Tuesday, February 12, 2019

পশ্চিমা সাহিত্যে ধর্ম ও রসূল (স.) প্রসঙ্গ


আহমদ মনসুর :
পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় রসূলুল্লাহ (স.)-এর জীবনী রচিত হয়েছে, তাঁর জীবনের বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে প্রচুর লেখা হয়েছে। আমরা যখন আধুনিক বিজ্ঞান-দর্শন ও বিভিন্ন টেকনিক্যাল জ্ঞানের জন্য পশ্চিমা জ্ঞান - বিজ্ঞান মন্দিরে ধর্ণা দেই তখন আমাদের খেয়াল থাকে না যে, পশ্চিমা জগৎ আধ্যাত্মিক প্রশান্তি লাভের জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল। আমরা যখন সাহিত্যে নীতিবোধ বা ধর্মের উপস্থিতিকে সাহিত্য গুণের পরিপন্থী মনে করি তখন পশ্চিমা জগতের অনেক শীর্ষ স্থানীয় সাহিত্য- শিল্পী ধর্মকে সাহিত্যের কেন্দ্র শক্তি হিসেবে গ্রহণ করে তাদের সাহিত্য সম্ভার বিশ^কে উপহার দিয়ে থাকেন। তারা শুধু ধর্মের জয়গান গেয়েই থেমে থাকেন না বরং ইসলামের নবী প্রসঙ্গ নিয়ে সাহিত্য রচনা করে তৃপ্তি লাভ করে ধন্য হন। 
পশ্চিমা জগতের অনেকেই ধর্মাশ্রয়ী লেখক হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন। যেমন, সাহিত্যিক ঔপন্যাসিক জুলিয়াস গ্রিণ। ১৯০০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর প্যারিসে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর পিতা মাতা ছিলেন আমেরিকান, কিন্তু গ্রিন জীবনের বেশির ভাগ সময় ফ্রান্সে কাটিয়েছেন এবং প্যারিসকেই তিনি নিজের শহর বলে মনে করেছেন। 
জুলিয়াস গ্রিন শতাব্দীর তিন -চতুর্থাংশ সময় জুড়ে এমন এক বিশাল সাহিত্য জগত নির্মাণ করেছেন যার ব্যাপ্তি তলস্টয়-এর শিল্পকর্ম থেকে বিস্তৃত। টি, এস. ইলিয়ট, আন্দ্রেজিঁদ, ম্যালকম লাউরী, জর্জ অরওয়েল এবং রাইনের মারিয়া লিরকের মত বিশ্ব বিশ্রুত কবি সাহিত্যিকগণ গ্রিনের অনুরক্ত পাঠক।
 পারলৌকিক বিশ্বাস ছিল গ্রিনের জীবনের প্রধান অবলম্বন। আন্দ্রেজিঁদ ধর্মীয় গোড়ামীর অভিযোগ এনে গ্রিনকে প্রায়ই সমালোচনা করতেন। জিঁদের ধর্ম চেতনার সমালোচনা করে ম্যুরিয়াক লিখেছিলেন, তিনি শয়তানের পথ বেছে নিয়েছেন। এ মন্তব্যে গ্রিন মর্মাহত হয়ে তার জার্নালে লিখেছিলেন’। ‘অদৃষ্টের ব্যাপারে ম্যুরিয়াক কি জানেন? শেষ বিচারের মালিক তো একমাত্র আল্লাহ।’
গ্রিনের চিন্তার মধ্যে ধর্মের প্রগাঢ়তা কত গভীর ছিল তা তাঁর কয়েকটি বাণী থেকে উপলদ্ধি করা সম্ভব। যেমন তিনি বলেন, Faith means walkink in water-  বিশ্বাসের অর্থ হচ্ছে পানির উপর দিয়ে হেটে চলা। তিনি আল্লাহর রহমতের উপর বেশি আশা করে লিখেছেন, Even I go down as far as Hell, God’s arm is long enough to pull me up again - এমনকি আমি যদি জাহান্নামে নেমে যাই, স্রাষ্টার হাত এত দীর্ঘ যে, তিনি আমাকে আবার টেনে তুলবেন। 
আল্লাহর পথে মৃত্যুকেই ধর্মের সার বিবেচনা করে গ্রিন লিখেছন : To be ready to die, for some one, you have never seen, whose Voice you have never heard that is the whole of Christianity-
তুমি যাকে কখনো দেখনি, যার কথা কখনো শোননি তাঁর জন্য মরতে প্রস্তুত থাকাই হচ্ছে ধর্মের সার কথা। গ্রিনের এ কথার মধ্য দিয়ে ধর্মের প্রতি তাঁর গভীর আন্তরিকতা প্রকাশ পেয়েছে। 
গ্রিন যখন Christianity- এর জন্য মরণ বরণ করতে প্রস্তুত তখনই দেখতে পাই নোবেল বিজয়ী হোসে সারামাগোকে ধর্মের মূল কথাকে বিস্তৃতভাবে প্রকাশ করতে। পর্তুগালের দক্ষিণ অঞ্চলে ১৯২২ সনের ১৬ নভেম্বর এই ঔপন্যাসিক জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৮ সালে সারামাগো নোবেল সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং বিতর্কিত উপন্যাস হচ্ছেThe Gospel according to Jesus Christ (1991)। এই উপন্যাসে তিনি দেখিয়েছেন যে, অতি সাধারণ মানুষের ন্যায় আল্লাহ যীশু খৃষ্টকে বলেছেন যে, পৃথিবীতে তুমি একটি নতুন ধর্ম স্থাপন করবে কিংবা ঐ একই কথা, তোমার নামে তা স্থাপিত হবে। এবং হানাহানি অসহিষ্ণুতা হিংসা অর্থাৎ সব ধরনের অশ্রুরক্ত আত্মহুতির শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াবে ঐ ধর্ম। এ উপন্যাসের মূল চরিত্র পৃথিবীর সব দুঃখ দুর্দশা, অবিচার অনাচারের জন্য দোষী করা হয় স্রাষ্টাকে। ফলে পর্তুগালের রাজনীতিকরা এই বইয়ের প্রকাশনা ও বিক্রি বন্ধ করে দেন এবং European literary award for fiction এ এই বইয়ের নাম পাঠান থেকে বিরত থাকেন।
শুধু হোসে সারা মোগেই নন, এমন আরও দুই একজন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ধর্মের ব্যাপারে মানুষের ভক্তি ও বিশ্বাসকে নড়বড়ে করে তুলতে ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছেন। ২০০১ সালে  নোবেল সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত ভি. এস. নাইপল এ বিষয়ে কম পিছিয়ে নেই। তাঁর বিখ্যাত বই ‘বিয়ন্ড বিলিফ’ বইটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ‘ইসলামের কাছে নিজকে সঁপে দেয়ার মানে চরম নির্বুদ্ধিতা ’। তিনি নিজের শেকড়ের প্রতি অনুরক্ত থেকে লেগেছেন ইসলামের পেছনে। তিনি আবিস্কার করেছেন তৃতীয় বিশে^র অপরাপর সমস্যার চেয়ে বড় আপদ হচ্ছে ইসলাম। নাইপল উক্ত বইয়ে লেখেন, “পশ্চিম হচ্ছে জ্ঞান- বিজ্ঞান সমালোচনা, কারিগরী বিদ্যা, আর যাবতীয় হিতকর কেজো প্রতিষ্ঠানের আধার। আর ইসলাম হচ্ছে এর উপর ভয়ানকভাবে ক্ষিপ্ত আর নির্ভরশীল এক প্রতিবন্ধী, যে কিনা ক্রমশ নতুন আর অপ্রতিরোধ্য এক শক্তির অস্তিত্ব আঁচ করতে পারছে। পশ্চিমা বিশ্ব ইসলামকে কতই না ভালো জিনিস উপহার দিয়েছে। আর যারা ইসলামর কাছে নিজেদেরকে সঁপে দিয়েছিল তারা তা ভিতরের তাগিদ থেকে করেনি”। ইসলামের প্রতি এ ধরনের মন্তব্য নাইপলের বুদ্ধিবৃত্তিক বিপর্যয় ব্যতিত কিছু নয়। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এডওয়ার্ড সাইদ নাইপলের ‘বিয়ন্ড বিলিফ’ এর সমালোচনা করে যে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করেন তা শান্তিকামী ধর্মীয় বিশ্বাসে গভীর চিত্তের মানুষদের হৃদয়ে চিন্তার ঝড় তোলে। এডওয়ার্ড সাইদ বলেন, “বড় খেদের কথা হচ্ছে, ইসলামকে নিয়ে লেখা নাইপলের সর্বশেষ বইটিকে বৃহৎ একটি ধর্ম সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা বলে বিশ^াস করা হবে। এর ফলে আরো বেশি সংখ্যক মুসলমান দুর্ভোগ আর অপমানের শিকার হবেন। আর পশ্চিমা দুনিয়ার সঙ্গে তাদের ফারাকটা আরও বাড়বে ও গভীর হবে।”
ধর্মবোধ ও ইসলামকে যখন কোন কোন সাহিত্যিক এভাবে মানুষের জন্য বিকৃত বিশ্লেষণের মাধ্যমে হেয় প্রতিপন্ন করতে চান তখন আমরা দেখি কিছু কিছু সাহিত্যসেবী এহেন বিভ্রম এড়িয়ে কর্পুরধর্মী মেধা বর্জিত রস সম্ভোগ পরিত্যাগ করে ধর্মের সশ্রদ্ধ অধ্যয়নে লিপ্ত হন। ধর্ম পাঠে যারা মেধা সমৃদ্ধ তারাই ধর্মীয় ভাবধারায় সাহিত্যের একটা নতুন যুগ গড়ে তোলার প্রয়াসে সন্ধানশীল। এ সব সন্ধানশীল সাহিত্যিকগণ রসুলের জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছেন সহিত্য সৌধের উঁচু মিনার। 
আলোচনা করা যাক এজরা পাউন্ডের কথা। মার্কিন কবি এজরা পাউন্ড তাঁর বিরাট কাব্যগ্রন্থ, একটি মাত্র কবিতায় তিনি লিখেছেন আজীবন, সেটা হচ্ছে Cantoes মানে অংশ। সে দীর্ঘ কবিতাটি বর্তমান কালের একটি জীবন জিজ্ঞাসার প্রতিশ্রুতি। 
Thrones ক্যানটোজের একটি অধ্যায়। যেখানে তিনি একটি জায়গায় রসূলে খোদার উল্লেখ করে ইউরোপের লোকদেরকে বলেছেন, তোমরা তো সব সময় হাতই পাতলে এবং হাত পেতে কেবল গ্রাস করতে চাচ্ছ, গ্রহণ করতে চাচ্ছ, কিন্তু পৃথিবীতে এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি অনবরত দানই করেছেন। তিনি মানুষের কাছে কোন কিছু চাননি। রসূলে খোদা সম্পর্কে এই অসাধারণ উক্তি - এ নিয়ে কেউ কখনো আলোচনা করে না। Thrones -এর মধ্য্যে এ উক্তিটি যে আছে তাও অনেকে জানে না। বলার এক মাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে হবে।(১) 
সুইডেনের মনীষী লেখক জি. ওয়াইডেন গ্রেন তাঁর সদ্য প্রকাশিত ‘পয়গম্বরের স্বর্গারোহন ও স্বর্গীয় গ্রন্থ নামক গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, কয়েকজন পয়গম্বর তাঁদের নির্ধারিত কর্তব্য পালনের পর হয় একটি ঐশীগ্রন্থ কিংবা একটি ব্যবস্থাপত্র অথবা হজরত মুসার মতো কতগুলো বিধান- লিপি লাভ করেছেন। অবশ্য মুসলিম জাহানে রসূলুল্লাহর ‘মেরাজ’ -এর যে ভূমিকা, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর হার্টম্যান তাঁর এক গ্রন্থে প্রমাণ করেছেন, রহস্যবাদী ও কবি, উভয় শ্রেণীর লেখকদের রচিত কতিপয় গ্রন্থের যে বিষয় বস্তু, তার আদর্শ হচ্ছে রসূলুল্লাহর এই ‘মেরাজ।’ প-িত বুসেট এই সমস্যাটি নিয়ে বিশেষভাবে আলোচন্ করেছেন।(২)
পৃথিবীতে এমন কোন মানব নাই যাঁহার সাথে সর্বোত্তম ব্যক্তিত্ব রসূলুল্লাহর তুলনা হইতে পারে।
...উইনউড্ বলিয়াছেন, “মুহম্মদ (স.) অধিক করেন নাই বলিয়া দুঃখ না করিয়া আমাদের উচিত তিনি যে এত করিয়াছেন তাহার জন্য অবাক হওয়া। ইতিহাসের উপর ব্যক্তি বিশেষের প্রভাবের উদাহরণ হিসাবে তাঁহার জীবন হইল যোগ্যতম উদাহরণ। এই একক ব্যক্তি তাঁহার জাতিকে গৌরাবান্বিত করিয়াছেন, অর্ধেক পৃথিবী জুড়ে তাঁহার ভাষা ব্যাপ্ত করিয়াছেন। বারো শত বৎসর পূর্বে ব্যঙ্গ বিদ্রুপের মুখে তিনি মানুষের কাছে যে বাণী প্রচার করিয়াছেন, আজ তাহাই লন্ডনে, প্যারিসে, বার্লিনে, মক্কায় -যেখানে তিনি কাজ করিয়াছেন, মদীনায়- যেখানে তিনি ইন্তেকাল করিয়াছেন, কনস্ট্যান্টিনোপলে, কায়রোতে, ফেজে টিমবুকটুতে, জেরুজালেমে, দামেস্কে, বসরায়, বাগদাদে, বোখারায়, কাবুলে, কলিকাতায়, পিকিং-এ, মধ্য-এশিয়ার উচ্চ ভূমিতে, ভারতীয় দ্বীপ পুঞ্জের দ্বীপসমূহে, মানচিত্রে স্থান পায়নি এমন সব স্থানে, তৃষ্ণার্ত মরুর মরুদ্যানে, অজানা নদীর তীরবর্তী গন্ডগ্রামে, পন্ডিত অথবা অনুগামিগণ গভীর মনোনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করেন।(৩) 
“রোমান্টিক যুগের কবি (১৭৯৪- ১৮৩২ গ্যেটে। রোমান্টিক যুগের কাজ হল এমন কোনো নতুন সূত্র বা তত্ত্ব বা শক্তির কিংবা তাদের নূতন কোনো সম্বন্ধ বিন্যাসের আবিষ্কার যার দ্বারা আবার ঐ ভেঙ্গে ছত্রাকার হয়ে যাওয়া জীবনকে কোন একটি মূল দ্যোতনা ও প্রবেগের মধ্যে গেঁথে নেওয়া যায়।
গ্যেটে যা সমাধান দিলেন তাকে বলা যায় বুদ্ধি মুক্তি বিশোধন, বিশ্বব্যাপী প্রসারণ। “গ্যেটে এই প্রকাশিত জগতের বস্তু প্রাণ- মনকে তার চেতনার দ্বারা আয়ত্ব বা উদ্ভাসিত করতে চেয়েছিলেন। একটা অধ্যয়ন তত্ত্বের বুদ্ধিগত প্রতিফলন ছিল তাঁর চেতনায়, যা ফুটে উঠেছিল তাঁর ‘ম্যাহোমেটস গেসাঙ্গ’ শীর্ষক এক অপূর্ব কবিতায়। গ্যেটে এই কবিতায় রসুলুল্লাহর জীবনকে একটি নদীর সঙ্গে তুলনা করেছেন, যে নদী অন্য মস্ত উপনদী, প্রবাহ ইত্যাদির জলধারা বহন করে সমুদ্র বক্ষে নিয়ে যাচ্ছে। 
রসূলুল্লাহর মহৎ ব্যক্তিত্বের কালজয়ী স্তুতিবাদ ধ্বণিত হয়েছে তার ‘ম্যাহোমেটস গেসাঙ্গ’ শীর্ষক কবিতায়। কবিতাটির শুরু ছিল নিম্নরূপ : 
প্রস্তরগাত্র থেকে প্রবাহমান
নির্ঝরটির দিকে তাকিয়ে দেখ। 
কী তার দীপ্তি, 
আসমানের নক্ষত্রপূঞ্জকে হার মানায়।
মেঘমালারও ঊর্ধ্ব দেশে
যে সহৃদয় ফেরেশতারা বিচরণ করেন 
তারাই লালন করেছেন,
গড়ে তুলেছেন 
এই প্রাণবন্ত শিশুকে 
পাহাড় চূড়াবলীর কঠোর অথচ দয়ার্দ পরিবেশে।” 
 ‘গ্যেটের উপরে কোরআনের প্রভাব সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ আমাদের লভ্য। তিনি এ মহাগ্রন্থের দ্বিতীয় সূরাতে ইসলামের অন্তর্নিহিত বাণীর সন্ধান লাভ করেন। এই কিতাব, “এতে সন্দেহের কোন আবকাশ নেই.” এ ধরনের বর্ণনা তাঁকে একান্তভাবে অনুপ্রাণিত করে। তিনি বলেন: এভাবে সুরার পর সুরা বিবৃত হয়ে চলেছে। বিশ্বাস ও অবিশ্বাসকে পরিষ্কার ভাষায় পৃথক করে দেখান হয়েছে। বিশ্বাসীর স্থান উঁচুতে আর অবিশ্বাসীদের স্থান নীচুতে। বেহেশত্ অপেক্ষা করছে বিশ্বাসীর জন্যে, আর দোযখ অবিশ্বাসীর জন্যে। এই পবিত্র গ্রন্থের বিশাল বক্ষে রয়েছে বিধিসিদ্ধ এবং অবিধেয় বস্তু ও বিষয়াবলী সম্বন্ধে বিস্তৃত নির্দেশ, ইহুদী ও খ্রিষ্ট ধর্মীয় ঐতিহ্যাশ্রিত পৌরাণিক কাহিনী সমষ্টি, ব্যাখ্যা, পুনরুক্তি, অন্তহীন অতিভাষণ - এমন কত কি! কিন্তু আপনি একবার অভিনিবেশ সহকারে এ-গ্রন্থ অধ্যয়ন শুরু করলে আর ছাড়া পাবেন না। বারবার আপনি ত্যক্ত হয়ে এ বই তুলে রাখবেন, কিন্তু আবার নামিয়ে হাতে নিতে হবে। এমনি বিকর্ষণ ও আকর্ষণের মধ্য দিয়ে আপনি দেখতে পাবেন যে আপনার অন্তর গভীর প্রশংসায় ভরে উঠছে এবং শেষতক্ ভক্তিতে নুয়ে পড়েছে। ... ইসলামী একেশ্বর বাদের প্রতি গ্যেটে গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাঁর মতে “আল্লাহর এই নিরঙ্কুশ হাতিয়ার দিয়েই মুহাম্মদ (স.) বিশ্ব বিজয়ী হয়েছিলেন।”
গ্যেটের নিম্নোক্ত বাণী সুপ্রসিদ্ধ : 
“ইসলামের অর্থ যদি হয় আল্লাহর বিধানের প্রতি আত্মসমর্পণ, তবে আমরা সকলেই ইসলামী নীতি অনুযায়ী বেঁচে থাকি এবং ইসলামী নীতি অনুযায়ীই মৃত্যুবরণ করি।”(৪) 
গ্যেটের সমসাময়িক বিলাতের বিখ্যাত কবি উইলিয়ম ব্লেক ( ১৭৫৭- ১৮২৭)। কবি ধর্মের বিজয় বার্তা প্রচার করতে চেয়েছেন। কবি লিখলেন:
Bring me my bow of burning gold! 
Bring me my arrows of desire! 
Bring me my spear! oh clouds unfold!
Bring me my chariot of fire!
I will not erase from mental flight. 
কবি তাঁর এ লেখার মধ্য দিয়ে অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যাবার দৃঢ় ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। যতদিন না ইংল্যাণ্ডের ভূমিতে পবিত্র জেরুজারেনমের অবস্থান তথা ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠিত না হবে ততদিন তার হাত থেকে তরবারি খসে পড়বে না আর হৃদয়ের বাসনা থাকবে জাগরুক। 
 উইলিয়ম ব্লেক একজন অতীয়ন্দ্রবাদী বিশ্বাসী কবি ছিলেন। কবি তার প্রভাব বিস্তার করেছেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আইরিশ জাতীয়তাবাদী কবি উইলিযম বাটলার ইয়েটস-এর উপর। ইয়েটস এ সত্য স্বীকার করে বলেছেন, ব্লেকের প্রফেটিক বই আমার মনোরাজ্যে বিপ্লব ঘটিয়েছে। ইয়েটস ছিলেন অলৌকিকতায় বিশ্বাসী বৈজ্ঞানিক জড়বাদ বিরোধী অপ্রাকৃত ও থিওসফিতে আকৃষ্ট কবি। ইয়েটস সন্ধান করেছেন চিরন্তনকে, যা তাঁর ‘সেইলিং টু বাইজেন্টাইন’ (Sailing to Byzantium) কবিতায় পরিস্ফুটিত হয়েছে। 
কবি সত্তা ব্যক্তিত্ব নিরালম্ব বস্তু নয়, অর্থাৎ দেশ ও কাল গত পরিবেশ নিরপেক্ষ নয়। পশ্চিমা সাহিত্যিকদের সাহিত্য চর্চা তাদের পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু অন্তরের সুর স্থান কালের সীমারেখা না মেনে সব দেশে সবকালে একই রকম বেজে উঠেছে। তাই সাহিত্যে ধর্মীয় চেতনার প্রতিফলন সব দেশে সব কালে কম বেশি ছিল, আজও আছে। কিন্তু সামাজিক বিবর্তন ও পরিবর্তনের ধারায় যারা সাহিত্য থেকে ধর্মীয় মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে শুধু রসের চর্চায় মেতে থাকতে চান তারা অন্তরের ডাক শোনেন না বা শোনলেও বুঝতে অক্ষম। আজ বাংলা সাহিত্যে যারা অন্তরের বেজে ওঠা সুরকে বধিরতার ভনিতায় শুনতে না রাজ তাদের উচিত পাশ্চাত্য সাহিত্যের আঙ্গিনায় হাজির হয়ে গ্যেটে, ব্লেক, ওয়ার্ডস ওয়ার্থ, ইয়েটস প্রমুখদের সাথে তাল মিলিয়ে সাহিত্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা।
তথ্যসূত্র :
(১) সাহিত্য ও বিশ্বাস-সৈয়দ আলী আহসান 
(২) ড.এ্যানমেরী শিমেল-তারী
(৩) নতুন আলোকে ইকবালের চিন্তাধারা - লেঃ কর্ণেল কে . এ রশীদ
(৪) ইকবাল ও গ্যেটে-মুমতাজ হাসান। 

যে আসন থেকে সরানো যাবে না আল্লামা সাঈদীকে - মাসুদ সাঈদী


Thursday, January 24, 2019

ভালো দিয়ে মন্দ দূরীভূত করো । জাফর আহমাদ


ভালো দিয়ে মন্দ দূরীভূত করা আল-কুরআনের অনুসারীদের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আচ্ছা তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার ওপর যে কিতাব নাজিল হয়েছে, তাকে যে ব্যক্তি সত্য মনে করে আর যে ব্যক্তি এ সত্যটির ব্যাপারে অন্ধ, তারা দু’জন সমান হবে; এটা কেমন করে সম্ভব? উপদেশ তো শুধু বিবেকবান লোকেরাই গ্রহণ করে। আর তাদের কর্মপদ্ধতি এমন হয় যে, তারা আল্লাহকে প্রদত্ত নিজেদের অঙ্গীকার পালন করে এবং তাকে মজবুত করে বাঁধার পর ভেঙে ফেলে না। তাদের নীতি হয়, আল্লাহ যেসব সম্পর্ক ও বন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখার হুকুম দিয়েছেন সেগুলো তারা অক্ষুণ্ণ রাখে, নিজেদের রবকে ভয় করে এবং তাদের থেকে কড়া হিসাব না নেয়া হয় এই ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকে। তাদের অবস্থা হয় এই যে, নিজেদের রবের সন্তুষ্টির জন্য তারা সবর করে, নামায কায়েম করে, আমার দেয়া রিজিক থেকে প্রকাশ্যে ও গোপনে খরচ করে এবং ভালো দিয়ে মন্দ দূরীভূত করে। আখেরাতের গৃহ হচ্ছে তাদের জন্যই।” (সূরা আর রাদ-১৯-২২)
আল্লাহ তা’আলা অন্যত্র বলেন, “হে নবী সৎ কাজ ও অসৎ কাজ সমান নয়। তুমি অসৎ কাজকে সেই নেকি দ্বারা নিবৃত্ত করো যা সবচেয়ে ভালো। তাহলে দেখবে যার সাথে তোমার শত্রুতা ছিল সে অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে গিয়েছে।” (সূরা হা-মিম আস সেজদা : ৩৪)
উল্লেখিত আয়াতে বিবেকবান মু’মিনের কর্মপদ্ধতি, নীতি ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছো :
কর্মপদ্ধতি
“তারা আল্লাহকে প্রদত্ত নিজেদের অঙ্গীকার পালন করে এবং তাকে মজবুত করে বাঁধার পর ভেঙে ফেলে না।” এটি হচ্ছে অনন্তকালীন অঙ্গীকার যা সৃষ্টির শুরুতেই আল্লাহ সমস্ত মানুষের কাছ থেকে নিয়েছিলেন। তিনি অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, মানুষ একমাত্র তাঁর বন্দেগি করবে। সূরা আরাফের ১৭২ নম্বর তা আরো স্পষ্ট আকারে বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, “আর হে নবী! লোকদের স্মরণ করিয়ে দাও সেই সময়ের কথা যখন তোমাদের রব বনি আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরদের বের করেছিলেন এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের ওপর সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন: আমি কি তোমাদের রব নই? তারা বলে ছিলো: নিশ্চয়ই তুমি আমাদের রব, আমরা এর সাক্ষ্য দিচ্ছি। এটা আমি এ জন্য করেছিলাম যাতে কিয়ামতের দিন তোমরা না বলে বসো, আমরা তো এ কথা তো জানতাম না।” প্রত্যেকটি মানুষের কাছ থেকে নেয়া এ অঙ্গীকার তার প্রকৃতির মধ্যে মিশে আছে। মায়ের গর্ভ থেকে মৃত্যু অবদি অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে মানুষের অস্তিত্ব লাভ এবং তাঁর প্রতিপালন কর্মকাণ্ডের আওতাধীনে সে প্রতিপালিত হতে থাকে তখই এটি পাকাপোক্ত হয়ে যায়। আল্লাহর রিজিকের সাহায্যে জীবন যাপন করা, তাঁর সৃষ্ট প্রত্যেকটি বস্তুকে কাজে লাগানো এবং তাঁর দেয়া শক্তিগুলো ব্যবহার করা- এ গুলো মানুষকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে একটি বন্দেগির অঙ্গীকারে বেঁধে ফেলে। কোন সচেতন, বিবেককান ও বিশ্বস্ত মানুষ এ অঙ্গীকার ভেঙে ফেলার সাহস করতে পারে না।
নীতি
“তাদের নীতি হয়, আল্লাহ যেসব সম্পর্ক ও বন্ধন অক্ষুণœ রাখার হুকুম দিয়েছেন সেগুলো তারা অক্ষুণœ রাখে, নিজেদের রবকে ভয় করে এবং তাদের থেকে কড়া হিসাব না নেয়া হয় এই ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকে।” এমন সব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক যেগুলো প্রতিষ্ঠিত হলেই মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ ও সাফল্য নিশ্চিত হয়। বিশ্ব মুসলিমদের মাঝে অশান্তির প্রধান কারণ হলো, তারা আজ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শতধা বিভক্ত হয়ে গেছে। হোক তাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বা হোক তা ধর্মীয়। আল্লাহর ভয় ও আখিরাতের কড়ায় গণ্ডায় হিসাব দিতে হবে সে ভয়ও তাদেরকে বিচলিত করে না। অথচ স্বয়ং আল্লাহর রাসূল সা: এ হিসাবের ভয়েও বিচলিত হতেন। তিনি হযরত আয়েশা রা:কে নামাজে এ দো’আ করতে শিখিয়েছেন “আল্লাহুম্মা হাসিবনি হিসাবাই ইয়াসিরা” হে আল্লাহ! আমার হিসাব নিও সহজ করে।
কার্যক্রম বা বৈশিষ্ট্য
“তাদের অবস্থা হয় এই যে, নিজেদের রবের সন্তুষ্টির জন্য তারা সবর করে, নামায কায়েম করে, আমার দেয়া রিজিক থেকে প্রকাশ্যে ও গোপনে খরচ করে এবং ভালো দিয়ে মন্দ দূরীভূত করে। আখেরাতের গৃহ হচ্ছে তাদের জন্যই।” তারা সবর করে মানে নিজেদের প্রবৃত্তি ও আকাক্সক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে, অনুভূতি ও ঝোঁক প্রবণতাকে নিয়ম ও সীমার মধ্যে আবদ্ধ রাখে, আল্লাহর নাফরমানিতে বিভিন্ন স্বার্থলাভ ও লোভ-লালসার চরিতার্থ হওয়ার সুযোগ দেখে পা পিছলে যায় না এবং আল্লাহর হুকুম মেনে চলার পথে যেসব ক্ষতি ও কষ্টের আশঙ্কা দেখা দেয় সেসব বরদাশ্ত করে যেতে থাকে। এ দৃষ্টিতে বিচার করলে মু’মিন আসলে পুরোপুরি সবরের জীবন যাপন করে। কারণ সে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় এবং আখেরাতের স্থায়ী পরিণাম ফলের প্রতি দৃষ্টি রেখে এ দুনিয়ার আত্মসংযম করতে থাকে এবং সবরের সাথে মনের প্রতিটি পাপ প্রবণতার মোকাবেলা করে। নামাজ কায়েম করে। সমাজে পুরোপুরি নামায যাতে চালু হয়ে যায় সেই লক্ষ্যে কাজ করে। আর আল্লাহর দেয়া রিজিক হতে প্রকাশ্যে ও গোপনে খরচ করে। ফরজ খরচ তথা যাকাত এবং অন্যান্য সাদাকা এবং আল্লাহর রাস্তায় দান করে।
তারা মন্দের মোকাবেলায় একই মন্দ বা অন্য কোন মন্দ কাজ দিয়ে করে না বরং মন্দের মোকাবেলায় ভালো কোন কাজের মাধ্যমে করে। অন্যায়কে প্রতিহত করার জন্য অন্যায়ের সাহায্য গ্রহণ না করে ন্যায়ের সাহায্য গ্রহণ করে। কেউ তাদের প্রতি যতই জুলুম করুক না কেন তার জবাবে তারা পাল্টা জুলুম করে না বরং ইনসাফ করে। কেউ তাদের বিরুদ্ধে যতই মিথ্যাচার করুক না কেন জবাবে তারা পাল্টা সত্যই বলে। কেউ তাদের সাথে যতই বিশ্বাস ভঙ্গ করুক না কেন জবাবে তারা বিশ্বস্ত আচরণই করে থাকে। রাসূলুল্লাহর সা: নিম্নোক্ত হাদিসটি এ অর্থই প্রকাশ করে: “তোমরা নিজেদের কার্যধারাকে অন্যের কর্মধারার অনুসারী করো না। এ কথা বলা ঠিক নয় যে লোকেরা ভালো করলে আমরা ভালো করবো এবং লোকেরা জুলুম করলে আমরাও জুলুম করবো। তোমরা নিজেদেরকে একটি নিয়মের অধীন করো। যদি লোকেরা সদাচরণ করে তোমরাও সদাচরণ করো। আর যদি লোকেরা তোমাদের প্রতি অসৎ আচরণ করে তাহলে তোমরা জুলুম করো না।” রাসূলের সা: আরেকটি হাদিস একই অর্থ প্রকাশ করে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, আল্লাহ আমাকে নয়টি কাজের হুকুম দিয়েছেন। এর মধ্যে তিনি এ চারটি কথা বলেছেন : কারো প্রতি সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট যাই থাকি না কেন সর্বাবস্থায় আমি যেন ইনসাফের কথা বলি। যে আমার অধিকার হরণ করে আমি যেন তার অধিকার আদায় করি। যে আমাকে বঞ্চিত করবে আমি যেন তাকে দান করি। আর যে আমার প্রতি জুলুম করবে আমি যেন তাকে মাফ করি। একই অর্থ প্রকাশ করে নিম্নের হাদিসটিও। “যে তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তুমি তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করো না।” হযরত উমরের রা: উক্তিটিও এ অর্থ প্রকাশ করে : “যে ব্যক্তি তোমার প্রতি আচরণ করার ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে না তুমি আল্লাহকে ভয় করে তার প্রতি আচরণ করো।”
এ ভাগ্যবান কারা
আল্লাহ তা’আলা বলেন, “ধৈর্যশীল ছাড়া এ গুণ আর কারো ভাগ্যে জোটে না। এবং অতি ভাগ্যবান ছাড়া এ মর্যাদা আর কেউ লাভ করতে পারে না।” (সূরা হা-মিম আস সেজদা : ৩৫) অসৎ কর্ম বা দুষ্কর্মকে সৎকর্ম দ্বারা মোকাবেলা করা কোন ছেলেখেলা নয়। এ জন্য দরকার সাহসী লোকের। এ জন্য দরকার দৃঢ়সঙ্কল্প, সাহস, অপরিসীম সহনশীলতা এবং চরম আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। কেবল সেই ব্যক্তিই এ কাজ করতে পারে যে বুঝে শুনে ন্যায় ও সত্যকে সমুন্নত করার জন্য কাজ করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেছে, যে তার প্রবৃত্তিকে সম্পূর্ণরূপে জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিচার শক্তির অনুগত করে নিয়েছে এবং যার মধ্যে নেকি ও সততা এমন গভীরভাবে শিকড় গেড়ে বসেছে যে, বিরোধীদের কোন অপকর্ম ও নোংরামি তাকে তার উচ্চাসন থেকে নামিয়ে আনতে সফল হতে পারে না। অত্যন্ত উঁচু মর্যাদার মানুষই কেবল এসব গুণাবলির অধিকারী হয়ে থাকে। আর যে ব্যক্তি এসব গুণাবলির অধিকারী হয় দুনিয়ার কোন শক্তিই তাকে সাফল্যের মনযিলে মকসুদে পৌঁছা থেকে বিরত রাখতে পারে না। নিচু প্রকৃতির মানুষ তাদের হীন চক্রান্ত জঘন্য কৌশল এবং কুৎসিৎ আচরণ দ্বারা তাকে পরাস্ত করবে তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
পুুরস্কার
এ ব্যক্তিদের সাথে আখেরাতে কি ধরনের আচরণ করা হবে নিম্নোক্ত আয়াতে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে : “আখেরাতের গৃহ হচ্ছে তাদের জন্যই। তারা নিজেরা এতে প্রবেশ করবে এবং তাদের সাথে বাপ-দাদারা ও স্ত্রী-সন্তানদের মধ্য থেকে যারা সৎকর্মশীল হবে তারাও তাদের সাথে সেখানে থাকবে। ফেরেশতারা সবদিক থেকে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য আসবে এবং বলবে : “তোমাদের প্রতি শান্তি। তোমরা দুনিয়ায় যেভাবে সবর করে এসেছো তার বিনিময়ে তোমরা এর অধিকারী হয়েছো।” -কাজেই কতই চমৎকার এ আখেরাতের গৃহ!” (সূরা আর রাদ : ২২-২৪) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন, “যারা আত্মসংযমী তাদেরকে বিনা হিসেবেই প্রতিদান দেয়া হবে।” ওমর রা: বলেন, “যখন আমরা আত্মসংযমী ছিলাম, তখনকার জীবনই সুন্দর ছিল।” (বুখারি কিতাবুর রিকাক)
লেখক : ইসলামী গবেষক

জামায়াত নেতারা রাজাকার ছিলেন না: তারেক রহমান

Monday, January 21, 2019

পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য আগ্রাসন : আমাদের করণীয়


খুরশীদ আলম বাবু : বাংলাদেশের সাহিত্যের বাজার এখন সত্যিই দুঃসময়ের মুখোমুখি। পশ্চিমবঙ্গের বাজারী লেখকদের বাজার দখলের প্রাণান্তর প্রচেষ্টার সাথে এ দেশীয় এক শ্রেণির প্রকাশকদের সহযোগিতা রীতিমত ভয়ংকর শংকার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য এর জন্য কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের ঢালাও ভাবে দোষারোপ করাটা মোটেও ঠিক হবে না। প্রথমতঃ পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের গল্প উপন্যাস এদেশের সাধারণ পাঠক পড়তে আগ্রহী। আমার অনেকের সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় রয়েছে, যারা এদেশের গল্প-ঔপন্যাসিকদের খুব একটা গুরুত্ব দেবার পক্ষপাতি নন; এমনকি হিসেবের মধ্যেও আনেন না। আবার এও সত্যিকার ভাবে লক্ষ্য করে দেখেছি তাঁদের প্রিয় লেখকদের মধ্যে অনেক ভালো ঔপন্যাসিক রয়েছে। এটাও আবার স্বীকার্য যে, আমাদের সাহিত্যের মানটাও আশানুরূপ ভালো না। দ্বিতীয়তঃ এখানে ভালো ও সৎ প্রকাশকের অভাব সব সময় ছিলো, উপরন্তু আমাদের সাহিত্য এখনও শিবিরে বিভক্ত। রাজনীতি এসে সর্বনাশ অনেক আগেই ঘটিয়েছিল; এখন সেটাই চূড়ান্ত আকার ধারণ করেছে। এখন লেখকের পরিচয় নির্ধারিত হয় উনি বামপন্থী আর উনি মৌলবাদী। সেই সাথে রয়েছে আমাদের দূর্বল রাষ্ট্রনীতি। কারণ আমাদের দেশে সত্যিকার ভাবে এখন অবধি খাঁটি দেশপ্রেমিক সরকার আসেনি। আসলে হয়তো এই নিবন্ধ লেখার প্রয়োজন হতো না। ভারত বিশাল শক্তিধর দেশ, তার সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতে গিয়ে আমাদের রাজনীতিবীদরা নিজেদের মর্যাদা হারাতেও দ্বিধাবোধ করেন না। ফলশ্রুতিতে বাণিজ্যে যে অসমতা দেখা দিয়েছে তার রীতিমত প্রভাবও আমাদের সাহিত্য বাজারে পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু তথাকথিত উদারবাদী বুদ্ধিজীবীরা এখনো প্রকাশ্যে বলেই বসেন- বইয়ের বিষয়ে-কোন রকম বাধা প্রদান করাটা ঠিক হবে না। কেন করেন? তাঁদের বদ উদ্দেশ্যের হাঁড়ির খবর আমাদের অজানা নেই। ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় সামান্যতম একটি লেখা প্রকাশের সুযোগের কেল্লাফতে দান মারার কারণে নিজের দেশ প্রেমিকতাবোধ বিসর্জন দিতে দ্বিধাবোধ করেন না। তাদের দেশপ্রীতির নজির আমাদের জানা আছে। আমাদের দেশে এই রকম বুদ্ধিজীবী কারা, নাম না বললেও খুব একটা বুঝে নিতে অসুবিধা হবে না। মনে রাখতে হবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও বই এখনো গুরুত্বপূর্ণ বস্তু। পশ্চিমবঙ্গের সাথে আমাদের বই আমদানী-রফতানী বাণিজ্যিক ঘাটতি এখনো অত্যন্ত বেশি। আত্মবিস্মৃতি জাতি হিসেবে আমরা আবার খ্যাতি উপার্জন করেছি, সেটা বারবার প্রমাণিত হয়। কবি জসিম উদদীন বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পরই আমাদের সর্ব প্রথম স্মরণ করিয়ে দেন, এই সমস্যাটির কথা। কারণ তিনি ব্যক্তিগত ভাবে আমাদের প্রকাশকদের চরিত্র সম্পর্কে জানতেন। আমাদের সচেতন করার জন্য লিখেছিলেন-
“পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমরা প্রতি বছর ৬০/৭০ লাখ টাকার বই-পুস্তক আনাইয়া থাকি। কিন্তু আমাদের লিখিত বই পশ্চিমবঙ্গে যাইতে পারে না। আমাদের এখানে কত টাকার বই আনিব তাহার অংক নির্দিষ্ট করা আছে, কিন্তু আমাদের বিশ্বাস পশ্চিমবঙ্গে তেমনটি নাই। প্রতিদান না হইলে সখ্য বেশি দিন টেকে না। একমুখী পথে যাওয়া আসা চলে তা না, ওদেশের ভালোবাসার যাহারা অন্তরঙ্গ করিতে চান তাহারা যেন এই কথাটি ভালো করে ভাবিয়া দেখেন।” 
আমার  দেশের প্রচলিত আইনকে লংঘন করে তারা এই সমস্ত গল্প-উপন্যাস ক্রমাগত ছাপিয়ে চলেছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে কবি জসীম উদদীন যখন এই নিবন্ধটি সৃজন করেন তখন সবে মাত্র দেশ স্বাধীন হয়েছে, আর সেই সমস্যা আজকে বিশাল থেকে বিশালাকার ধারণ করেছে। আমাদের অস্বীকার করার উপায় নেই, পশ্চিমবঙ্গের গল্প-উপন্যাসের পাঠক আমাদের দেশে অনেক রয়েছে। অনেকে বলেন পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় বেশি আছে। কারণ পশ্চিমবঙ্গে বাংলা চর্চা করার লোকজনেরই অভাব ক্রমশ পরিলক্ষিত হচ্ছে, তারই আভাসই পাওয়া যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের সদ্য প্রয়াত প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী প্রাবন্ধিক আশোক মিত্রের ভাষ্যে। আমি তার কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি। -
“কে জানে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক চৌহদ্দির মধ্যে হয়তো বাংলা 
ভাষা তথা সাহিত্য আর তেমন বেশীদিন টিকবে না, কতিপয় পূর্ব লক্ষণ দেখে অন্তত : সেই রকম সন্দেহ হয়।”
আবার পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশের কথা স্মরণে রেখেই বলেছেন,
“তাছাড়া একটু সংকোচ এর সাথে বলতেই হচ্ছে, রাজনৈতিক সীমান্তের ওপারে রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত; এই প্রান্তে যারা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে আলোচনায় ব্রত হবেন, তাদের কাছে এই সংকলনের(চতুরঙ্গ থেকে-১ম খণ্ড) মূল্য অপরিসীম।” (সম্পাদকীয় নিবেদন, চতুরঙ্গ থেকে-১ম খণ্ড)
অবশ্য এই মন্তব্যের মধ্যে কতখানি সত্যতা রয়েছে সেই সম্পর্কে আমার ঘোরতর সন্দেহ বিদ্যমান, কারণ আজকাল প্রায়শ; বাংলাদেশের পাঠককে তোষামোদ করার জন্য এই রকম কথাবার্তা প্রয়াত কবি ও কথাশিল্পী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও বলে থাকতেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। তার ঐতিহাসিক স্বাতন্ত্রিক ঐতিহ্য রয়েছে। আর এই কারণে তার সাহিত্যও সৃজিত হবে আলাদা ভাবধারায় এবং আলাদা আংগীকে। আমাদের দেশে সুনীল-শীর্ষেন্দুরা এলে যে মনোহর সংবর্ধনা পান; তার এক কণাও বাংলাদেশের কবিরা ও দেশে পান না। এটা পরীক্ষিত সত্য যে, আমাদের সাহিত্য তাঁদের  কাছে অপাংতেয় অষ্পৃশ্য। অবশ্য একশ্রেণির সমালোচকরা সেটা স্বীকার করতে নারাজ। কারণ তারা পশ্চিমবঙ্গীয় ভাবধারার সাথে বরাবরই আমাদের সাহিত্যকে মেলাতে চান। আর সেখানেই বেধেছে যত মুশকিল। ইদানীং ভিসিডি ও চ্যানেলে হিন্দি ছবির মত পশ্চিমবঙ্গীয় কবি সাহিত্যিকদের লেখা গল্প উপন্যাস বাংলাদেশের বাজারে জোয়ারের মত ভাসতে শুরু করেছে। আর এর সাথে যোগ হয়েছে আমাদের দেশের একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী সুলভ পাঠকদের উদাসীনতা। ফলশ্রুতিতে আমাদের দেশের লেখকদের বই প্রায়শ অবিক্রিত অবস্থায় থাকছে। এই শ্রেণির পাঠকরা পশ্চিমবঙ্গীয় লেখকদের নামে মূর্ছা যাবার উপক্রম হন। আমাদের অধিকাংশ তরুণ লেখকরা তাদের প্রভাবের দ্বারা প্রভাবান্বিত। 
আমি অবশ্য তাদের প্রভাবের বিষয়টিকে সমালোচনার নজরে দেখছি না, কারণ এটাই স্বাভাবিক। বাজারী লেখকদের সাফল্য দরুন নতুন লেখকরা প্রভাবিত হবেন। আমি অবশ্য এও মনে করি সুনীল-শীর্ষেন্দু এরা শক্তিমান কথা-সাহিত্যিক। তারা এখানেও পশ্চিমবঙ্গের মতন স্বীকৃত মর্যাদা পাচ্ছেন। তবে আপাতত আমার সমালোচনার জায়গাটি একটু অন্য জায়গায় রাখতে চাই। কারণ আমাদের পাঠকরা অমিয় ভূষণ মজুমদার, দেবেশ রায়ের বই কিংবা নাম কোনটাই শুনতে পারেন না। আসলে বাজারী উপন্যাসের ভিড়ে তাদের নাম হারিয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে। কারণ এই দুইজন লেখক আনন্দবাজার কিংবা যুগান্তর গোষ্ঠীর লেখক নন। ফলশ্রুতিতে আমাদের পাঠক গোষ্ঠীর কাছেও খুব বেশি পরিচিত নন। তাদের লেখা নিরলস কঠোর সাধনার মধ্যে দিয়েই এই সাফল্য উপার্জন করা সম্ভব। স্বীকার করি পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু লেখক এই কাজটি নিপুণতার সাথে করছেন। তার মানে এই নয় যে, তাদের লেখার গতি-প্রকৃতি আমাদের দেশের লেখকদের আদর্শ হতে পারে। তাদের দেশেও এই ধরনের লেখক সত্যিকার ভাবে সমালোচনা যোগ্য। অকাল প্রয়াত প্রখ্যাত কথাশিল্পী দ্বীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের গবেষণা পরিষদের পক্ষ থেকে ১৯৭৫ সালে এক সাক্ষাতকার নেওয়া হয়, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের সম্বন্ধে অসামান্য কৌতুকর মন্তব্য করেছিলেন। সেই সাক্ষাতকারে তিনি বামপন্থী আন্দোলনের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেছিলেন, এমনকি শিল্প সাহিত্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের কম্যুনিস্ট পার্টির সমালোচনা করতে দ্বিধা করেননি। আবার পাশাপাশি সমরেশ বসুর বিবর এর প্রশংসাও করেছেন। শুধু তাই নয় বাজারী লেখকদের ‘ইয়েস স্যার’ এ কটাক্ষ করতেও দ্বিধা করেননি। এদের লেখক মানসিকতাকে কটাক্ষ করে তাঁর মূল্যবান মতামত ছিল এই রকম- 
‘সাহিত্যে বাজারটা প্রায় সিনেমা স্টারদের অবস্থায় পরিণত হয়েছে। ফিল্মস্টাররা যেমন তাদের বয়সের ভাবনায় ভাবিত থাকেন তেমনি আমাদের সাহিত্যকূলের একাংশ ভাবিত হলেন কি পরিমাণে উপস্থিতির প্রমাণ দিতে পারছেন। রচনায় মানের উপর নয়।’ দ্বীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য তুলে ধরলাম বলে কেউ যেন মনে না করে আমি এই মন্তব্য পুরোপুরি বিশ্বাস করে বসে আছি। সাহিত্যে উচ্চমানের সাহিত্যিকদের আগ্রাসন এমন নতুন কোন ঘটনা নয়। আরবের সাহিত্যিক আক্রমণ ইরানীরা অত্যন্ত সুকৌশলে রক্ষা করেছিল। বিগত শতাব্দীতে আইরিশ সাহিত্যের নবজাগরণ কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যের বিরুদ্ধেই হয়েছিল, নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের নেতৃত্বে। কারণ তারতো কোন সময় বার্নাডশোর  সাহিত্যকে আইরিশ সাহিত্য বলে মনে করেনি। অথচ আইরিশদেরও মাতৃভাষা ইংরেজি। আমি এই আন্দোলনের কথা উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, আমাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মুখে সেই রীতি অবলম্বন করা দরকার। তবে আমরা সৌভাগ্যবান, বয়স ভাবনায় ভাবিত লেখকদের সংখ্যা কম হলেও পাঠকরা তাদের ধরতে পেরেছেন। তবে আমাদের দেশের প্রকাশকরাও কম দায়ী নয়। নতুন লেখকদের উৎসাহ দান করাটা তারা একেবারে ভুলে গিয়েছেন। কবিতার বই বের করতে হলে আল মাহমুদ ও শামসুর রাহমান ছাড়া যেন প্রকাশকদের কোন গত্যন্তর নেই। এই মানসিকতা পরিবর্তন করা দরকার। মনে রাখতে হবে পশ্চিমবঙ্গেও প্রতিযোগীতার মধ্য দিয়ে মতি নন্দী ও অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় এর মত বড় বড় সাহিত্যিকরা বেরিয়ে এসেছিল। আমাদের দেশে প্রকাশকরা এই দায়িত্ব নিতে কি পারবেন? আর প্রকাশকরা এখন অবধি প্রচার বিমুখ পদ্ধতি আঁকড়ে ধরে আছেন। প্রকাশকরা যদি বইয়ের প্রচার না করেন তাহলে সাধারণ পাঠকরা কিভাবে বইয়ের খবর জানবেন। লেখক লিখবেন আর প্রকাশক প্রকাশ করবেন কথাটা যতটায় সরলীকরণ হোকনা কেন-প্রমথ চৌধুরী যেমন মনে করতেন- ভালো বই খোঁজার অর্থই হলো খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজার মত।

সাম্প্রতিককালে আর একটি প্রচলতার যোগ হয়েছে সেটা হলো, দৈনিক পত্রিকার মালিকদের দ্বারা ঈদসংখ্যা বের করা, আমার জানামতে কেবলমাত্র নয়াদিগন্ত, প্রথম আলো এবং সাপ্তাহিক ২০০০ ছাড়া সমস্ত পত্রপত্রিকার প্রকাশকদের ধারা পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের উপন্যাস-গল্প না হলে ঈদসংখ্যার মর্যাদাই থাকে না। লক্ষ্য করা গেছে যে পত্রিকা একসময় সবচেয়ে বেশি ভারত বিরোধী ভূমিকা নিয়েছিল, তাদের সাপ্তাহিক পত্রিকায় একবার সবচেয়ে বেশি পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের লেখা গল্প-উপন্যাস বেরিয়েছে। আমার জানামতে সেই পত্রিকার কয়েকজন মনোযোগী পাঠক মৃদু অনুযোগও জানিয়ে ছিলেন। কিন্তু সেই পত্রিকার সম্পাদকের মতিগতির পরিবর্তন হয়েছে বলে আমার জানা নেই। অথচ আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আনন্দবাজার গোষ্ঠীর দেশ পত্রিকার বৃহৎ পাঠক গোষ্ঠীই কিন্তু আমাদের দেশেই অবস্থান করছে। সোজাসাপ্টা উত্তর হলো তাদের পত্রিকার ভূত ভবিষ্যৎ আমাদরে দেশের পাঠকদের উপরেই এখনো নির্ভর করছে। কারণটা স্বাভাবিক। আমরা যতটা সাহিত্য বিমুখ, তারা কিন্তু ততটা নয়। পার্থক্যটা সৃজিত হয়েছে এখানেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্য উর্দুর পরেই সমগ্র ভারতের মধ্যে সবচাইতে সমৃদ্ধশালী সাহিত্য। আমাদের মত দেশের পক্ষে স্বল্প সময়ের মধ্যে সেই রকম সাহিত্য সৃজন করাটা সম্ভব নয়। কিন্তু তাই বলে তার সামনে নতজানু হওয়াটাও বেমানান। আর একটি বিষয় পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের সাহিত্যিক বাজার বাংলাদেশি পাঠকদের উপরেই নির্ভরশীল, তার প্রামাণিক তথ্য দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত আনন্দ বাগচীর লিখিত নিবন্ধেই সরাসরি পাওয়া যাচ্ছে। ঐ নিবন্ধে বলা হয়েছে,
“বাঙালির উপর চাপ আসছিল নানা ভাবে। ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের(১৯৬৫) পর বাংলা বইয়ের বাজার দ্বি-খণ্ডিত। বাংলা সাহিত্যে আদি পর্বে প্রথম পর্বের  প্রথম বলি হলো ছোটগল্প।” (ছোটগল্পের রূপান্তর) 
পৃথিবীর সব সাহিত্যের জনপ্রিয় বহুলপ্রজ লেখকরা পাঠকদের মনোরঞ্জনের দিকটিই লক্ষ্য করেই সাহিত্যচর্চা করে থাকেন। হিট লেখক ও ফ্লপ লেখক ইত্যাদি দুটি বিশেষণকে সব সময় গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। প্রথমটি অর্জন করতে পারলে যেন ইহকাল ধন্য হবার মত দশা হয়। নোবেল বিজয়ী হাইনরিস বোলের কাছে আর্থিক মর্যাদার রহস্য উপন্যাস লেখক হেডলি চেজ অনেক উচ্চ অবস্থান করেন। আমাদের দেশের অনেক লেখকই রয়েছেন, বিষয় হিসেবে নারী ও প্রেমের বিশেষত কিশোর প্রেম ও যৌনতাকে পুঁজি করে সফল ব্যবসায়ী ক্যারিয়ার গড়ে তোলার জন্য সাহিত্যচর্চা করে চলেছেন। কোথায় কমিটমেন্ট, কোথায় সামাজিক চেতনা? এসব খুঁজতে গেলে ব্যর্থ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। সমকালের ক্লাসিক লেখকদের সেটাই পরম আরাধ্য। আমাদের দেশে এই রকম লেখক যে নেই সেটা আমার বলার উদ্দেশ্য না। মাহমুদুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের নাম শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারণ করা যায়। ইদানীং আল মাহমুদ বড় বেশি বাণিজ্যিক হয়ে পড়েছে, কি লিখছেন তিনিই নিজেই জানেন না। টি এস এলিয়ট বরাবরই মনে করতেন কেবলমাত্র দশটি উপন্যাস ও কাব্যগ্রন্থ থেকে সমকালীনকে ধরে রাখা সম্ভব। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চৈতালী ঘূর্ণি’ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যয়ের ‘চিহ্ন’ উপন্যাসদ্বয় পড়লে তৎকালীন সংঘময় পরিবেশকে বুঝতে সহায়তা করে। লেখকও যেমন বই প্রকাশ করতে বাধ্য নয়, তেমনি ভাবে পাঠকও সব বই পড়তে বাধ্য নয়। প্রমথ চৌধুরীর এই মন্তব্যের মত, আমিও মনে করি। পাশাপাশি  আমাদের ভাষারীতিকে ক্রমশ পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য তরুণ সাহিত্যিনুবিসীদের কবিতার উপর দুর্দান্ত আসক্তি পরিত্যাগ করা প্রয়োজন। কবিতার পাশাপাশি লেখাও প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে গদ্য। পশ্চিমবঙ্গের লেখকরা বলছেন : তোমাদের কবিতা সুন্দর। কিন্তু উপন্যাস-গল্প ভালো নয়। অতএব আমাদের গদ্য পড়। তার মানে এই নয় যে, আমাদের দেশে কোন গদ্যশিল্পী নেই। রয়েছে। তবে যে দুঃখটি সর্বাগ্রে স্মরণ করলে আমাদের ব্যথিত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না সেটি হলো এই যে, উৎকৃষ্ট মানের সাহিত্য পত্রিকার অভাব, যা দুএকটা প্রকাশিত হয় তাও ক্ষণজীবী। পশ্চিমবঙ্গের পাঠকরাও যে মুসলমান লেখক বিদ্বেষী তার উজ্জ্বল উদাহরণ হলো প্রয়াত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ এর প্রতি দারুণ অবহেলা। এই বিদ্বেষ প্রবণতা কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের নজর এড়িয়ে যায় নি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন,
হুমায়ূনের উপন্যাস দেশ শারদীয়াতে কয়েকবছর পর পর ছাপা হয়েছিল। বইও বেরিয়েছিল কলেজ স্ট্রিট থেকে। কিন্তু এই পশ্চিমবঙ্গের পাঠকরা তেমন উৎসাহিত হননি ওর সম্পর্কে। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দুঃখিত হয়েছি। এখনও এই বাংলায় উপন্যাসে পাঠকরা মুসলমান না, রীতিনীতি বা ধর্মীয় আচার উপন্যাসে থাকলে রসগ্রহণে অনাসক্ত হয়ে পড়েন। আমার মতে এটাও এক ধরনের মৌলবাদ। (সমরেশ মজুমদার, ছদ্মবেশী সম্রাট, ভারত বিচিত্রা, আগস্ট ২০১২) 
কারণ আমাদের সাহিত্য জগৎ এখন অবধি নানা ভাবে বিভক্ত, যদিও বামধারা আগের মত শক্তিশালী অবস্থানে নেই। তবুও বেশির ভাগ জায়গায় যে পরিত্যাজ্য-করার নীতি কৌশলের বিষ বপন করে গেছেন। তার প্রভাব এখনো রয়ে গেছে। অতি বামপন্থী মনোভাব সম্পন্ন সাহিত্য সম্পাদক সর্বপ্রথমে যাচাই বাছাই করতে শুরু করেন, কে কোন পন্থী আর কে মৌলবাদী। এছাড়াও কর্পোরেট বাণিজ্যকে আশ্রয় করে নিয়েছেন সাহিত্যিকরা।
আমাদের দেশের সাহিত্যিকরা যে ভাবে এই সমস্ত বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তার চেঁচামেচি করে থাকেন, পৃথিবীর অন্য কোন জায়গায় এমনটি হয় না। আমাদের পার্শ¦বর্তী পশ্চিমবঙ্গে কট্টর বামবাদী কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক অনুষ্ঠানে বসে আলোচনা করতে পারেন, আমাদের এখানে এটা কল্পনা করা যায় না।
ঐতিহ্যপন্থীদের হাতে ভাল সাহিত্য সৃষ্টি হবে না, আমাদের দেশে বামপন্থীরা আগে ভাগেই ভেবে বসে থাকেন। হুমায়ুন কবীর ও বুদ্ধদেব বসু তাদের সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকায় ফররুখ আহমদ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা গল্প ছেপেছিলেন। কে কোন পন্থী তারা সেটা বিচার-বিবেচনার আওতায় আনেন নি। এসব করলে কি আমাদের হুমায়ুন কবীর ও বুদ্ধদেব বসু স্মৃতি সত্তার মধ্যে থাকতেন? মোটেও না। কাল তাদের সেই ভাবেই চিত্রিত করত। আমাদের সাহিত্য সম্পাদকদের হতে হবে উদার মানসিকতা সম্পন্ন। ভাল লেখা শুধু নয়, লেখক খোঁজার দায়িত্বও রয়েছে তাদের। সেটা ভুলে গেলে চলবে না। তরুণ লেখকদের মধ্যে প্রতিভার পরিচয় পেলে তাকেই বেশি করে আশ্রয় প্রশয় দিতে হবে। কিন্তু আমরা সেটা ভুলে বসে আছি। আর সেই কারণে এখন দরকার রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত তরতাজা, অজস্র সুফলপ্রসু সাহিত্য পত্রিকার প্রকাশ। আশা করি সেইদিন আর সুদূর পরাহত নয়। 

Popular Posts