আশিকুল হামিদ : প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটে। নানাভাবে মানুষের মৃত্যু ঘটতেও থাকবে। কিন্তু কিছু মানুষের মৃত্যু সমগ্র পৃথিবীকে আন্দোলিত করে। বিশ্ববাসীর মনে প্রচন্ডভাবে নাড়া দেয়। গত ১৭ জুন মিসরের রাজধানী কায়রোর একটি আদালতে মৃত দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসি ছিলেন তেমন একজন মানুষ। প্রকৃতপক্ষে এ যুগের একজন মহামানব। অভিযোগ উঠেছে, মিসরে এ পর্যন্ত জনগণের ভোটে নির্বাচিত একমাত্র প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে আসলে সুকৌশলে হত্যা করা হয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েফ এরদোয়ান জনাব মুরসিকে ‘শহীদ’ বলে ঘোষণা করেছেন।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বহু দেশ ও সংগঠনের পক্ষ থেকে মোহাম্মদ মুরসির মৃত্যুর ব্যাপারে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে। এর কারণ, তার মৃত্যু সাধারণ অসুস্থতার কারণে বা স্বাভাবিক অবস্থায় ঘটেনি। তিনি মারা গেছেন আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য রাখার এক পর্যায়ে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে। জনাব মুরসি অজ্ঞান হয়ে মাটিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন কিন্তু দীর্ঘ ২০ মিনিট পর্যন্ত সরকার কোনো চিকিৎসককে আনার ব্যবস্থা করেনি। অনেক পরে হাসপাতালে নেয়া হলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। সরকারিভাবেও প্রচার করে জানানো হয়, মোহাম্মদ মুরসি ইন্তিকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন)। পরদিন, ১৮ জুন তুরস্কসহ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে একই সময়ে জনাব মুরসির গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানসহ মুসলিম বিশ্বের অনেক নেতাই গায়েবানা জানাজায় শরিক হয়ে জনাব মুরসির মাগফিরাতের জন্য দোয়া করেছেন। তার নিজের দেশ মিসরে অবশ্য ব্যতিক্রম ঘটেছে। সেখানে প্রকাশ্যে কারো পক্ষে গায়েবানা জানাজা পড়া সম্ভব হয়নি। যারা পড়েছেন তারা গোপনীয়তা বজায় রাখতে বাধ্য হয়েছেন।
এমন অবস্থার কারণ সম্পর্কে নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, মিসরে এখন অবৈধ প্রেসিডেন্ট জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির স্বৈরশাসন চলছে। দেশের সংবিধান সংশোধন করে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পদে থাকার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ২০১৩ সালের ৪ জুলাই এই জেনারেল আল-সিসিই সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর মিথ্যা মামলায় কারাগারে ঢুকিয়েছিলেন। প্রথম কিছুদিন পর্যন্ত তার অবস্থান সম্পর্কে জানতে দেয়া হয়নি। পরবর্তীকালে জেনারেল সিসির সরকার জানিয়েছিল, রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র ও কর্মকান্ডের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় জনাব মুরসিকে বন্দী করা হয়েছে। সে সময় থেকেই জনাব মুরসিকে করাগারে রেখেছে আল-সিসির সরকার।
অন্যদিকে ২০১৩ সাল থেকে বন্দী সাবেক প্রেসিডেন্ট বহুবার আদালতে অভিযোগ করেছেন, তার ওপর প্রচ- নির্যাতন চালানো হয় এবং তাকে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সাধারণ কয়েদীদের সঙ্গে বাস করতেও বাধ্য করা হয়। তিনি দুর্গন্ধযুক্ত পচা ও বাসী খাবার খেতে বাধ্য হচ্ছিলেন। তাকে কোনো ওষুধ ও চিকিৎসার সুযোগও দেয়া হয়নি। এ প্রসঙ্গে অন্য একটি তথ্যও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোড়ন তুলেছে। বন্দী অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে জনাব মুরসি একবারের জন্য পবিত্র কোরআন শরীফ ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নামে মুসলিম হলেও আল-সিসির সরকার তাকে কোরআন শরীফও দেয়নি। ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশে জনাব মুরসি বলে গেছেন, তারা হয়তো জানেই না যে তিনি অর্থাৎ মোহাম্মদ মুরসি ৪০ বছর আগেই পবিত্র কোরআন শরীফ মুখস্থ করেছেন। মৃত্যুর আগে তিনি শুধু কোরআন শরীফকে একটু ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সুযোগটুকুও তাকে দেয়নি মুসলিম নামের আল-সিসির সরকার। এভাবে সব মিলিয়ে তাকে এত বেশি নির্যাতিত অবস্থায় রাখা হয়েছিল যে, সাবেক নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসি তার জীবন নিয়ে আশংকা প্রকাশ করেছিলেন। প্রকাশ্য আদালতে বিচারপতিদের তিনি জানিয়েছিলেন, তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। সবশেষে গত ১৭ জুন জনাব মোহাম্মদ মুরসির সে আশংকাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তাকে আসলেও হত্যা করেছে আল-সিসির সরকার। না হলে একজন জনপ্রিয় ও নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ২০ মিনিট পর্যন্ত বিনা চিকিৎসায় মাটিতে ফেলে রাখা হতো না। একই কারণে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান জনাব মুরসিকে ‘শহীদ’ বলে ঘোষণা করেছেন। বিশ্বের মুসলিমরাও তাকে ‘শহীদ’ এর মর্যাদা দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে মোনাজাত করেছেন।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে মোহাম্মদ মুরসির এবং সেই সাথে মিসরের ইতিহাস স্মরণ করা দরকার। সবচেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য তথ্যটি হলো, প্রায় ৮৪ বছর ধরে নিষিদ্ধ অবস্থায় থাকা মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী হিসেবে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসিকে মেয়াদের এক বছরও পূর্ণ করতে দেয়া হয়নি। এর আগে প্রায় তিন দশকের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি। প্রচন্ড গণআন্দোলনের মুখে তার পতন ঘটে ১০ ফেব্রুয়ারি। হোসনি মোবারক ক্ষমতায় এসেছিলেন ১৯৮১ সালের ১৪ অক্টোবর, প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত নিহত হওয়ার আট দিন পর। ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা হিসেবে মোবারক চারবার প্রেসিডেন্ট পদে ‘নির্বাচিত’ হয়েছিলেন। সেগুলো এমন নির্বাচন ছিল যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা পাত্তাই পেতেন না। শেষবার ২০০৫ সালে নির্বাচনে মোবারক কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীকে দাঁড়াতে পর্যন্ত দেননি।
এভাবে সময়ে সময়ে লোক দেখানো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও মিসর আসলে ছিল অঘোষিত সামরিক শাসনের অধীনে। এরও শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালে রাজা ফারুককে উৎখাত করার পর থেকে। প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন রাজা ফারুক বিরোধী অভ্যুত্থানের নেতা কর্নেল গামাল আবদেল নাসের। নাসেরের আমলে ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খালের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরাইলের সঙ্গে মিসরের যুদ্ধ হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সংঘটিত সে যুদ্ধে গোটা বিশ্ব দাঁড়িয়েছিল মিসরের পক্ষে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রেসিডেন্ট নাসের সে সময় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু এবং যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল যোসেফ টিটোর সঙ্গে নাসের ছিলেন জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
অমন ভূমিকা ও অবস্থান সম্মানজনক হলেও মিসরকে প্রেসিডেন্ট নাসের গণতন্ত্রের পথে এগোতে দেননি, তিনি বরং সেনাবাহিনীকে সামনে রেখে স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকা পালনের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা বর্তমান রাশিয়ার সমর্থন পাওয়ার কৌশল হিসেবে তিনি এমনকি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি অনুসরণের অভিনয়ও করতেন। ১৯৭০ সালে নাসেরের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় এসেছিলেন তার ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং আরেক জেনারেল আনোয়ার সাদাত। ইসরাইলের সঙ্গে ক’টনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগে আনোয়ার সাদাত জনসমর্থন খুইয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর এক সদস্য তাকে প্রকাশ্য এক সামরিক অনুষ্ঠানে গুলী করে হত্যা করেছিলেন। আনোয়ার সাদাত মারা যাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক। তিনি ছিলেন বিমান বাহিনীর প্রধান। এভাবেই মিসরে বছরের পর বছর ধরে চলেছে সামরিক শাসন। মুখে গণতন্ত্রের আড়াল নেয়া হলেও হোসনি মোবারকের ৩০ বছরই মিসর ছিল জরুরি অবস্থার অধীনে। মিসরে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল হোসনি মোবারকের পতনের পর, ২০১২ সালের ৩০ জুন। প্রথম সে নির্বাচনে ৫১.২ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন ড. মোহাম্মদ মুরসি। তিনি ছিলেন আল-ইখওয়ান আল-মুসলিমুন বা মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী। ১৯২৮ সালে মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাববিদ ও রাজনীতিক হাসান আল বান্না। ১৯৪৮ সালে তাকে হত্যা করা হয়। একযোগে মুসলিম ব্রাদারহুডের ওপর নেমে আসে সরকারের প্রচন্ড দমন-নির্যাতন। ১৯৫৪ সালে নাসেরকে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করা হয়। এর নেতা-কর্মি ও সমর্থকদের ওপর চলতে থাকে প্রচন্ড নির্যাতন। সুদীর্ঘ এ সময়কালে মুসলিম ব্রাদারহুডের কয়েকজন নেতাকে এমনকি ফাঁসিতেও প্রাণ হারাতে হয়েছে। কিন্তু এত প্রতিক’লতার পরও মুসলিম ব্রাদারহুড শুধু টিকেই থাকেনি, গোপন তৎপরতার মাধ্যমে মিসরের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের অবস্থানেও পৌঁছে গিয়েছিল। এজন্যই মোহাম্মদ মুরসি ৫১ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পেরেছিলেন।
কিন্তু নির্বাচিত হলেও এবং দেশের জন্য একটি সংবিধান রচনা ও গণভোটের মাধ্যমে সে সংবিধানকে পাস করিয়ে নিলেও রাষ্ট্রীয় কোনো একটি ক্ষেত্রেই মোহাম্মদ মুরসিকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে বা পদক্ষেপ নিতে দেয়া হয়নি। ড. মুরসি ও তার সমর্থকরা প্রকাশ্যেই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন। বাজেট ও ব্যয়সহ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবেন না বলে ২০১২ সালের আগস্টে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করা সত্ত্বেও রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট মুরসি সেনাবাহিনীর কোনো সহযোগিতা পাননি। পাশাপাশি ছিল স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের সাজিয়ে যাওয়া বিচার বিভাগ, পুলিশ ও প্রশাসন। অর্থাৎ সবদিক থেকেই প্রেসিডেন্ট মুরসি প্রচন্ড প্রতিক’ল এক অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলেন, যার কারণে সদিচ্ছা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও তার পক্ষে জনকল্যাণমূলক কোনো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
ঘটনাপ্রবাহে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন মোহাম্মদ এল বারাদেইয়ের মতো পাশ্চাত্যের ক্রীড়নক রাজনীতিকরা। উল্লেখ্য, এই এল বারাদেই-ই প্রধান আন্তর্জাতিক পারমাণবিক পরিদর্শক হিসেবে সাদ্দাম হোসেনের ইরাকে ব্যাপক মানববিধ্বংসী সমরাস্ত্র রয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার সে মিথ্যাচারকে অবলম্বন করেই যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা চালিয়েছিল। সেই থেকে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে একের পর এক রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন ঘটেছে। এই প্রক্রিয়ায় মিসরেও এল বারাদেইকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু মোহাম্মদ মুরসি ও মুসলিম ব্রাদারহুডের জনপ্রিয়তার কাছে এল বারাদেই চুপসে গিয়েছিলেন। তিনি এবং তার ইসলামবিরোধী বিদেশি সমর্থকরা যে নীরবে বসে থাকেনি তারই প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল আল-সিসির নেতৃত্বে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানে। ২০১৩ সালের ৪ জুলাইয়ের সামরিক অভ্যুত্থানে প্রমাণিত হয়েছে, মুরসি তথা মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধাচরণের মধ্য দিয়ে মিসরে প্রকৃতপক্ষে ইসলামী শক্তির বিরুদ্ধেই অভ্যুত্থান ঘটানো হয়েছে। এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে জানাজানি হতেও সময় লাগেনি। প্রমাণিত হয়েছে, এল বারাদেই এবং তার ইসলামবিরোধী বিদেশি সমর্থকরা এতদিন নীরবে বসে থাকেনি। তারাই ঘটিয়েছিল মুরসি বিরোধী অভ্যুত্থান।
তারও আগে মূলত সেনাবাহিনীর অসহযোগিতাজনিত অক্ষমতাকে মোহাম্মদ মুরসি ও মুসলিম ব্রাদারহুডের অযোগ্যতা হিসেবে প্রচার করেছে ক্ষমতালোভী চক্র। এই গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন মোহাম্মদ এল রারাদেইয়ের মতো পাশ্চাত্যের ক্রীড়নক রাজনীতিকরা। তারা সম্মিলিতভাবে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুরসি বিরোধী বিক্ষোভ উস্কে দিয়েছে। হোসনি মোবারকের পতনের পর রাতারাতি কোনো সুফল ভোগ করতে না পারায় তরুণরাও নতুন করে রাজপথে নেমে এসেছে। তারা লক্ষ্যই করেনি যে, প্রেসিডেন্ট মুরসির কথিত ব্যর্থতা বা অযোগ্যতার পেছনে দায়ী আসলে ছিল সেনাবাহিনী। বিরামহীন উস্কানিতে বিক্ষুব্ধ তরুণদের পাশাপাশি মুসলিম ব্রাদারহুড বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও রাজপথে আন্দোলন করেছে। সে অবস্থার সুযোগ নিয়ে সেনাবাহিনী প্রসিডেন্ট মুরসিকে হঠাৎ ২০১৩ সালের ৩ জুলাই পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর সমন্বয়ে জাতীয় সরকার গঠন এবং সংবিধান সংশোধন করাসহ বেশ কিছু শর্ত পূরণের দাবি জানিয়েছিল সেনাবাহিনী। ওদিকে মুরসির পদত্যাগের দাবিতে রাজধানী কায়রোর তাহরির স্কয়ারে শুরু হয়েছিল গণসমাবেশ। কিন্তু প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি সেনাবাহিনীর দাবি ও আল্টিমেটাম প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে মুরসি ঘোষণা করেছিলেন, জীবন দিতে হলেও অবৈধ কোনো শক্তির অশুভ ইচ্ছার কাছে তিনি নতি স্বীকার করবেন না। তিনি বরং জনগণের ইচ্ছা ও আশা-আকাংক্ষা এবং দেশের সংবিধানকে সমুন্নত রাখবেন। প্রেসিডেন্ট মুরসির এই অস্বীকৃতি ও বলিষ্ঠ অবস্থান সেনাবাহিনীকে ক্ষুব্ধ করেছিল। ইসলামবিরোধী পাশ্চাত্যের ক্রীড়নক হিসেবে চিহ্নিত সাবেক ক’টনীতিক মোহাম্মদ এল বারাদেইসহ কিছু রাজনৈতিক নেতা ও দলের সমর্থন নিয়ে সেনাবাহিনী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে ২০১৩ সালের ৪ জুলাই। সেদিন থেকেই কায়রোর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণস্থানে অবস্থান নিয়েছিলেন মুরসির সমর্থক লাখ লাখ নারী-পুরুষ। এসব স্থানে দিনের পর দিন অবস্থান করেছেন তারা। বন্দি প্রেসিডেন্ট মুরসির মুক্তি ও পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছেন। তাদের ওপরই দিনের পর দিন ধরে সশস্ত্র অভিযান চালিয়েছে সেনাবাহিনী। তুরস্ক একে গণহত্যা বলেছে। ক্ষোভ প্রকাশ করেছে এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নও।
গণহত্যা চালানোর পাশাপাশি অস্ত্রের মুখে সমাবেশ পন্ড করতে এবং মুরসি সমর্থকদের রাজধানী কায়রো থেকে তাড়িয়ে দিতে পারলেও সেনাবাহিনীর পক্ষে পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করা সম্ভব হয়নি। কারণ, মোহাম্মদ মুরসি শুধু গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্টই ছিলেন না, ছিলেন এমন একদল মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিনিধিওÑ যে দলটি নিষেধাজ্ঞা এবং নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতনের মধ্যেও দীর্ঘ ৮৪ বছর ধরে বিকশিত হয়েছে। জনপ্রিয়তারও শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল দলটি। অমন একটি দলকে কেবলই বন্দুকের জোরে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে রাখা কিংবা নির্মূল করা সম্ভব হতে পারে না। এরই মধ্যে পরিবর্তনের হাওয়াও বইতে শুরু করেছিল বলেই মোহাম্মদ মুরসিকে শেষ পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকরা। তারা বলেছেন, ৬৭ বছরের বেশি সময় ধরে সেনা শাসনে অতীষ্ঠ ও পিছিয়ে পড়া মিসরের সাধারণ মানুষও নতুন করে সেনাবাহিনীর অধীনস্থ হতে সহজে সম্মত হবে না। প্রেসিডেন্ট পদে মোহাম্মদ মুরসির পুনর্বহাল আর সম্ভব নয় সত্য, কিন্তু সংবিধান, গণতন্ত্র এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠবে মিসরের জনগণ। সে ইঙ্গিত এর মধ্যে পাওয়াও যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, আল-সিসির সেনাবাহিনী নতুন করে এক গভীর সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা মোটেও সহজ হবে না। সেনাবাহিনীকে বরং জনগণের ইচ্ছার কাছে নতিস্বীকার করতে হবে।
ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জীবন হারাতে হলেও প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার পাশাপাশি রয়েছে এমন এক রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুড, ২০১১ সালে হোসনি মোবারকের পতন পর্যন্ত নিষিদ্ধ অবস্থায় কাটানোর পরও যে দলটির প্রার্থী হিসেবেই প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন মোহাম্মদ মুরসি। সুবিধাবাদী ও পাশ্চাত্যের ক্রীড়নক রাজনীতিকদের সহযোগিতা নিয়ে সেনাবাহিনী তাকে ক্ষমতাচ্যুত এবং শেষ পর্যন্ত হত্যা করলেও তার দলই আবারও ক্ষমতায় আসতে পারেÑ এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না পর্যবেক্ষকরা। সব মিলিয়ে বলা যায়, মিসর আসলে নতুন করে এক গভীর সংকটের মধ্যে পড়েছে। শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি মিসরকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিতে চাইলে সেনাবাহিনীকে অবশ্যই ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে। আবারও সুযোগ দিতে হবে গণতন্ত্রকে, যার সূচনা করতে হলে আয়োজন করতে হবে নতুন একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের। গণতন্ত্রসম্মত এই পথে যাওয়ার পরিবর্তে জেনারেল আল-সিসি যদি সামরিক শাসনের ভিত্তিকেই দৃঢ়মূল করার চেষ্টা চালান তাহলে সভ্য ও ঐতিহ্যের মুসলিম দেশটি এমনকি গৃহযুদ্ধেরও শিকার হতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। বলা দরকার, যা কিছুই ঘটুক না কেন মিসরের ভবিষ্যৎ সকল পরিবর্তনের পেছনে থাকবেন ‘শহীদ’ মোহাম্মদ মুরসি।
Source: http://www.dailysangram.com