠ ব্যতীত অপর সকল শিক্ষালয়ের কথা কল্পনাও করে নি, তার শত শত বছর আগে মুসলমানরা বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছিল, যেখানে হাজারো ছাত্র উন্নত পরিবেশে পাঠগ্রহণ করতো।’৫ গ্রন্থাগার ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নও ইসলামি সভ্যতার অবদান। মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল লাখো গ্রন্থে ঠাসা। ব্যক্তিগত লাইব্রেরীর তখন ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছিল। ঐতিহাসিক Dozy এর মতে স্পেনের আলমেরিয়ার ইবনে আব্বাসের ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে অসংখ্য পুস্তিকা ছাড়া শুধু গ্রন্থের সংখ্যাই ছিল ৪ লাখ।৬ এসব মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্রন্থাগারটি ছিল বিজ্ঞান চর্চা ও বৈজ্ঞানিক সৃষ্টির সুতিকাগৃহ।
বিজ্ঞানের সকল শাখাতেই ছিল মুসলমানদের গৌরবজনক বিচরণ। গণিত শাস্ত্রে রয়েছে মুসলমানদের মৌলিক অবদান। আমরা যে ৯ পর্যন্ত নয়টি সংখ্যা ব্যবহার করি, তার অস্তিত্ব আগে থেকেই ছিল। কিন্তু শূণ্য (Zero) এর বিষয়টি সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল। দ্বাদশ শতাব্দীতে মোহাম্মদ ইবনে মুসা সর্বপ্রথম ‘শূণ্য’ আবিষ্কার করেন। গণিত শাস্ত্রে ইনিই সর্বপ্রথম দশমিক বিন্দু (decimal notation) ব্যবহার করেন। সংখ্যার স্থানীয় মান (value of position) তারই আবিষ্কার। বীজগণিত বা ‘এলজেব্রা’ মুসলমানদের সৃষ্টি। মুসলিম গণিতজ্ঞ আল-জাবের এর নাম অনুসারে ‘এলজেব্রা’ নামকরণ হয়। শিঞ্জিনী (sine), সার্শ-জ্যা (tangent), প্রতি স্পর্শ ক্যক (co-tangent) প্রভৃতি আবিষ্কার করে বর্তুলাকার ক্রিকোণমিতির উন্নতি করেন মুসলিম বিজ্ঞানীরা। আলোক বিজ্ঞানে focus নির্ণয়, চশমা আবিষ্কার মুসলিম বিজ্ঞানী আল হাজানের কীর্তি। কিন্তু রজার বেকন এই আবিষ্কার পাশ্চাত্যে আমদানি করে নিজেই এর আবিষ্কারক সেজেছেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানে ‘মানমন্দির’ (observatory) ব্যবহার মুসলিম বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার। এর আগে মানমন্দির সম্পর্কে কোন ধারণা কারও ছিল না। গণনা দ্বারা রাশিচক্রের কোণ (angle of the ecliptic), সমরাত্রি দিনের প্রাগয়ণ (pre-cission of the equinoxes), Almanac (পঞ্জিকা), Azimuth (দিগন্তবৃত্ত), Zenith (মস্ত্রকোর্দ্ধ নভোবিন্দু), Nadir (অধঃস্থিত নভোবিন্দু) প্রভৃতির উদ্ভাবন মুসলিম বিজ্ঞানীদের কীর্তি। মুসলিম বিজ্ঞানীরাই চিকিৎসার বিজ্ঞানকে প্রকৃত বিজ্ঞানে রূপ দান করেন।৭ ইউরোপে যখন খ্রিস্টান গির্জা ঔষধের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে ধর্মানুষ্ঠান দ্বারা রোগের ব্যবস্থা নিতেন, তখন চিকিৎসা বিজ্ঞান মুসলমানদের হাতে এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানী আল রাজীর চিকিৎসা বিষয়ক ‘বিশ্বকোষ’ দশখন্ডে সমাপ্ত। এই চিকিৎসা বিশ্বকোষ ও ইবনে সিনা’র ব্যবস্থা ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য ছিল। বিজ্ঞানের অন্যতম শাখা কেমিষ্ট্রির নামকরণই হয় মুসলিম বিজ্ঞানী ‘আল কেমী’র নামানুসারে। কেমিষ্ট্রি এর সুবাসার (Alcohol), কাঠ ভস্ম ক্ষারের ধাতার্বকমুল (potassium), পারদবিশেষ (corrosive sublimate), কার্ষকি (Nitrate of silver), যবক্ষার দ্রাবক (Nitric Acid), গন্ধব দ্রাবক (Sulphuric Acid), জুলাপ (Julep), অন্তসার (Elixer), কর্পুর (Caurphar) এবং সোনামুখী (senna) প্রভৃতি মুসলিম বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার। ভূগোল শাস্ত্রে মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান অবিস্মরণীয়। ইউরোপ যখন মনে করতো পৃথিবী সমতল, তখন বাগদাদে গোলাকার পৃথিবীর পরিধি নির্ণিত হয়েছিল। চন্দ্র যে সূর্যের আলোকে আলোকিত হয়, একথা মুসলিম বিজ্ঞানীরা জানতেন। মুসলিম বিজ্ঞানীরাই চন্দ্র, সূর্য ও অন্যান্য গ্রহের কক্ষ নির্ধারণ করেন। অতি গুরুত্বপূর্ণ কম্পাস যন্ত্র মুসলিম বিজ্ঞানীর আবিষ্কার। মুসলমানরা নকশার বৈচিত্র্য ও সৌন্দয এবং শিল্প কৌশলের পূর্ণতা বিধানে ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, পিতল, লৌহ, ইস্পাত প্রভৃতির কাজে তারা ছিল দক্ষ। বস্ত্র শিল্পে এখনো মুসলমানদের কেউ অতিক্রম করতে পারেনি। উত্তম কাঁচ, কালী, মাটির পাত্র, নানা প্রকার উৎকৃষ্ট কাগজ প্রস্তুত করা সহ রং পাকা করার কৌশল ও চর্ম সংস্কারের বহুবিধ পদ্ধতি সম্পর্কে মুসলিম কৌশলীরা ভালোভাবে অবহিত ছিলেন। তাদের এসব কাজ ইউরোপে খুব জনপ্রিয় ছিল। সিরাপ ও সুগন্ধি দ্রব্য তৈরিত মুসলমানদের ছিল একাধিপত্য। মুসলমানদের কৃষি পদ্ধতি ছিল খুবই উন্নত। তারা স্পেনে যে কৃষি পদ্ধতির প্রচলন করেন, ইউরোপের জন্য তা তখনও বিস্ময়। পানি সেচ পদ্ধতি তাদের উৎকৃষ্ট ছিল। মাটির গুণাগুণ বিচার করে তারা ফসল বপণ করতেন। সারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তারা জানতেন। ‘কলম’ করার ও নানা প্রকার ফল-ফুলের উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবনে তারা ছিলেন খুবই অভিজ্ঞ।
বহু শতাব্দী পর্যন্ত মুসলমানরা বাণিজ্য জগতের ছিল একচ্ছত্র সম্রাট। নৌ যুদ্ধে তারা ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তারা ছিলেন অতুলনীয় সমুদ্রচারী। তাদের জাহাজ ভূমধ্যসাগার, আটলান্টিক মহাসাগর, ভারত সাগর ও চীন সাগরে এককভাবে চষে ফিরত। মুসলিম নাবিকদের ছাত্র হিসেবেই ইউরোপীয়রা গভীর সমুদ্রে প্রথম পদচারণা করে। ভন ক্রেমার বলেন, আরব নৌবহর ছিল বহু বিষয়ে খৃস্টানদের আদর্শ।’ মুসলমানদের যুদ্ধ পদ্ধতি ও যুদ্ধ বিদ্যাও ইউরোপকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। ইউরোপের Chivalry স্পেনীয় মুসলিম বাহিনীর অনুকরণ।
মোট কথা, বলা যায়, মুসলমান ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রসহ জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখায় যে অবদান রাখেন, তা এক নতুন সভ্যতার জন্ম দেয়, বিশ্ব সভ্যতাকে করে নতুন এক রূপে রূপময় যা চিন্তা, চেতনা, আচার আচরণ, জীবন যাপন, জীবনাপোকরণ সব দিক দিয়েই আধুনিক। ১৩৫০ খৃস্টাব্দে সভ্যতার নতুন এই উত্থান যাত্রা থেমে না গেলে আরও কয়েকশ’ বছর আগেই বিশ্ব আধুনিক বিজ্ঞান যুগে প্রবেশ করতো। কিন্তু তা হয়নি। না হলেও তাদেরই ছাত্র ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা আরও কয়েকশ বছর পরে হলেও মুসলমানদের কাজ সম্পন্ন করেছে। ইসলামি সভ্যতাকে বাদ দিলে বা মুসলমানদের অবদান মাইনাস করলে ইউরোপীয় রেনেসাঁ আর থাকে না, তার সভ্যতাও অন্ধকারে তলিয়ে যায়।
লিওনার্দো এজন্যই লিখেছেন, “আরবদের মধ্যে উচ্চ শ্রেণীর সভ্যতা, জ্ঞানচর্চা, সামাজিক ও মানসিক সমৃদ্ধি এবং অভ্রান্ত শিক্ষা প্রথা বিদ্যমান না থাকলে ইউরোপকে আজও অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমগ্ন থাকতে হতো।”৯

রেফারেন্স :
১। S. Khuda Bakhsh. M.A. BCL. Bar-at-Law প্রণীত Arab civiliztion  গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ. ১৬
২। ‘A general History of Europe, Vol-1, Page-172
৩। Mayers, `Mediaeval and Modern History’ Page-54
৪। নোবেল বিজ্ঞানী আবদুস সালাম’-এর Ideas and Realities’ গ্রন্থে উদ্ধৃত (বাংলা অনুবাদ : ‘আদর্শ ও বাস্তবতা’, পৃষ্ঠা-২৬৮
৫। Mayers, `Mediaeval and Modern History’ Page-56
৬। Dozy, Spanish Islam’, Page-610
৭। Thateher, Ph. D and F.Schwill Ph.D, `A General History Europe’, Vol-1, Page 173
৮। Von Kremer  এই উক্তি S.Khuda Bakhsh  এর Arab civilization’ এর Page, 72
৯। Thateher, and F. Schwill, `A General History of Europe’, Vol-1, Page 174-188
Source: http://www.dailysangram.com

Thursday, January 17, 2019

সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ.) ও জামায়াতে ইসলামী

- কাজী হোসাইন আহমদ
[সাবেক আমীর, জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান]

মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ.) ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ সালে ভারতের হায়দরাবাদ দাক্ষিণাত্যের শহর আওরঙ্গাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন নিজ জীবনকালের এক মহান ব্যক্তিত্ব। তার অন্তর ছিল আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের যথার্থ ভালবাসা, মুসলিম উম্মাহর দরদ এবং গোটা মানবজাতির কল্যাণকামিতার চেতনায় পরিপূর্ণ। মাওলানা মওদূদী (রহ.) তার রচিত বহুমূখী জ্ঞানে সমৃদ্ধ গ্রন্থাবী ছাড়াও যেই মহামূল্যবান ‘উত্তরাধিকার' সম্পদ এ পৃথিবীতে রেখে গেছেন, তা হচ্ছে তারই প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ‘জামায়াতে ইসলামী'।
২৬ আগস্ট ১৯৪১ সাল। পাক-ভারত বাংলা তথা গোটা হিমালয়ান উপমহাদেশের কিছু বিশিষ্ট লোক, যারা আগে থেকেই মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ.)-এর অতীব জ্ঞানগর্ভ লেখায় প্রভাবিত ছিলেন এবং তার সম্পাদনাধীন মাসিক ‘তারজুমানুল কুরআন'-এর মাধ্যমে তার চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গি  এ ব্যক্তিত্বের চারিত্রিক গুণাবলী সম্পর্কে ছিলেন পূর্ণ অবহিত, তারই আহবানে তারা লাহোরে সমবেত হন। ঐ সভাতেই ‘জামায়াতে ইসলামী' নামক একটি ছোট্ট সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। কয়েক বছর ধরে মওলানা মওদূদীর ব্যক্তিগত বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বেই দলটি চলতে থাকে।
তখন খোদ বিশ্বকবি আল্লামা ইকবালের পরামর্শ ও এই সংগঠনের চালিকা শক্তিরূপে কাজ করে। মওলানা মওদূদী (রহ.) এবং কবি আল্লামা ইকবালের মধ্যে কি গভীর সম্পর্ক ছিল এ থেকেই তা অনুমেয় যে, জামায়াতে ইসলামীর প্রথম কেন্দ্রটি পূর্ব পাঞ্জাবের পাঠানকোট সংলগ্ন ‘দারুল ইসলাম' নামক একটি বস্তি এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। মওলানা মওদূদীই জামায়াতের কেন্দ্রীয় অফিসের জন্যে দারুল ইসলামকে বেছে নেন। দারুল ইসলামের এ ভূমিটি ছিল পাঞ্জাবের জনৈক জমিদার মরহুম চৌধুরী নিয়াজ আলীর তিনি আল্লামা ইকবালকে এই লক্ষ্যে কমিটি প্রদান করেছিলেন, যেন কবি ইসলামী কর্মকান্ডের প্রধান কেন্দ্র হিসাবে তা ব্যবহার করেন। আল্লামা ইকবাল মাওলানা মওদূদীকে (রহ.) এই মর্মে আহবান জানালেন, তিনি যেন এখানে একটি ইসলামী কেন্দ্র স্থাপন করেন। ব্যাপারটি এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা, যা কারোর অস্বীকার করার উপায় নেই। শুধু তাই নয়, এ ঐতিহাসিক বাস্তবতা দ্বারা ঐ সকল অভিযোগের অসারতা প্রমাণ হয়ে যায়, যা মাওলানা মওদূদী সম্পর্কে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রশ্নে বিরোধিতার অন্যায় অভিযোগ তোলা হয়েছিল। পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা আল্লামা ইকবাল (রহ.) নিজেই গোটা হিমালয়ান উপমহাদেশে মাওলানা মওদূদীকে (রহ.) এরূপ যোগ্য মনে করেছেন যে, তিনিই উক্ত দারুল ইসলামে ইসলামী প্রচার কেন্দ্রের ভিত্তি স্থাপনের যোগ্য ব্যক্তিত্ব। যেখান থেকে উপমহাদেশের মুসলমানরা সার্থক নেতৃত্ব পেতে পারে।
জামায়াতে ইসলামী সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা কেন হয়েছিল? এর কী প্রয়োজন ছিল? যেখানে ঐ সময় আগে থেকেই মুসলিম লীগ এবং মুসলমানদের অন্যান্য দল বিদ্যমান ছিল? মাওলানা সায়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ.) এমন কোন ব্যক্তি ছিলেন না যে, শুধু একটি আনুসাঙ্গিক দল সৃষ্টির জন্যে অথবা নিজ নেতৃত্বের জৌলূস দেখাবার উদ্দেশ্যে কোন নতুন দল গঠনের তার প্রয়োজন ছিল। তিনি তার মাসিক গবেষণাধর্মী ম্যাগাজিন ‘তার জুমামুল কোরআন'-এ বিস্তারিতভাবে সেসব কারণ বর্ণনা করেছিলেন যার ফলে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন। মূলত যেই লক্ষ্যণীয় আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সাঃ) নিজ সাহাবীদের সমন্বয়ে সংগঠিত হয়েছিলেন, সেই লক্ষ্য হাসিলের উপযোগী ও সেই কর্মপদ্ধতির অনুসরণের জন্যেই তিনি একটি নতুন দলের চিন্তা করেন। তারই মহানবীর নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছেন মানব ইতিহাসের এক সর্বাত্মক বিপ্লব মানবের সার্বিক কল্যাণের দিক যার সাথে পৃথিবীতে সংঘটিত আর কোনো বিপ্লবেরই তুলনা চলে না।
কোরআন ও হাদীসে বর্ণিত উদ্দেশ্য লক্ষ্য অর্জনের জন্য তখন মহানবী (সঃ) কর্তৃক মনোনীত কর্মপদ্ধতি অনুযায়ী কাজ করার জন্য একটি দলের প্রয়োজন ছিল। হাদীস শরীফে রয়েছে যে, শেষ যুগেও মুসলিম উম্মাহর সংশোধন ঐ কর্মপদ্ধতিতেই হবে, ইসলামের শুরুতে যেই পদ্ধতিতে এই জাতির সংশোধনের সূচনা হয়েছিল। মহানবী (সঃ) যেসব সুমহান লক্ষ্যে এবং যেই কর্মপদ্ধতির ভিত্তিতে মুসলিম দল গঠন করেছিলেন আজও সেই উদ্দেশ্য লক্ষ্য অর্জন এবং এই জাতির সংশোধন সেই কর্মপদ্ধতিতেই সম্ভব-- অন্য কোনো কর্মপদ্ধতিতে নয়। আল্লাহ এবং তার রাসূল (সঃ) মুসলিম জাতির যেই দায়িত্ব কর্তব্য বর্ণনা করেছেন এই জন্যে এই জাতিকে পুনর্বার সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করা অপরিহার্য। আর এই জন্যে প্রয়োজন একটি সুসংগঠিত দলের মূলত মাওলানা মওদূদী (রঃ) জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা করার আগে কুরআন  ও সুন্নাহর আলোকে তারই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছিলেন একথাটি স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন যে, মাওলানা মওদূদী (রঃ) নিজের পক্ষ থেকে নতুন কোন ফেকাহ্ প্রদান করেননি, বরং কোরণ ও সুন্নাহর নির্দেশনার অধীনই মুসলিম জাতিকে এক সুমহান লক্ষ্যের অভীশারী করতে সচেষ্টা হয়েছেন।
গোটা হিমালয়ান উপমহাদেশ থেকে প্রথমে মাত্র ৭০/৭২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি সমবেত হয়েছিলেন। তাদের সকলেই তেমন বড় মাপের আলেম ছিলেন না। তবে তাদের মধ্যে এমন কয়েক জন দক্ষ ইসলামী জ্ঞান বিশেষজ্ঞ আলেম ছিলেন যারা ইল্ম ও তাকওয়ার দিক থেকে ছিলেন শীর্ষস্থানীয়। এদের মধ্যে ছিলেন কতিপয় যোগ্য ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তি। আর ছিলেন প্রচুর সাধারণ শিক্ষিত লোক। তাঁরা মাওলানা মওদূদীর লেখায় প্রভাবিত হয়ে এই জামায়াতে শরীক হয়েছিলেন কিন্তু স্বল্পসংখ্যক এই কতিপয় লোক যারা ছিলেন  দরিদ্র, অতি সামান্য মূলধন হাতে নিয়ে একটি নতুন দলের ভিত্তি স্থাপন করলেন। তারা নিজেদের পক্ষ থেকে এই দলটির জন্য কোনো আকীদা বিশ্বাস ও লক্ষ্য উদ্দেশ্য পেশ করেননি। বরং কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে দলটির আকীদা-বিশ্বাস ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারণ করেন, যা জামায়াতে ইসলামী গঠনতন্ত্রে পূর্ণ ব্যাখ্যা সহকারে বর্ণিত হয়েছে। তা হচ্ছে-- ‘‘আমাদের আকীদা হলো : লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোনো ‘ইলাহ' নেই। মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসূল)। এটি হচ্ছে সেই আকীদা বিশ্বাস যা বিশ্বজাহানের প্রতিপালক খোদ আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন এবং মহানবী (সাঃ) নিজ উম্মতের প্রতিটি ব্যক্তিকে এর শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। মওলানা মওদূদী (রহ.) তার নিকট আকীদা বিশ্বাসের ব্যাপারে সে কথাই জানিয়েছেন যে কথার ওপর গোটা মুসলিম জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা যেতে পারে। এটা কারও পক্ষেই অস্বীকারের উপায় নেই যে, মুসলিম জাতির মৌলিক আকীদা বিশ্বাস হচ্ছে একমাত্র লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)। যার ভিত্তিতে গোটা মুসলিম জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা যেতে পারে। এর সেই ব্যাখ্যাই সঠিক ও নির্ভরযোগ্য যা পবিত্র কুরআনে বিদফোন : ০১৭১৫৮১৯টি উপেক্ষা করে মনগড়া ব্যাখ্যা দিতে গেলেই ইখতেলাফ ও মতবিরোধী দেখা দেয়। কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক আকীদা-বিশ্বাসের বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দানের সঙ্গে সঙ্গে মাওলানা মওদূদী (রহ.) জামায়াতে ইসলামীর প্রকৃত লক্ষ্য উদ্দেশ্য কি তাও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন শব্দে বর্ণনা করেছেন যে, আমাদের উদ্দেশ্য লক্ষ্য হচ্ছে একমাত্র বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। আমাদের সকল কর্মপ্রচেষ্টা এ জন্যেই নিবেদিত যেন আল্লাহ আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন এবং আখেরাতে মুক্তি ও সফলতা আমাদের ভাগ্যে জুটে। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখেরাতে মুক্তি লাভের জন্যে সেই কর্মপদ্ধতিই সকলের গ্রহণ করা কর্তব্য, মহানবী (সা.) যেই কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন। জামায়াতে ইসলামী সেই কর্মপদ্ধতি এভাবে স্পষ্ট ভাষায় চিহ্নিত করেছে যে, মানুষকে একমাত্র আল্লাহর দিকেই দাওযাত দিবে, শুধু তাঁর দিকেই সকলকে আহবান জানাবে। মাওলানা মওদূদী (রহ.) এবং জামায়াতে ইসলামী কিংবা অপর কোনো দল, দলনেতা অথবা কোনো ব্যক্তিত্বের দিকে কখনও জানাবে না। পবিত্র কুরআনও এই কর্মপদ্ধতিকে সঠিক আখ্যায়িত করে স্বল্পশব্দে বলে দিয়েছে,-
কুল্ হাযিহী সাবীলী, উদঊ ইলাল্লাহে আলা বাসীরাতি আনা ও মানিত্তাবাআনী (অর্থাৎ হে নবী; আপনি জানিয়ে দিন যে, আমার পথ তো এটাই যে, আমি আল্লাহর দিকে মানুষকে দাওয়াত দেই। আমি এবং আমার অনুসরণকারীরা পূর্ণ আলোতে নিজ রাস্তা দেখতে পাচ্ছে। (সূরা ইউসুফ : আয়াত ১০৮)
আমরা মৌলিকভাবেই আল্লাহর প্রতি মানুষকে দাওয়াত দেয়ার লক্ষ্যেই এই জামায়াত গঠন করেছি। শুধু একটি জামায়াত বা দল গঠনই উদ্দেশ্য নয় বরং এটি আল্লাহর প্রতি মানুষকে ডাকার আসল উদ্দেশ্যের একটি মাধ্যম মাত্র।
এ নিয়ে ওলামা-এ-কেরামের মধ্যে বহু বাহাস-গবেষণা হয়েছে যে, আল্লাহর প্রতি মানুষকে দাওযাত দানের জন্যে কোনো জামায়াত বা দল গঠন বৈধ অথবা উম্মতের প্রতিটি মানুষ ব্যক্তিগতভাবে এ কাজ সম্পাদন করবে? অবশেষে তারা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, কোনো একটি দল সংগঠিত করা ছাড়া এ মহান লক্ষ্যের দাওয়াতী কাজ কার্যকর হবে না। সুতরাং এ জন্যে একটি দল সংগঠন কারা অত্যাবশ্যক। তবে সঙ্গে সঙ্গে একথাও স্পষ্ট ভাষায় বলে দেয়া হয় যে, আল্লাহর প্রতি মানুষকে দাওয়াত দানের লক্ষ্যে গঠিত কোনো জামায়াত বা দল এ দাবি করতে পারবে না যে, তাতে যেসব লোক শামিল না হবে, তারা গোমরাহ বা পথহারা। কেননা, কোনো সংগঠিত দল বা জামায়াতের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি মানুষকে দাওয়াত দেয়াটা, মহানবী (সা.) এরই পদ্ধতি। সুতরাং এই পদ্ধতিতে জাতিকে সংশোধন ও পরিশুদ্ধ করার জন্যে আমরা জামায়াত আকারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। যাদের সুযোগ হয় এবং এ পদ্ধতি যারা পছন্দ করে, তারা আমাদের সঙ্গে মিশে কাজ করতে পারেন। যারা আমাদের সাথে মিলে কাজ করতে অনিচ্ছুক তাদের কর্তব্য হলো, এ মহান কাজ সম্পাদনকল্পে, তারা সম্মিলিতভাবে সংগঠিত হোন। নবী মুহাম্মদ (সা.) ছাড়া অপর কেউ এই দাবি করতে পারবে না যে, যারা আমার অনুসরণ না করে, তারা গোমরাহ পথভ্রষ্ট। একমাত্র আল্লাহর কোনো নবীই একথা বলতে পারেন। শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর পর আর কোনো নবী আসবেন না। তিনিই খাতামুন্নাবীঈন। অপর কোনো জাতিও এ দাবি করতে পারবে না যে, তাদের সঙ্গে মিলে কাজ করতে অস্বীকারকারীরা পথভ্রষ্ট-গোমরাহ। মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ.) নতুন কোনো ধর্ম প্রবর্তন করেননি। তেমনি এটা কোনো নতুন দল বা ফেরকাও নয়। এ জামায়াত কখনও মানুষকে একথাও বলেনি যে, আমাদের সঙ্গে যারা না আসবে, তারা গোমরাহ ভ্রান্ত।
জামায়াতে ইসলামী কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা আদর্শমাফিক যেই আকীদা-বিশ্বাস, উদ্দেশ্য-লক্ষ্য কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করেছে, এগুলোর ভিত্তিতেই দলটি মানুষকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়। যারা এ দাওয়াত গ্রহণ করে মহানবী (সা.)-এর অনুসৃত নীতি অনুসারে জামায়াত তাদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও কর্মপদ্ধতিগত প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এভাবে তাদেরকে আত্মশুদ্ধি, আল্লাহপ্রীতির প্রশিক্ষণ দিয়ে জামায়াত তাদের অন্তর থেকে নেফাক তথা দ্বিমুখী নীতি, কর্ম বৈপরীত্ব ও চিন্তার বৈষম্য দূর করে। তাদের মধ্যে ইসলামের কাক্মিখত মানবের গুণাবলী সৃষ্টির চেষ্টা করে।
এ পদ্ধতিতে তাদের চিন্তা, মনন ও চরিত্র গঠনের কাজ সমাপ্তির পর তাদেরকে এমন এক সুসংগঠিত ও দলভুক্ত করে, যে দলটি উল্লেখিত মানদন্ডে সমাজ সংস্কার ও সংশোধনে তৎপর হয়ে ওঠে। এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সুসংগঠিত দলটির মাধ্যমেই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এবং চেষ্টা সাধনা অব্যাহত রেখে আসছে।
উদ্দেশ্য, যাতে সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব কর্তৃত্ব কোনো অসৎ নেতৃত্বের হাতে না গিয়ে সৎ নেতৃত্বের হাতে যায়। কারণ অসৎ নেতৃত্বে শোষণ, জুলুম-নিপীড়নে মানুষ একদিকে যেমন বৈষয়িক শান্তি-সুখ, নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হয়, অপরদিকে পরজীবনের মুক্তি ও কল্যাণের পথ থেকেও তারা বিচ্যুত হয়ে পড়ে। মহানবী (সা.) মদীনা কেন্দ্রিক একটি ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঐ রাষ্ট্রকে তিনি সংশোধনও করেছেন। ক্ষমতায় সমাসীন অযোগ্য অসৎ নেতৃত্ব অপসারণ করে তিনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, সৎ, খোদাভীরু যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী ((রহ.) মুসলিম জাতির মধ্যে ঐক্য-সংহতি প্রতিষ্ঠায় সকল সময় সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর এই আহবানে সাড়া দিয়ে যারা তাঁর সঙ্গে এসে এ মহান কাজে শরীক হননি, তিনি তাদের ব্যাপারে কখনও একথা বলেননি যে, তারা ভ্রান্ত পথের অনুসারী। জাতিকে সুমহান লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে জামায়াত একটি আন্দোলন, যেই আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন মাওলানা মওদূদী (রহ.)। জামায়াতে ইসলামী যদি কোনো একটি সম্প্রদায় হতো আজ আমরা কুরআন-সুন্নাহ ছেড়ে বিশেষ কোনো মতানুসারী হতাম, তাহলে জাতীয় ঐক্য-সংহতি বিধানে কোনোই অবদান রাখতে পারতাম না। এই খেদমতটি এ জন্যেই সম্পন্ন হবার যোগ্য যে, আমরা কুরআন ও সুন্নাহ ছাড়া কোনো মতবিশেষের সঙ্গে নিজেকে জড়িত করিনি।
এ সময় মুসলিম উম্মাহর সামনে যেই চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান তা হলো, আমেরিকা গোটা মুসলিম জাহানের বিরুদ্ধে এক অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করেছে। সে বিশ্ব এবং বিশ্ববাসীর উপর নিজের ইচ্ছা আধিপত্য ও শোষণমূলক ব্যবস্থা চাপিয়ে দিতে চায়। তার পাল্টা মুসলমানদের কাছে রয়েছে, আল্লাহ প্রদত্ত ইসলামী কল্যাণধর্মী জীবন ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া অপরিহার্য। এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণের জন্য মুসলিম উম্মাহর একনিষ্ঠ ও ঐক্যবদ্ধ হওয়া সময়ের মস্ত বড় দাবি। জামায়াতে ইসলামী এই ঐক্যেরই আহবায়ক। এ জন্যেই জামায়াত নিজেকে কোনো বিশেষ ধর্মীয় মত ও সম্প্রদায়ে পরিণত করেনি, যেন তারা জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে বরং এই উম্মতের মধ্য থেকেই মুসলমানদেরকে তওহীদের একই প্লাটফরমে সমবেত করে মহানবীর কর্মপদ্ধতি মোতাবেক তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহবানের কাজে ভুক্ত করতে সচেষ্ট, যেন ভূপৃষ্ঠ পুনরায় নবুওত পদ্ধতির খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, যেই খেলাফত তথা রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল আল্লাহর নবীর জীবদ্দশায়, ছিল সাহাবা-এ-কেরামের শাসনকালের সোনালী যুগে।
ভাষান্তরিতকরণ : জুলফিকার আহমদ কিসমতী
Source: www.dailysangram.com

Popular Posts