আশিকুল হামিদ : আজকের নিবন্ধে এশিয়ার দুই পরাশক্তি চীন ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার ইচ্ছা রয়েছে। কারণ, শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্কের জন্য পরিচিত দেশ দু’টির সামনে নতুন এক প্রতিবন্ধক তৈরি হয়েছে। সে প্রতিবন্ধক এরই মধ্যে প্রাধান্যেও এসে গেছে। কিন্তু এ বিষয়ে বলার আগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্পর্কে বলা দরকার। এর প্রথম কারণ, এই সময়ে ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের প্রতিযোগিতা চলছে আর সাবেক ক্রিকেটার হিসাবে ইমরান খানের আন্তর্জাতিক পরিচিতি ও সুখ্যাতি রয়েছে। বহু রসাত্মক গালগল্পের নায়কও তিনি। বড়কথা, ‘শত্রু রাষ্ট্র’ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেও ভারতে এখনো তার জনপ্রিয়তা কম নয়। অনেক ভারতীয়র সঙ্গেই ইমরান খানের ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চাইলেই তিনি অন্য পাকিস্তানী সরকার প্রধানদের মতো অন্ধ ভারতবিদ্বেষী হতে পারবেন না।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ভারতের লোকসভা নির্বাচন এবং প্রধানমন্ত্রীর পদে নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয়বার অধিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহের পর্যালোচনায়ও দেখা গেছে, ইমরান খান আসলেও ভারতবিদ্বেষী হতে চাননি। তিনি বরং প্রথম বিদেশী সরকার প্রধান হিসেবে নরেন্দ্র মোদিকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এরই সূত্র ধরে ধারণা করা হয়েছিল, নরেন্দ্র মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ইমরান খানকে সাদরে আমন্ত্রণ জানানো হবে। কিন্তু সেটা হয়নি। আশপাশের সব দেশের, এমনকি মরিশাস ও কিরগিস্তানের সরকার প্রধানদের পর্যন্ত আমন্ত্রণ জানানো হলেও বিস্ময়করভাবে বাদ পড়েছেন ইমরান খান। এর কারণ হিসেবে পুলওয়ামার সন্ত্রাসী হামলাকেন্দ্রিক যুদ্ধমুখী উত্তেজনার পাশাপশি পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনের আগে ইমরান খানের বিভিন্ন বক্তব্যের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। কারণ, নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় দেয়া প্রায় প্রতিটি বক্তৃতায় তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ‘মোদি’ নয়, ‘নরেন্দ্র মোডি’ বলেছেন এবং তুমি তথা ‘তুম’ ও ‘তুমহারা’ বলে এমনভাবে তুলোধুনো করেছেন, যা শুনে মনে হয়নি যে, ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হলে দু’দেশের শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্কে আদৌ কোনো শুভ পরিবর্তন ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। নির্বাচনের পরে ইমরান খান অবশ্য কিছুটা হলেও কথা ও সুর পাল্টেছিলেন। তিনি ভারতের সঙ্গে আলোচনা ও বন্ধুত্বের কথাও বলেছেন।
ইমরান খান কিন্তু তাই বলে কাশ্মীর প্রশ্নে ইঞ্চি পরিমাণও সরে আসেননি। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের গভীর সম্পর্কের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার সময়ও প্রকারান্তরে ভারতকে তিনি হুমকিই দিয়েছেন। চীন যে পাকিস্তানের পাশে রয়েছে এবং যে কোনো যুদ্ধ বা সংকটে পাকিস্তানের পাশেই থাকবে- সে কথাটা যথেষ্ট জোর দিয়েই ভারতকে শুনিয়েছেন তিনি। এসব কারণের পাশাপাশি অতি সম্প্রতি আবারও যুক্ত হয়েছে কাশ্মীর সমস্যার প্রশ্ন। ক’দিন আগে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ওআইসি’র শীর্ষ সম্মেলনে দেয়া বক্তৃতায় ইমরান খান কাশ্মীরকে ভারতের দখলমুক্ত করার ব্যাপারে মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন চেয়েছেন। এর ফলেও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই পিছিয়ে গেছে।
অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এই দূরত্ব এমন সময়ে সৃষ্টি হয়েছে- যখন দুই বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র গণচীন ও ভারতের মধ্যে তিক্ততার নতুন এক প্রতিবন্ধক নিয়ে শান্তিকামী বিশ্বে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রায় তিনশ’ কোটি জনসংখ্যার কারণে শুধু নয়, উভয় দেশের হাতেই পারমাণবিক সমরাস্ত্র রয়েছে বলেও দেশ দু’টির সম্পর্কে অবনতি ঘটলে আশংকার সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক। নতুন প্রতিবন্ধক তথা তিক্ততার সর্বশেষ কারণ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে, চীন বিশাল এক বাঁধ নির্মাণ করে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পাল্টে দিয়েছে। চীন সেই সাথে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এবং যথেষ্ট প্রশস্ত টানেল বা খালও খনন করে চলেছে। এই টানেলের মধ্য দিয়ে চীন ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে যাবে তার জিন জিয়াং প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায়। এর ফলে ব্রহ্মপুত্রের পানি ভারত আর আগের মতো পাবে না। পানির প্রায় সবটুকুই বরং চলে যাবে চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে। বাঁধটি সম্পূর্ণরূপে চালু হলে আসামসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর কৃষি ও চাষাবাদ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, এসব রাজ্য সেচের জন্য প্রধানত ব্রহ্মপুত্রের পানির ওপর নির্ভরশীল।
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের বিবৃতিতে বলেছে, চীনের তৈরি বাঁধের কারণে বিশেষ করে কৃষিনির্ভর আসাম সর্বনাশের মুখে পড়বে। পানির সংকটে পুরো রাজ্যই স্বল্প সময়ের মধ্যে শুকিয়ে যাবে। আসামের পাশাপাশি ভারতের ভবিষ্যতও অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাবে বলেও সাবধান করে দিয়েছে দলগুলো। তারা সেই সাথে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ‘শত্রু প্রতিবেশি’ চীনের সঙ্গে দ্রুত বৈঠক করে সমাধান বের করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে দাবি জানিয়েছে। বিরোধী দলগুলোর দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন এমনকি বিজেপির অনেক নেতাও। এটাই স্বাভাবিক। কেননা, ব্রহ্মপুত্রের উৎস তিব্বতে এবং চীনে এর নাম সাংপো। ভারত রয়েছে চীনের নিচের দিকে, যেমনটি বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের ‘ভাটিতে’। প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী সাংপো বা ব্রহ্মপুত্রের পানি ভাটির তথা নিচের দিকে প্রবাহিত হয়। এর ফলেই ভারত এতদিন নদটির পানি পেয়ে এসেছেÑ যেভাবে বাংলাদেশ এক সময় পেতো ভারত থেকে নেমে আসা গঙ্গা এবং অন্য ৫৪টি অভিন্ন নদ-নদীর পানি। সব নদ-নদীর পানিই ভারতের পর বাংলাদেশ হয়ে গিয়ে পড়তো বঙ্গোপসাগরে।
অবস্থায় পরিবর্তন ঘটেছে ফারাক্কা, গজলডোবা ও টিপাইমুখসহ ভারতের নির্মিত অসংখ্য ছোট-বড় বাঁধের কারণে। পানির তীব্র অভাবে ‘নদীমাতৃক’ বাংলাদেশে এখন মরুকরণ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বাঁধের ভয়ংকর কুফল সম্পর্কে নিজেরা জানেন বলেই চীনের বাঁধ ও এক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন ভারতের সকল দলের নেতারা। খবরে জানা গেছে, ‘চীনপন্থি’ হিসেবে পরিচিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিÑ সিপিআইএমও প্রধানমন্ত্রীর কাছে চীনের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করার দাবি জানিয়েছেন। এটাই অবশ্য যে কোনো দেশের দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলের কর্তব্য- যার ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশে দেখা যায়।
ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে চীন ও ভারতের তিক্ততা কোনদিকে কতটা গড়ায় তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হলেও জানিয়ে রাখা দরকার, দেশ দুটির সম্পর্ক কিন্তু ইতিহাসের কোনো পর্যায়েই ঘনিষ্ঠ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না। চীন ও ভারত ১৯৬২ সালে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। পরবর্তীকালে কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কৌশল নিয়েও কমিউনিস্ট রাষ্ট্র চীনের সঙ্গে তিক্ততার অবসান ঘটাতে পারেননি। কাশ্মীর প্রশ্নে চীন পাকিস্তানের পক্ষে ভ’মিকা পাল করে চলেছে। চীন এখনো ভারতের রাজ্য অরুণাচলকে নিজের ভ’খন্ড বলে মনে করে। এর বাইরেও দীর্ঘ সীমান্তের অসংখ্য এলাকায় দেশ দুটির সেনারা মাঝে-মধ্যেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে। গত বছর ২০১৮ সালের প্রথম দিকেও ডোকলাম সীমান্তে ছোটখাটো যুদ্ধ করেছে চীন ও ভারত। ওই এলাকায় এখনো পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়নি।
এভাবেই এগিয়ে চলেছে চীন ও ভারতের অবন্ধুসুলভ তথা শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক। এরই মধ্যে ২০১৭ সালের আগস্টে দু’ দেশের বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এই ‘যুদ্ধ’ ব্যবসা-বাণিজ্যের সীমা ছাড়িয়ে দু’ দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপরও অশুভ প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন পর্যবেক্ষকরা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে, ভুটান সংলগ্ন ভূখন্ড ডোকলামের মালিকানা নিয়ে তীব্র উত্তেজনাকর ও সংঘাতময় পরিস্থিতির মধ্যে ভারত ওই সময় হঠাৎ ৯৩টি চীনা পণ্যের ওপর শাস্তিমূলক শুল্ক তথা অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি আরোপ করেছিল। এর ফলে ভারতে চীনের রফতানিই কেবল অনেক কমে যায়নি, বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি চীনের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকাও সৃষ্টি হয়েছিল।
নিজেদের সিদ্ধান্তের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভারত সরকার অভিযোগ করেছিল, দেশটির বাজারে বিক্রি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে চীন নাকি তার উৎপাদন খরচের চাইতেও কম মূল্যে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে। এর ফলে একদিকে ভারতে চীনা পণ্যের বিক্রি বাড়ছে অন্যদিকে ক্রমাগত কমছে ভারতীয় পণ্যের বিক্রি। এভাবে ভারতের দেশীয় পণ্য মার খাচ্ছে এবং ক্ষতি স্বীকার করতে গিয়ে অনেক শিল্প-কারখানা এমনকি বন্ধও হয়ে যাচ্ছে। এসবের মধ্যে মোবাইল ফোনের মতো বেশি প্রচলিত পণ্যের পাশাপাশি ইস্পাতের তৈরি ভারি অনেক পণ্যও রয়েছে। মূলত দেশীয় পণ্যকে নিরাপত্তা দেয়ার অজুহাত দেখিয়ে অতীতেও ভারত চীনা পণ্যের ওপর শাস্তিমূলক অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি আরোপ করে দেখেছে। কিন্তু পরিস্থিতিতে উন্নতি হয়নি। সে কারণেই ৯৩টি পণ্যের ওপর নতুন করে এই শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভারত সরকার।
অন্যদিকে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে ভারতকে ‘ভয়াবহ কুফল’ ভোগ করতে হবে বলে সতর্ক করেছিল চীন। দেশটির কমিউনিস্ট সরকারের মুখপাত্র গ্লোবাল টাইমসের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ভারতের এ ধরনের ‘দুর্বল সিদ্ধান্তের জন্য’ চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থ সাময়িকভাবে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে সত্য, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে ভয়াবহ কুফল ভোগ করার জন্য ভারতকেও প্রস্তুত থাকতে হবে। চীনা পণ্যের ব্যাপারে ভারতের নেতিবাচক ও শত্রুতাপূর্ণ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির কমিউনিস্ট সরকার চীনা কোম্পানিগুলোকে ভারতে বিনিয়োগ করার এবং বিনিয়োগ বাড়ানোর আগে ‘দ্বিতীয়বার’ ভেবে দেখার এবং সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার আহবান জানিয়েছিল। এর ফলে ধারণা করা হয়েছিল, এককেন্দ্রিক কঠোর কমিউনিস্ট সরকারের অধীনস্ত বলে চীনের কোনো কোম্পানির পক্ষেই সরকারকে পাশ কাটিয়ে ভারতে বিনিয়োগ বাড়ানো কিংবা উৎপাদনসহ ব্যবসা-বাণিজ্য অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না। তেমন অবস্থায় বন্ধ হয়ে যাবে ভারতে উৎপাদনকাজে নিয়োজিত অসংখ্য চীনা শিল্প-কারখানা এবং চাকরি হারাবে হাজার হাজার ভারতীয় শ্রমিক। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে ভারতের সমাজ ও অর্থনীতির ওপর। শুল্কবিরোধী প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে এ বিষয়টিকেই চীন সামনে নিয়ে এসেছিল।
দেশ দু’টির অর্থনৈতিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তথ্যাভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ডোকলামকেন্দ্রিক সংকটে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভারত। কারণ, চীনে ভারতের রফতানি কমেছিল ১২ দশমিক তিন শতাংশ তথা এক হাজার ১৭৫ কোটি মার্কিন ডলার। কৌতূহলোদ্দীপক একটি তথ্য হলো, রফতানি কমলেও একই সময়ে চীন থেকে ভারতের আমদানি বেড়েছিল প্রায় দুই শতাংশÑ মার্কিন মুদ্রায় যার পরিমাণ পাঁচ হাজার নয়শ’ কোটি ডলার। অর্থাৎ একদিকে ভারতের আয় কমেছে এক হাজার ১৭৫ কোটি মার্কিন ডলার, অন্যদিকে কমার পরিবর্তে উল্টো চীনের আয় বেড়েছে পাঁচ হাজার নয়শ’ কোটি ডলার!
জানা গেছে, এমনিতেই ভারতের তুলনায় চীন চার হাজার সাতশ’ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রফতানি করে থাকে। এমন অবস্থায় ভারত শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপ করলে এবং সিদ্ধান্তটি বজায় রাখলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে কমিউনিস্ট দেশটিকে। জবাবে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে চীন যদি ভারতে চীনা কোম্পানিগুলোর শিল্প-কারখানা বন্ধ করে দেয় এবং চীনের শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীরা যদি ভারতে আর বিনিয়োগ না করেন তাহলে ভারতীয় শ্রমিকরা তো চাকরি হারাবেই, অন্য অনেকভাবেও ভারতকে যথেষ্ট পরিমাণে খেসারত দিতে হবে।
এজন্যই ডোকলামের দখল ও মালিকানাকেন্দ্রিক সংকটের ঘটনাপ্রবাহে ভারতের প্রতি সংযম দেখানোর আহবান এসেছিল বিভিন্ন দেশ ও গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে। ভারতে আশ্রিত চীনের ধর্মীয় নেতা দালাইলামা একথা পর্যন্ত বলেছিলেন যে, যুদ্ধ-সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার পরিবর্তে চীনা বৌদ্ধদের আরো বেশি সংখ্যায় তীর্থে আসার সুযোগ দেয়ার মাধ্যমে ভারতের উচিত চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা, শান্তি বজায় রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানো। যুদ্ধ শুরু হলে চীন ও ভারতের কেউই জিততে পারবে না বলেও মন্তব্য করেছিলেন দালাইলামা।
বলার অপেক্ষা রাখে না, দুই বিরাট প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীন ও ভারতের বাণিজ্য যুদ্ধ এবং ডোকলামের দখল ও মালিকানা নিয়ে সৃষ্ট সংকট সকল বিচারেই অত্যন্ত আশংকাজনক। প্রায় তিনশ’ কোটি জনসংখ্যার কারণে শুধু নয়, উভয় দেশের হাতেই পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে বলেও বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ দেশ দুটির মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কামনা করে। প্রতিবেশি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশও চায় চীন ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যাতে সংঘাতমুখী না হয়। এশিয়ার এ অঞ্চলের জন্য তো বটেই, বিশ্বশান্তির জন্যও চীন ও ভারতের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া ও বন্ধুত্বপূর্ণ থাকা দরকার।
এ প্রসঙ্গেই ব্রহ্মপুত্রের ওপর চীনের নির্মিত বিশাল বাঁধ এবং জিন জিয়াং প্রদেশ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলকেন্দ্রিক সমস্যাকে সামনে আনা দরকার। বিষয়টি নিয়ে চীনের সঙ্গে বৈঠকে বসারও আগে ভারতের উচিত বাংলাদেশকে গঙ্গা ও তিস্তাসহ অভিন্ন ৫৪টি নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা দেয়া। তেমন অবস্থায়ই ভারত চীনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়ার আশা করতে পারে। এখন দেখা দরকার, ভারত ঠিক কোন পথে পা বাড়ায় এবং চীন ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কে ব্রহ্মপুত্রের বাঁধ সত্যিই স্থায়ী প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে কি না! বলা দরকার, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান চীন ও ভারতের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে পারতেন। তেমন সদিচ্ছার প্রকাশও তিনি বিভিন্ন উপলক্ষে ঘটিয়েছেন। কিন্তু ভারতের বিজেপি সরকার প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে অসম্মানিত করেছে। একই কারণে চীনের সঙ্গে সম্ভাব্য বিরোধ ও সংঘাতে ভারত অন্তত পাকিস্তানের সহযোগিতা পাবে না বলেই মনে করেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা।
Source: http://www.dailysangram.com