ইঞ্জিনিয়ার ফিরোজ আহমাদ : গণমানুষের গণজোয়ার দেশ-বিদেশে অনেক দেখেছি । কিন্তু মিশরের শহিদ মুরসির মত এমন গণজোয়ার মনে হয় আর কোথাও দেখিনি । সেটা ছিল দীর্ঘ ৩০ বছরের কুখ্যাত স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আয়োজিত মিশরের গণমানুষের অগ্রণী মুসলিম ব্রাদারহুডের বিপ্লবী নেতাদের অন্যতম ড. মোহাম্মদ মুরসির সফল সংগ্রামী মিছিলের গণজোয়ার । বিশ্ব কাঁপানো সেই মিছিল ছিল মিশরের চরম বিরক্তিকর স্বৈরশাসক হোসনী মোবারকের বিরুদ্ধে সাধারণ গণমানুষের ন্যায্য অধিকারের মিছিল । সেই মিছিল ছিল শোষণ, নিপীড়ন, জুলুম, অত্যাচার আর বাকস্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে । সেই মিছিল ছিল ঐতিহ্যবাহী মিশরের মুসলমানদের প্রাণের আদর্শ ইসলামী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মিছিল । সেই মিছিল ছিল আল্লাহর দুনিয়াতে আল্লাহর আইন কায়েমের বলিষ্ঠ স্লোগান ‘নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবারের’ মিছিল । তাই সেদিন ২০১২ সালে মিশরের লক্ষ-কোটি গণমানুষের প্রাণের নেতা ড. মোহাম্মদ মুরসি বিজয়ী হয়েছিলেন । কুখ্যাত স্বৈরশাসক হোসনী মুবারকের পতন হয়েছিল । মিশরের গণমানুষের সেদিনের মুক্তি ছিল স্বাধীনতাকামী বিশ্ববাসীর স্বতঃস্ফুর্ত অভিনন্দন । স্বৈরতন্ত্রের পতন আর গণতন্ত্রের বিজয় ছিল শান্তিকামী বিশ্ববাসীর অনিবার্য দাবী । তাই ড. মোহাম্মদ মুরসি সেদিনই বিশ্বজাহানের হৃদয়ের সেরা নেতা হয়ে গেলেন । সারা বিশ্বে ড. মোহাম্মদ মুরসির অগ্রযাত্রা কামনা করছিল ।
উল্লেখ্য যে,বিশ্বব্যাপী মহা আতংক এই মিশরের মানবতাবিরোধী কুখ্যাত স্বৈরশাসন । যুগ যুগ ধরে যারাই অত্যাচারী এই জালিমশাহীর বিরোধিতা করতে গিয়েছে তাদেরকেই স্বৈরাচারীর যাতাকলে নিস্পিষ্ট হতে হয়েছে । বিভিন্নভাবে বিরোধী দলের নেতা কর্মীদের অত্যাচার করা হয়েছে । অগণিত ইখওয়ানুল মুসলেমিন বা মুসলিম ব্রাদারহুড নেতাকর্মীদের জেল জুলুম বা ফাঁসী দিয়ে আন্দোলন থামিয়ে দেয়ার সব অ¯্র ব্যবহার করা হয়েছে । কারাগারই নয় শুধু, পুরা মিশরই ব্রাদারহুডের নেতা কর্মী তথা গণ মানুষের কারাগারে পরিণত করা হয়েছে । হাসানুল বান্না,সাইয়েদ কুতুবদের মত অসংখ্য আল্লাহর শ্রেষ্ট মুজাহিদদেরকে সেখানে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিয়ে শহিদ করা হয় । মিশরের সবুজ শান্ত ভ’মিতে লাল রক্তের জোয়ার বহানো হয় । ড. মোহাম্মদ মুরসির এ বিজয় হল ঐ সব ফাঁসি, জেল, জুলুম আর অত্যাচারের ফসল । বিজয়ী মিশর গণতান্ত্রিক বিশ্বে রূপ নিল বিজয় উল্লাস, ইসলামপ্রিয় বিশ্ববাসীর জন্য হয়ে উঠল মাইলফলক ,অন্য সবার জন্য হল প্রেরণার উৎস ।
কিন্তু যারা মানবতা আর গণতন্ত্রের শত্রু আধিপত্যবাদী সেই সব পশ্চিমা দুষমণেরা মুরসির এ মহা বিজয়কে সামনে বাড়তে দিল না । অভিশপ্ত ইসরাইল চরম ক্ষিপ্ত হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে এ বিজয়কে নির্মূলে টার্গেট নিল । ফলে মাত্র এক বছরের মধ্যেই ২০১৩ সালে অন্যায়ভাবে ড. মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে কারাগারে নিক্ষেপ করে মিশরের সেনাবাহিনী । নেতৃত্ব দিল প্রেসিডেন্ট মুরসির নিয়োগপ্রাপ্ত তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সেনাপ্রধান এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট আব্দুল ফাত্তাহ আল সিসি । পশ্চিমাবিশ্বের মোড়লদের সহায়তায় প্রেসিডেন্টের পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর প্রহসনমূলক বিচারের মুখোমুখি করা হয় ড, মুরসিকে । মিথ্যা এক মামলা চাপিয়ে দিয়ে সেখানে বলা হয় মিশরের মধ্যে বিদেশের সন্ত্রাসীদের দিয়ে আক্রমণের ষড়যন্ত্রের গুপ্তচরবৃত্তির প্রধান নায়ক প্রেসিডেন্ট মুরসি । তাই আসামী করা হয় মুরসি এবং তার দল মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা কর্মীদের । সেই প্রহসনমূলক বিচারে অন্যায় স্বিদ্ধান্ত নেয়া হয় । বিচারে দেশোদ্রেীহিতার আসামী ঘোষণা দিয়ে মুরসিকে এক পর্যায়ে মৃত্যদন্ড দেয়া হয় । পরবর্তীতে তার মৃত্যুদন্ডাদেশ বাতিল করে কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয় । বিশ্বনেতা ড. মোহাম্মদ মুরসিকে সেই থেকে কারাভ্যন্তরে সীমাহীন অবহেলা, অত্যাচার, হুমকী, মানসিক যাতনা ইত্যাদিতে আতংকিত করে ফেলে । তার ছেলে মেয়ে এবং পরিবারের অন্যান্যদের উপরও চালানো হয় সীমাহীন অত্যাচার । দলের নেতা কর্মীদের উপর কারাগারের ভিতর ও বাহিরে চলতে থাকে জেল জুলুমসহ অকথ্য রকমের নির্যাতন । এতোসব যন্ত্রণার ভারেই গত ১৭ই জুন ২০১৯ইং সাল মিশরের একটি আদালতে বক্তব্য দিবার সময় মহান এই নেতা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরে বলা হয়,‘আদালতের এজলাসে হঠাৎ পড়ে গিয়ে’ তার মৃত্যু হয় । গত ৭ ই মে মুরসি বলেছিলেন,তার জীবন হুমকীর মুখে।
সামরিক অভ্যুথানে ক্ষমতাচ্যুত মিশরের ইতিহাসের প্রথম নির্বচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির লাশ কঠোর গোপনীয়তায় ১৮ ই জুন ভোরে কায়রোতে সরকারের লোক দিয়ে কড়া নিরাপত্তার সাথে দাফন করা হয় । এর আগে পরিবারের পক্ষ থেকে সারকিয়া প্রদেশের নিজ শহরে তার দাফনের অনুরোধ জানালে সরকার তা দেয় নি । তবে কায়রোর নসর এলাকায় গোপণীয় ওই দাফনে মুরসির পরিবারের সদস্যদের উপস্থিত থাকার অনুমতি দেয়া হয় ।
মুরসির এ মৃত্যু বিশ্ববাসী মেনে নিতে পারছে না । সারা বিশ্ব মুরসির এমন নির্মম মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ও শোকবার্তা জানাচ্ছে । তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান বলেছেন ,জালিমের কারাগারে শহিদ হয়েছেন মুরসি । কারাগারে নিক্ষেপ করে যারা তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে সেই জালিমদের ইতিহাস কখনও ক্ষমা করবে না । আমাদের চোখে মুরসি একজন শহিদ । তিনি তার বিশ্বাসের জন্য জীবন দিয়েছেন । ইতিহাস একনায়ক সেই জেনারেল সিসিকে ক্ষমা করবে না ,যে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে,মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নির্যাতন করেছে এবং মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার যাবতীয় চক্রান্ত করা হয়েছিল । আদালতে নিজের ওপর জুলুমের প্রতিবাদ করেছেন তিনি । মিশরীয়দের মুক্তির জন্য শেষ নি:শ্বাস পর্যন্ত মুরসি যে সংগ্রাম করে গিয়েছেন তা যুগ যুগ ধরে মুসলমানরা স্মরণ রাখবে । আল্লাহ তায়ালার দরবারে আমাদের শহিদ ভাইদের জন্য রহমত কামনা করছি । মোহাম্মদ মুরসি তার হাজার হাজার বিপ্লবী সমর্থককে নিয়ে গত পাঁচ বছর ধরে কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন । কিন্তু পাশ্চাত্যের কেউ এর প্রতিবাদ করেনি । জেনারেল সিসি নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে হটিয়ে বলপূর্বক ক্ষমতা দখল করে ৫০ জনকে ফাঁসি দিয়েছে । তার দেয়া মৃত্যু দন্ডের ব্যাপারে পশ্চিমারা সব সময়ই নিরব থেকেছে ।
মিশরের জালিম শাসক হয়তো গ্রেপ্তারকৃত নেতাদের অত্যাচার করে সাময়িক বিজয় অর্জন করেছে । কিন্তু তাদের ত্যাগ - ইতিহাস মানুষের মন থেকে মুছে দিতে পারবে না।
মিশরের ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা দ্য ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি এক বিবৃতিতে বলে,মুরসিকে নির্জন কারাবাসে রাখা হয়েছে । চিকিৎসা নিতে দেয়া হয়নি । দুর্গন্ধযুক্ত খাবার খেতে দেয়া হয়েছে । মৌলিক মানবাধিকারের সবকিছু থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে । আর এতে ধীরে ধীরে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে । হিউম্যান রাইট্স ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মুরসির মৃত্যুতে বলেছে, তাকে পর্যাপ্ত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে । তার মৃত্যু ও আটকাদেশ নিয়ে একটি পূর্ণাংগ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ রিপোর্ট তৈরী করতে মিশরীয় কর্তৃপক্ষের কাছে তারা আহবান জানিয়েছে । [চলবে]
source: http://www.dailysangram.com/