Thursday, May 23, 2019

প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ : ফকীর বিদ্রোহ - আ বু সা ঈ দ মু হা ম্ম দ ও ম র আ লী


উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কে বা কারা প্রথম শুরু করে এবং কখন তা শুরু হয়, এককালে তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বাংলার ‘ফকীর বিদ্রোহের ইতিহাস’ উদ্ঘাটিত হবার পর এ বিতর্কের একটা সুরাহা হয়েছে বলেই আমাদের ধারণা। বিষয়টি নিয়ে আরও গবেষাণার প্রয়োজন যে নেই তা নয়, বরং আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিপূর্ণ ইতিহাস রচনার স্বার্থেই সে ইতিহাস খুঁজে বের করবার প্রয়োজন অপরিহার্য হয়ে দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের পরবর্তী স্তরগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ে সংঘটিত ‘ত্রিপুরার শমশের গাজীর বিদ্রোহ’, ‘সিরাজগঞ্জের বিদ্রোহ’, ওহাবী আন্দোলন’, ‘ফারায়েজী আন্দোলন’, স›দ্বীপের বিদ্রোহ’, ‘১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব’ ও ‘নীল বিদ্রোহের’ পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস সংকলন করা দরকার, দরকার তা ভবিষ্যৎ বংশদরদের হাতে তুলে দেবার।
সুদীর্ঘ ৭০০ বছল ধরে ভারতের বুকে যে মুসলিম শাসন অব্যাহত ছিল- পলাশীর বিয়োগান্ত প্রহসনের মাধ্যমে তার হাতবদল মুসলমানরা স্বাভাবিক কারণেই মেনে নিতে পারেনি। মেনে নেয়া সম্ভবও ছিল না। আর কোনো আত্ম-মর্যাদাসম্পন্ন জাতির পক্ষেই রাতারাতি এই পরিবর্তনকে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। পলাশীর আম্রকাননের আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত এই ভাগ্য বিপর্যয়ে বাংলার মুসলমান সাময়িকভাবে দিশেহারা ও মুহ্যমান হয়ে পড়লেও সম্বিৎ ফিরে পেতে তাদের বেশি দেরিও হয়নি। সিরাজউদ্দৌলার পর শাসকদের পক্ষ থেকে মীর কাসেম আপ্রাণ চেষ্টা চালান দেশের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখতে। কিন্তু তাঁর এ চেষ্টা ফলবতী হয়নি। পরাধীনতার অভিপাশ সম্বন্ধে জনগণের চেতনা প্রথমেই জাগেনি। তার কারণ প্রথম দিকে আপামর জনসাধারণে একে শাসকের পালাবদল হিসেবে ধরে নিলেও মাত্র কিছুদিননের ভেতরই তারেদ সামনে এ সত্যও ধরা পড়ল- শাসকের পালাবদলের সংগে তাদের ভাগ্যেরও পালাবদল ঘটেছে। আর এই সত্য উপলব্ধির সংগেই শুরু হল প্রতিরোধ সংগ্রাম। ব্রিটিশ শাসকেরা একে বিদ্রোহ বলে চালাতে চাইলেও এবং এসব বিদ্রোহকে (অবশ্য তাদের ভাষায়) নির্মম হস্তে দমন করতে সমর্থ হলেও স্বাধীনতাকামী সুসলমানদের কাছে তা স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবেই সম্মান ও শ্রদ্ধার সংগে স্মরণীয় হয়ে রইল-আর সেসব ‘বিদ্রোহ’ (?) যারা অংশ নিতে এগিয়ে গেলেন, নির্যাতন সইলেন, প্রাণ বিলিয়ে দিলেন, সা¤্রাজ্যবাদী শাসক ও শোষকদের লেখায় তারা দস্যু, তস্কর, লুটেরা ও সন্ত্রাসীবাদী হিসেবে আখ্যায়িতত হলেও এদেশের মানুষ কিন্তু তাদের ঠিকই স্বাধীনতার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অমর শহীদ হিসেবেই হৃদয়ে ঠাঁই দিলো।
এখানে অনিবার্যভাবেই একটি প্রশ্ন মনে না জেগে পারে না তাহল- পলাশী প্রহসন অনুষ্ঠিত হবার যে দিনটিতে অক্রকাননের কিছু দূরেই ভূমি কর্ষণরত যে কৃষকের হাতে লাঙলের মুঠি ধরা রইল, এতটুকু ভাবান্তর যাবে বিব্রত করল না, -হস্তীপৃষ্ঠে শহীদ সিরাজের লাশ দৃষ্টেও যে মুর্ষিদাবাদবাসী ফ্যাফফ্যাল করে চেয়ে রইল, লাশ বহনকারী হাতীর সামনে আলুথালুবেশী নবাব মাতা আমিনার ভূলুণ্ঠিত চেহারা যাদের চোখের কোণে এক বিন্দু অশ্রæ ভিন্ন আর কিছু দিতে পারল না, হঠাৎ এমন কি ঘটল যে, সেই লাঙলের মুঠি ধরা হাতই প্রতিরোধের শাণিত অস্ত্র তুলে নিল? সে এক ইতিহাস; বড় করুণ, বড় নির্মম।
ষড়যন্ত্র এবং কূটকৌশলের মাধ্যমে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার ক্ষমতা দখল করলেও দেশের উপর সর্বময় কর্তৃত্ব স্থাপন করতে তারা প্রথমেই সাহসী হয়নি। সাত-সমুদ্দুর তেরো নদীর ওপারের সাদা চামড়ার শাসন এদেশবাসী সহজে কিংবা আদৌ মানবে কিনা এই ভয় তাদের গোড়াতেই ছিল। নির্লজ্জ শোষক ও লোভী হায়েনার চেহারা নিয়ে হঠাৎ করে দেশের সাধারণ মানুষের সামনে হাজির হতে প্রথমে তাদের সংকোচ বেধেছিল। তাই তারা মীরজাফর প্রমুখ কতিপয় সাক্ষী-গোপালের আড়ালে নিজেদের হিংস্র ও লোভী চেহারা লুকিয়ে রাখার ভেতর নিজেদেরকে নিরাপদ ভেবেছিল। পর্দার আড়ালে থেকে চালিয়ে যেতে থাকল শাসন, শোষণ এবং উৎপীড়ন। বাংলার অফুরন্ত ধন-সম্পদ লুট করবার মূল চাবিকাঠি কোম্পানী নিজ হাতে রেখে এদেশের মানুষের অর্বণনীয় দুঃখ-কষ্টের কারণ হিসেবে এদেশের কতিপয় কুলাংগারের মাথায় সব দোষের বোঝা তুলে দিলো। রবার্ট ক্লাইভ সব অপকর্মের নায়ক হয়েও চতুর্যের বদৌলতে ধোয়া তুলসী পাতা হয়ে রইলেন।
“বিজয়ের সাথে সাথে ক্লাইভ ও তার অনুচরেরা সমগ্র দেশের কায়েম করল লুণ্ঠন ও অত্যাচারের বিভীষিকা। পলাশী যুদ্ধের পর ক্লাইভ মীরজাফরের নিকট থেকে উৎকোচ স্বরূপ লাভ করলেন দু’লক্ষ চৌত্রিশ হাজার পাউন্ড। রাতারাতি লর্ড ক্লাইভ গণ্য হলেন ইংল্যান্ডের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী বলে। নবাবী লাভের ইনাম স্বরূপ মীরজাফরের কাছ থেকে কোম্পানির কর্মচারীরা গ্রহণ করলো ৩০ লক্ষ পাউন্ড এবং চব্বিশ পরগণা জেলার জমিদারী। এরপর একটানা চললো উৎকোচ গ্রহণ, লুণ্ঠন ও ক্রমবর্ধমান হারে রাজস্ব আদায়। ১৭৬৬ সালে (ব্রিটিশ) পার্লামেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত অনুসন্ধান কমিটি ইংরেজ কর্মচারীদের উৎকোচ গ্রহণের যে তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন তাতে দেখা যায়, “১৭৫৭ সাল থেকে ১৭৬৬ সাল পর্যন্ত ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্চচারীরা বাংলাদেশ ও বিহার থেকে মোট ৯ কোটি টাকা উৎকোচ গ্রহণ করেছিল।”
লুণ্ঠনের এমন দুঃখজনক ইতিহাস দুনিয়াতে বোধকরি অল্পই আছে। এই শোষণ-নির্যাতনের রূপ যে কত ঘৃণীত ও ভয়াবহ ছিল তা তাদেরই একজন লর্ড মেকলের ভাষায় শুনুন;
‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী স্বার্থে নয়, নিজেদের জন্যই কোম্পানির কর্মচারীরা এদেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যক্ষেত্রে নিজেদের একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। দেশীয় লোকদের তারা দেশীয় উৎপন্ন দ্রব্য অল্প দামে বিক্রয় এবং ব্রিটিশ পণ্যদ্রব্য বেশি দামে ক্রয় করতে বাধ্য করলো। কোম্পানির আশ্রয়ে প্রতিপালিত দেশীয় কর্মচারীরা সমগ্র দেশে সৃষ্টি করেছিল শোষণ ও অত্যাচারের ভয়াবহ বিভীষিকা। কোম্পানির প্রতিটি কর্মচারী ছিল তার প্রভুর শক্তিতে শক্তিমান, আর এইসব প্রভুর শক্তির উৎস ছিল স্বয়ং ইষ্ট ইন্ডি’া কোম্পানি। কোলকাতায় ধন-সম্পদের পাহাড় তৈরি হল, অপরদিকে তিন কোটি মানুষের দুঃখ-দুর্দশার শেষ স্তরে উপনীত হল। সত্য কথা যে, বাংলার মানুষ শোষণ-উৎপীড়ন সহ্য করতে অভ্যন্ত; কিন্তু এমন ভয়াবহ শোষণ ও উৎপীড়ন তারা কোনোদিন দেখেনি।” (ঊংংধুং রহ খড়ৎফ ঈষরাব).
এদেশ দখলের পর এদেশের বুকে তাদের শাসন ও শোষণের পাকাপোক্ত ও কায়েমী করবার লক্ষ্যে বেনিয়া কোম্পানী প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থা ধ্বসিয়ে দিল। পূর্ব থেকে চালু সমষ্টিগতভাবে গ্রাম্য সমাজের কাছ থেকে রাজস্ব আদয়ের প্রথা বাতিল করে চাষিদের কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে রাজস্ব আদায়ের প্রথা চালু করল। মোগল আমল থেকে প্রচলিত উৎপন্ন ফসলের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ও বাতিল হলো। পরিবর্তে চালু করা হলো মুদ্রার মাধ্যমে রাজস্ব আদায়। ফলে ব্যক্তিগতভাবে মুদ্রার মাধ্যমে রাজস্ব পরিশোধের জন্য মুদ্রা সংগ্রহ করা অপরিহার্য হয়ে দেখা দিলো। আর সেই মুদ্রা সংগ্রহের প্রয়োজনে ফসল বিক্রি করা ছাড়া চাষির অন্য কোনো উপায় রইল না।
চাষির ফসল ক্রয় করার জন্য ইংরেজ বণিকেরা বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন স্থানে ক্রয়কেন্দ্র খোলে। শুধু তাই নয়, বেশি মুনাফার আশায় এসব ক্রয়কৃত খাদ্যদ্রব্য গুমামজাত করা শুরু করল। পরে সুযোগ-সুবিধামতো এসব খাদ্যই চড়ামূল্যে সেই চাষিদের নিকট আবার বিক্রি করত। ফলে খাদ্য গুদামজাতকরণের মাধ্যমে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টির কারণেই এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে দুর্ভিক্ষ ঘনিয়ে এলো। ১৭৬৯ সালে ক্রয়কৃত সমস্ত ফসল ১৭৭০ সালেই আবর বেশি দামে বিক্রি হল। বাংলার চাষি তা ক্রয় করতে ব্যর্থ হয়ে নজিরবিহীন দুর্ভিক্ষের শিকার হলো। মারা গেল কয়েক লক্ষ আদম সন্তান। বাংলা ১১৭৬ সালের এই দুর্ভিক্ষই ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে ইতিহাস খ্যাত। ইংরেজ ঐতিহাসিক ‘ইয়ং হাজব্যান্ড’- এর ভাষায় :
“তাদের (ইংরেজ বণিকদের) মুনাফার পরবর্তী উপায় ছিল চাল কিনে গুদামজাত করে রাখা। তারা নিশ্চিত ছিল যে, জীবনধারণের পক্ষে অপরিহার্য এ দ্রবটির জন্য তারা যে মূল্যই চাইবে, তা পাবে।........ চাষিরা তাদের প্রাণপাত করা পরিশ্রমের ফল অপরের গুদামে মজুদ থাকতে দেখে চাষাবাস সম্বন্ধে এক রকম উদাসীন হয়ে পড়ল। ফলে দেখা দিলো ভয়ানক খাদ্যাভাব। দেশে যেসব খাদ্য ছিল, তা ইংরেজ বণিকদের দখলে। খাদ্যের পরিমাণ যত কমতে থাকল, ততই দাম বাড়তে লাগল। শ্রমজীবী দরিদ্র জনগণের চির দুঃখময় জীবনের ওপর পতিত হলো এই পুঞ্জিভূত দুর্যোগের প্রথম আঘাত। কিন্তু এটা এক অশ্রুতপূর্ব বিপর্যয়ের আরম্ভ মাত্র।’
“এই হতভাগ্য দেশে দুর্ভিক্ষ কোনো অজ্ঞাতপূর্ব ঘটনা নয়। কিন্তু দেশীয় জনশত্রুদের সহযোগিতায় একচেটিয়া শোষণের বর্বরসুলভ মনোবৃত্তির অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ যে অভূতপূর্ব বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখা দিলো, তা ভারতবাসীরাও আর কোনো দিন চোখে দেখেনি বা কানে শোনেনি। চরম খাদ্যাভাবের এক ভয়াবহ ইঙ্গিত নিয়ে দেখা দিলো ১৭৬৯ সাল। সঙ্গে বাংলা-বিহারের সমস্ত ইংরেজ বণিক তাদের সকল আমলা, গোমস্তা রাজস্ব বিভাগের সকল কর্মচারী যে যেখানে নিযুক্ত ছিল সেখানেই দিবারাত্র অক্লান্ত পরিশ্রমে ধান-চাল কিনতে লাগল। এই জঘন্যতম ব্যবসায়ে মুনাফা এত শীঘ্র ও এত বিপুল পরিমাণে পেয়েছিল যে, মুর্শিদাবাদের নবাব দরবারে নিযুক্ত একজন কপর্দকশূন্য ভদ্রলোক এ ব্যবসায় করে দুর্ভিক্ষ শেষ হওয়ার সাথে সাথে প্রায় ৬০ হাজার পাউন্ড (দেড় লক্ষাধিক টাকা) দেশে পাঠিয়েছিল।’
ব্রিটিশ বেনিয়া রাজের সৃষ্ট ভয়াবহ এই দুর্ভিক্ষ কেবল বাংলাদেশের নয়-গোটা মানব জাতির ইতিহাসের একট কলংকিত অধ্যায়। মানব শিক্ষা ও সভ্যতার ইতিহাস থেকে বাংলার ভয়ঙ্কক এই দুর্ভিক্ষের তান্ডবলীলার কথা কোনদিন মুছবার নয়।
ডব্লিউ. ডব্লিউ. হান্টার এই দুর্ভিক্ষের বর্ণনা করে লিখেছেন:
“১৭৭০ সালের সারা গ্রীষ্মকালব্যাপী লোক মারা গিয়েছে। তাদের গরু-বাছুর, লাংগল-জোঁয়াল বেচে ফেলেছে এবং বীজধান খেয়ে ফেলেছে। অবশেষে তারা ছেলেমেয়ে বেচতে শুরু করেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এক সময় আর ক্রেতাও পাওয়া গেল না। তারপর তারা গাছের পাতা ও ঘাস খেতে শুরু করে এবং ১৭৭০ সালের জুন মাসে দরবারের রেসিডেন্ট স্বীকার করেন যে, জাতির মানুষ মরা মানুষের গোশ্ত খেতে শুরু করে। অনশনে শীর্ণ, রোগে ক্লিষ্ট, কঙ্কালসার মানুষ দিনরাত সারি বেঁধে বড় বড় শহরে এসে জমা হতো। বছরের গোড়াতেই সংক্রামক রোগ শুরু হয়েছিল। মার্চ মাসে মুর্শিদাবাদে পানি বসন্ত দেখা দেয় এবং বহুলোক এই রোগে মারা যায়। শাহজাদা সাইফুতও এই রোগে মারা যান। মৃত ও মরণাপন্ন রোগী স্তূপাকারে পড়ে থাকায় রাস্তাঘাটে চলাচল করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। লাশের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, তা পুঁতে ফেলার কাজও দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল না। প্রাচ্যের মেথর, কুকুর, শিয়াল ও শকুনের পক্ষেও্র এত বেশি লাশ নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব ছিল না। ফলে দুর্গন্ধযুক্ত গলিত লাশ মানুষের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছিল।” (পল্লী বাংলার ইতিহাস; সুপ্রকাশ রায়)।
হান্টারের লেখায় আরও জানা যায় যে, সরকারি হিসেবে ১৭৭০ সালের মে মাস শেষ হওয়ার আগেই জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ শেষ হয়ে গিয়েছিল। জুন মাসের প্রতি ষোলজনের ৬ জন মারা গিয়েছিল। শেষাবধি জমিতে আবাদ করার মত পর্যাপ্ত লোকও আর অবশিষ্ট ছিল না।
এত বেশি রায়ত মারা গিয়েছিল এবং জমি পরিত্যাগ করেছিল যে, তাদের পক্ষে বকেয়া খাজনা আদায় করার সম্ভাবনা তিরোহিত হয়েছিল।
“কোম্পানি সরকারের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা তবুও মেটেনি, শোষণ-পীড়ন গতিতেই। শকুনের মতো লাশের ওপর বসেও কোম্পানির কর্মচারীরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছিল মৃতপ্রায় চাষিদের ওপর। তাই দেখা যায়, দুর্ভিক্ষের পূর্বে (১৭৬৮) যেখানে বাংলাদেশের রাজস্ব, ১,৫২,০৪,৮৫৬ টাকা, দুর্ভিক্ষের পর ১৭৭১ সালে সমগ্র দেশের এক-তৃতীয়াংশ লোক মরে যাওয়ার পরও মোট রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াল ১,৫৭,২৬,৫৭৬ টাকায়।” (পলাশী যুদ্ধোত্তর মুসলিম সমাজ ও নীল বিদ্রোহ পৃ. ০৯-১১)
এ তো গেল কৃষি ও কৃষির ওপর নির্ভরশীল কৃষকদের দুরবস্থার কথা। এবার আসুন, আমরা পলাশী যুদ্ধোত্তর আমাদের শিল্পী ও কারিগরদের অবস্থার দিকে তাকাই : ব্রিটিশ বেনিয়া রাজ এদেশে শিল্প-পণ্যের ওপর কি পরিবর্তন চাপিয়ে দিয়েছিল এবং তার ফল কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এর আগে এদেশের গ্রামীন অর্থ-ব্যবস্থা ছিল কৃষি ও শিল্প পেশানির্ভর। তাঁত এবং চরকাই ছিল একমাত্র অর্থকরী শিল্পের মূল ভিত্তি। বেনিয়া শাসক ও শোষকেরা সেখানেও ছোবল হানল। তাঁত ভেঙে ছারখার করল, চরকা করল ধ্বংস। যে দেশের শিল্প-পণ্য সম্ভার দিয়ে ইংল্যান্ডে ব্যবসায় চলত, ইউরোপের কোনো দেশের পণ্য সম্ভার এদেশের বাজারে বিক্রি করার কথা যখন কেউ কল্পনাও করেনি- বাংলাদেশের তথা উপমমহাদেশের বস্ত্রশিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামার কল্পনাও যখন ইউরোপ করেনি; পলাশী যুদ্ধ সেই ইউরোপের ভাগ্য ফিরিয়ে দিলো। ব্রুক এডামস-এর ভাষায় : ১৭৫০ সালে যখন বার্ক ইংল্যান্ডে আসেন, তখন সমগ্র প্রদেশে বারটার বেশি ব্যাংক ছিল না। অথচ ১৭৯০ সালে শহরের প্রত্যেকটি বাজারেই ব্যাংক ছিল। বাংলাদেশ থেকে রৌপ্য আসার পর শুধু অর্থের প্রচলন বেড়ে যায়নি, (ব্যাংক) আন্দোলনও জোরদার হয়েছে। কারণ হঠাৎ দেখা গেল, ১৭৫৯ সালে ব্যাংক ১০ পাউন্ড ও ১৫ পাউন্ডের নোট বাজারে ছেড়েছে।
শিল্প বিপ্লবের পূর্বকার ইংল্যান্ডের অবস্থার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে ব্রæক এডামস অন্যত্র বলেছেন :
“পলাশী যুদ্ধের পর থেকেই বাংলাদেশের লুণ্ঠিত ধন-রতœ ইংল্যান্ডে আসতে লাগল এবং তখনই এর চাক্ষুস ফল বোঝা গেল। পলাশীর যুদ্ধ হয়েছিল ১৭৫৭ সালে। তারপর থেকে (ইংল্যান্ডে) যে পরিবর্তন আরম্ভ হয়েছিল তার তুলনা বোধহয় ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যাবে না। ১৭৬০ সালে আগে ল্যাংকাশায়ারে বস্ত্র-শিল্পের যন্ত্রপাতি এদেশের মতোই সহজ-সাধারণ ছিল এবং ১৭১০ সালে ইংলন্ডে লৌহ শিল্পের অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়।..... .ইংল্যান্ডে ভারতের ধন-সম্পদ পৌঁছার এবং ঋণ ব্যবস্থা প্রবর্তনের আগে পর্যন্ত প্রয়োজন অনুরূপ শক্তি (মূলধন) ইংলন্ডের ছিল না।” (পলাশী যুদ্ধোত্তর মুসলিম সমাজ : পৃ. ৫৫-৫৬)
বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের বস্ত্র ও অন্যান্য পণ্যের মুকাবিলায় টিকাতে না পেরে যেখানে ব্রিটিশ বস্ত্র-শিল্পের মালিকরা তাঁতের অনুন্নত বস্ত্র-শিল্প বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে আন্দোলন শুরু করে, সেখানে ১৭৬০ সালের পর দেখা দিল বিস্ময়কর পরিবর্তন।’ ৬০ সালে এল তাঁতের উড়ন্ত মাকু, ’ ৬৪ ও ’৭৬ সলে তৈরি হল সুতা কাটার যন্ত্র ‘জেনি’ ও ‘সিউল’। ‘৬৮ সালে আবিষ্কৃত হল বাষ্পীয় যন্ত্র। এসব আবিষ্কারের সঙ্গে যুক্ত হল ভারতবর্ষের অফুরন্ত লুণ্ঠিত সম্পদ। ফলে অঢেল অর্থ আর বাষ্পীয় শক্তির যৌথ সহযোগে অসম্ভব সম্ভব হলো। ইংল্যান্ডের বস্ত্র-শিল্পের মান ও পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপের বাজারে এদেশের বস্ত্র-শিল্পের চাহিদা কেবল কমেই গেল না-অধিকন্তু তাদের উদ্ধৃত্ত কাপড় এদেশে রফতানি করবারও প্রয়োজন বোধ করল ইংলন্ডের বস্ত্র-শিল্প মালিকরা। এরপরও দেশীয় বস্ত্র-শিল্পের চাহিদাকে শূণের কোটায় নামিয়ে আনার এবং সেই সংগে বিলেতী বস্ত্রের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তোলার স্বার্থে বেনিয়া শোষক গোষ্ঠী দেশী পণ্যের উপর ট্যাক্সের গুরুভার চাপিয়ে দিল। কিন্তু তদ্সত্তে¡ও দেশী পণ্যের মুকাবেলায় টিকতে না পেরে অবশেষে বস্ত্রের ওপর ৭০-৮০ ভাগ শুল্ক চাপিয়ে দিলো আর বিলেতী মালের ওপর থেকে শুল্ক উঠিয়ে নিলো। ফলে দেশীয় শিল্প আত্মরক্ষায় ব্যর্থ হয়ে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে গেল। একই অবস্থা হলো অন্যান্য শিল্পের ক্ষেত্রেও। অতএব এসব শিল্প ধ্বংস হবার সংগে শিল্পের সংগে জড়িত বিরাট শ্রম ও জনশক্তি গেল ধ্বংস হয়ে। দৈনিক অত্যাচার ও অর্থনৈতিক দরবস্থায় পড় তাঁতীরা তাঁত ছেড়ে দিল। পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে তাঁতীদের সংগে অন্যান্য শিল্পের লোকেরাও কৃষির দিকে হাত বাড়াল শেষ সম্বল হিসেবে। অথচ সেখানেও যে তাদের জন্য কোন আশ্বাস ছিল না- তা পূর্বেই বলা হয়েছে।
ব্রিটিশ বেনিয়া শাসক ও শোষক গোষ্ঠীর নির্মম শাসন ও শোষণেল যাঁতাকালে পিষ্ট হয়ে এদেশের কৃষক, তাঁতী, মজুরসহ সর্বশ্রেণীর মানষের বাঁচার নূনতম পথও আর খোলা রইল না। কেবল তখনই দুটো পথ তাদের সামনে উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিল। এক, শোষণ-নির্যাতনের চাপে তিল তিল করে অনিবার্য ধ্বংসে পরিণত হওয়া। দুই. বাঁচার শেষ চেষ্টায় বিদ্রোহের মাঝে মরণ আঘাত দেওয়া, বিপ্লবের মাধ্যমে শোষক বেনিয়া গোষ্ঠীর উচ্ছেদ সাধন করে আজাদী ও মুক্তির স্বর্ণোজ্জ্বল প্রভাব ছিনিয়ে আনা। বাংলা বিহারের মানুষ দ্বিতীয় পথকেই বেছে নিল। শোষণ-নিষ্পেষণে অতিষ্ঠ ও মরণোন্মুখ এদেশের শ্রমজীবী মানুষ, চিরকালের নিরীহ মানুষ মুখ বুঁজে মার খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করে হয়ে উঠল বিদ্রোহ ও প্রতিবাদমুখর। যে হাত ছিল একদিন লাঙলের মুঠোয়, যে হাত সৃষ্টি করত বিখ্যাত মসলিন, সে হাত উঠিয়ে নিলো সুতীক্ষè অস্ত্র। শত্রুকে ক্ষমা না করার এবং ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’র নীতি গ্রহণ করল সে হাত শাসক ও শোষকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জয় ধ্বজা উড়িয়ে যিনি সর্বপ্রথম মজলুম মানুষের মুক্তি মিছিলের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসলেন- তিনিই ইতিহাস খ্যাত ফকীর মজুন শাহ। আমাদের আযাদী সংগ্রামের সর্বপ্রথম সৈনিক। ফকীর মজনু শাহ বর্তমান ভারতের গোয়ালিয়র রাজ্যের নেওয়াত এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাদরী-বেরিহানা তরিকার ফকীর বা দরবেশ ছিলেন। এই তরিকার ফকীরদের সম্পর্কে মরহুম নওয়াবজাদা আবদুল আলী বলেন : “তারা মাথায় লম্বা চুল রাখে, রঙিন কাপড় পরে এবং লোহার শিকল ও লম্ব চিমটা ব্যবহার করে। প্রধানত আতপ চাল, ঘি ও নুনই তাদের খাদ্য। তারা মাছ- গোশ্ত খায় না এবং কিছুকাল আগেও তারা কৌমার্যব্রত পালন করত। সফরের সময় তারা মৎস্যশোভিত পতাকা বহন করে এবং বিরাট দলবল নিয়েই তারা চলাফেরা করে। তাদের উপাধি ‘বোরহানা’ এসব ফকীর ‘বসরিয়া’ তরিকার ‘তৈফুরিয়া খানেওয়াড়ো’ ও ‘তাবাগাতি’ ঘরের অন্তর্ভুক্ত।............শাহ মাদার হচ্ছেল এ তরীকার প্রবর্তন।” (বাঙলার ফকীর বিদ্রোহ : পৃ. ৬)
১৬৫৯ সালে বাংলার তদানীন্তন সুবেদার শাহ সুজা বোরাহানা ফকীর শাহ সুলতান হাসান মুরিয়া বোরহানাকে এক সনদ দান করেন। উক্ত সনদবলে বোরহানা ফকীরগণ বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার যে কোনো স্থানে যাতায়াতে তাদের পতাকা, বাদ্যযন্ত্র, অন্যান্য জিনিসপত্র বহনের অধিকার লাভ করে। সনদে মালিকবিহীন ভূ-সম্পত্তি ভোগ দখলের অধিকারও তাদের দান করা হয়। অধিকন্তু তারা যেখানেই যাক, সেখনাকার জমিদার কিংবা প্রজা তাদের খাওয়া খরচ বহন করবে এবং তাদের কোনোরূপ কর দিতে হবে না বলেও উক্ত সনদে উল্লেখ করা হয়।
এরা এক সময় দল বেঁধে ভারতবর্ষের নানা স্থানে বসবাস ও ইতস্তত ঘোরাফেরা করে আসলেও কালক্রমে এরা দেশের নানা স্থানে পতিত ও খাস জমি দখল করে কিংবা মুসলিম শাসকদের থেকে ‘দান’ প্রাপ্ত জমিতে চাষাবাদ শুরু করে। কালক্রমে স্থায়ী কৃষকে পরিণত হলেও পোশাক-আশাকে এরা কিন্তু নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে। ব্রিটিশ বেনিয়া শাসন হঠাৎ করেই এদের যাতায়াতের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে (দ্র. পলাশী যুদ্ধোত্তর মুসলিম সমাজ ও নীল বিদ্রোহ, পৃ. ৮৫-৮৬)। এমনকি তীর্থ ক্ষেত্র ভ্রমণের উদ্দেশ্য যাতায়াতকারী ফকীরদের উপরও বিরাট কর ধার্য করে। যে জমি তারা নিষ্কর ভোগ করত,তার উপরও অতিরিক্ত কর প্রয়োগ করা হল। ফলে একদিকে জীবিকা, অপরদিকে ধর্মীয় অধিকারের উপর এই বাধা-নিষেধ তাদেরকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। আর এই ক্ষোভই তাদরকে বিদ্রোহের পেছনে মদদ যোগায়। অতএব জীবিকার স্বাভাবিক তাগিদে একদিকে খাদ্যশস্য গুমামজাতকারী মহাজন ও কুঠিয়ালদের উপর তারা আক্রমণ চলাতে শুরু করে এবং অধিক মুনাফার আশায় মজুদ করা খাদ্য লুট করতে শুরু করে, অপরদিকে এই জালিম শাসক ও শোষকদের সহযোগী যেকোন লোকদের তারা আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত করতে থাকে।
১৭৬৩ সালে ফকীর বাহিনী সর্বপ্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঢাকা কুঠির আক্রমণ করে। সে সময় ঢাকা কুঠির ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী মি. র‌্যালফ লিসেস্টার নামক জনৈক শ্বেতাঙ্গ ফকীর বাহিনীর আগমনে ভীত হয়ে কোনোরূপ প্রতিরোধের চেষ্টা না করেই বুড়িগঙ্গার বুকে আশ্রয় নেন। ফলে বিনা বাধায় ফকীরদের লুণ্ঠন ক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়। কোম্পানির তৎকালীন গভর্নর কুখ্যাত লর্ড ক্লাইভ মি. র‌্যাফল লিসেস্টারকে কাপুরুষ আখ্যা দিয়ে ফকীরদের ‘ছোট লোকের দল’ হিসেবে অভিহিত করে।
ঢাকা কুঠির থেকেই ফকীর বাহিনীকে অব্যাহত অগ্রাভিযানে লিপ্ত দেখা যায়। এসব অভিযানের সবগুলোকেই লক্ষ্যস্থল হিসেবে দেখা যায় কোম্পানি কুঠি এবং তাদের খাজনা আদায়কারী অত্যাচারী পাষন্ড জমিদারদের কাছারিগুলো। অনেক সময় তারা জমিদারদের নিজস্ব বসতবাটি এবং সুদখোর-মহাজন ও দালাল-ফড়িয়াদের বাড়িতেও আক্রমণ চালিয়েছে। আক্রমণ অভিযানগুলোর অধিকাংশই যে দলপতি ফকীর মজনু শাহ্র নেতৃত্বে পরিচালিত হতো- এ ব্যাপারে সকল বর্ণনাই একমত এবং আরও একমত যে, মুসা শাহ্, পরাগল শাহ্, চেরাগ আলী শাহ্, সোবহান শাহ্, করিম শাহ্ প্রমুখ এক্ষেত্রে ফকীর মজনু শাহ্র বিশিষ্ট শাগরেদ ও সহচর ছিলেন। মূসা শাহ্ ছিলেন তাঁর জ্ঞাতিভ্রাতা এবং দক্ষিণ হস্তস্বরূপ। প্রধানত তাঁর সঙ্গে পরামর্শক্রমেই তিনি অভিযানের সকল পরিকল্পনা তৈরি করতেন। অধিকন্তু এই মুসা শাহ্ই ফকীর মজনু শাহ্র মৃত্যু-পরবর্তী বহু বছর ফকীর বাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে এ আন্দোলনে নেতৃত্বে দিয়েছিলেন।
মজনু শাহ্ ভারতের কানপুর থেকে চল্লিশ মাইল দূরে মকানপুর নামক শাহ্ মাদারের দরগায় বাস করতেন। এখান থেকেই তিনি প্রতি বছর সহস্রাধিক অনুচরসহ বেনিয়া কোম্পানির অধিকারভুক্ত বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করতেন। বিহারের পূর্নিয়া, কুচবিহার, বাংলার রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, জলপাইগুড়ি, মালদহ, পাবনা ও ময়মনসিংহ জেলায় অধিকাংশ সময়ে এবং ঢাকা ও সিলেট জেলায় মাঝে মধ্যে অভিযান পরিচালনা করতেন তারা। এসব অভিযানে ফকীরদের সঙ্গে উট, ঘোড়া, হাউই, গাদা-বন্দুক, বর্শা, কয়েকটি ঘূর্ণায়মান কামান থাকত। এই ঘূর্ণায়মান কামানটিকে ‘ভেলা’ বলা হতো। এর সঙ্গে একটা চক্র যুক্ত ছিল এবং চক্রটি ঘূর্ণনের ফলে চতুর্দিকে অজ¯্র ধারায় অগ্নিবর্ষিত হতো। হয়তো এ জন্যই লোকে একে ‘ঘূর্ণায়মান কামান’ বলে জানত।
ফকীর মজনু শাহ্ পরিচালিত অভিযানগুলোর ভেতর আমরা ১৭৬৩ সালের ঢাকা কুঠি আক্রমণ ছাড়া, পরবর্তী কয়েক বছর অন্য কোনো আক্রমণ অভিযানের সংবাদ অবগত নই। ১৭৬৯ সালে ফকীর বাহিনীর বিরুদ্ধে লে. কীথের নেতৃত্বাধীনে একটি সেনাদল প্রেরিত হয়। পূর্নিয়ার উত্তরে বোরাং অঞ্চলে ফকীর দলের সঙ্গে সংঘর্ষে কীথ নিহত হন। এবং অন্যরাও মারা যান। ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুরে ফকীরদের বিরুদ্ধে ১০ জন সিপাই ও ১০০ বরকন্দাজের সমস্বয়ে একটি কোম্পানি পাঠানো হয়। ফকীরদের সংখ্যাধিক্যে তারা ভয় পেয়ে ফিরে আসে। পরের বছর ১৭৭১ খ্রিষ্টাব্দে পাবনার বেলকুচি ও লক্ষীনামপুর নামক স্থানে ফকীরদের আগমন ঘটেছিল বলে ক্যাপ্টেন রেনেল মুুর্শিদাবাদ কর্র্তৃপক্ষকে জানান। পরে তারা সেখানে থেকে ময়মনসিংহ জেলার পুখরিয়া পরগনাার দিকে গেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেছিলেন। ক্যাপ্টেনের চিঠি পেয়ে লে. টেইলরের নেতৃত্বে দু’দল সিপাই পাঠানো হয়। তার সঙ্গে লে. ফেলথামের নেতৃত্বে আর দুটো দল ফকীরদের পথরোধ করার জন্য ঘোড়াঘাট (রংপুর) পাঠানো হয়। গোবিন্দগঞ্জ (রংপুর) থেকে ১২ মাইল দূরে কাজীপাড়া নামক স্থানে ফকীর বাহিনী ফেলথাম বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের শিকার হয়। ফকীর বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং তাদের নেতা মজনু শাহ বগুড়ার মস্তানগড়ের দিকে পালিয়ে যান। পরে দলবল সেখানে তাঁর সঙ্গে মিলিত হয়। মস্তানগড়ে তিনি একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ দেখা যায়।

Popular Posts