Wednesday, March 6, 2019

সুদানের ড.হাসান আল তুরাবির চিন্তাধারায় আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সরকারের সাথে সম্পর্ক


মুহাম্মদ নূরে আলম:
ড. হাসান আল-তুরাবি নামটি সুদানের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে থাকলেও তার খ্যাতি বিশ্বজোড়া। তিনি সুদান সংসদের স্পিকার, সেদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, উপপ্রধানমন্ত্রী, এটর্নি জেনারেল প্রভৃতি নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। সুদানের এই বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ড. হাসান আল তুরাবি ছিলেন সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বের একজন মেধাবী ও সৃজনশীল চিন্তাবিদ। সুদানের মূল ধারার ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতা, বিশিষ্ট আইনজ্ঞ, বহু ভাষাবিদ ও ইসলামী আন্দোলনের পাওয়ার শেয়ারিং থিউরির জনক। তার চেয়ে বড় কথা লন্ডন ও সোরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র তুরাবি একই সঙ্গে ইসলামী ঐতিহ্য ও আইন বিশেষজ্ঞ, পশ্চিমা সভ্যতা সম্পর্কে সমসাময়িক ইসলামী ভাবনার অন্যতম প্রধান ভাষ্যকার এবং ইসলামী জগতের অগ্রণী তাত্ত্বিক নেতা। তিনি একাধারে আলেম, মুফাসসির, আইনবিদ, শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তাঁর চিন্তাধারার আলোকেই গড়ে উঠেছে আজকের আধুনিক সুদান। একারণেই তিনি সুদানের একজন  সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। তুরাবি একজন গণতান্ত্রিক নেতা ছিলেন। তিনি সব সময় বিশ্বাস করতেন পশ্চিমা গণতন্ত্রের চেয়ে ইসলাম আরও ভালো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র উপহার দিতে পারে। 
আজকে ইসলামী ও পশ্চিমা সভ্যতার ঠানাপোড়ন থেকে উঠে আসা সামাজিক রাজনৈতিক প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে তুরাবির নজির টানা জরুরী হয়ে পড়ে। এ কারণেই তাকে আধুনিক ইসলামী মননের অন্যতম সংকট বিশ্লেষক হিসেবে গণ্য করা হয়। মুসলিম বিশ্বের অবিসাংবাদিত নেতা এবং সুদানের বিরোধীদলীয় “পপুলার কংগ্রেস পার্টির” প্রধান ড. হাসান আল-তুরাবি ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের কল্যাণের কথা চিন্তা করে অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করার থিউরি আবিষ্কার করেন যা আমরা জানি পাওয়ার শেয়ারিং থিউরি নামে। এই থিউরির আলোকে মুসলিম বিশ্বের অনেক ইসলামপন্থী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল দীর্ঘকাল এর কিছু সুফল ভোগ করে। এক সময় সুদানের সামরিক প্রেসিডেন্ট বশিরের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ১৯৮৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন বশির। এরপর থেকেই তিনি বশির সরকারের বিরোধিতা শুরু করেন। প্রেসিডেন্ট বশিরের দীর্ঘ শাসনামলে তিনিই ছিলেন তার প্রধান সমালোচক। তিউনিসিয়ার আদলে দেশে একটি রাজনৈতিক বিপ্লবেরও স্বপ্ন দেখেছিলেন এই নেতা। তুরাবি ছিলেন একজন উদারপন্থী মুসলিম চিন্তাবিদ। তিনি ইসলামের অনেক বিষয়েই বিতর্ক এড়িয়ে চলতেন। এবং অনেক কঠোর ইসলামী বিধানের ব্যাপারে উদরতার পরিচয় দেন। তুরাবি মনে করতেন মুসলিম রাষ্ট্রের সরকার প্রধান একজন নারীও হতে পারে। এমনকি অন্য যেকোনো ধর্মের নারী হলেও তিনি এতে কোনো সমস্যা আছে বলে বলে মনে করেন। তুরাবি নারী অধিকারের ব্যাপারে একজন সোচ্চার মুসলিম নেতা ছিলেন। বিস্তারিত পড়তে পারেন: [Hasan Turabi, Women in Islam and Muslim Society. London: Mile Stones, 1991.]
সুদানের ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ড. হাসান আল তুরাবির মতে মুসলিম রাষ্ট্র মানে মুসলিম আধিপত্যশীল রাষ্ট্র। তবে ইসলামী রাষ্ট্র মানে যে রাষ্ট্রে ইসলামী নীতি-আদর্শকে কেবল ব্যক্তিজীবনে নয়, বরং প্রকাশ্য জনপরিমণ্ডলে চর্চা করা হয়। এর মানে হচ্ছে, যেখানে রাজনীতি, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্কসহ সবকিছুই হবে ইসলাম দ্বারা অনুপ্রাণিত। যেহেতু ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। খ্রিষ্টানদের বেলায় রাষ্ট্র পরিচালিত হতো তাদের ধর্মীয় যাজকদের মাধ্যমে। কারণ খ্রিষ্টান যাজকরা মনে করত, স্রষ্টা রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন না। ফলে তারা নিজেদেরকে স্রষ্টার খাস প্রতিনিধি মনে করত এবং সবসময় গণমানুষের জীবনে হস্তক্ষেপ করত। যদিও খ্রিষ্টান ধর্মের সাথে রাজনীতির তেমন বিদ্বেষ ছিল না, বিদ্বেষ ছিল ধর্মীয় যাজকদের সাথে বিপ্লবীদের। এর বিপরীতে, ইসলামে কোনো মোল্লাতন্ত্র নেই। এখানে প্রত্যেক মানুষ সরাসরি আল্লাহর সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে পারে। সুতরাং ইসলাম ধর্মে শুধুমাত্র মোল্লারা নয়, বরং ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা করবে আল্লাহ বিশ্বাসী মানুষেরা। মুসলিমরাই ইসলামী রাষ্ট্রের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে। 
ড.হাসান আল তুরাবি ১৯৩২ সালে সুদানের কাসসালা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের শরিয়াহ আদালতের বিচারক। তিনি শিক্ষাজীবন শুরু করেন গ্রামের একটি মাদ্রাসায়। সেখানে তিনি ইসলামী শিক্ষা অর্জনের পর সুদানের রাজধানী খারতুমে আসেন আইন পড়ার জন্যে। স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন সুদানের বিখ্যাত খারতুম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর তিনি সেখানকার ছাত্র সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের সংস্পর্শে আসেন। ব্রাদারহুড তাঁর চিন্তা ভাবনার মোড় অনেকটাই ঘুরিয়ে দেয়। তিনি সেদিনকার অভিজ্ঞতার কথা এভাবে বলেছেন, The Islamic movement which I met at the university was quite an experience for me. All of the dead literature that I had learned by heart became alive. I saw everything in a different light.[ John L. Esposito and John O. Voll, Makers of Contemporary Islam. New York; Oxford University Press, 2001.]..এরপর উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্যে তিনি গমন করেন লন্ডনে এবং সেখানকার কিংস কলেজ থেকে আইনের উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর গমন করেন ফ্রান্সে; সেখানকার প্যারিসে অবস্থিত বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রাচীন সোরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। তার পিএইচডি’র বিষয় ছিল ‘উদার নৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জরুরি অবস্থায় ক্ষমতা প্রয়োগ কতটা গ্রহণযোগ্য?’ হাসান আল-তুরাবির মত ইসলামী জ্ঞানের সাথে বৈশ্বিক জ্ঞানের এমন অসাধারণ সমন্বয় সৃষ্টিকারী দ্বিতীয়জন সুদানে খুঁজে পাওয়া দায়। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি সুদানের এটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন এবং ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি সুদানের ন্যাশনাল এসেম্বলির স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন।
ইসলাম ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা ও সমাজ সংস্কারের উদ্দেশে তিনি প্রচুর কাজ ও লেখালেখি করেন। ‘তাফসীর আত-তাওহীদ’ নামে তিনি একটি তাফসীর লিখেন, যেখানে সমসাময়িক সমস্যাগুলোর কোরআন ভিত্তিক সমাধান তিনি দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, ইসলামী জ্ঞানের সাথে আধুনিক জ্ঞানের সমন্বয় করা এখন খুবই প্রয়োজন। তিনি অসংখ্য বই ও প্রবন্ধ লিখেছেন, ইংরেজি ও আরবিতে তার অনেক বক্তৃতা রয়েছে; এগুলোর মাধ্যমে তিনি সুদানের দারিদ্র্যতা, গোত্রীয় সংকীর্ণতা, মাজহাব নিয়ে ঝগড়াসহ বিভিন্ন নাগরিক সমস্যার সমাধান দিয়েছেন। বিভিন্ন বিষয়ে তার উদার ও আধুনিক সমাধান সুদানের মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করেছে। ফলে সুদানসহ বিশ্ববাসীর কাছে তার সম্মান ও মর্যাদা আকাশচুম্বী।
ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমরা যেসব অভিযোগ তোলে, ড. হাসান আল তুরাবি চমৎকারভাবে সেসব খ-ন করেন। বিশেষত, ইসলামে নারীর মর্যাদা ও অধিকারের প্রশ্নে তিনি কিছু অসাধারণ বিষয় তুলে ধরেছেন, যা অমুসলিমদের সকল অভিযোগকে ধূলিসাৎ করে দেয়। নারী বিষয়ে তিনি একটি বিখ্যাত বই লিখেন, ‘Women between the teachings of religion and the customs of society’। এ বইয়ে ইসলামে নারীর ভূমিকা সম্পর্কে তুরাবি যে বিপ্লবী ভাষ্য দিয়েছেন তা রীতিমত মৌলবাদী, নারীবাদী, মার্কসবাদী সব তরফের কাছেই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। তুরাবীর এই ভূমিকার ফলেই সুদানে মহিলা ভোটের হাওয়া ঘুরে যায় ইসলামী শক্তির পক্ষে এবং ইসলামিক আইডেন্টিটি ও নারীবাদী চেতনায় বিশ্বাসীরা সুদানে মার্কসবাদীদের ছাড়িয়ে যায়। তুরাবী এ বইয়ে প্রথমে যুগের মুসলিম সমাজে নারীদের ভূমিকার নজির দিয়েছেন এবং এই ভূমিকাকে কুরআন ও হাদীসের নির্দেশের সাথে সমন্বয়  করে বলতে চেয়েছেন : in the religion of Islam, a women is and independent entity, and thus a fully responsible human being. Islam addresses her directly and does not approach her through the agency of Muslim males.
এ বইটি বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য তালিকায় রাখা হয়েছে। তিনি কেবল বই লিখেই বসে থাকেননি; ইসলামী ঐতিহ্যের আলোকে সুদানের নারীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে হাজির করার ক্ষেত্রে অসামান্য ত্যাগও স্বীকার করেছেন। বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড এবং ইসলামের প্রতি অনড় অবস্থানের কারণে সুদানের সামরিক সরকার তাকে কারাগারে প্রেরণ করে। ২০০১ সাল থেকে প্রায় চার বছর কারাভোগ করার পর ২০০৫ সালে তিনি মুক্তি পান। এ মানুষটির বহুবিদ প্রতিভা বিশ্ববাসীকে কেবল অবাক করেই দেয় না, আত্মবিশ্বাসী মানুষকে সামনে চলার পথও খুঁজে দেয়।
১৯৬৪ সালে দেশে ফেরার পর ড. তুরাবি খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ফ্যাকাল্টিতে গুরুত্বপূর্ণ পদায়ন পান। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই আহ্বান উপেক্ষা করে তৎকালীন সুদানী সামরিক শাসক ইব্রাহিম আবুদের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত জনসমাবেশে এক তীব্র ও ঝাঁঝালো বক্তৃতা দেন। সেই থেকে তুরাবি সুদানী রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে এসে হাজির হন এবং আজও তিনি সেখানে অবস্থান করছেন। অনেকের ধারণা ১৯৮৯ সালে সুদানে ইসলামী শক্তির মদদে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে যে উমর আল বশিরের সরকার ক্ষমতায় আসে তার প্রধান তাত্ত্বিক ও নেপথ্যের নায়ক আসলে তিনি। তুরাবির সবচেয়ে বড় ভূমিকা হচ্ছে তিনি তাঁর জীবদ্দশায় কয়েক দশকের মধ্যে সুদানী সমাজ ও রাষ্ট্রের ইসলামীকরণের ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ইসলামের অন্তর্মুখিতা কাটিয়ে তিনি এটিকে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রোগ্রাম হিসেবে সকলের সামনে তুলে ধরেছেন যা অনেকের কাছে চ্যালেঞ্জের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে প্রেসিডেন্ট বশিরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত। দারফুরে গণহত্যার ঘটনায় বশিরকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করেছিল আদালত।  ড. তুরাবি ছিলেন সুদানের একমাত্র রাজনৈতিক নেতা যিনি ওই গ্রেফতারি পরোয়ানাকে সমর্থন করেছিলেন।  অবশ্য নিজের ওই কর্মকান্ডের জন্য তাকে মাসুল দিতে হয়েছে।  এ ঘটনার দুদিন পরই ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে তাকে গ্রেফতার করেছিল সরকার।  এক সময়ের বন্ধু সামরিক শাসক বশিরের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার পর তিনি নিজের দল ‘পপুলার কংগ্রেস পার্টি’ গড়ে তুলেছিলেন।  উচ্চশিক্ষিত তুরাবির ইংরেজি, ফারসি, জার্মান ও আরবি ভাষায় সমান দক্ষতা ছিল।  ভাষাগত পান্ডিত্যের কারণেই বিদেশী সংবাদ মাধ্যমগুলোতে তার কদর ছিল।  ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি সুদানের এটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন।  ১৯৮৯ সালে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রী হয়েছিলেন এবং ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি সুদানের ন্যাশনাল এসেম্বলি’র স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন।  তিনি ২০১৬ সালের ৫ মার্চ ইন্তিকাল করেন।
বর্তমান সময়ে প্রয়োজনের আলোকে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ থিউরি গুলোকে সম্বনয় করা অতি জরুরি।  ইসলামের নিয়মগুলোকে বর্তমান সময়ের আলোকে ইন্টারপেইট করতে হবে বলে মনে করতেন তুরাবি।  পশ্চিমা বিশ্বের হলেই গ্রহণ করা যাবেনা এমন ধারণা করা ঠিক বলে মনে করতেন না তুরাবি।  ভালো কিছু গুলো গ্রহণ করার পক্ষে সব সময় তুরাবি ছিলেন। ১৯৬৪ সালে দেশে ফিরে তিনি প্রথম কাজ করেন খার্তুম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নীতি-নির্ধারণী বিতর্কে সুদানের তৎকালীন সামরিক শাসক ইব্রাহীম আবুদকে আক্রমন করেন। এটি চলমান আবুদবিরোধী আন্দোলনে নতুন গতি দেয় এবং বিরোধী দলের এই আন্দোলনে মুসলিম ব্রাদারহুডের অবস্থানকে আরো মজবুত করে। এর ফলে ১৯৬৪ সালের অক্টোবরে আবুদ সরকারের পতন ঘটে। এই আন্দোলনের সফলতা এবং তুরাবী ও মুসলিম ব্রাদারহুডের অভিজ্ঞতা তুরাবির রাজনৈতিক পরিপক্বতার প্রমাণ। তুরাবির এই সাফল্য ঠিক সরাসরি ইসলামী কোন অবস্থান থেকে আসেনি বরং একটি সামগ্রিক সমস্যার তিনি একটি ইসলামী অভিব্যক্তি ঘটিয়েছিলেন। তুরাবির নেতৃত্বের এই বিশেষ কৌশলই তাঁকে সুদানী রাজনীতি ও ইসলামী আন্দোলনের মধ্যমণি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তুরাবি একই সাথে সুদানের ব্রাদারহুডের নেতৃত্বও দিয়েছেন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিতে যেয়ে অন্যান্য রাজনীতিবিদদের সাথে তার প্রতিদ্বদ্ধিতায় নামতে হয়েছে। এই প্রতিদ্বদ্ধিতায় তিনি অন্য সকলকে ছাড়িয়ে গেছেন এবং ব্রাদারহুডের মতো একটি এলিটিস্ট প্রতিষ্ঠানকে রীতিমত জনপ্রিয় রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত করেছন।
হাসান আল তুরাবির চিন্তাভাবনার মূলে আছে তাঁর ইসলামকে বিশ্বশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। কিন্তু সেই রকম সামর্থ্য অর্জন করতে হলে তুরাবি মনে করেন আধুনিককালে ইসলামের তাজদীদ বা পুনরুজ্জীবন দরকার। এই কাজ করতে হলে প্রথমে চাই একালে মুসলিম সমাজের দুর্বলতাগুলোকে চিহ্নিত করা এবং সকল বিশ্বাসীকে এই পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়া। তুরাবির মুসলিম ইতিহাস চিন্তার একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে তাজদীদ। কারণ প্রতি যুগেই ইসলামের তাজদীদ প্রয়োজন। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত না থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের বিকাশ স্তব্ধ হয়ে যায় এবং ইসলাম পরিণত হয় একটি আচারসর্বস্ব জীবনীশক্তিহীন ধর্মে। অবশেষে দেখা যায় ইসলাম বিশ্বাসীরা এমন রীতিনীতি নিয়ে বসবাস করছে যাকে আর কোনভাবেই ইসলামসম্মত বলা চলে না। 
তুরাবি তাই মনে করেন ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসে এই তাজদীদ ও তাকলীদের (অতীতের অন্ধ অনুকরণ) পারস্পারিক উত্তেজনা ও দ্বন্দ্বমানতা বরাবর ছিল। তুরাবি অবশ্য এটা মনে করেন না তাজদীদ মানে হচ্ছে ইসলামের মৌলিক নীতিকে পাল্টে দেয়া কিংবা নতুন পরিস্থিতির সাপেক্ষে কুরআন শরীফের পরিবর্তন ঘটানো। তুরাবির কাছে তাজদীদ মানে হচ্ছে: The revelation in the Qur’an is the comprehensive revelation of God’s eternal truth. However, the implications of that Qur’anic message for specific peoples, times and places do change.[ John L. Esposito and John O. Voll, Makers of Contemporary Islam. New York; Oxford University Press, 2001..]
১৯৬৫ সালে সুদান কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হওয়ার পর সেখানকার সাংবিধানিক সংকটের প্রেক্ষাপটে গঠিত কমিটির সদস্য হিসেবে তুরাবী যে মতামত দেন তার মধ্যে এরকম অভিব্যক্তি দেখা যায়। সুদান কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৬৪ সালে আবুদ সরকারের পতনে গুরুতপূর্ণ ভূমিকা রাখা এবং পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালের সংসদ নির্বাচনে বেশ কয়েকটি সিট পায়। কিন্তু ব্রাদারহুডের চাপে পার্লামেন্টে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করে বিল পাস হয়। এ ঘটনাকে সুপ্রিম কোর্ট অসাংবিধানিক হিসেবে আখ্যায়িত করলে সেখানকার সুপ্রিম কাউন্সিল তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে সার্বিক পরিস্থিতির সাপেক্ষে রিপোর্ট দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন, যার সদস্য হিসেবে তুরাবি কাজ করেন। কমিটির অন্যান্য সদস্যের মতো তুরাবিও আইন প্রণয়নে সংসদের চূড়ান্ত ক্ষমতার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন এবং একই সাথে তিনি রিপোর্টের সাথে যোগ করে দেন: The Constituent Assembly is the agency entrusted with the exercise of the highest constitutional authority and it is an expression of the sovereignty which the constitutions establish for the Ummah after God.
এখানে তুরাবির ‘খোদার পরে’ শব্দটার ব্যবহার লক্ষণীয়। পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বকে তিনি খোদায়ী কর্তৃত্বের আয়ত্তাধীন রেখেছেন যা তাঁর ইসলামী প্রত্যয়ের বহিঃপ্রকাশ। তুরাবী শুধুরিপোর্ট দিয়েই ক্ষান্ত ছিলেন না, এই সাংবিধানিক সংকটের কারণ বিশ্লেষণ করে তিনি লেখেন: The Sudanese constitution is simply a collection of limbs amputated from foreign constitutions and imposed on the Sudanese people.
সুতরাং ধার করা ব্যবস্থা নয়; কার্যকর সংস্কার ও পুনর্জীবনের কাজ করতে হলে ইসলামের ভিত্তিতেই করতে হবে। এ প্রসঙ্গে তুরাবির পুনর্জীবনের জন্য দু’টি বিষয় চিহ্নিত করেছেন। একটি ফিকাহ্র পুনঃনির্মাণ, অপরটি শরীয়াহ্র বাস্তবায়ন। মুসলিম চিন্তার জগতে শরীয়াহ বিবেচিত হয় ইসলামী আইন হিসেবে যার উৎস হলো পবিত্র কুরআন ও রাসূলের (সা.) সুন্নাত। অন্যদিকে ফিকাহ্ হচ্ছে শরীয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা, বিশ্লেষণ ও তার ফলাফল। তার মানে ফিকাহ্ হচ্ছে মানবীয় চিন্তাপ্রসূত, শরীয়াহ ঐশী জ্ঞানলব্ধ। ফিকাহ্ হচ্ছে শরীয়াহ্র উপর ভিত্তি করে মানবীয় সমস্যার সমাধান বের করার পদ্ধতি। মুসলিম সমাজের মধ্যকার সমতা ও ইনসাফের ধারণা যা কিনা শরীয়াহ্ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে তাকে উপেক্ষা করা হলো। এর ফলে জন্ম হলো তথাকথিত ঐতিহ্যবাহী মুসলিম সমাজের। ঐতিহাসিক অবক্ষয়ের ধাক্কায় যে তথাকথিত মুসলিম সমাজ তৈরি হয়েছে তুরাবী মনে করেন এটিকে আজ বদলে ফেলা দরকার এবং ইসলামপন্থীদের দায়িত্ব হচ্ছে সেই সংগ্রামে এগিয়ে আসা। তার কথা শোনা যাক:  A revolution against the condition of women in the traditional Muslim societies is inevitable and that is the task of Islamists to close the gap between the fallen historical reality and the desired model of ideal Islam.[ Hasan Turabi, Women in Islam and Muslim Society. London: Mile Stones, 1991.] তাত্ত্বিকভাবে চিন্তা করলে ইসলামী রাষ্ট্র বা সরকার বলতে কি বোঝায়? তুরাবী একটা মডেল খাড়া করেছেন, যদিও এ মডেল প্রশ্নোর্ধ্ব নয়। তবুও বলতে হবে ইসলামী দুনিয়ায় ইসলামী রাষ্ট্রের মডেল একালে তাঁর মত দু’একজনই সৃষ্টি করতে পেরেছেন। এখানেই তুরাবীর সাফল্য। ইসলামবাদীরা এ মডেল থেকে অনুপ্রেরণা পাবেন। ভবিষ্যতের ইসলামবাদীরা এ মডেলের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো অতিক্রম করে নতুন মডেল উপস্থাপন করবেন এ আশা করা যায়।
তুরাবী বলেছেন ইসলামী রাষ্ট্রের মডেল হবে পুরোপুরি গণতান্ত্রিক। কোনভাবেই এটা স্বৈরাচারী বা কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা নয়। এখানে সরকারের ভূমিকা অনেকখানি সীমিত। আইন সামাজিক নিয়ন্ত্রনের একমাত্র চাবিকাঠি নয়। নৈতিক বিধি, ব্যক্তির বিবেকবোধ এসবেরও গুরুত্ব রয়েছে এবং এসবই স্বাধীন মতামতের ব্যাপার। ইসলামের প্রতি মননশীল মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কি হবে তা মোটেই নিয়ন্ত্রিত বা বিধিবদ্ধ হবে না। মূল ধারণাটা হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রে স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ। শুধু অমুসলিমের স্বাধীনতা নয়, মুসলমানদের মধ্যে চিন্তার বহুত্বকেও স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ইসলামের মূল তত্ত্বটা তৌহিদবাদী। সুতরাং ইসলামী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব সেকুলার রাষ্ট্রের মতো নয়। ইসলামী রাষ্ট্রও সেকুলার নয়। ইসলামী রাষ্ট্রে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। ধর্মহীনতা আত্মবিভাজন ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার পথ পরিষ্কার করে

Monday, March 4, 2019

মুক্তিযুদ্ধোত্তর জাতীয় সংহতির চেষ্টা ও বিভেদের প্রয়াস - আবুল আসাদ

    

        মুক্তিযুদ্ধোত্তর শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার এক পর্যায়ে জাতীয় সংহতি ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠার শক্তিশালী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা উপলক্ষে ‘বাঙালীরা ক্ষমা করতে জানে’-কথা দিয়েই তার এই উদ্যোগের যাত্রা শুরু।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, সেটা মানব ইতিহাসের চলমান সংস্কৃতির একটা অংশ। আজকের আধুনিক বিশ্ব যাকে বলা হয়, সেখানেও রয়েছে এর উজ্জ্বল অনেক দৃষ্টান্ত। ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক অন্যায় যুদ্ধে হাজার হাজার ভিয়েতনামীকেই শুধু হত্যা করা হয়নি, বর্বর বোমা বর্ষণে হাজারো জনপদ, ফসলের মাঠ, বিলিয়ন বিলিয়ন টাকার সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে তাদের গলাগলি ধরার ক্ষেত্রে ক্ষমা চাওয়ার দাবী বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। সবচেয়ে বড় আত্মঘাতি ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর দক্ষিণের মধ্যে এই গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়, অন্য অর্থে বলা যায় এই গৃহযুদ্ধ হয় ঐক্যপন্থী ও বিভেদ পন্থীদের মধ্যে। এই যুদ্ধে ৬ লাখ ২০ হাজার মানুষ মারা যায়। আহত হওয়ার সংখ্যা ৪ লাখ ৭৬ হাজার। এই যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐক্যপন্থীরা বিজয়ী হয়, পরাজিত হয় দক্ষিণের বিচ্ছিন্নতাবাদিরা। যুদ্ধকালে যত রক্তই ঝরুক, দক্ষিণের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যে দিন যুদ্ধ শেষ হয়, তারপর আর এক ফোটাও রক্ত ঝরেনি। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে, বিচার তো দূরে, ফাঁসি তো আরও দূরে, কেউ অভিযুক্তই হয়নি। যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ঘোষণা করেন, “To get the deluded men of the rebel armies disarmed and back to their homes ......... Let them once surrender and reach their homes, they wan’t take arms again.... Let them all go, officers and all, I want submission, and no more bloodshed.... I want no one punished, treat them liberally all around” যার সারকথা হলো: বিদ্রোহী সৈনিক যারা অস্ত্র ত্যাগ করবে, আত্মসমর্পণ করবে এবং বাড়িতে ফিরে যাবে, আর অস্ত্র হাতে নেবে না, তাদের অফিসারসহ সকলকে ছেড়ে দাও। আমি আনুগত্য চাই, আর কোনো রক্তপাত চাই না। চাই না কেউ শাস্তি পাক। সর্বত্র সকলকে উদারভাবে দেখতে হবে।’ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের এ ঘোষণা অক্ষরে প্রতিপালিত হয়েছে। ঐক্যপন্থী বিভেদপন্থী সকলেই যুদ্ধের পর একে অপরের গলা জড়িয়ে ধরেছে। আজও গলা জড়িয়ে ধরেই রয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশে তা হয়নি। স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান বাহিনীর যুদ্ধ অপরাধীদের ছেড়ে দিলেও, যাদের যুদ্ধ অপরাধী কিংবা মানবতা বিরোধী অপরাধীর তালিকায় নাম ছিল না, তাদের জন্যে নতুন আইন করে, নতুন ট্রাইবুন্যাল করে, বিচারের কাঠ গড়ায় তুলে ফাঁসি পর্যন্ত দেয়া হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৫ দশক পর। কেউ কেউ অবশ্য বলেন এই বিচারে বাইরের হাত রয়েছে। সেই ‘বাহির’টা যদি ভারত হয়, তাহলে ব্যাপারটা বিস্ময়কর হয়ে দাড়ায়। কারণ ভারতের কারণেই বা ভারত চেয়েছিল বলেই ১৯২ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী সৈন্যের বিচার বাংলাদেশ করতে পারেনি বিচারের জন্যে আইন তৈরি ও ট্রাইবুন্যাল গঠন করা সত্ত্বেও। ভারত তার স্বার্থেই তখন ওটা করেছিল। কারণ ভারত চায়নি যে, পাকিস্তানী সৈন্যের ১৯২ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার হোক। এর পিছনে রহস্য ছিল, সিমলা চুক্তি (২ জুলাই ১৯৭২) এবং দিল্লী এগ্রিমেন্ট (২৮ আগস্ট ১৯৭৩) অনুসারে ভারত ও পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তার মধ্যে বাংলাদেশে ধৃত পরে ভারতে আশ্রয়ে যাওয়া পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীরাও শামিল ছিল। এর বড় প্রমাণ হলো, দিল্লী এগ্রিমেন্ট ধারা-৩ এর ৩ ও ৫ উপধারায় যেখানে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে আটকে পড়া মানুষ বিনিময়ের কথা আছে। সেখানে যুদ্ধবন্দীর উল্লেখ নেই। পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের উল্লেখ আছে ধারা-৩ এর উপধারা ১ এবং ২-এ, কিন্তু এই বিনিময় সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের ভূমিকার কোন উল্লেখ নেই। অন্যদিকে উপধারা ৬-এ ভারত-প্রতিশ্রুত পাকিস্তানী বন্দী বিনিময় শেষ না হওয়া পর্যন্ত ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীর বিচার না করার বাংলাদেশের সম্মতির কথা বলা হয়েছে, কিন্তু এ সম্মতি বাংলাদেশ কখন দিল সে কথার কোন উল্লেখ নেই। উল্লেখ্য, দিল্লী এগ্রিমেন্টটি সিমলা চুক্তির মতই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এর পরিষ্কার অর্থ হলো, বাংলাদেশের মতামতের তোয়াক্কা না করেই ভারত পাকিস্তানের সাথে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের চুক্তি করেছিল। যুদ্ধাপরাধীদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে এইভাবে ভারতের ইচ্ছাটি প্রধান নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে।
শেখ মুজিব সরকার ভারতীয় চাপে ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীসহ ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দীকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবার পর স্বাভাবিকভাবেই দেশীয় কলাবরেটরদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেন। অবশ্য স্বাধীনতা উত্তর শেখ মুজিবের সরকার কিন্তু হঠাৎ করেই কলাবরেটরদের ক্ষমা ঘোষণা করেননি। কেউ কেউ মনে করেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী ও যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানী সৈন্যদেরই যখন অবস্থার কারণে বা অবস্থার প্রয়োজনে নিঃশর্তে ছেড়ে দিতে হলো, তখন ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় দেশের যারা পাকিস্তানী সৈন্যের সহায়তা করেছেন বা তাদের সহযোগী হয়েছেন, তাদের শাস্তি দেয়ার যৌক্তিকতা খুঁজে পাননি বলেই বাংলাদেশের তদানীন্তন সরকার প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান কলাবরেটরদের সাধারণ ক্ষমা করেন। ঘটনা কিন্তু মাত্র এটুকুই নয়। কলাবরেটরদের ক্ষমা ঘোষণা মাত্র এ ধরনের কোন চিন্তা থেকে হয়নি। সাধারণ দাবি ও সাধারণ জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতেই এই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা হয়। ১৯৭২ সালের মার্চ থেকেই আবুল মনসুর আহমদ, আবুল ফজলের মত দেশের শীর্ষ বুদ্ধিজীবীসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের তরফ থেকে কলাবরেটরদের ছেড়ে দেবার আবেদন ও দাবি উত্থিত হতে থাকে। এককালীন আওয়ামী লীগ নেতা এবং সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী একজন সর্বজনমান্য নেতা জনাব আতাউর  রহমান খান এই সময় এক বিবৃতিতে বলেন, “জাতি পুনর্গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সমাধা না করে সরকার সারা দেশে দালাল ও কল্পিত শত্রুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ায় রত আছেন। মনে হচ্ছে, এটাই যেন সরকারের সব চাইতে প্রধান কর্তব্য। যারা ভিন্ন রাজনৈতিক মত পোষণ করতেন, অথচ খুন, অগ্নিসংযোগ, নারী ধর্ষণ, কিংবা লুটপাটের মতো জঘন্য কার্যে প্রবৃত্ত হননি, তাদের উপর গুরুতর শাস্তি আরোপের মাধ্যমে দেশের কোন উপকার হবে না। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগে যারা বেপরোয়াভাবে বাংলাদেশ আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন, তাদের অনেকে সরকারের উচ্চপদে আসীন হয়েছেন, অথচ মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থন থাকা সত্ত্বেও যারা পাক বাহিনীকে সমর্থন দান করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাদের অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে কিংবা শরণার্থী হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। এই আইন জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলেছে এবং এই আইনের মাধ্যমে বিচার একটা প্রহসনে পরিণত হয়েছে। বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করে ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ বিচার ও সকল বিরোধী দলীয় রাজনীতিবিদদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সুপারিশ করছি।”
এই ধরনের বিভিন্ন বিবৃতি ও দাবির প্রেক্ষিতে এবং দেশের প্রকৃত পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর শেখ মুজিবের সরকার সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিয়ে নিম্নোক্ত ‘প্রেস নোট’ প্রচার করেন :
“সরকার ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশে (১৯৭২) সালের রাষ্ট্রপতির ৮ নং আদেশ মোতাবেক অপরাধের দায়ে দণ্ডিত অথবা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষমা প্রদর্শনের প্রশ্নটি পুনরায় বিবেচনার পর ঘোষণা করিতেছেন :
১. এই আদেশের ২ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত (ক) উক্ত আদেশ মোতাবেক যে কোন অপরাধের দায়ে দণ্ডিত ব্যক্তিদের দণ্ড ১৮৮৮ সালের ফৌজদারী দণ্ডবিধির ৪০১ ধারা মোতাবেক মওকুফ করা হইল এবং উক্ত আদেশ ব্যতীত অপর কোন আইন বলে বিচার্য ও শাস্তিযোগ্য কোন অপরাধের সহিত জড়িত থাকার জন্য গ্রেফতারী পরওয়ানা না থাকিলে সেইসব ব্যক্তিকে কারাগার হইতে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হইবে। (খ) উক্ত আদেশ বলে যে সকল ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেট অথবা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলা বিচারাধীন রহিয়াছে উল্লিখিত ম্যাজিস্ট্রেট অথবা ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে সে সব প্রত্যাহার করিতে হইবে এবং এই আদেশ ব্যতীত অপর কোন আইনে বিচার্য ও শাস্তিযোগ্য অপরাধের হুলিয়া না থাকিলে তাদেরকে সরকারি হেফাজত হইতে মুক্তি প্রদান করিতে হইবে। (গ) এই আদেশ বলে বিচার্য ও শাস্তিযোগ্য অপরাধের দায়ে যে সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হইয়াছে অথবা তদন্ত চলিতেছে সেই সব মামলা ও তদন্ত কার্য বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে এবং সব গ্রেফতারী পরওয়ানা অথবা আদালতের হাজির হওয়ার নির্দেশ এবং এই আদেশ বলে কোন ব্যক্তির ব্যাপারে তাহার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ থাকিলে ইহা বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে এবং অপর কোন আইনে বিচার্য ও শাস্তিযোগ্য না হইলে তাহাদেরকে সরকারি হেফাজত হইতে মুক্তি প্রদান করিতে হইবে; তবে কোন ব্যক্তি অনুপস্থিতিতে দণ্ডিত হইয়া থাকিলে অথবা কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরওয়ানা থাকিলে তাদের ক্ষেত্রে উপযুক্ত আদালতে হাজির হইয়া ক্ষমা ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা পর্যন্ত এই আদেশ কার্যকর থাকিবে।
২. এই আদেশ বলে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা (হত্যা), ৩০৪ ধারা (হত্যার চেষ্টা কিন্তু হত্যার শামিল নয়), ৩৬৭ ধারা (ধর্ষণ), ৪৩৫ ধারা (অগ্নিসংযোগ অথবা বিস্ফোরক দ্রব্য দ্বারা অপকর্ম সাধন), ৪৩৬ ধারা (ঘরবাড়ি ধ্বংসের অভিপ্রায়ে অথবা বিস্ফোরক দ্রব্য দ্বারা অপকর্ম সাধন) এবং ৪৩৮ ধারা (জাহাজে অগ্নিসংযোগ অথবা বিস্ফোরক দ্রব্য দ্বারা অপকর্ম সাধন) মোতাবেক অভিযুক্ত ও দ-িত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ১ নং অনুচ্ছেদ মোতাবেক ক্ষমা প্রদর্শন প্রযোজ্য হইবে না।
মুজিব সরকারের এই ক্ষমা ঘোষণা সর্বমহল থেকে অভিনন্দিত হয়। মুজিব সরকারের প্রবল বিরোধী এবং বাম আন্দোলনের গুরু বলে পরিচিত, ভাসানী ন্যাপের সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তার এবং দলের সম্পাদক মণ্ডলীর পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ন্যাপ বহু আগে থেকেই নিরপরাধ ব্যক্তিদের মুক্তি দাবি করে আসছে।’ বিবৃতিতে বাংলাদেশ দালাল আইন সংক্রান্ত আইনের ৮ নং ও ৫০ নং ধারা বাতিল করার দাবি জানান। তিনি ১৫ ডিসেম্বর আরেক বিবৃতিতে বলেন, ‘ক্ষমা চাই, সমানাধিকার চাই। রাষ্ট্রপতি আদেশের ৫০ ও ৮ ধারা বাতিল চাই।’ বাংলাদেশ  জাতীয় লীগের সভাপতি জনাব আতাউর রহমান খান তার বিবৃতিতে বলেন, ‘আরো আগেই দেশের স্বার্থে এ সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল। এর ফলে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির আরো উন্নতি হবে এবং মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ দেশ গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করে বিশ্বস্ততার প্রমাণ দেবেন।’ দেশের প্রবীণ রাজনীতিক ও চিন্তাবিদ জনাব আবুল হাশিম প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারকে অভিনন্দিত করে বলেন, ‘জনগণের ভাগ্যকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্যে সরকার সঠিক পন্থাই বেছে নিয়েছেন। গণতন্ত্রের এ উদ্যম বজায় থাকলে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা রয়েছে।’ সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা এবং স্বনামধন্য কলামিস্ট ও লেখক আবুল মনসুর আহমদ (স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের পিতা) বলেন, ‘আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় সরকার যখন একবার অনুকম্পার দরজা খুলিয়াছেন, ষোল হাজারের মতো বন্দীকে মাফ করিয়া দিয়েছেন, তখন বাকী সবার ক্ষেত্রেও তেমনি উদারতা প্রদর্শন করুন। অন্যথায় দুই বছর পরে আজ  যেমন চারশ লোককে প্রমাণের অভাবে মুক্তি দিতে হলো, বার বছর পর (৩৭ হাজার দালালদের বিচারে ১২ বছর লাগবে) মানে গ্রেফতারের সময় হতে ১৪ বছর পর আরো অনেক লোককে তেমনি মুক্তি দিতে হইতে পারে।’ (ইত্তেফাক, ২ নভেম্বর, ১৯৭৩)। তদানীন্তন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ শেখ মুজিব সরকারের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সিদ্ধান্তকে অভিনন্দিত করে বিবৃতি দেয়।
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মত ১৯৭৬ সালে কলাবরেটর আইনের বাতিলও ছিল অবস্থার একটা স্বাভাবিক পরিণতি। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছিল ১ লাখ লোককে এবং ৩৭৪৭১ জন দালালকে অভিযুক্ত করা হয়। তাদের বিচারের জন্য ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এই ৭৩টি ট্রাইব্যুনালে ২২ মাসে ২৮৪৮টি মামলার বিচার কাজ সম্পন্ন হয়। এদের মধ্যে দণ্ডিত হয় মাত্র ৭৫২ জন, তাও প্রায় সব ক্ষেত্রেই ছোট খাটো অপরাধের জন্য। অবশিষ্ট ২০৬ জন খালাস পেয়ে যান। এই পটভূমিতে ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষিত হয়। সাধারণ ক্ষমার অধীনে ১৯৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছাড়া পেয়ে যায় ৩০ হাজার বন্দী। এখানে উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের বিভিন্ন অপরাধ ও অভিয়োগে স্বাধীনতা উত্তরকালের যাদের বন্দী রাখা হয়, বিচার করা হয়, শাস্তি দেয়া হয়, তাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী নাম করার মতো কেউ ছিলনা। তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা অভিয়োগ দায়ের করা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের পাঁচ দশকের মাথায় জামায়াত নেতৃবৃন্দের অপরাধ খুঁজে পাওয়া কোনো যুক্তিতেই আসে না।
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলেও হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ এই চার অপরাধের  বিচার, গ্রেফতার ও শাস্তি বিধানের আইনী বিধান বহাল রাখা হয়। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার ১৯৭৬ সালের দালাল আইন বাতিল হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ দুই বছর এক মাস সময়ে উক্ত চার অপরাধের অভিযোগে একটিও মামলা দায়ের হয়নি। এই অবস্থার পটভূমিতেই ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে দালাল আইন বাতিল হয়ে যায়।
এখানে একটা বড় প্রশ্ন হলো ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর হতে ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে কোন মামলা দায়ের হলো না কেন? এর একটি জবাব হলো ঐ চারটি অপরাধের ক্ষেত্রে দায়েরযোগ্য কারও কোনো অভিযোগ ছিল না। এই জবাবটি অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তব নয়। কারণ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সংঘাতে দায়েরযোগ্য ঐ ধরনের কোন অপরাধ একেবারেই ছিল না তা হতে পারে না। অন্য আরেকটি জবাব এই হতে পারে যে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিও ছিল, অপরাধও ছিল কিন্তু সংশ্লিষ্ট সংক্ষুব্ধরা অভিযোগ বা মামলা দায়েরে আগ্রহী হয়নি। এটাই অনেক ক্ষেত্রের বাস্তবতা বলে ধরে নেয়া যায়। কেন আগ্রহী হয়নি? কেন সংক্ষুব্ধ মানুষ অপরাধীর শাস্তি বিধানের জন্য মামলা দায়েরে এগিয়ে যায়নি? খুব বড় একটা প্রশ্ন এটা। এক কথায় এর কোন জবাব মিলবে না। এই প্রশ্নের জবাব প্রকৃতপক্ষে সন্ধান করতে হবে বাংলাদেশের সমাজ কাঠামো এবং বাংলাদেশের মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সমন্বয় চিন্তার মধ্যে। এই ক্ষেত্রে এই সময়ের সুন্দর একটা সমাজ বিশ্লেষণ দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক ড. তারেক মুহাম্মদ তওফীকুর রহমান তার “বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলেম সমাজ : ভূমিকা ও প্রভাব (১৯৭২-২০০১)” শীর্ষক গ্রন্থে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর অবস্থার উত্তাপ ঠাণ্ডা হয়ে আসার সাথে সাথে দালাল আইনে ধৃত এবং বিচারের সম্মুখীন ব্যক্তিদের বিচার সংক্রান্ত বিষয়টি সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও জটিলতার সৃষ্টি করে চলছিল অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে-এই সামাজিক চিত্রটি এক কথায় সামনে আনার পর তিনি লিখেছেন :
“আপাত: পরস্পর বিচ্ছিন্ন ও শত্রুতার নেপথ্যে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ হলো ‘কমপ্যাক্ট সোসাইটি।’ আবহমান কাল থেকে শাশ্বত গ্রাম্য সালিশ বিচার ব্যবস্থার প্রচলনে গ্রামীণ সমাজে যে ভারসাম্য বর্তমান ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় তা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তা নতুন আঙ্গিকে ও নেতৃত্বে স্থিতিশীল হয়ে আসতে শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের উত্তেজনা কেটে যেতে থাকে এবং মুক্তিযোদ্ধাগণও সমাজের রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হতে থাকেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তীতে উত্তেজনা প্রশমনে রক্তের বন্ধন, আত্মীয় সূত্রতা এবং সমাজ গোষ্ঠীর বন্ধনে অপরাধকারী দালালদের আশ্রয় দেবার ব্যাপক প্রবণতা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে। ‘ক্ষমাই মহত্বের লক্ষণ’ এই মহানুভবতার চিরন্তনী আবহে লালিত বাংলার মানস গঠন শাস্তি বিধানের  পরিবর্তে সামাজিক সালিশ ও সমঝোতার পথেই অগ্রসর হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় একই পরিবারের পিতা শান্তি কমিটির সদস্য হয়েছে, অপরদিকে পুত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। পিতা ও পুত্রের এই বিপরীত অবস্থান দীর্ঘদিন আক্রোশ মনোভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি। মুক্তিযোদ্ধা পুত্র দালাল পিতাকে বাঁচানোর জন্য তদবির শুরু করতে কুণ্ঠিত হয়নি। অনেক দালাল এমনও ছিল যে, তারা গোপনে মুক্তিবাহিনীকে আশ্রয় দিয়েছে, খাদ্য দিয়েছে এবং প্রয়োজনমত নিরাপত্তা দিয়েছে। দালালীর অভিযোগে অভিযুক্ত ঐ ব্যক্তিটি পরবর্তীকালে ঐসব মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় প্রার্থনা করেছে এবং আশ্রয় পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রকৃত অবস্থায় বা ভিন্নভাবে যাই হোক না কেন, মুক্তিযোদ্ধাগণ প্রায় দুই হাতে ধৃত ও অভিযুক্ত দালালদের ছেড়ে দেবার সুপারিশ করতে থাকে। যা প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর দপ্তরকে পর্যন্ত প্রভাবিত করে তোলে। গ্রাম্য সালিশ, দেনদরবার, তদবির হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান ইত্যকার কারণে পরবর্তীকালে কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত বাদীপক্ষগণ মামলা চালাতে উদ্যোগ গ্রহণ হতে পিছিয়ে আসে, এমনকি মামলার ন্যূনতম সাক্ষ্য জোগাড় করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে।”
এটাই ঘটনা। সামাজিক রাজনৈতিকসহ নানা ধরনের সম্পর্ক ও আত্মীয়তার বাঁধন স্বাধীনতা যুদ্ধোত্তর পক্ষ-বিপক্ষকে সমন্বয় ও সমঝোতার দিকে নিয়ে যায়। সৈয়দ আবুল মকসুদ ‘প্রথম আলো’তে তার ‘সহজিয়া কড়চায়’ এই কথাই লিখেছেন এইভাবে, “কোন যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দালালদের বিচার না হওয়ার মূল কারণ, অনেক মন্ত্রী, সাংসদ নেতা ও বীর উত্তম মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের সহযোগী ছিল। তাদের বাঁচাতে গিয়ে সকলকেই বাঁচিয়ে দেয়া হয়। (প্রথম আলো, ১৩ নভেম্বর, ২০০৭)। শুধু বাঁচিয়ে দেয়া নয়, দীর্ঘ দুই বছর এক মাস সময় পর্যন্ত দালাল আইন বহাল তবিয়তে থাকলেও খুন, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ এই চার অপরাধের অভিযোগে মামলা দায়ের না হবার এটাও একটা কারণ।  আরেকটা কারণ হলো মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যাদের অবস্থান ছিল কিংবা পাকিস্তান বাহিনীর সহায়ক হিসেবে রাজাকার এর মত যে সব বাহিনী কাজ করেছে, যুদ্ধাপরাধী বা অপরাধী শুধুমাত্র তাদের মধ্যেই ছিল না অন্যান্য দল ও গ্রুপের মধ্যেও যুদ্ধাপরাধী বা অপরাধী ছিল। এ বিষয়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছেন : ‘এখনকার পত্রিকা পড়লে মনে হয় শুধু মুসলিম লীগ, জামায়াত বা নেজামে ইসলামীর লোকেরাই পাকিস্তানীদের দালাল ছিল। বস্তুত সবশ্রেণী ও গোষ্ঠীর মধ্যেই পাকিস্তানীদের সহযোগী ছিল। আব্দুল হক তার কম্যুনিস্ট পার্টির নামের সাথে বাংলাদেশ হবার পরও ‘পূর্ব পাকিস্তান’ রেখে দেন। অত্যন্ত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ পাকিস্তানীদের সহযোগিতা করছেন। (প্রথম আলো, ১৩ নভেম্বর, ২০০৭)। এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রুপের পরস্পরের মধ্যেও যুদ্ধাপরাধ বা অপরাধ সংগঠিত হয়েছে। বিভিন্ন বইয়ের বিভিন্ন বিবরণীতে এক দৃষ্টান্ত আছে। সম্প্রতি এটিএন-এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে মেজর জেনারেল (অব.) মইনুল হোসেন চৌধুরী এক দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধী বলতে আমরা জানি একটা ইসলামী দলকে বোঝানো হচ্ছে যারা ডানপন্থী। আমি বলবো যুদ্ধাপরাধীতো সরকারী কর্মচারীও ছিল। আমি আপনাকে প্রমাণ দিতে পারি। কারণ আমি প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। একজন বাঙালী ক্যাপ্টেন মারা যায় সরাইলে। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে হত্যা করে। কিন্তু ঐ ক্যাপ্টেনকে পরে শহীদ উল্লেখ করা হয়। সুতরাং যখন যুদ্ধাপরাধী বলবেন তখন সবাইকে বলতে হবে।’
সবাইকে যুদ্ধাপরাধী বলতে হচ্ছে বলেই স্বাধীনতা উত্তরকালে অবশেষে বিষয়টাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরে এগিয়ে যায়নি কেউ। দু’বছর সময়কালে দালাল আইনে মামলা দায়ের না হবার এটাও একটা বড় কারণ। বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতাসহ উপরোক্ত সব কারণ সম্মিলিতভাবে ১৯৭৬ সালে দালাল আইন বাতিল করার পটভূমি রচনা করে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কাছে বিষয়টা এইভাবে প্রতিভাত হবার সময়ের দাবী পূরণের অংশ হিসেবেই তিনি দালাল আইন বাতিল করেন। আওয়ামী লীগসহ যারা এ জন্য জিয়াউর রহমানের সমালোচনা করেন, তারা নিছকই রাজনীতি করেন, বাংলাদেশের সমাজ ও জনগণের কথা, এমনটি তাদের মন কি বলে সেটাও বিবেচনা করেন না।
আসলে একশ্রেণীর সুবিধাবাদীরা এবং আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দল বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধাচারণকে তাদের যে রাজনীতি, সে রাজনীতির খোরাক হিসাবেই ব্যবহার করছে যুদ্ধাপরাধের বিচার ও স্বাধীনতা বিরোধী শ্লোগানকে। এই মনোভাব এই শ্লোগান স্বাভাবিক নয়, সঙ্গতও নয়।
স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে তাদেরকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে যুদ্ধাপরাধ চ্যাপ্টার ক্লোজ করেছেন এবং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে নিছক ‘কলাবরেটর’ হওয়াকে শাস্তিযোগ্য করার পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত শেখ মুজিবুর রহমানের এসব সিদ্ধান্তকে আমরা যেন এখন অন্যায় অবাঞ্ছিত মনে করছি। এটা যদি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার রাজনীতি হয়, তাহলে আমাদের জানা দরকার জনগণের ইচ্ছার প্রতিধ্বনি করে স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবই এই রাজনীতিকে অচল করে দিয়ে গেছেন। জনগণও এই সাথে একে সমাধিস্থ করেছে। এই কারণেই দালাল খান-এ-সবুর তিন আসন থেকে নির্বাচিত হন, শাহ আজিজুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, বিচারপতি নূরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের মনোনীত এমপি প্রার্থী হতে পেরেছিলেন, মাওলানা নূরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের ধর্মপ্রতিমন্ত্রী হবার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী হয়েছেন। হাজার বলেও যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতা বিরোধী বলে জামায়াতে ইসলামীকে খাটো করা যাবে না। স্বাধীনতা উত্তরকালে তদন্ত করে তৈরি যুদ্ধাপরাধীদের তালিকায় জামায়াতে ইসলামীর কারও নাম ছিল না এবং দালাল আইনে যে ৭৫২ জনের শাস্তি কনফার্ম করা হয়েছিল, এবং যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছিল, তাদের মধ্যেও ছিল না জামায়াতে ইসলামীর কোনো লোক। 
জাতিকে ভাগ করার বিভেদাত্মক এই অভিযান শুধু স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নীতি ও ইচ্ছার ব্যতিক্রম নয়, পৃথিবীর চলমান সংস্কৃতিরও ভায়োলেশন।  আন্তঃজাতি যেমন, তেমনি দেশ জাতির অভ্যন্তরেও সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা অস্বাভাবিক নয়।  তেমনি আবার খুব স্বাভাবিক হলো তাদের সমঝোতা প্রতিষ্ঠা ও সমন্বয়ের ঘটনা।  জাতির স্বার্থেই এটা প্রয়োজন। 
বিভেদের রাজনীতি, হিংসার রাজনীতি আমাদের দেশে তীব্র হোক, এটা বাইরের অনেকেই চায়, যারা চায় আমাদের ভাগ করে শাসন করতে এবং শোষণ করতে। আমরা তাদের  এ চাওয়ার শিকার হতে পারিনা।

ইসলামের দৃষ্টিতে বাল্যবিবাহ-২


এডভোকেট আব্দুস সালাম প্রধান : ॥ পূর্বপ্রকাশিতের পর

বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে জটিলতা : ইসলামী শরীয়তে যেহেতু বাল্য বিবাহ পরিহার করার ক্ষেত্রে কোন গোনাহ নেই। সে কারনে বাল্যবিবাহ পরিহার করাই বেশী যুক্তিযুক্ত। পৃথিবীর সব দেশের ছেলেমেয়েরা ছোট বেলায় একইভাবে বেড়ে উঠেনা। পৃথিবীর অনেক দেশের ছেলেমেয়েরা নয়, দশ, এগার বা বার বছর বয়সের মধ্যে বিশাল এক শক্তিশালী দেহের অধিকারী হয়। যেমন পাকিস্তানের খাইবার পাখতুন প্রদেশ, আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার দেশ সমূহের ছেলেমেয়েরা। কিন্তু বাংলাদেশ, ভারতের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। আমাদের বাংলাদেশের মেয়েরা ষোল থেকে আঠারো বৎসরের আগে এবং ছেলেরা আঠারো থেকে তেইশ বৎসরের আগে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে বিবাহের জন্য শক্তিশালী দেহের অধিকারী হয় না। তাছাড়াও বিবাহের পর দাম্পত্য জীবন যাপন, সন্তান গ্রহণ এবং সন্তান প্রতিপালনের ন্যায় দায়িত্বপালনের জন্য মানসিক ক্ষমতার অধিকারী হয় না। স্বল্প সংখ্যক ছেলে মেয়ে বার, তের, চৌদ্দ বৎসরের মধ্যেই সুস্থ সবল দেহের অধিকারী হতে দেখা যায়। কিন্তু সে সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। আমাদের দেশের প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা বাল্য বিবাহের ক্ষেত্রে নানারুপ জটিলতার সৃষ্টি করেছে। আমার জানা একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। দুজন অন্তরঙ্গ বন্ধু তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ককে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্য তাদের সদ্য জন্ম নেওয়া কন্যা ও পুত্রের সাথে বিবাহ দেয়। এ ধরনের বিবাহকে কোলাকুলি বিবাহ বলা হত। ছেলে শিশুটি বেড়ে উঠার একপর্যায়ে খারাপ বন্ধুদের সংস্পর্শে এসে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। পড়াশোনায় ভাল রেজাল্ট করতে না পেরে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে থেমে যায়। কিন্তু মেয়ে শিশুটি সুস্থ শরীরে বেড়ে উঠে। লেখাপড়াতেও ভাল ফলাফল করে। একপর্য়ায়ে বাল্যবিবাহটি অকার্যকর হয়ে যায়। বাল্যবিবাহটি অকার্যকর হবার কারনে দু বন্ধুর বন্ধুত্বের বন্ধন চিরতরে ছিন্ন হয়ে যায়।
মেয়েটি ভাল ছাত্রী হিসেবে স্নাতোকোত্তর পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করে উত্তীর্ণ হলেও তার পরিবারকে মেয়েটির পরবর্তী বিবাহের ক্ষেত্রে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। এ ধরনের জটিলতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়ার জন্য মেয়েটি দায়ী ছিল না। বরং তার পিতার সম্পাদিত বাল্যবিবাহই জটিলতার সৃষ্টি করেছিল। দুজন কিশোর কিশোরীর মধ্যে বা একজন পরিপূর্ণ সাবালক যুবক এবং একজন কিশোরীর মধ্যে বিবাহ দেয়ার ক্ষেত্রেও এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে।   ধরা যাক কোন নাবালিকা মেয়ে যাকে নাবালক অবস্থায় তার পিতা বা কোন অভিভাবক বিবাহ দিয়েছিল। সে যদি সাবালকত্ব অর্জনের পর দেখে যে তার স্বামী অশিক্ষিত বা মাদকাসক্ত বা কর্কশ স্বভাবের। তাহলে স্বামীর সাথে যৌনমিলনের পূর্বেই মেয়েটি তার বাল্যবিবাহ বাতিল করার অধিকার রাখে। ইসলামে এ ধরনের একটি সুন্দর নীতিমালা ইসলামে থাকার পরেও  বাল্যবিবাহের কারণে মেয়েটির পরবর্তী বিবাহের ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হবে না তা কোনভাবেই বলা  যাবে না। রসুলুল্লাহ (দ.) এর যুগে এবং পরবর্তীকালে সাহাবায়ে কেরামের যুগে তালাকপ্রাপ্তা বা বিবাহিতা কোন নারী অবিবাহিতা থাকত না। আমাদের দেশের পরিস্থিতি ভিন্ন। আমাদের দেশের তালাকপ্রাপ্তা বিধবা মেয়েদের পরবর্তী বিবাহ সহজসাধ্য নয়। আমাদের দেশের স্বাভাবিক সংস্কার হলো একজন অবিবাহিত যুবক অবশ্যই একজন অবিাহিতা মেয়েকে বিবাহ করবে। আর তালাকপ্রাপ্তা বা বাধ্য হয়ে তালাক গ্রহণকারী এবং বিধবা মেয়েরা যত সুন্দরই হোক তাদের বিবাহ হবে বয়স্ক কোন পুরুষের সাথে বা যাদের স্ত্রী বিয়োগ ঘটেছে বা ঘড়ে পূর্বের স্ত্রী আছে এমন পুরুষের সাথে বিবাহ দিতে হয়। ইদানিংকালে কিছু কিছু ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বাল্যবিবাহ পরিহার করাই হবে যুক্তিযুক্ত।  তবে উঠতি বয়সের কিশোর কিশোরীদের মধ্যে অবাধ মেলামেশার ফলে যাতে কোন মেয়ে কিশোরী বয়সে গর্ভধারণ না করে, সেদিকে অভিভাবকদের কড়া নজর রাখতে হবে। শিশু বা কিশোর বয়সে ছেলেমেয়েদের বিবাহ দেয়া হলে তারা একটা বন্দী বা শৃঙ্খলিত জীবন নিয়ে তারা পরিপূর্ণ সাবালকত্বের বয়সে পা দেয়। অনেক সময় এ ধরনের বিবাহের মাধ্যমে জুড়ে দেয়া স্বামী স্ত্রীর সংসার সুখের হয় না। দুটি পরিবারের সু সম্পর্কের কারণেই সাধারণতঃ এধরনের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। কোন কারনে এধরনের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে  দুটি পরিবার পরষ্পর শত্রুতে পরিণত হয়। বাল্যবিবাহ সম্পাদন এবং পরিহার দুটিই ইসলামে জায়েজ। যে জায়েজটি সমাজের জন্য বেশী কল্যাণকর সেটি গ্রহণ করা উচিৎ। ইসলামে এই নীতিমালাকে ইস্তিহ্সান বলা হয়। অর্থাৎ দুটি ভালর মধ্যে অপেক্ষাকৃত ভালটিকে গ্রহন করা। বাল্য বিবাহ আইনের মাধ্যমে বন্ধ করার চাইতে এর কুফল তুলে ধরে গণসচেতনতা সৃষ্টি করাই যথেষ্ঠ হবে। গণসচেতনতা সৃষ্টি হলে আইন প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না। এছাড়াও আমাদের দেশের জনগনের বিরাট একটি অংশ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। অনেক সময় হতদরিদ্র ঘরের পিতা মাতারা তাদের তরুণী বা যুবতী মেয়েকে আর্থিকভাবে সচ্চল অতিবয়স্ক পুরুষদের সাথে বিবাহ দেন। এধরনের বিবাহ এখনও সংঘটিত হচ্ছে। এধরনের বিবাহে কিছুদিনের মধ্যে অনেক মেয়েই বিধবা হন। তাদের যৌবনের বিরাট একটি অংশ বৈধব্য জীবন নিয়ে কাটিয়ে দিতে হয়।
ইসলামী বিবাহ আইনের খিয়ারই বুলুগ নীতি : 
নাবালক বা নাবালিকার বিবাহ তাদের পিতা বা অভিভাবক কতৃক নাবালক অবস্থায় সম্পাদিত হইয়া থাকিলে সাবালকত্ব অর্জনের পর ঐ ধরনের বিবাহ বাতিল করার অধিকার ছেলেমেয়েদের রয়েছে। এই নীতিমালাটিকে ইসলামী আইনে খিয়ারই বুলুগ বলা হয়। এ ব্যাপারে ইসলামী আইনবিদগণের মধ্যে ইমাম আবু হানিফা (র.) এবং তার ছাত্ররা (আবু ইউসুফ র. ব্যতীত) অত্যন্ত উদার। আইনগত অভিভাবক পিতা, পিতার অবর্তমানে দাদাসহ যেকোন ডিফ্যাক্টো গার্ডিয়ান কর্তৃক নাবালক নাবালিকার বিবাহ সাবালকত্ব অর্জনের পর বাতিল করিবার অধিকার আছে মর্মে তাহারা ফতোয়া দিয়েছেন। এই ফতোয়ার স্বপক্ষে দলিল হলো সহীহ বুখারীর হাদিস নং ৫৩৩৮ এবং ৫৩৩৯। খানসা বিনতে খিযামা আনসারিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন তিনি যখন কুমারি ছিলেন তখন তার পিতা তাকে বিবাহ দেন। ঐ বিবাহ খানসার (রা.) পছন্দ ছিল না। রসুলুল্লাহ (দ.) তার নিকট সবকিছু শুনে বিবাহটি বাতিল ঘোষণা করেন। ইসলাম বিবাহযোগ্যা কুমারি, বিধবা এবং তালাক প্রাপ্তা সকল নারীর বিবাহ তার অনুমতি ছাড়া নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রসুলুল্লাহ (দ.) বলেছেন কোন কুমারী মেয়ের অনুমতি ছাড়া তার বিয়ে দেয়া যাবে না। রসুলুল্লাহ (দ.) কে জিজ্ঞাসা করা হলো কিভাবে (বিশেষতঃ কুমারী মেয়েদের ক্ষেত্রে) অনুমতি নেয়া হবে। তিনি বললেন (অনুমতি চাওয়ার পর) চুপ থাকাই তার সম্মতি। উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন কুমারী মেয়েদের অনুমতি গ্রহনের ক্ষেত্রে তাদের লাজুকতার বিষয়ে উলেল্লখ করে তিনি রসুলুল্লাহ (দ.) কে জিজ্ঞেস করলেন যে ইয়া রসুলুল্লাহ কুমারী মেয়েরা নিশ্চয়ই লজ্জা করে (বিবাহের অনুমতি দানের ক্ষেত্রে)। রসুলুল্লাহ (দ.) বললেন তার চুপ থাকাটাই তার সম্মতি। সহীহ বুখারী হাদিস নং ৩১৩৭। ইসলামে নারী পুরুষের বিবাহের ক্ষেত্রে তাদের সাবালকত্ব প্রাপ্তি হচ্ছে তাদেরসাধারন বয়স সীমা। উক্ত বয়সে পৌছার পরেই একজন যুবক যুবতী কেবল ইসলামের বিবাহ আইনের যাবতীয় শর্তাবলী যেমন ইজাব কবুল, মোহরানা, খোরপোশের বিধানসমূহ সরাসরি কার্যকর করা যায় সেই সাথে তালাকের বিধানসমূহ প্রয়োগ করা যায়।
গোটা বিশ্বের মুসলমান ছেলেমেয়েদের বিবাহের বয়সের মানদন্ড কত হওয়া উচিত : রসুলুল্লাহ (দ.) এবং মক্কায় ইসলাম গ্রহনকারী সাহাবায়ে কেরাম (রা.) নবুয়তের তের তম বর্ষে স্বপরিবারে মদীনায় হিজরত করেন। রসুলুল্লাহ (দ.) এর নেতৃত্বে মদীনায় একটি আদর্শ ইসলামী সমাজ বা একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামী রাষ্ট্র মদীনায় ইসলামী আইনের বাস্তবায়ন শুরু হয়। দ্বিতীয় হিজরী সনে তিনি তাঁর অতি আদরের ছোট মেয়ে  ঊনিশ বৎসর বয়স্কা ফাতিমা (রা.) এর সহিত চব্বিশ বৎসর বয়স্ক চাচাতো ভাই আলী (রা.) এর বিবাহ দেন। মুসলীম উম্মাহ তাদের ছেলেমেয়েদের বিবাহের ক্ষেত্রে ফাতিমা (রা.) এবং আলী (রা.) এর বয়স কে আদর্শ বয়স হিসাবে গ্রহণ করতে পারে। বিশুদ্ধ মতানুযায়ী রসুলুল্লাহ (দ.) এর নবুয়ত লাভের সময় আলী (রা.) এর বয়স ছিল দশ বৎসর (তাবকাতে ইবনে সাদ)। আর ফাতেমা  (রা.) ছিলেন রসুলুল্লাহ (দ.) এবং খাদিজাতুল কুবরা (রা.) এর ছোট মেয়ে। নবী করীম (দ.) এর ওহী লাভের পাঁচ বৎসর পূর্বে কাবা ঘর পূনঃনির্মাণের বছর ফাতিমা (রা.) জন্মগ্রহণ করেন। (সিয়ারুআলামআন্নুবালা দ্বিতীয় খন্ড পৃষ্ঠা ১১৯)। হিজরতের বৎসর ফাতেমা (রা.) এর বয়স ছিল আঠারো ছুঁই ছুঁই। আলী ও ফাতেমা (রা.) এর বিবাহের বয়স গণনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকগণের আরো কিছু বর্ণনা আছে। বর্ণনাগুলি পরস্পর বিরোধী হওয়ায় সেগুলি গ্রহণযোগ্য নয়। বিবাহের বয়সের এই সিমাটি মান্য করা ফরজ নয়। এই বয়স সীমার আগে বা পরেও বিবাহ হতে পারে। তবে নিঃসন্দেহে মেয়েদের বিবাহের ক্ষেত্রে ঊনিশ এবং ছেলেদের বিবাহের ক্ষেত্রে চব্বিশ বৎসরের বয়স সীমাকে সুন্নাহ সম্মত বয়স সীমা বলা যায়। নবী করিম (দ.) কখনই তাঁর উম্মতকে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে উৎসাহিত করেননি। বরং তিনি একজন মুসলিম যুবকের সাথে একজন কাছাকাছি বয়সের মুসলমান যুবতীর বিবাহ হোক  সে বিষয়ে উৎসাহিত করে গিয়েছেন। বাংলাদেশের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ এ উল্লেখিত বিবাহের বয়স মেয়েদের জন্য কমপক্ষে আঠারো এবং ছেলেদের জন্য কমপক্ষে একুশ বৎসরের সীমাটি ইসলামী শরীয়তের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
রসুলুল্লাহ (দ.) এর সাথে আয়েশা (রা.) এর বিবাহ বাল্যবিবাহ ছিল কিনা : আধুনিক বিশ্বে মুসলমান তথা ইসলামী আদর্শকে হেয় করার জন্য এবং মহানবী (দ.) এর একাধিক বিবাহ ও অল্প বয়সী আয়েশা (রা.) কে বিবাহ করা নিয়ে একধরনের মিথ্যাচার করে তাঁর চরিত্র হনন করে মুসলমানদের মনে কষ্ট দেয়ার একটা মহাপ্রচার যুদ্ধ শুরু করা হয়েছে। এই প্রচারণার ফলে আল্লাহর শত্রুরা বিশেষ করে সাধারণ শিক্ষিত মুসলমানদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে যে মুহাম্মদ (দ.) এর সমস্ত কার্যক্রম ভালো বা প্রশংসনীয়। কিন্তু আয়েশা (রা.) এর সাথে তার বিবাহটি ব্যতিক্রম। আমার এক বন্ধু আমাকে একদিন বললেন বিষয়টির কারণে তিনি লজ্জাবোধ করেন (নাউজুবিল্লাহ)। তিনি বলেছিলেন বিষয়টি নবী (দ.) এর অন্যান্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে খাপ খায় না। ইদানিং এ ধরনের একটি বিষয় কতিপয় নাস্তিক মুরতাদ ব্লগার অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ আলোচনার ভিডিও প্রস্তুত করে ইউটিউবে আপলোড করেছেন। পাশ্চাত্যের কার্টুন ছবি নির্মাতারা হযরত আয়েশা (রা.) এর সাথে রসুলুল্লাহর বিবাহের কাহিনীকে অবলম্বন করে বেশ কিছু ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন ছবি নির্মাণ করে গুগল ও ইউটিউবে আপলোড করেছেন। তাদের আশা ভবিষ্যতের মুসলিম প্রজন্ম এসব দেখে যেন রসুলুল্লাহ (দ.) কে চরিত্রহীন, শিশু ধর্ষণকারী হিসাবে জানে। এ বিষয়ে প্রথম যুগের ইসলামী আইনবিদ ও বিশেষজ্ঞগণ কোন আলোচনা করেন নাই।
সে কারণে আধুনিক আলেম সমাজ ও ইসলামী বিশেষজ্ঞগণও এ বিষয়ে তথ্যভিত্তিক যুক্তিপূর্ণ কোন আলোচনা সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত বা সাধারন মুসলমানদের সামনে তুলে ধরেন নাই। ফলে নাস্তিক মুরতাদরা এক তরফা ডুগডুগি বাজানোর সুযোগ পেয়েছে। এ বিষয়ে একটি তথ্য নির্ভর বস্তুনিষ্ঠ জবাব সকল মুসলমানের নিকট থাকা উচিৎ। প্রাথমিক যুগের ইসলামী আইনবিদ, ঐতিহাসিক এবং রসুলুল্লাহ (দ.) এর জীবনী রচয়িতাগণের আলোচনায় দেখা যায় রসুলুল্লাহ (দ.) এর আপন ফুফাতো ভগ্নি যয়নাব বিনতে জাহাশ (রা.), যাকে তিনি তার পালিত পুত্র যায়িদ বিন হারেছা (রা.) এর সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন। পরে যয়নাব বিনতে জাহাশ (রা.) (যায়িদ বিন হারেছা (রা.)) কে স্বামী হিসাবে মেনে না নেয়ায় যায়িদ বিন হারেছা (রা.)  তাকে তালাক দেন। পরে আল্লাহর হুকুমে রসুলুল্লাহ (দ.) যয়নাব বিনতে জাহাশ (রা.) কে বিবাহ করেন। পালিত ছেলের স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন সেই ধুয়া তুলে রসুলুল্লাহ (দ.) এর চরিত্র হননের ব্যাপক প্রচেষ্টা চালায় তৎকালীন মুনাফিক ও ইসলামের শত্রুরা। একটি যুদ্ধে আয়েশা (রা.)  রসুলুল্লাহ (দ.) এর সাথে ছিলেন। যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে প্রাকৃতিক প্রয়োজনে আয়েশা (রা.) উটের পিঠে স্থাপিত হাউদাজ ছেড়ে দূরে চলে যান। ইতিমধ্যে যোদ্ধা দলের কাফেলা রসুলুল্লাহ (দ.) সহ চলতে শুরু করে। আয়েশা (রা.) সেখানে এসে কাউকে না পেয়ে দুঃখ ভরা মন নিয়ে শরীর চাদরে ঢেকে বসে থাকেন। সৈন্যদলের কোন কিছু নেয়া বাদ পড়েছে কিনা তা দেখার দায়িত্বপ্রাপ্ত সাহাবী সাফওয়ান বিন মুয়াত্তাল (রা.) সেখানে উপস্থিত হয়ে আয়েশা (রা.) কে দেখতে পান এবং তিনি নিজের উটের পিঠে তাকে উঠায়ে নিয়ে মদিনায় ফেরেন। ঘটনাটিকে নিয়ে মুনাফিকগণ আয়েশা (রা.) এর চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করে রসুলুল্লাহ (দ.) এর মনে কষ্ট দিতে থাকে। পরে হযরত আয়েশার (রা.) নির্দোষ হবার ব্যাপারে সুরা আন নুরের ২৩ নং আয়াত নাজিল হয়। এই আয়াতে আয়েশা (রা.) কে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়। মিথ্যা অপবাদ দান কারীদের কোরআনের বিধানের নির্ধারিত শাস্তি প্রদান করা হয়। হযরত আয়েশা (রা.) কে রসুলুল্লাহ (দ.) যদি মাত্র ছয় বছর বয়সে বিবাহ করে থাকেন তাহলে সে যুগে কেন বিষয়টি নিয়ে অপপ্রচার হল না ? অপপ্রচারটি শুরু হল রসুলুল্লাহ (দ.) এর ইন্তিকালের চৌদ্দ কিংবা পনের শত বৎসর পর। মনে হচ্ছে যেন আয়েশার (রা.) দরদে এদের কলিজা ফেটে যাচ্ছে। রসুলুল্লাহ (দ.) ঠিক কত বছর বয়সে আয়েশা (রা.) কে বিবাহ করেছেন নির্ভরযোগ্য হাদিছ গ্রন্থ বা তাবকাত ও রসুলুল্লাহ (দ.) সীরাত বা জীবনী রচয়িতা ইতিহাসবিদ এবং হাদিস বিশারদদের  সন্নিবেশিত একাধিক তথ্য পাওয়া যায়। তথ্যসমূহের মধ্যে একটি তথ্যমতে আয়েশা (রা)কে রসুলুল্লাহ (দ.) ছয় বছর বয়সে বিবাহ করেন। আর দৈহিক মিলন করেন নয় বছর বয়সে। যদি এই তথ্যটিকে সত্য বলে মেনে নেয়া যায় তাতে মুসলমানদের লজ্জিত হবার কোন কারন নাই। এর কারন মুসলমানদের ইসলামের জ্ঞান লাভের দুটি মূল উৎস আল কোরআন এবং আল হাদিস। হাদিস হচ্ছে রসুলুল্লাহ (দ.) এর বাণী,কর্ম এবং অনুমোদন। প্রায় সত্তরটির অধিক হাদিস গ্রন্থের নাম আমরা জানতে পেরেছি। সবগ্রন্থে বর্ণনাকারী গণের নাম বাদ দিলে এবং শুধুমাত্র হাদিস  অংশগুলো হিসেব করলে তা দশ হাজার অতিক্রম করে না। সিহাহ সিত্তাহ এবং মুয়াত্তা মালিক গ্রন্থগুলির হাদিসগুলিকে বিষয়ভিত্তিক আলাদা করলে দেখা যাবে হাদিসের সংখ্যা আট হাজারের নীচে। ঐ হাদিসগুলির মধ্যে বিরাট সংখ্যক হাদিসের বর্ণনাকারী আবু হুরায়রা (রা.)। তার পরের স্থান হযরত আয়েশা (রা.)।  হযরত আবু হুরায়রা বর্ণিত হাদিস সংখ্যা পাঁচ হাজার তিনশত চুয়াত্তর।  হযরত আয়েশা (রা.)  বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা দুই হাজার দুইশত দশ। আর একটি বর্ণনামতে চার হাজারের কিছু বেশী। যাহোক  আয়েশা (রা.) কে যদি রসুলুল্লাহ বিবাহ না করতেন তাহলে কমপক্ষে দুই হাজার দুইশত দশটি  হাদিস থেকে মুসলমানরা বঞ্চিত হত। আয়েশা (রা.) এর সঙ্গে রসুলুল্লাহ (দ.) এর সংসারে আরো নয়জন স্ত্রী একইসাথে বিদ্যমান ছিল।  কিন্তু অন্য নয় জনের মধ্যে উম্মে সালমা (রা.) ছাড়া বাকি অন্যান্য উম্মুল মুমীনীনগণের মাধ্যমে হাতে গোনা কয়েকটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। আয়েশা (রা.) একাধারে হাদিস বর্ণনাকারী এবং ফকীহা অর্থাৎ ইসলামী আইন বেত্তাও ছিলেন।  অনেক বড়  বড় হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবী ফিকহি মাসআলার সমাধান দানের ক্ষেত্রে তার ধারে কাছেও পৌঁছতে পারেন নাই। আয়েশা (রা) এর যদি ছয় বছর বয়সে ৪৫ বা ৫০ বৎসর বয়সী মহানবী (দ.) এর সাথে বিবাহ হয়ে থাকে তাহলে ঐ বিবাহ দ্বারা আয়েশা (রা.) কি হারিয়েছেন? তিনি হারিয়েছেন ১৮ বৎসর বয়স থেকে পরবর্তী ৩২ বৎসর এর যৌন চাহিদা পূরণের মধুময় সময়। (চলবে)

Monday, February 18, 2019

ইসলামের দৃষ্টিতে বাল্যবিবাহ-১


-এডভোকেট আব্দুস সালাম প্রধান
ভূমিকা : কোন ছেলে বা মেয়ের ঠিক কত বছর বয়সে বিয়ে হওয়া উচিৎ সে বিষয়টি আধুনিক বিশ্বের মানব সমাজের একটি নতুন ভাবনা। ভারতীয় উপমহাদেশের সকল ধর্মের ছেলে মেয়েদের বয়স নির্ধারণ করে তৎকালীন বৃটিশ সরকার ১৯২৯ সালে “পযরষফ সধৎৎরধমব ধপঃ”(১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন) প্রবর্তন করে। ১৯৪৭ সালের ১৪ এবং ১৫ ই আগস্ট ভারতীয় উপমহাদেশকে পাকিস্তান ও ভারতীয় ডমিনিয়ন নামে বিভক্ত করে স্বাধীনতা দেয়া হয়। পাকিস্তানের অংশ তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান বর্তমানের বাংলাদেশে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আইনটি বলবৎ ছিল। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল পূর্ব পাকিস্তান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। একই সালের ১৬ই ডিসেম্বর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের একপর্যায়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পরিপূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্বের দরবারে স্থান করে নেয়। ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান জাতীয় পরিষদে পাশ হয়। ঐ সংবিধানে ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ আইনটিকে পূণরায় কার্যকরিতা দেয়া হয়। আইনটি কার্যকর থাকার পরেও বাংলাদেশের অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের বিবাহের ক্ষেত্রে আইনটি মানা হচ্ছে কি না তার কোন কড়াকড়ি ছিল না। ২০১৭ সালের ২৪ শে নভেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনটিকে বিলুপ্ত করে “বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭” অনুমোদিত হয়। আইনটি তৎপূর্বে ২০১৭ সালের ৬ নং আইন হিসাবে ১১-০৩-২০১৭ ইং তারিখে জনসাধারনের জ্ঞাতার্থে গেজেট আকারে আইনটির খসড়া প্রকাশ করা হয়। নতুন আইনটির বৈশিষ্ট হলো পূর্বে বলবৎ থাকা ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে ছেলেদের বিবাহের বয়স ছিল ২২ বছর এবং মেয়েদের বয়স ছিল ১৮ বছর।

 বর্তমান আইনে মেয়েদের বিবাহের বয়স সর্বনিম্ন ১৮ বছর এবং ছেলেদের বিবাহের বয়স সর্বনিম্ন ২২ এর স্থলে ২১ বছর নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বর্তমান বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে আরেকটি বৈশিষ্ট হলো আইনটির ১৯ ধারায় বলা হয়েছে যে “এই আইনে অন্যান্য বিধানে যা কিছুই বলা থাকুক না কেন বিধি দ্বারা নির্ধারিত বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্ত বয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে, আদালতের নির্দেশ এবং পিতামাতা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতিক্রমে, বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণক্রমে, বিবাহ সম্পাদিত হইলে উহা এই আইনের অধীনে অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবেনা।

নতুন “বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭” বাংলাদেশে বলবৎ হওয়ার ফলে ইসলামী আইনে বাল্যবিবাহ আইনের সাথে বর্তমান আইনের অসংগতি দূরীভূত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ইসলামের নামে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করলেও ১৯৭১ সাল  পর্যন্ত ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনসহ বৃটিশ সরকারের প্রবর্তিত কোন আইনকেই ইসলামী আইনের সাথে সামঞ্জস্য করে সংশোধন করা হয়নি। যা গোটা পাকিস্তানের ইসলামপ্রিয় মানুষের প্রত্যাশা ছিল। বর্তমান বাংলাদেশ সরকার ও জাতীয় সংসদ নতুন বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন পাশ করায় এবং আইনটি ইসলামী আইনের সাথে সামঞ্জস্য হওয়ায় বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আনন্দিত। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রত্যাশা বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ এর মত দেশে প্রচলিত আইন গুলিকেও ইসলামী আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে সংশোধন করা হবে।
বাল্যবিবাহ বলতে কি বুঝায় : 
বাল্য বিবাহ সাধারণতঃ দুই প্রকার। এক.সাবালকত্ব প্রাপ্ত হয় নাই এমন একটি কন্যা শিশুকে অভিভাবক কর্তৃক বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ বা তদুর্ধ্ব বয়সের কারো সাথে বিবাহ দেয়া। দুই. ছেলে বা মেয়ে উভয়ের মধ্যে বিবাহের বয়সে পৌছার আগে বা সাবালকত্ব লাভের পূর্বে উভয় পক্ষের অভিভাবক কর্তৃক বিবাহ দেয়া।
ইসলামী আইনে বাল্য বিবাহ : ইসলামী আইন বিশেষেজ্ঞ (ফকিহ)গণ নাবালক নাবালিকা ছেলেমেয়েদের উল্লেখিত দু ধরনের পদ্ধতিতে বিবাহ দেয়ার বিষয়ে দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে ফতোয়া প্রদান করেছেন। একদল সাধারণভাবে বাল্যবিবাহ নিষেধ করেছেন। যেমন ইমাম আবু হনিফা (র.) এর সমসাময়িক ইরাকী ফকিহ (ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ) ইমাম ইবনে শুবরুমা এবং কাজি আকুবকর আল আছাম। যে সমস্ত ফকিহ বাল্যবিবাহ সম্পাদন নিষিদ্ধ করার পক্ষে তাদের শরয়ী দলিল হলো কুরআন মজিদের সুরা আন নিসার ৬ নং আয়াতের প্রথম অংশ। “ওবতালুল ইয়াতামা হাত্তা ইযা বালাগুন্নিকাহা” অর্থাৎ তোমরা এতিমদের কে পরীক্ষা করতে থাক যতদিন না তারা বিবাহযোগ্য বয়সে পৌঁছে যায়। আয়াতংশটি আইনগত অভিভাবক পিতা, পিতার অভাবে দাদা বা বিকল্প অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানে থাকা সম্পদ এতিমদের দায়িত্বে কখন প্রত্যার্পণ করা যাবে সে বিষয়ে নাজিল হয়েছে। এ বিষয়ে আল্লাহর নির্দেশ হলো এতিমরা বিবাহের বয়সে না পৌছা পর্যন্ত তাদেরকে সম্পত্তির দেখা শোনার দায়িত্ব অর্পণ করা যাবে না। উদ্ধৃত আয়াতাংশটিতে ছেলে মেয়েদের  বিবাহের জন্য একটি বয়স নির্ধারিত আছে মর্মে বুঝা যায়। আর সেটা হলো বুলুগ বা সাবালকত্ব। ছেলেরা যখন এমন বয়সে উপনীত হয় যে সময়ে তাদের ইহ্তিলাম বা স্বপ্নদোষ হয়। এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে যখন তাদের মাসিক হায়িয বা মাসিক ঋতু আরম্ভ হয়। ইসলামী শরিয়তে সেটাই হলো ছেলেমেয়েদের বিবাহের বয়স। এই ধারার ফকিহগণের আর একটি যুক্তি হলো আরবী নিকাহ্ (বিবাহ) শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো যৌনমিলন শব্দটি নিয়ে। যেহেতু বিবাহের মূল উদ্দেশ্য হলো নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈধ যৌন মিলন। একজন নাবালক ও নাবালিকার মধ্যে  বা একজন সাবালক বা সাবালিকার সাথে আরেকজন নাবালিকা বা নাবালকের মধ্যে বিবাহ সম্পাদন করা হলে বিবাহের মূল উদ্দেশ্য পূরণ হয় না। ফলে বিবাহটি  গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। নাবালক ও নাবলিকার বিবাহ সম্পাদন করা গেলেও তারা সাবালক না হওয়া পর্যন্ত তাদের উপর শরয়ী আইন প্রয়োগ করা যায় না। সে কারণে এ ধরনের বিয়ে অপ্রয়োজনীয় বা পরিত্যক্ত।
উল্লিখিত মতামতটির বিপরীতে ফকিহগণের অধিকাংশের ফতোয়া বা মতামত হলো নাবালক ও নাবালিকার মধ্যে বা কোন নাবালিকা মেয়ের সাথে যে কোন বয়সের সাবালক পুরুষের সাথে সম্পূর্ণরুপে জায়েজ বা বৈধ। এ মতটির সাথে যেসব ইসলামী আইনবিদ ঐক্যমত পোষণ করেছেন তারা হলেন ইমাম আবু হানিফা (র.), ইমাম শাফেয়ী (র.), ইমাম মালিক বিন আনাস (র.), ইমাম আহমদ বিন হাম্বাল (র.) এবং তাদের অনুসারী পরবর্তী যুগের ইসলামী আইনবিদগণ। শীয়াহ্ বা জাফরী ফিকহের অনুসারীগণও এ মতের সাথে ঐক্যমত পোষন করেন। এই ধারার ফকিহ বা ইসলামী আইনবিদগণের অভিমত হলো ইসলামী শরিয়তের বিধান মোতাবেক নাবালক ছেলেমেয়েদের বিবাহ তাদের পক্ষে অভিভাবকগণ সম্পাদন করতে পারেন। ইসলামী শরীয়তে এধরনের বিবাহ সম্পূর্ণরুপে জায়েজ মর্মে তারা মত দিয়েছেন।
তাদের এ মতের স্বপক্ষে তারা পবিত্র কুরআনের সুরা আত তালাকের ৪ নং আয়াত এবং সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈগণের কতিপয় আসার (কর্মধারা বা আমল) দলিল হিসাবে উল্লেখ করেছেন। সুরা আত তালাকের ৪নং আয়াতে আল্লাহ বলেন“ওল্লায়ী ইয়াইস্না মিনাল মাহিদ্বি মিন নিসায়ীকুম ইনির তাবতুম ফাইদ্দাতুহুন্না ছালাছাতা আশহুরিন ওল্লায়ী লামইয়া হিদ্বনা” অর্থাৎ যেসব স্ত্রীলোকের মাসিক ঋতু বন্ধ হয়ে গেছে তাদের ব্যাপারে তোমাদের যদি সন্দেহ হয় (জেনে নাও) তাদের ইদ্দতকাল হলো তিন মাস(পরবর্তী বিবাহের জন্য বা স্বামীর সাথে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য)। আর  যাদের মাসিক ঋতু আরম্ভ হয়নি তাদের জন্যও একই নির্দেশ। যেসব আসার (কর্মধারা) এ মতের স্বপক্ষে পেশ করা হয়েছে তা হলো এক.কুদামা ইবনে মাজউন (রা.) যুবাইর (রা.) এর সদ্য ভূমিষ্ঠ কন্যাকে বিবাহ করেন। তিনি অত্যন্ত বয়োবৃদ্ধ ছিলেন। বিবাহের পর কুদামা ইবনে মাজউন (রা.) ঘোষনা দেন যে তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন তাহলে যুবাইর (রা.) এর উক্ত কন্যা তাহার ত্যক্ত সম্পত্তির ওয়ারিশ বা মালিক হবে। দুই.হযরত ওমর (রা.) তার এক নাবালিকা কন্যার সাথেসাবালক ওরওয়া ইবনে যুবাইর (র.) এর বিবাহ দেন। তিন. ওরওয়া ইবনে যুবাইর (র.) তার এক ভাইয়ের তরফের নাবালক পুত্রের সাথে অপর এক ভাইয়ের নাবালিকা কন্যার বিবাহ দেন। চার.এক ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবনে হাসান (র.) এর সাথে তার নাবালিকা কন্যার বিবাহের প্রস্তাব দেয়। তিনি ঐ প্রস্তাব জায়েজ হিসাবে গ্রহনপূর্বক উক্ত নাবালিকাকে গ্রহন করেন। পাঁচ.আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এর সাথে একজন মহিলা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং ঐ মহিলার প্রথম স্বামীর তরফের নাবালিকা কন্যার সাথে সাবালক মুসাইব ইবনে নাখবার সাথে বিবাহ দেন। আব্দুলল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বিবাহটিকে জায়েজ বা বৈধ ঘোষনা করেন। উল্লেখিত দুটি ধারার ফকিহগণের মতামত পর্য়ালোচনার পর দ্বিতীয় ধারার ফকিহগণের মতামত শরয়ী দিক থেকে অধিকতর শক্তিশালী।
রসুলুল্লাহ (দ.) মুসলীম উম্মাহকে তাদের ছেলেমেয়েদের যৌবনকালে বিবাহ দেয়ার বা করার বিষয়ে উৎসাহিত করেছেন। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রসুলুল্লাহ (দ.)  এর সাথে একটি যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে রসুলুল্লাহ (দ.) জাবেরকে জিজ্ঞেস করলেন যে তুমি কি বিবাহ করেছ? জাবের (রা.) বলেন যে আমি বললাম হ্যা। রসুলুল্লাহ (দ.) জিজ্ঞেস করলেন তোমার স্ত্রী কি কুমারী না পূর্ব বিবাহিতা? জাবের (রা.) উত্তর দিলেন পূর্ব বিবাহিতা। রসুলুল্লাহ (দ.) বললেন তুমি কেন একজন কুমারী যুবতী মেয়েকে বিয়ে করলে না। যার সাথে তুমি আনন্দ উপভোগ করতে এবং সেও তোমার সাথে আনন্দ উপভোগ করত। (সুনানে আবু দাউদ,হাদিস নং ২০৪৪)। কুমারী যুবতীদের সাথে যুবকদের বিয়ে হোক নবী করিম (দ.) সেটাই পছন্দ করতেন।
জাবের (রা.) এর পিতা হযরত আব্দুলল্লাহ (রা.) উহুদের যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন। ঐ সময়ে জাবের (রা.) অবিবাহিত যুবক ছিলেন। তার ৭ জন অবিবাহিতা ভগ্নি ছিল। তাদের দেখাশোনার জন্য জাবের (রা.) একজন বয়স্কা পূর্ববিবাহিতা মহিলাকে বিবাহ করেছিলেন। এ বিষয়ে রসুলুলল্লাহ (দ.) আরো বলেন পূর্বে বিবাহ হয়নি এমন মেয়ে বিয়ে করাই তোমাদের জন্য উচিত হবে কেননা তারা মিষ্টি মুখের অধিকারী ও নির্মল জরায়ুধারী এবং অল্পে তুষ্ট চিত্তের হয়ে থাকে। (সুনানে ইবনে মাযাহ,হাদিছ নং ১৮৬১)। আরেকটি হাদিসে দেখা যায় রসুলুলল্লাহ (দ.) তার উম্মতের যুবকদেরকে পূর্বে বিবাহ হয়নি এমন সুন্দরী ধর্মপরায়ণা যুবতী স্ত্রী গ্রহণে উৎসাহ দিতেন। (যাদুল মায়াদ, ৩য় খন্ড)।
ইসলামে বিবাহের গুরুত্ব : 
ইসলামে সাধারণভাবে নাবালক ও নাবালিকাদের বিবাহ দেয়া বা করানো বৈধ বা জায়েয। কিন্তু এ ধরনের বাল্যবিবাহ সম্পাদন ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত কোনটিই নয়। সাবালক পুরুষদের বিবাহ করা কোন কোন ক্ষেত্রে ফরজ। আবার কোন ক্ষেত্রে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। সুরা আন্ নিসার ৩ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন“ফানকিহু মা ত্ববা লাকুম মিনান নিসায়ী” অর্থাৎ তোমরা বিবাহ কর মেয়েদের মধ্য থেকে যাকে তোমার ভাল লাগে। বিবাহ করার প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করতে গিয়ে নবী করীম (দ.) বলেন যে, হে যুবকদল তোমাদের মধ্যে যে বিবাহ করার সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে। আর যে বিবাহ করার সামর্থ্য রাখে না সে যেন রোজা রাখে। রোজা যৌন মিলনের ইচ্ছাকে দমন করে। সহীহ বুখারী,হাদিস নং ৫২৯২। সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ১৪০০, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ৪৬৯২। রসুলুল্লাহ (দ.) পুরুষদের যৌন মিলনের  ইচ্ছাকে দমন করার জন্য খাশি (াধংবপঃড়সু) হতে নিষেধ করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (দ.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন আমরা রসুলুল্লাহ (দ.) এর সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতাম। আমাদের সাথে স্ত্রীরা থাকত না।
তাই আমরা রসুলুল্লাহ (দ.)কে বলতাম আমরা কি খাশি হয়ে যাব? তিনি আমাদেরকে খাশি হতে নিষেধ করলেন। (সহীহ বুখারী,হাদিস নং ৫০৭১) হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন তিনজন সাহাবীর একটি দল রসুলুল্লাহ (দ.) এর স্ত্রীদের নিকট আসলেন (এবং নবী করীম (দ.) এর স্ত্রীর নিকট তাঁর ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন)। জিজ্ঞাসার জবাবে নবী করীম (দ.) এর ইবাদত সম্পর্কে তাদেরকে জানানো  হলে তারা (নবী দঃ) এর ইবাদতকে কম মনে করলেন এবং মন্তব্য করলেন যে আমাদের সাথে রসুলুল্লাহ (দ.) এর তুলনা হয় না। কারন তাঁর আগের এবং পরের গুনাহ সমূহ মাফ করে দেয়া হয়েছে। তাদের একজন বলল আমি আমার বাকী জীবন সমস্ত রাত জুড়ে এবাদত করব। আর একজন বলল আমি সব সময় রোজা রাখব। আর একজন বলল আমি নারী সঙ্গ ত্যাগ করব (এধরনের কথোপ কথন চলা অবস্থায় রসুলুল্লাহ (দ.) তাদের মাঝে আসলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন তোমরাই কি তারা যারা এসব কথা বলেছ ?)। (তারা হ্যা বললে) রসুলুল্লাহ (দ.) বললেন আল্লাহর শপথ আমি তোমাদের থেকে অনেক বেশী আলল্লাহকে ভয় করি এবং তোমাদের থেকে আল্লাহর প্রতি বেশী অনুগত।
আমি রোজা রাখি (নফল) আবার তা থেকে বিরতও থাকি। নামাজ (নফল) আদায় করি। আবার ঘুমিয়ে পড়ি এবং আমি মেয়েদেরকে বিবাহ করি। যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতের প্রতি বিরাগ ভাব পোষণ করবে সে আমার উম্মাত (দলভুক্ত) নয়। সহীহ বুখারী হাদিস নং ৫০৬৩, সহীহ মুসলিম হাদিস নং ১৪০১। এই হাদীসে রসুলুল্লাহ (দ.) বিবাহ করাকে অবশ্য পালনীয় সুন্নাত হিসাবে ঘোষনা করেছেন এবং সামর্থ্য থাকা স্বত্বেও  সুন্নাতটি পালন না করলে উম্মতে মুহাম্মদী হিসাবে গণ্য হবে না মর্মেও ঘোষণা করেছেন। বিবাহ করার বিষয়ে সমস্ত তাগিদ প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান নর নারীদের প্রতি দেয়া হয়েছে। বাল্যবিবাহ ফরজ বা সুন্নাত এই মর্মে কোন ঘোষনা কুরআন মজীদ কিংবা হাদীসে রসুলে বর্ণিত হয়নি। কোন সমাজ বা রাষ্ট্রের মুসলমানরা যদি সম্পূর্ণরুপে বাল্যবিবাহ সম্পাদন থেকে বিরত থাকে তাতে গোনাহ হবে বা ইসলামী শরীয়া লংঘন হবে এমন কোন কথাও কোরআন হাদীসে বর্ণিত হয় নাই।
ইসলামী আইনে বিবাহ কোন পবিত্র বন্ধন বা sacrament নয় বরং ইসলামী আইনে বিবাহ এক ধরনের সোস্যাল কন্ট্রাক্ট বা সামাজিক, পারিবারিক চুক্তি মাত্র। এ বিবাহ চুক্তির অধীনে কোন সমাজের দুজন নারী এবং পুরুষ একত্রে বসবাস এবং সন্তান গ্রহন ও পরষ্পরের উত্তরাধিকারী হওয়ার জন্য শরীয়তের বিধান মোতাবেক এ ধরনের চুক্তিতে আবদ্ধ হন। যা যে কোন সময় খন্ডনযোগ্য। (চলবে)

Popular Posts