Wednesday, July 10, 2019

ক্ষুদ্র ঋণ ও কর্জে হাসানা প্রসঙ্গ



ড. মো. নূরুল আমিন : গত মাসের ১৫ তারিখে স্থানীয় একটি সংগঠনের আমন্ত্রণে উত্তরায় একটি সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছিলাম। আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক কর্তৃক কিশোরগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার নয়ারহাট এবং খানারচর গ্রামের দারিদ্র্য বিমোচনে সমবায় সমিতি, মহাজনী সংস্থা ও এনজিওসমূহের ক্ষুদ্র ঋণের সম্ভাব্যতার উপর সম্পাদিত একটি সমীক্ষার ফলাফল ঘোষণা উপলক্ষে এই সেমিনারটির আয়োজন করা হয়েছিল। সমীক্ষায় প্রত্যেকটি গ্রামের ১০০টি করে মোট ২০০টি পরিবারকে একটি পূর্বপ্রস্তুতকৃত প্রশ্নমালা সরবরাহ করা হয়। নির্বাচিত পরিবারসমূহের সকলেই ছিলেন মুসলিম। প্রশ্নমালার মাধ্যমে এই মুসলিম পরিবার ও ঋণগ্রহিতাদের কাছ থেকে তাদের ধর্মীয় অঙ্গীকারের বিষয়টিও ক্ষুদ্র ঋণের সাথে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এতে ঋণ তাদের আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য নিরসনে কতটুকু ভূমিকা রেখেছে এবং ধনী দরিদ্রের ব্যবধান কতটুকু কমিয়েছে তার প্রায়োগিক যথার্থতাও পরীক্ষা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এ ধরনের সমীক্ষায় বাংলাদেশে সম্ভবতঃ এই প্রথম। সমীক্ষাটির জন্য আমি Bangladesh Institute of Islamic Thoughts (BIIT) কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই।

সমীক্ষার ফলাফল ব্যাপক ও বহুমুখী। এই নিবন্ধের ক্ষুদ্র পরিসরে তার সবকিছু আলোচনা করা সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না। তথাপিও এই সমীক্ষার মাধ্যমে বেরিয়ে আসা কয়েকটি বিষয় নিয়ে আমি কিছুটা আলোচনা করা জরুরি বলে মনে করছি।
সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, এনজিওদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে গ্রামের অনেক সদস্যই তাদের দারিদ্র্যকে যথেষ্ট পরিমাণে কমিয়েছেন। পাশাপাশি উৎপাদনমূলক বা আয়বর্ধক কাজের জন্য নয়, বরং অপেক্ষাকৃত ধনীদের জীবনযাত্রা প্রণালী অনুকরণের জন্য ও বেশী বেশী ঋণের জন্য তারা এনজিওদের দ্বারস্থ হয়েছেন। ঋণ পরিশোধের সাপ্তাহিক কিস্তি প্রদানের বাধ্যবাধকতা, উচ্চ সুদের সমস্যা এবং ঋণের অন্যান্য কঠোর শর্তাবলী তাদের ঋণমুখী হওয়া থেকে নিবৃত করতে পারেনি। ফলে বহুমুখী ঋণের জালে তারা আবদ্ধ হয়ে পড়েছেন। এক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের ঋণ শোধ করেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকসহ সরকারি বেসরকারি সংস্থাসমূহ কর্তৃক ভোগ্য ও বিলাসপণ্যের জন্য ঋণ চালু করার ফলে গ্রামের মানুষের Multiple indebtedness বেড়েছে। এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, গ্রামে এখন এমন লোক খুব কম আছে যারা ঋণগ্রস্ত নয়। ঋণ নিয়ে তারা স্বচ্ছন্দে টিভি, ফ্রিজ কিনছে, খাট পালঙ্ক ও ঘরের আসবাবপত্র কিনছে। এমনকি ঘরও তৈরি করছে। মেয়ের বিয়ের যৌতুক দিচ্ছে। এর সবই সুদভিত্তিক ঋণ।
সমীক্ষার প্রশ্নপত্রের একটি আইটেম ছিল ঋণগ্রহিতা পরিবারের লোকদের ধর্মানুশীলনের ব্যাপারে। দেখা গেছে যে, তারা নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন, কুরআন তেলাওয়াত করেন এমনকি হজ্বও করেন। সুদ আল্লাহতায়ালা হারাম করেছেন। পবিত্র কুরআনে এ ব্যাপারে পরিষ্কার নির্দেশনা আছে। প্রশ্ন উঠেছে, একজন ঈমানদার মুসলমান যিনি নামাজ রোজা করেন, যাকাত দেন তিনি কি সুদী ঋণ নিতে পারেন? যদি না পারেন, নিচ্ছেন কিভাবে?
এক এজেন্সি থেকে কর্জ নিয়ে অন্য এজেন্সির কর্জ পরিশোধ করার কথা আমি আগেই বলেছি। কৃষি এবং শিল্প ঋণের ক্ষেত্রে আগে পেপার ট্রানজেকশনের বিষয়টি বহুল আলোচিত ছিল। এখন ক্ষুদ্র ঋণও এই রোগ থেকে মুক্ত নয়। গ্রামীণ ব্যাংকসহ এনজিওগুলো থেকে ঋণ নিয়ে লগ্নি ব্যবসা করেন এই প্রমাণও ইতিপূর্বে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও সুইডিশ সিডাসহ একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত সমীক্ষায় ধরা পড়েছে। এই ঋণ এবং সুদের জাল যেভাবে বিস্তৃত হচ্ছে তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। একজন মুসলমান ঋণ পরিশোধ না করে মারা গেলে তার জানাযা হয় না। এ কথাটিও আমরা এখন মনে করি না। আমাদের আলেম উলেমারাও এ ব্যাপারে নিশ্চুপ।
আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের সমাজে বিশেষ করে মুসলমানদের মধ্যে অনেকগুলো মূল্যবোধ ছিল। সুদখোর, ঘুষখোর এদেরকে সকলেই ঘৃণা করতো। তখন এখনকার মত গ্রামে-গঞ্জে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ছিল না। তফসিলি বা বাণিজ্যিক ব্যাংক তো কেউ নামই শুনেনি। মহকুমা পর্যায়ে সেন্ট্রাল কোঅপারেটিভ ব্যাংক এবং জেলা পর্যায়ে ল্যান্ডমর্গেজ ব্যাংক ছিল। তারা গ্রামীণ সমবায় সমিতি এবং সমবায়ী সদস্যদের বিভিন্ন মেয়াদী   কর্জ দিতো। এই কর্জ ছিল সুদভিত্তিক, এই সুদভিত্তিক সমবায় সমিতি অথবা কর্জের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক ছিল কম। ১৭৯৩ সালের সূর্যাস্ত আইনের পর বৃটিশ শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দুরা রাতারাতিভাবে এই দেশের জমিদারী প্রথার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে; ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা পর্যন্ত এখানকার জমিদারদের শতকরা ৯৮ ভাগই ছিল হিন্দু। হিন্দু জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় পূর্ববাংলার মহাজনী প্রথা ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। সমবায় সমিতি, সমবায় ব্যাংক ও মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে হিন্দুরা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যথেষ্ট এগিয়ে যায়। সুদী লেনদেনের ক্ষেত্রে মুসলমানদের সংখ্যা খুবই কম ছিল। তাদের মধ্যে শরিয়া প্রতিপালনের প্রবণতা ছিল। যেহেতু ইসলামে সুদ হারাম সেহেতু তারা সুদী লেনদেনকে এড়িয়ে চলতেন। সুদখোরদের সাথে তারা বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতেন না। একইভাবে ঘুষখোরদেরও তারা ঘৃণা করতেন।  একজন মুসলমান নামাজ পড়বে, রোজা রাখবে, হজ্জ করবে আবার সুদ নেবে এবং দেবে এটা কল্পনা করা অসম্ভব ছিল। আমি আমার বাবা, চাচা, আত্মীয়-স্বজন ও মুসলমান পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে কর্জে হাসানার ব্যাপক প্রচলন দেখেছি। ওশর ব্যবস্থাও ঐ সময় সক্রিয় ছিল। আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন গরীব হয়ে গিয়েছিলেন। তাদের কর্মসংস্থান ছিল না এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে অন্যের কাছে হাতপাতা ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু আমরা তাদের তা করতে দিতাম না। আমরা প্রত্যেক গৃহস্থ পরিবার থেকে ওশরের ধান তুলে তাদের বাড়ীতে পৌঁছিয়ে দিতাম এবং তাদের সারাবছরের খোরাকির জন্য তা যথেষ্ট ছিল। মাদ্রাসা/এতিমখানাও ওশরের ফসলে চলতো। আমাদের গ্রামে কদবানু নামে একজন মহিলা ছিলেন, পাশের গ্রামে তার বিয়ে হয়েছিল। তার কোনও সন্তান ছিল না, তার স্বামী ছিলেন উদ্ভ্রান্ত দরবেশ; সংসারের কোন খবর নিতেন না। খড়ম পায়ে গ্রামে গ্রামে হাঁটতেন। কদবানু খুবই বিপদগ্রস্ত ছিলেন। কদবানু যেহেতু আমাদের গ্রামের মেয়ে গ্রামের মুরুব্বীরা ঠিক করলেন কদবানুর সহযোগিতার দায়িত্ব গ্রামই নেবে, গ্রামের বাইরে কারুর কাছে তিনি হাত পাততে পারবেন না। আমৃত্যু তিনি এ সেবা পেয়েছেন। এখন দিন বদলেছে। আমরা আমাদের মূল্যবোধগুলোকে হারিয়ে ফেলছি। আমাদের পূর্বপুরুষরা আমাদের মতো শিক্ষিত ছিলেন না। তাদের ঈমানী চেতনা ছিল। তারা কোরআনের একাংশকে বিশ্বাস ও অপরাংশকে অবিশ্বাস করতেন না। আমরা যারা ঈমানদার বলে নিজেদের দাবী করি তারা কি সুদ হারামের কুরআনী নির্দেশ পালন করতে পারেনা?
আমার অগ্রজ প্রতীম ও মুরুব্বী সাবেক সচিব ও বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ শাহ আব্দুল হান্নান সম্প্রতি একটি দৈনিকে প্রকাশিত এক নিবন্ধে কর্জে হাসানার একটি বিস্মিত ইস্যু তুলে এনেছেন। কর্জে হাসানা ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম ইন্সট্রুমেন্ট। তার প্রবন্ধ থেকে আমি এখানে কিছুটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি :
কোরআনের কয়েকটি আয়াতে ‘করজে হাসানা’র কথা বলা হয়েছে। করজে হাসানার অর্থ হচ্ছে এমন ঋণ বা করজ দেয়া যেটা সময়মতো পরিশোধ করা হবে; কিন্তু দাতা কোনো অতিরিক্তি অর্থ বা বেনিফিট নিতে পারবেন না। এর উদ্দেশ্য ছিল, সমাজের একটি প্রয়োজন পূর্ণ করা। সেটি হচ্ছে- ব্যবসা-বাণিজ্যের বাইরেও নানা কারণে মানুষের বা প্রতিষ্ঠানের করজে হাসানার দরকার হতে পারে। সবসময় ব্যক্তির কাছে প্রয়োজনীয় অর্থ থাকে না। কিন্তু সম্ভাবনা থাকে যে, পরে তা থাকবে। এবং সেই অর্থ দিয়ে করজ পরিশোধ করা সম্ভব হবে। সুদকে ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে। ফলে কোনো ব্যক্তির পক্ষে  সুদের ভিত্তিতে অর্থ নেয়া সম্ভব ছিল না বা উচিত নয়। এ জন্যই আল্লাহতায়ালা করজে হাসানার নিয়ম করে দিয়েছেন; যেন মানুষ সাময়িকভাবে করজে হাসানা নিতে পারে সুদ ছাড়া এবং পরে তা দিয়ে দিতে পারে। এ প্রসঙ্গে করজে হাসানার বিষয়ে কুরআনের আয়াতগুলো দিচ্ছি : “তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে, আল্লাহকে ‘করজে হাসানা’ দিতে প্রস্তুত, তাহা হইলে আল্লাহ তাহাকে কয়েক গুণ বেশি ফিরাইয়া দিবেন। হ্রাস-বৃদ্ধি উভয়ই আল্লাহর হাতে নিহিত। আর তাহাদের নিকট তোমাদের ফিরিয়া যাইতে হইবে (বাকারা-২৪৫)।
আল্লাহ বনী-ইসরাঈলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন এবং তাদের মধ্য থেকে বারোজন সর্দার নিযুক্ত করেছিলেন। আল্লাহ বলেন, আমি তোমাদের সাথে আছি। যদি তোমরা নামাজ প্রতিষ্ঠিত কর, জাকাত দিতে থাক, আমার পয়গম্বরদের প্রতি বিশ্বাস রাখ, তাদের সাহায্য কর এবং আল্লাহকে উত্তম পন্থায় করজে হাসানা দিতে থাক, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের গোনাহ দূর করে দেব এবং অবশ্যই তোমাদেরকে উদ্যানসমূহে প্রবিষ্ট করব, যেগুলোর তলদেশ দিয়ে নির্ঝরিণীসমূহ প্রবাহিত হয়। অতঃপর, তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি এরপরও কাফের হয়, সে নিশ্চিতভাবেই সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে (আল মায়িদাহ-১২)।
কে সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহকে উত্তম করজে হাসানা দেবে, এরপর তিনি তার জন্য তা বহু গুণে বৃদ্ধি করবেন এবং তার জন্য রয়েছে সম্মানিত পুরস্কার। (আল-হাদীদ-১১)। নিশ্চয় দানশীল ব্যক্তি ও দানশীল নারী, যারা আল্লাহকে উত্তমরূপে করজে হাসানা দেয়, তাদের দেয়া হবে বহু গুণ এবং তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার (আল-হাদীদ-১৮)। যদি তোমরা আল্লাহকে করজে হাসানা দান কর, তিনি তোমাদের জন্য তা দ্বিগুণ করে দেবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ গুণগ্রাহী, সহনশীল (আত-তাগাবুন-১৭)।
“আপনার পালনকর্তা জানেন, আপনি ইবাদতের জন্য দ-ায়মান হন রাত্রির প্রায় দু’তৃতীয়াংশ, অর্ধাংশ ও তৃতীয়াংশ এবং আপনার সঙ্গীদের একটি দলও দ-ায়মান হয়। আল্লাহ দিবা ও রাত্রি পরিমাপ করেন। তিনি জানেন, তোমরা এর পূর্ণ হিসাব রাখতে পার না। অতএব, তিনি তোমাদের প্রতি ক্ষমাপরায়ণ হয়েছেন। কাজেই কুরআনের যতটুকু তোমাদের জন্য সহজ ততটুকু আবৃত্তি কর। তিনি জানেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হবে, কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে দেশে-বিদেশে যাবে এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে জিহাদে নিয়োজিত হবে। কাজেই কুরআনের যতটুকু তোমাদের জন্য সহজ, ততটুকু আবৃত্তি করো। তোমরা নামাজ কায়েম করো, জাকাত দাও এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও। তোমরা নিজেদের জন্য যা কিছু অগ্রে পাঠাবে, তা আল্লাহর কাছে উত্তম আকারে এবং পুরস্কার হিসেবে বর্ধিতরূপে পাবে। তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু (আল মুযযামমিল-২০)।”
কর্জে হাসানার ব্যবস্থাটি দুর্ভাগ্যবশত: বাংলাদেশে গৌণ হয়ে পড়েছে। তুরস্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রফেসার ড. নাজমুদ্দিন আরবাকানের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম দেশসমূহের ফোরাম ‘ডিএইট’-এর সাথে আমি দীর্ঘকাল সম্পৃক্ত ছিলাম এবং বাংলাদেশ সরকারের আন্তঃমন্ত্রণালয় স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে সদস্য দেশগুলোর মাইক্রোক্রেডিট এবং দারিদ্র্য বিমোচন সংক্রান্ত বিষয়গুলো অধ্যয়ন করার আমার সুযোগ হয়েছিল। তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইরান, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মিশরসহ প্রত্যেকটি দেশেই কর্জে হাসানা প্রথা ব্যাপকভাবে চালু রয়েছে। সুদের কারণে এসব দেশে মাইক্রো ক্রেডিট ব্যাপকতা পায়নি। শ্রীলংকায় শরণদ্বীপ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে মুসলমানরা আমানা নামে একটি ব্যাংক স্থাপন করেছে। ব্যাংকটি বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংকের RDS Program ও কর্জে হাসানার নীতিমালা অনুসরণ করে বিনিয়োগ ব্যবস্থা চালু করেছে।  চীনের মুসলমানরাও বহু বছর কর্জে হাসানা পরিচালনা করে আসছেন।  বেইজিং শহরে কূটনেতিক জোনের সাথেই নভোটেল থেকে পায়ে হেঁটে ম্যাক ডোনাল্ডের দিকে পাঁচ মিনিট গেলেই তাদের একটি বিরাট ইসলামিক কমপ্লেক্স পাওয়া যাবে।  সেখানে মসজিদ, মাদ্রাসা, শপিং সেন্টারের পাশাপাশি একটি ব্যাংকও আছে যেখানে সদস্যদের শুধু কর্জে হাসানা দেয়া হয়। ফিলিপাইনের ম্যানিলা, লসবেনস, মিন্দানাও এবং কালাম্বা শহরেও মুসলমানদের বেশ কিছু সমিতি আছে যেখানে সদস্যরা কর্জে হাসানার লেনদেন করেন।
ইসলাম সুদকে হারাম করেছে। সাথে সাথে তার বিকল্পও বাতলে দিয়েছে। আমাদের উচিত ঈমানকে রক্ষা করা এবং এই সুযোগ গ্রহণ করা।

Monday, July 8, 2019

নরেন্দ্র মোদিরা কি পারবেন কাশ্মীর হজম করতে?


আবদুল হাফিজ খসরু: দলের সভাপতি অমিত শাহকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমনি এমনি বানাননি নরেন্দ্র  মোদি। এরা দু’জনই দাঙ্গা কবলিত রাজ্য গুজরাটের বাসিন্দা। ২০০২ সালে আহমেদাবাদের মুসলিম বিরোধী দাঙ্গার অন্যতম প্রধান অভিযুক্তও এই দু’জন। এবারে বিজেপির নির্বাচনী এমন কিছু স্পর্শকাতর এজেন্ডা ছিল যা বাস্তবায়নে অমিত শাহর মত দলীয় প্রভাবশালী লোকটিকে লোকসভা ও মন্ত্রিসভায় দরকার ছিল  মোদির। যেমন মুসলিম নারীদের তিন তালাক আইন বিলুপ্তি, কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসন ধারা বিলোপ, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক পুঞ্জি (এনআরসি) তৈরি করে বাংলাদেশের উপর শরণার্থী চাপ সৃষ্টি, অযোধ্যায় বাবরী মসজিদের স্থলে রামমন্দির নির্মাণ, কংগ্রেসের মতো বৃহৎ দলকে নির্বাচনে কারচুপি করে হলেও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতার বাইরে রাখার মাস্টারপ্লান বাস্তবায়ন প্রভৃতি।
ইসরাইলের কাছে নরেন্দ্র  মোদি ও তার দল দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। সম্প্রতি ইসরাইলের নির্বাচনী প্রচারণার একটি ছবি দেখলাম। সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মেক্রনের মত বিশ্বনেতাদের পাসাপাশি নরেন্দ্র  মোদির ছবিও শোভা পাচ্ছে তেলআবিবের রাস্তা-ঘাটে। ইহুদীবাদী ইসরাইল ও ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতের এই সামরিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন দক্ষিণ এশিয় অঞ্চলে যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে কাশ্মীরের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী তারই চাক্ষুষ প্রমাণ।  মোদির এই দুঃসাহসের অন্যতম নিয়ামক হচ্ছে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের ইসরাইলি লবি।
গত ৫ আগস্ট লোকসভায় ‘জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্গঠন বিল ২০১৯’ পাসের মধ্য দিয়ে বিলুপ্ত হয়ে গেল ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫ (এ) ধারা। বিলুপ্তি ঘটলো কাশ্মীরের বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা। আরো বিলুপ্তি ঘটলো কাশ্মীরের ভারতীয় ইউনিয়নে যুক্ত থাকার শর্তও। এজন্যই নরেন্দ্র  মোদিরা সেখানে সেনাসংখ্যা রাতারাতি বৃদ্ধি করলেন। যাতে বিক্ষুব্ধ কাশ্মীরি জনগণ তাৎক্ষণিকভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু করতে না পারে।
স্বাধীন কাশ্মীর রাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদান করেছিল ১৯৪৯ সালের ২৭ মে কাশ্মীরি গণপরিষদে পাস হওয়া একটি বিলের মাধ্যমে। প্রস্তাব পেশ করার সময় বলা হয়েছিল যদিও ভারতভুক্তি সম্পন্ন হয়ে গেছে, তা সত্ত্বেও ভারতের তরফ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে যে পরিস্থিতি তৈরি হলে গণভোট নেওয়া হবে এবং গণভোটে ভারতভুক্তি যদি গৃহীত না হয়, তাহলে “আমরা কাশ্মীরকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করবো না।” এই বিলটি একই বছরের ১৭ অক্টোবর ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারায় সংযোজিত হয়। এই ধারা বলে জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারতীয় সংবিধানের আওতামুক্ত রাখা হয় এবং ওই রাজ্যকে নিজস্ব সংবিধানের খসড়া তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়। পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ছাড়া সর্বময় ক্ষমতা কাশ্মীরিদের দেয়া হয়। অলিখিত চুক্তি ছিল, যোগদানের সময়কালীন প্রতিশ্রুতি রক্ষিত না হলে, দু’ পক্ষই নিজেদের পূর্বতন অবস্থানে ফিরে যেতে পারবে।
কিন্তু কাশ্মীরে আর গণভোটও হয় না, সাত লক্ষ ভারতীয় সেনাও অপসারণ করা হয় না। সর্বশেষ দু’দিন আগে কাশ্মীর হারালো তার স্বায়ত্বশাসন। ভারত পূর্ণ করলো তার দখলের ষোলকলা। এই জনপদের কতিপয় নেতার টালবাহানার কারণে সোয়া কোটি কাশ্মীরী জনগণের জীবনে নেমে এলো সাময়িক অন্ধকার। নরেন্দ্র  মোদিদের প্লান হলো, কাশ্মীরে এখন জনমিতি যুদ্ধ পরিচালিত করবে। সারা ভারতের হিন্দুত্ববাদী লোকজন দিয়ে সেখানে বসতি স্থাপন করাবে এবং মুসলমানদের সেখানে সংখ্যালঘুতে পরিণত করবে। ইসরাইল প্রথমদিকে যেভাবে ফিলিস্তিনীদের ভূমি ক্রয় করে বহিরাগত ইহুদীদের পুনর্বাসন শুরু করেছিল। ঠিক সেভাবেই ভারতীয় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিয়ে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো কাশ্মীরের ভূমি ক্রয় করাবে এবং একপর্যায়ে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর বানাবে। ভারতীয় সংবিধানের ৩৫ (এ) ধারা বলে এতদিন কাশ্মীরে যা কেউ পারতো না।
নরেন্দ্র  মোদিকে এইভাবে দখলদারিত্ব বজায় রাখতে হলে জাতীয় অর্থনীতির বিশাল একটি অংশ এখন কাশ্মীরের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে। কাশ্মীর ফ্রন্টে অবস্থিত প্রায় দশ লক্ষ সেনা ও অস্ত্র-গোলাবারুদের বিশাল ব্যয়ভার বহন উদীয়মান অর্থনীতির এই দেশটির অগ্রগতি নিশ্চিত বাধাগ্রস্থ করবে। লক্ষাধিক কাশ্মীরি ইতিমধ্যে জীবন দিয়েছেন। অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করা তাদের নিকট এখন স্বাভাবিক বিষয়। যে জাতি তাদের শহীদদের জন্য কবর প্রস্তুত রাখে, যে প্রজন্ম আযাদীর স্লোগান দিতে দিতে বড় হয় তাদেরকে দমানো যায় না। কাশ্মীরে স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলোর সাথে এখন যোগ দিবে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোও। যারা এতদিন রাজনৈতিকভাবে সমাধান চাইতো তারাও সশস্ত্র হতে বাধ্য হবে। অনেক বেশী বিক্ষিপ্ত, চোরাগুপ্তা ও গেরিলা আক্রমণের শিকার হতে হবে ভারতীয় বাহিনীকে। শুধু কাশ্মীরে নয় সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়তে পারে এই ধরণের চোরাগুপ্তা হামলা। বিমান ছিনতাই, রাজনৈতিক নেতাদের গুমের মত ঘটনাও ঘটতে পারে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ৭টি রাজ্যের ৫টিই এখন খৃস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ। এগুলোও কাশ্মীরের মত এতদিন বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা ভোগ করে আসছে। কাশ্মীরের এই ঘটনার পর রাজ্যগুলোর অস্বস্তি আরো বাড়বে। তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গ্রুপগুলো আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এমনিতেই পশ্চিমাদের দীর্ঘদিনের শ্যোন দৃষ্টি রাজ্যগুলোর উপর। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সেভেন সিস্টার্স খ্যাত ভারতের রাজ্যগুলোকে নিয়ে পৃথক স্বাধীন খৃস্টান রাষ্ট্র গড়ার মেকানিজম এগিয়ে রেখেছে তারা। এছাড়াও নরেন্দ্র  মোদিকে আরো সামাল দিতে হবে অন্যান্য রাজ্যের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র মাওবাদী, দলিত ও শিখ সংগঠনগুলোকে।
নরেন্দ্র  মোদি জাতিসংঘে কাশ্মীর ইস্যুতে কথাবার্তা হয়তো আটকাতে পারবেন। ওআইসির কাগুজে বাঘের হুংকারকে হয়তোবা সামাল দিতে পারবেন। কিন্তু চিরশত্রু চীন ও পাকিস্তানকে কিভাবে নিবৃত্ত করবেন? যেখানে চীনের শ্যোন দৃষ্টি পড়ে রয়েছে অরুণাচল প্রদেশ ও আকসাই চীনের উপর। ইতিমধ্যে দু-দু’টি যুদ্ধে তারা জড়িয়েছে! মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়াসহ অনেকগুলো মুসলিম দেশে রয়েছে ভারতের প্রায় এক কোটি শ্রমিক। যাদের রেমিটেন্সে ভারতের অর্থনীতির চাকা ঘুরে। নরেন্দ্র  মোদি কি মনে করছেন, এসব মুসলিম দেশের সুবিধাবাদ সরকারগুলো সবসময়েই তার পাশে থাকবে? নরেন্দ্র  মোদিরা কী পারবেন ভারতীয় আধিপত্যবাদী আচরণের কারণে সৃষ্ট তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সাধারণ জনগণের তীব্র ঘৃণা নিয়ে বেঁচে থাকতে?
যদি মনে করা হয় যে, ইসরাইল ফিলিস্তিনে নিপীড়ন চালিয়ে দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে-সদম্ভে টিকে আছে তো তারাও কাশ্মীরে তা পারবেন, তাহলে নিশ্চিত ভুল করবেন। ইসরাইল একই সাথে অনেকগুলো ফ্রন্টে যুদ্ধ পরিচালনা করতে সক্ষম। তাদের সেই সক্ষমতা আছে। তারা অস্ত্র বানায় ও রপ্তানি করে। স্বয়ং ভারতের সাথে ঘনিষ্টতার মূলে রয়ে ইসরাইলী অস্ত্র বিক্রির ব্যবসায়। ভারতকে অস্থীতিশীল করে রাখতে পারলে মার্কিন-ইসরাইলের অস্ত্র ব্যবসায় চাঙ্গা থাকবে। মার্কিন রাজনীতির শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক হচ্ছে ইসরাইলী লবিস্টগ্রুপ। মার্কিন বিশাল নৌবহর তাদের রক্ষায় সর্বদা প্রস্তুুত থাকে। আশে পাশের মুসলিম দেশগুলোর দালাল শাসকদের সে হাত করে নিতে পেরেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলে কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের অস্তিত্ব নেই, যা সামাল দিয়ে তাকে বহি:শত্রু মোকাবেলা করতে হবে। এরপরও হামাস ও হিজবুল্লাহর মত ছোট ছোট কিছু গেরিলা বাহিনীর কাছে নিয়মিতই নাকানি চুবানি খেতে হয় ইসরাইলকে।
ইসরাইলের সক্ষমতার ধারে কাছেও নেই নরেন্দ্র  মোদির ভারতের। নিম্নমানের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের বিশাল সংখ্যক সেনা দিয়ে ইসরাইলী স্টাইলে কাশ্মীর দখলে রাখার দু:স্বপ্ন দেখছেন  মোদি! দীর্ঘদিন কাশ্মীরকে দখলে রাখা ভারতের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। যেমন অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন মার্কিনীদের আফগানিস্তানে টিকে থাকা।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী

চীন ও ভারতের সম্পর্ক এবং পাকিস্তান



আশিকুল হামিদ : আজকের নিবন্ধে এশিয়ার দুই পরাশক্তি চীন ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার ইচ্ছা রয়েছে। কারণ, শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্কের জন্য পরিচিত দেশ দু’টির সামনে নতুন এক প্রতিবন্ধক তৈরি হয়েছে। সে প্রতিবন্ধক এরই মধ্যে প্রাধান্যেও এসে গেছে। কিন্তু এ বিষয়ে বলার আগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্পর্কে বলা দরকার। এর প্রথম কারণ, এই সময়ে ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের প্রতিযোগিতা চলছে আর সাবেক ক্রিকেটার হিসাবে ইমরান খানের আন্তর্জাতিক পরিচিতি ও সুখ্যাতি রয়েছে। বহু রসাত্মক গালগল্পের নায়কও তিনি। বড়কথা, ‘শত্রু রাষ্ট্র’ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেও ভারতে এখনো তার জনপ্রিয়তা কম নয়। অনেক ভারতীয়র সঙ্গেই ইমরান খানের ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চাইলেই তিনি অন্য পাকিস্তানী সরকার প্রধানদের মতো অন্ধ ভারতবিদ্বেষী হতে পারবেন না।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ভারতের লোকসভা নির্বাচন এবং প্রধানমন্ত্রীর পদে নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয়বার অধিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহের পর্যালোচনায়ও দেখা গেছে, ইমরান খান আসলেও ভারতবিদ্বেষী হতে চাননি। তিনি বরং প্রথম বিদেশী সরকার প্রধান হিসেবে নরেন্দ্র মোদিকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এরই সূত্র ধরে ধারণা করা হয়েছিল, নরেন্দ্র মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ইমরান খানকে সাদরে আমন্ত্রণ জানানো হবে। কিন্তু সেটা হয়নি। আশপাশের সব দেশের, এমনকি মরিশাস ও কিরগিস্তানের সরকার প্রধানদের পর্যন্ত আমন্ত্রণ জানানো হলেও বিস্ময়করভাবে বাদ পড়েছেন ইমরান খান। এর কারণ হিসেবে পুলওয়ামার সন্ত্রাসী হামলাকেন্দ্রিক যুদ্ধমুখী উত্তেজনার পাশাপশি পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনের আগে ইমরান খানের বিভিন্ন বক্তব্যের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। কারণ, নির্বাচনী  প্রচারণা চালানোর সময় দেয়া প্রায় প্রতিটি বক্তৃতায় তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ‘মোদি’ নয়, ‘নরেন্দ্র মোডি’ বলেছেন এবং তুমি তথা ‘তুম’ ও ‘তুমহারা’ বলে এমনভাবে তুলোধুনো করেছেন, যা শুনে মনে হয়নি যে, ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হলে দু’দেশের শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্কে আদৌ কোনো শুভ পরিবর্তন ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। নির্বাচনের পরে ইমরান খান অবশ্য কিছুটা হলেও কথা ও সুর পাল্টেছিলেন। তিনি ভারতের সঙ্গে আলোচনা ও বন্ধুত্বের কথাও বলেছেন।
ইমরান খান কিন্তু তাই বলে কাশ্মীর প্রশ্নে ইঞ্চি পরিমাণও সরে আসেননি। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের গভীর সম্পর্কের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার সময়ও প্রকারান্তরে ভারতকে তিনি হুমকিই দিয়েছেন। চীন যে পাকিস্তানের পাশে রয়েছে এবং যে কোনো যুদ্ধ বা সংকটে পাকিস্তানের পাশেই থাকবে- সে কথাটা যথেষ্ট জোর দিয়েই ভারতকে শুনিয়েছেন তিনি। এসব কারণের পাশাপাশি অতি সম্প্রতি আবারও যুক্ত হয়েছে কাশ্মীর সমস্যার প্রশ্ন। ক’দিন আগে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ওআইসি’র শীর্ষ সম্মেলনে দেয়া বক্তৃতায় ইমরান খান কাশ্মীরকে ভারতের দখলমুক্ত করার ব্যাপারে মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন চেয়েছেন। এর ফলেও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই পিছিয়ে গেছে।
অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এই দূরত্ব এমন সময়ে সৃষ্টি হয়েছে- যখন দুই বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র গণচীন ও ভারতের মধ্যে তিক্ততার নতুন এক প্রতিবন্ধক নিয়ে শান্তিকামী বিশ্বে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রায় তিনশ’ কোটি জনসংখ্যার কারণে শুধু নয়, উভয় দেশের হাতেই পারমাণবিক সমরাস্ত্র রয়েছে বলেও দেশ দু’টির সম্পর্কে অবনতি ঘটলে আশংকার সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক। নতুন প্রতিবন্ধক তথা তিক্ততার সর্বশেষ কারণ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে, চীন বিশাল এক বাঁধ নির্মাণ করে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পাল্টে দিয়েছে। চীন সেই সাথে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এবং যথেষ্ট প্রশস্ত টানেল বা খালও খনন করে চলেছে। এই টানেলের মধ্য দিয়ে চীন ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে যাবে তার জিন জিয়াং প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায়। এর ফলে ব্রহ্মপুত্রের পানি ভারত আর আগের মতো পাবে না। পানির প্রায় সবটুকুই বরং চলে যাবে চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে। বাঁধটি সম্পূর্ণরূপে চালু হলে আসামসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর কৃষি ও চাষাবাদ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, এসব রাজ্য সেচের জন্য প্রধানত ব্রহ্মপুত্রের পানির ওপর নির্ভরশীল।
ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের বিবৃতিতে বলেছে, চীনের তৈরি বাঁধের কারণে বিশেষ করে কৃষিনির্ভর আসাম সর্বনাশের মুখে পড়বে। পানির সংকটে পুরো রাজ্যই স্বল্প সময়ের মধ্যে শুকিয়ে যাবে। আসামের পাশাপাশি ভারতের ভবিষ্যতও অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাবে বলেও সাবধান করে দিয়েছে দলগুলো। তারা সেই সাথে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ‘শত্রু প্রতিবেশি’ চীনের সঙ্গে দ্রুত বৈঠক করে সমাধান বের করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে দাবি জানিয়েছে। বিরোধী দলগুলোর দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন এমনকি বিজেপির অনেক নেতাও। এটাই স্বাভাবিক। কেননা, ব্রহ্মপুত্রের উৎস তিব্বতে এবং চীনে এর নাম সাংপো। ভারত রয়েছে চীনের নিচের দিকে, যেমনটি বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের ‘ভাটিতে’। প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী সাংপো বা ব্রহ্মপুত্রের পানি ভাটির তথা নিচের দিকে প্রবাহিত হয়। এর ফলেই ভারত এতদিন নদটির পানি পেয়ে এসেছেÑ যেভাবে বাংলাদেশ এক সময় পেতো ভারত থেকে নেমে আসা গঙ্গা এবং অন্য ৫৪টি অভিন্ন নদ-নদীর পানি। সব নদ-নদীর পানিই ভারতের পর বাংলাদেশ হয়ে গিয়ে পড়তো বঙ্গোপসাগরে।
অবস্থায় পরিবর্তন ঘটেছে ফারাক্কা, গজলডোবা ও টিপাইমুখসহ ভারতের নির্মিত অসংখ্য ছোট-বড় বাঁধের কারণে। পানির তীব্র অভাবে ‘নদীমাতৃক’ বাংলাদেশে এখন মরুকরণ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বাঁধের ভয়ংকর কুফল সম্পর্কে নিজেরা জানেন বলেই চীনের বাঁধ ও এক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন ভারতের সকল দলের নেতারা। খবরে জানা গেছে, ‘চীনপন্থি’ হিসেবে পরিচিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিÑ সিপিআইএমও প্রধানমন্ত্রীর কাছে চীনের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করার দাবি জানিয়েছেন। এটাই অবশ্য যে কোনো দেশের দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলের কর্তব্য- যার ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশে দেখা যায়।
ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে চীন ও ভারতের তিক্ততা কোনদিকে কতটা গড়ায় তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হলেও জানিয়ে রাখা দরকার, দেশ দুটির সম্পর্ক কিন্তু ইতিহাসের কোনো পর্যায়েই ঘনিষ্ঠ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না। চীন ও ভারত ১৯৬২ সালে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। পরবর্তীকালে কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কৌশল নিয়েও কমিউনিস্ট রাষ্ট্র চীনের সঙ্গে তিক্ততার অবসান ঘটাতে পারেননি। কাশ্মীর প্রশ্নে চীন পাকিস্তানের পক্ষে ভ’মিকা পাল করে চলেছে। চীন এখনো ভারতের রাজ্য অরুণাচলকে নিজের ভ’খন্ড বলে মনে করে। এর বাইরেও দীর্ঘ সীমান্তের অসংখ্য এলাকায় দেশ দুটির সেনারা মাঝে-মধ্যেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে। গত বছর ২০১৮ সালের প্রথম দিকেও ডোকলাম সীমান্তে ছোটখাটো যুদ্ধ করেছে চীন ও ভারত। ওই এলাকায় এখনো পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়নি।
এভাবেই এগিয়ে চলেছে চীন ও ভারতের অবন্ধুসুলভ তথা শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক। এরই মধ্যে ২০১৭ সালের আগস্টে দু’ দেশের বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এই ‘যুদ্ধ’ ব্যবসা-বাণিজ্যের সীমা ছাড়িয়ে দু’ দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপরও অশুভ প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন পর্যবেক্ষকরা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে, ভুটান সংলগ্ন ভূখন্ড ডোকলামের মালিকানা নিয়ে তীব্র উত্তেজনাকর ও সংঘাতময় পরিস্থিতির মধ্যে ভারত ওই সময় হঠাৎ ৯৩টি চীনা পণ্যের ওপর শাস্তিমূলক শুল্ক তথা অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি আরোপ করেছিল। এর ফলে ভারতে চীনের রফতানিই কেবল অনেক কমে যায়নি, বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি চীনের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকাও সৃষ্টি হয়েছিল।
নিজেদের সিদ্ধান্তের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভারত সরকার অভিযোগ করেছিল, দেশটির বাজারে বিক্রি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে চীন নাকি তার উৎপাদন খরচের চাইতেও কম মূল্যে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে। এর ফলে একদিকে ভারতে চীনা পণ্যের বিক্রি বাড়ছে অন্যদিকে ক্রমাগত কমছে ভারতীয় পণ্যের বিক্রি। এভাবে ভারতের দেশীয় পণ্য মার খাচ্ছে এবং ক্ষতি স্বীকার করতে গিয়ে অনেক শিল্প-কারখানা এমনকি বন্ধও হয়ে যাচ্ছে। এসবের মধ্যে মোবাইল ফোনের মতো বেশি প্রচলিত পণ্যের পাশাপাশি ইস্পাতের তৈরি ভারি অনেক পণ্যও রয়েছে। মূলত দেশীয় পণ্যকে নিরাপত্তা দেয়ার অজুহাত দেখিয়ে অতীতেও ভারত চীনা পণ্যের ওপর শাস্তিমূলক অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি আরোপ করে দেখেছে। কিন্তু পরিস্থিতিতে উন্নতি হয়নি। সে কারণেই ৯৩টি পণ্যের ওপর নতুন করে এই শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভারত সরকার।
অন্যদিকে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে ভারতকে ‘ভয়াবহ কুফল’ ভোগ করতে হবে বলে সতর্ক করেছিল চীন। দেশটির কমিউনিস্ট সরকারের মুখপাত্র গ্লোবাল টাইমসের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ভারতের এ ধরনের ‘দুর্বল সিদ্ধান্তের জন্য’ চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থ সাময়িকভাবে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে সত্য, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে ভয়াবহ কুফল ভোগ করার জন্য ভারতকেও প্রস্তুত থাকতে হবে। চীনা পণ্যের ব্যাপারে ভারতের নেতিবাচক ও শত্রুতাপূর্ণ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির কমিউনিস্ট সরকার চীনা কোম্পানিগুলোকে ভারতে বিনিয়োগ করার এবং বিনিয়োগ বাড়ানোর আগে ‘দ্বিতীয়বার’ ভেবে দেখার এবং সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার আহবান জানিয়েছিল। এর ফলে ধারণা করা হয়েছিল, এককেন্দ্রিক কঠোর কমিউনিস্ট সরকারের অধীনস্ত বলে চীনের কোনো কোম্পানির পক্ষেই সরকারকে পাশ কাটিয়ে ভারতে বিনিয়োগ বাড়ানো কিংবা উৎপাদনসহ ব্যবসা-বাণিজ্য অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না। তেমন অবস্থায় বন্ধ হয়ে যাবে ভারতে উৎপাদনকাজে নিয়োজিত অসংখ্য চীনা শিল্প-কারখানা এবং চাকরি হারাবে হাজার হাজার ভারতীয় শ্রমিক। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে ভারতের সমাজ ও অর্থনীতির ওপর। শুল্কবিরোধী প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে এ বিষয়টিকেই চীন সামনে নিয়ে এসেছিল।
দেশ দু’টির অর্থনৈতিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তথ্যাভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ডোকলামকেন্দ্রিক সংকটে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভারত। কারণ, চীনে ভারতের রফতানি কমেছিল ১২ দশমিক তিন শতাংশ তথা এক হাজার ১৭৫ কোটি মার্কিন ডলার। কৌতূহলোদ্দীপক একটি তথ্য হলো, রফতানি কমলেও একই সময়ে চীন থেকে ভারতের আমদানি বেড়েছিল প্রায় দুই শতাংশÑ মার্কিন মুদ্রায় যার পরিমাণ পাঁচ হাজার নয়শ’ কোটি ডলার। অর্থাৎ একদিকে ভারতের আয় কমেছে এক হাজার ১৭৫ কোটি মার্কিন ডলার, অন্যদিকে কমার পরিবর্তে উল্টো চীনের আয় বেড়েছে পাঁচ হাজার নয়শ’ কোটি ডলার!
জানা গেছে, এমনিতেই ভারতের তুলনায় চীন চার হাজার সাতশ’ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রফতানি করে থাকে। এমন অবস্থায় ভারত শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপ করলে এবং সিদ্ধান্তটি বজায় রাখলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে কমিউনিস্ট দেশটিকে। জবাবে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে চীন যদি ভারতে চীনা কোম্পানিগুলোর শিল্প-কারখানা বন্ধ করে দেয় এবং চীনের শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীরা যদি ভারতে আর বিনিয়োগ না করেন তাহলে ভারতীয় শ্রমিকরা তো চাকরি হারাবেই, অন্য অনেকভাবেও ভারতকে যথেষ্ট পরিমাণে খেসারত দিতে হবে।
এজন্যই ডোকলামের দখল ও মালিকানাকেন্দ্রিক সংকটের ঘটনাপ্রবাহে ভারতের প্রতি সংযম দেখানোর আহবান এসেছিল বিভিন্ন দেশ ও গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে। ভারতে আশ্রিত চীনের ধর্মীয় নেতা দালাইলামা একথা পর্যন্ত বলেছিলেন যে, যুদ্ধ-সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার পরিবর্তে চীনা বৌদ্ধদের আরো বেশি সংখ্যায় তীর্থে আসার সুযোগ দেয়ার মাধ্যমে ভারতের উচিত চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা, শান্তি বজায় রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানো। যুদ্ধ শুরু হলে চীন ও ভারতের কেউই জিততে পারবে না বলেও মন্তব্য করেছিলেন দালাইলামা।
বলার অপেক্ষা রাখে না, দুই বিরাট প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীন ও ভারতের বাণিজ্য যুদ্ধ এবং ডোকলামের দখল ও মালিকানা নিয়ে সৃষ্ট সংকট সকল বিচারেই অত্যন্ত আশংকাজনক। প্রায় তিনশ’ কোটি জনসংখ্যার কারণে শুধু নয়, উভয় দেশের হাতেই পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে বলেও বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ দেশ দুটির মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কামনা করে। প্রতিবেশি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশও চায় চীন ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যাতে সংঘাতমুখী না হয়। এশিয়ার এ অঞ্চলের জন্য তো বটেই, বিশ্বশান্তির জন্যও চীন ও ভারতের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া ও বন্ধুত্বপূর্ণ থাকা দরকার।
এ প্রসঙ্গেই ব্রহ্মপুত্রের ওপর চীনের নির্মিত বিশাল বাঁধ এবং জিন জিয়াং প্রদেশ পর্যন্ত প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলকেন্দ্রিক সমস্যাকে সামনে আনা দরকার। বিষয়টি নিয়ে চীনের সঙ্গে বৈঠকে বসারও আগে ভারতের উচিত বাংলাদেশকে গঙ্গা ও তিস্তাসহ অভিন্ন ৫৪টি নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা দেয়া। তেমন অবস্থায়ই ভারত চীনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়ার আশা করতে পারে। এখন দেখা দরকার, ভারত ঠিক কোন পথে পা বাড়ায় এবং চীন ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কে ব্রহ্মপুত্রের বাঁধ সত্যিই স্থায়ী প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে কি না! বলা দরকার, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান চীন ও ভারতের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে পারতেন। তেমন সদিচ্ছার প্রকাশও তিনি বিভিন্ন উপলক্ষে ঘটিয়েছেন। কিন্তু ভারতের বিজেপি সরকার প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে অসম্মানিত করেছে। একই কারণে চীনের সঙ্গে সম্ভাব্য বিরোধ ও সংঘাতে ভারত অন্তত পাকিস্তানের সহযোগিতা পাবে না বলেই মনে করেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা।

প্রেসিডেন্ট ড. মুরসির হত্যাকাণ্ড ও একটি বিভ্রান্তি



ড. মো. নূরুল আমিন : ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ব্রতি বর্তমান বিশ্বের প্রাচীনতম ইসলামী আন্দোলন ও দল মিসরের ইখওয়ানুল মুসলেমিনের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও দলটির রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম ও জাস্টিস পার্টির চেয়ারম্যান, মিসরের ইতিহাসে প্রথমবারের ন্যায় অবাধ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসি কারাগারে অন্তরীণ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন)। মৃত্যুকালে তিনি তার জন্য গঠিত বিশেষ আদালতে কাচের খাঁচায় দাঁড়িয়ে মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগের জবাব দিচ্ছিলেন। এ অবস্থায় হঠাৎ তিনি অজ্ঞান হয়ে খাঁচার মধ্যে পড়ে যান। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী ২০ মিনিট পর্যন্ত তার সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসেননি। আদালত তার প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য কোনও ডাক্তারও ডাকেনি। পরে তাকে হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় তার এই মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না, তার এই মৃত্যুকে রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞ বলে অভিজ্ঞমহল মনে করেন। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিত প্রাণ এই মহান নেতার অকাল মৃত্যু প্রকৃতপক্ষে শাহাদাতের মৃত্যু। জেলখানায় সরকারি নির্যাতন উপেক্ষা ও অবহেলায় ছয় বছরে তিনি এতই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন যে, জালেমের কারাগারে জালেম নির্মিত কাচের খাঁচায় দাঁড়িয়ে কথা বলার ক্ষমতাও তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছেন। এটা ছিল একটা রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড, ঠাণ্ডা মাথায় খুন। এই খুনের সাথে মিশরের সামরিক শাসক জেনারেল সিসিও তার সহযোগী কর্মকর্তাবৃন্দ, মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতালিপ্সু শাসকরা এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ইসলামী বিদ্বেষী ইহুদিবান্ধব শক্তি ও রাষ্ট্রসমূহ যৌথভাবে জড়িত ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রগুলোর বেশির ভাগ মিশরের গণতান্ত্রিক ও ইসলামী পুনরুত্থানে শংকিত ছিল। তারা মুরসি হত্যাকাণ্ড ও ইখওয়ান ধ্বংসে সিসিকে সহায়তা করেছে বলে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মত প্রকাশ করেছেন। ড. মুরসি বহু প্রতিভার অধিকারী একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ ছিলেন। মিশরের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হওয়া ছাড়াও তিনি ছিলেন একাধারে একজন প্রথিতযশা প্রকৌশলী, ডক্টরেট ডিগ্রীধারী উঁচুমানের শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, কুরআনে হাফেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিভাগীয় প্রধান, ইখওয়ানুল মুসলেমিনের অন্যতম শীর্ষ নেতা এবং ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টির চেয়ারম্যান। রাজনীতির কথা বাদ দিলেও তিনি একজন উচ্চ শিক্ষিত প্রথম শ্রেণীর নাগরিক, ইসলামী ও পাশ্চাত্য উভয় শিক্ষায় শিক্ষিত মননশীল একজন ব্যক্তি। কারাগারে তার প্রতি আচরণ ছিল নিকৃষ্ট ও অমানবিক। তাকে শারীরিক ও মানসিক উভয়ভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। কুরআন ছিল তার প্রাণ। কুরআনী বিধান বাস্তবায়ন ছিল তার জীবনের লক্ষ্যমাত্রা। কারাগারে তিনি জালেমদের কাছে এক জিলদ কুরআন চেয়েছিলেন কিন্তু পাননি। তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “আমি তাদের কাছে কারাগারে একটা কুরআন চেয়েছিলাম, তারা দেয়নি। কিন্তু ওরা জানেনা ৪০ বছর আগে আমি কুরআন মুখস্ত করেছি। কুরআনকে ছু’তে চেয়েছিলাম,” একজন মুমিনের জীবনে এই ঘটনা অত্যন্ত মর্মান্তিক।

ড. মুরসি ডায়াবেটিস এবং লিভার ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন। এই উভয় রোগের চিকিৎসা, পরিচর্যা এবং সময়ে সময়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা অপরিহার্য। প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা পাওয়া তার মৌলিক অধিকারের অপরিহার্য অংশ ছিল। জেলখানায় তাকে চিকিৎসা সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তার রক্তের সুগার লেবেল কমে যাওয়ায় তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসার সুযোগ দেয়া হলে তিনি হয়তো এভাবে মারা যেতেন না। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনগণের নেতা হিসেবে মিশরের অবৈধ সরকার ড. মুরসির প্রতি ন্যূনতম সম্মান দেখানো তো দূরের কথা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতিও সামান্যতম সম্মান প্রদর্শন করেননি। অবশ্য মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ লংঘন এবং গণহত্যায় পটু জেনারেল সিসির সরকারের কাছে এই দয়া, মানবিকতা ও নৈতিক মূল্যবোধ আশা করাও বৃথা। মিশরের ইতিহাসের সবচেয়ে অবাধ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটাধিক্যে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর যেতে না যেতেই দেশটির সামরিক প্রধান জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি ২০১৩ সালে রক্তাক্ত মিলিটারী ক্যুর মাধ্যমে ড. মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশটির কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। এই ক্যুতে তার গৃহীত পদক্ষেপ সমূহ নীতি-নৈতিকতা, মানবতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী বলে প্রমাণিত হয় এবং তিনি গণহত্যার জন্য এক নির্মম কসাইয়ের খেতাব পান। তার নির্দেশে মিশরীয় সৈন্যরা ২০১৩ সালের ১৪ই আগস্ট কায়রোর রাবা আল আদাবিয়া স্কয়ারে একই দিন ১৫০০ লোককে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ড থেকে যারা বেঁচেছিলেন তাদের গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় এবং সেখানে তাদের সীমাহীন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার বানানো হয়। এখানেই শেষ নয়, ইখওয়ানুল মুসলেমিনকে বেআইনি ঘোষণা করে তাদের লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে জেলে নিক্ষেপ করা হয়। গ্রেফতাকৃতদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে তার সৃষ্ট ক্যাঙ্গারু আদালতে বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে তাদের জেল জরিমানা এবং ফাঁসির শাস্তি দেয়া হয়।
পাশ্চাত্যের সরকারগুলো এবং গণতন্ত্রের প্রবক্তারা নব্য এই ফেরাউনের এই নির্মম অমানবিকতার কোনও প্রতিবাদ করেনি বরং ইসরাইলের ইন্ধনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলো ইসলাম নির্মূলের হাতিয়ার হিসাবে সিসিকে ব্যবহার করেছে। প্রতিবেশী মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ আরব রাজতান্ত্রিক দেশগুলো নিজেদের গদীকে হুমকিমুক্ত করার জন্য মিশরের গণতান্ত্রিক উত্থানকে প্রতিহত করার জন্য সিসিকে সহযোগিতা করেছে। এমনও শোনা গেছে যে, পার্শ্ববর্তী একটি মুসলিম দেশের একজন বাদশাহ স্বয়ং কায়রো বিমানবন্দরে ব্যক্তিগত বিমানে কোটি কোটি ডলারের তহবিল নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। তিনি বিমান থেকে নামেননি, আল সিসি বিমানে উঠে তাকে সালাম জানিয়ে এই তোহফা গ্রহণ করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ পাশ্চাত্য দেশগুলোর ইসলাম বিদ্বেষী শাসক ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ইসরাইলকে নিয়ে মিশরের এই অবৈধ স্বৈরশাসককে শুধু উৎসাহিত করেনি বরং মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক দেশগুলোকেও নানাভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। তারা ড. মুরসি ও তার দলের উপর নির্যাতন প্রত্যক্ষ করে সিসিকে বাহবা দিচ্ছিলেন। ড. মুরসি কারাগারে কিভাবে আছেন তা দেখা ও জানার কারুরই সুযোগ ছিল না। তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দল কাউকেই তার সাথে দেখা করতে দেয়া হচ্ছিল না। এই অবস্থায় ২০১৮ সালে ড. মুরসির পরিবারের অনুরোধে বৃটিশ হাউজ অব কমন্স এর ফরেন এফেয়ার্স সংক্রান্ত সিলেক্ট কমিটির একজন সাবেক সভাপতি ও এমপি জনাব ত্রিসপিন ব্লান্ট মিশর সফর এবং জেলখানায় ড. মুরসির অবস্থা প্রত্যক্ষ করতে রাজি হন। জনাব ব্লান্ট মিশর সরকারের অনুমতি নিয়ে এই সফর করেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট মুরসির অবস্থা অবহিত হয়ে একটি রিপোর্ট প্রদান করেন। রিপোর্ট অনুযায়ী সিসি প্রশাসন ড. মুরসির প্রতি এতই নিষ্ঠুর ও অমানবিক ছিলেন যে, প্রায় ছয় বছরে মাত্র তিনবার তারা ড. মুরসির পরিবারকে তার সাথে সাক্ষাতের অনুমতি দিয়েছিল।
ব্লান্ট রিপোর্টে কয়েকটি মর্মান্তিক বিষয় উঠে আসে। ড. মুরসি ডায়াবেটিস ও লিভার রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তাকে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অথচ মিশরীয় ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তিনি এই সেবা পাওয়ার যোগ্য। সেখানে তার চলাফেরা বা হাঁটা, ব্যায়ামেরও কোন ব্যবস্থা ছিল না। জেলকোড অনুযায়ী তিনি ভিআইপি মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। তাকে সাধারণ কয়েদি হিসাবে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে রাখা হয়েছে। রাত দিন ২৪ ঘণ্টার ২৩ ঘণ্টাই তিনি অন্ধকারে থাকতেন, মাত্র এক ঘণ্টা আলোর মুখ দেখতেন। তাকে প্রদত্ত খাবারের মান ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। তিনি খেতে পারতেন না। তিনি নিয়মিত অজু, গোসলের পানি পেতেন না। চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা ও ওষুধ পথ্যের অভাবে তার স্বাস্থ্য দিন দিন খারাপ হচ্ছিল এবং তিনি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছিলেন। জনাব ব্লান্ট আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, যদি এ অবস্থা অব্যাহত থাকে তাহলে ড. মুরসি শীঘ্রই মৃত্যুবরণ করবেন। প্রকৃতপক্ষে হয়েছেও তাই। এটা মৃত্যু নয়, ঠাণ্ডা মাথায় খুন, নরহত্যা। বৃটিশ সরকারের কাছে পেশ করা এই রিপোর্টের উপর তারা কোনও ব্যবস্থা নেননি, কেন নেননি তা সবাই জানেন। তার মৃত্যু শহীদি মৃত্যু, আল্লাহ তার শাহাদাত কবুল করুন, তাকে জান্নাতুল ফেরদাউসে স্থান দিন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারকে ধৈর্য ধরার তৌফিক দিন। আমরা তার মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্ত কামনা করি।
ড. মুরসির শাহাদাতের মাধ্যমে ইসলামিক বিশ্ব একজন মহান নেতাকে হারালো। তার জীবন ও সংগ্রাম এবং ইসলামের জন্য ত্যাগ যুগ যুগ ধরে ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
ফ্যাসিষ্ট ও মিলিটারী ডিক্টেটার আল সিসির অস্ত্রের মুখে ক্ষমতা দখল ও ড. মুরসির ইসলামী সরকারের পতনকে কেউ কেউ গণতন্ত্রের পতন বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং দাবি করছেন যে, গণতান্ত্রিক পন্থায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এই মন্তব্য ও বিশ্বাসটি সঠিক নয়। এখানে গণতন্ত্র সফল হয়েছে। জনগণ নানা প্ররোচনার মুখেও বিপুল ভোটে ড. মুরসিকে জয়ী করে ক্ষমতায় পৌঁছিয়ে দিয়েছে। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ক্ষমতালিপ্সা, ফ্যাসিবাদ, ইহুদী, খৃস্টান শক্তির ইসলাম বৈরিতা এবং প্রতিবেশী অগণতান্ত্রিক শক্তির মিথস্ক্রিয়ায় ড. মুরসিকে সরে যেতে হয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবেই ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রবণতার মোকাবিলা করতে হবে। দাওয়াত ও তরবিয়ত ব্যক্তি ও দলীয় চরিত্রকে পবিত্র ও সংহত করার জন্য তো থাকবেই। এখানে বিভ্রান্তির অথবা হতাশার কিছু নেই বলেই আমার বিশ্বাস।

গণমানুষের মহান নেতা শহিদ মুরসি বিশ্ববাসীর প্রেরণা-১



ইঞ্জিনিয়ার ফিরোজ আহমাদ : গণমানুষের গণজোয়ার দেশ-বিদেশে অনেক দেখেছি । কিন্তু মিশরের শহিদ মুরসির মত এমন গণজোয়ার মনে হয় আর কোথাও দেখিনি । সেটা ছিল দীর্ঘ ৩০ বছরের কুখ্যাত স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আয়োজিত মিশরের গণমানুষের অগ্রণী মুসলিম ব্রাদারহুডের বিপ্লবী নেতাদের অন্যতম ড. মোহাম্মদ মুরসির সফল সংগ্রামী মিছিলের গণজোয়ার । বিশ্ব কাঁপানো সেই মিছিল ছিল মিশরের চরম বিরক্তিকর স্বৈরশাসক হোসনী মোবারকের বিরুদ্ধে সাধারণ গণমানুষের ন্যায্য অধিকারের মিছিল । সেই মিছিল ছিল শোষণ, নিপীড়ন, জুলুম, অত্যাচার আর বাকস্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে । সেই মিছিল ছিল ঐতিহ্যবাহী মিশরের মুসলমানদের প্রাণের আদর্শ ইসলামী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মিছিল । সেই মিছিল ছিল আল্লাহর দুনিয়াতে আল্লাহর আইন কায়েমের বলিষ্ঠ স্লোগান ‘নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবারের’ মিছিল । তাই সেদিন ২০১২ সালে মিশরের লক্ষ-কোটি গণমানুষের প্রাণের নেতা ড. মোহাম্মদ মুরসি বিজয়ী হয়েছিলেন । কুখ্যাত স্বৈরশাসক হোসনী মুবারকের পতন হয়েছিল । মিশরের গণমানুষের সেদিনের মুক্তি ছিল স্বাধীনতাকামী বিশ্ববাসীর স্বতঃস্ফুর্ত অভিনন্দন । স্বৈরতন্ত্রের পতন আর গণতন্ত্রের বিজয় ছিল শান্তিকামী বিশ্ববাসীর অনিবার্য দাবী । তাই ড. মোহাম্মদ মুরসি সেদিনই বিশ্বজাহানের হৃদয়ের সেরা নেতা হয়ে গেলেন । সারা বিশ্বে ড. মোহাম্মদ মুরসির অগ্রযাত্রা কামনা করছিল ।

উল্লেখ্য যে,বিশ্বব্যাপী মহা আতংক এই মিশরের মানবতাবিরোধী কুখ্যাত স্বৈরশাসন । যুগ যুগ ধরে যারাই অত্যাচারী এই জালিমশাহীর বিরোধিতা করতে গিয়েছে তাদেরকেই স্বৈরাচারীর যাতাকলে নিস্পিষ্ট হতে হয়েছে । বিভিন্নভাবে বিরোধী দলের নেতা কর্মীদের অত্যাচার করা হয়েছে । অগণিত ইখওয়ানুল মুসলেমিন বা মুসলিম ব্রাদারহুড নেতাকর্মীদের জেল জুলুম বা ফাঁসী দিয়ে আন্দোলন থামিয়ে দেয়ার সব অ¯্র ব্যবহার করা হয়েছে । কারাগারই নয় শুধু, পুরা মিশরই ব্রাদারহুডের নেতা কর্মী তথা গণ মানুষের কারাগারে পরিণত করা হয়েছে । হাসানুল বান্না,সাইয়েদ কুতুবদের মত অসংখ্য আল্লাহর শ্রেষ্ট মুজাহিদদেরকে সেখানে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিয়ে শহিদ করা হয় । মিশরের সবুজ শান্ত ভ’মিতে লাল রক্তের জোয়ার বহানো হয় । ড. মোহাম্মদ মুরসির এ বিজয় হল ঐ সব ফাঁসি, জেল, জুলুম আর অত্যাচারের ফসল । বিজয়ী মিশর গণতান্ত্রিক বিশ্বে রূপ নিল বিজয় উল্লাস, ইসলামপ্রিয় বিশ্ববাসীর জন্য হয়ে উঠল মাইলফলক ,অন্য সবার জন্য হল প্রেরণার উৎস ।

 কিন্তু যারা মানবতা আর গণতন্ত্রের শত্রু আধিপত্যবাদী সেই সব পশ্চিমা দুষমণেরা মুরসির এ মহা বিজয়কে সামনে বাড়তে দিল না । অভিশপ্ত ইসরাইল চরম ক্ষিপ্ত হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে এ বিজয়কে নির্মূলে টার্গেট নিল । ফলে মাত্র এক বছরের মধ্যেই ২০১৩ সালে অন্যায়ভাবে ড. মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে কারাগারে নিক্ষেপ করে মিশরের সেনাবাহিনী । নেতৃত্ব দিল প্রেসিডেন্ট মুরসির নিয়োগপ্রাপ্ত তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সেনাপ্রধান এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট আব্দুল ফাত্তাহ আল সিসি । পশ্চিমাবিশ্বের মোড়লদের সহায়তায় প্রেসিডেন্টের পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর প্রহসনমূলক বিচারের মুখোমুখি করা হয় ড, মুরসিকে । মিথ্যা এক মামলা চাপিয়ে দিয়ে সেখানে বলা হয় মিশরের মধ্যে বিদেশের সন্ত্রাসীদের দিয়ে আক্রমণের ষড়যন্ত্রের গুপ্তচরবৃত্তির প্রধান নায়ক প্রেসিডেন্ট মুরসি । তাই আসামী করা হয় মুরসি এবং তার দল মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা কর্মীদের । সেই প্রহসনমূলক বিচারে অন্যায় স্বিদ্ধান্ত নেয়া হয় । বিচারে দেশোদ্রেীহিতার আসামী ঘোষণা দিয়ে মুরসিকে এক পর্যায়ে মৃত্যদন্ড দেয়া হয় । পরবর্তীতে তার মৃত্যুদন্ডাদেশ বাতিল করে কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয় । বিশ্বনেতা ড. মোহাম্মদ মুরসিকে সেই থেকে কারাভ্যন্তরে সীমাহীন অবহেলা, অত্যাচার, হুমকী, মানসিক যাতনা ইত্যাদিতে আতংকিত করে ফেলে । তার ছেলে মেয়ে এবং পরিবারের অন্যান্যদের উপরও চালানো হয় সীমাহীন অত্যাচার । দলের নেতা কর্মীদের উপর কারাগারের ভিতর ও বাহিরে চলতে থাকে জেল জুলুমসহ অকথ্য রকমের নির্যাতন । এতোসব যন্ত্রণার ভারেই গত ১৭ই জুন ২০১৯ইং সাল মিশরের একটি আদালতে বক্তব্য দিবার সময় মহান এই নেতা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরে বলা হয়,‘আদালতের এজলাসে হঠাৎ পড়ে গিয়ে’ তার মৃত্যু হয় । গত ৭ ই মে মুরসি বলেছিলেন,তার জীবন হুমকীর মুখে।
সামরিক অভ্যুথানে ক্ষমতাচ্যুত মিশরের ইতিহাসের প্রথম নির্বচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির লাশ কঠোর গোপনীয়তায় ১৮ ই জুন ভোরে কায়রোতে সরকারের লোক দিয়ে কড়া নিরাপত্তার সাথে দাফন করা হয় । এর আগে পরিবারের পক্ষ থেকে সারকিয়া প্রদেশের নিজ শহরে তার দাফনের অনুরোধ জানালে সরকার তা দেয় নি । তবে কায়রোর নসর এলাকায় গোপণীয় ওই দাফনে মুরসির পরিবারের সদস্যদের উপস্থিত থাকার অনুমতি দেয়া হয় ।
মুরসির এ মৃত্যু বিশ্ববাসী মেনে নিতে পারছে না । সারা বিশ্ব মুরসির এমন নির্মম মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ও শোকবার্তা জানাচ্ছে । তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান বলেছেন ,জালিমের কারাগারে শহিদ হয়েছেন মুরসি । কারাগারে নিক্ষেপ করে যারা তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে সেই জালিমদের ইতিহাস কখনও ক্ষমা করবে না । আমাদের চোখে মুরসি একজন শহিদ । তিনি তার বিশ্বাসের জন্য জীবন দিয়েছেন । ইতিহাস একনায়ক সেই জেনারেল সিসিকে ক্ষমা করবে না ,যে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে,মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নির্যাতন করেছে এবং মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার যাবতীয় চক্রান্ত করা হয়েছিল । আদালতে নিজের ওপর জুলুমের প্রতিবাদ করেছেন তিনি । মিশরীয়দের মুক্তির জন্য শেষ নি:শ্বাস পর্যন্ত মুরসি যে সংগ্রাম করে গিয়েছেন তা যুগ যুগ ধরে মুসলমানরা স্মরণ রাখবে । আল্লাহ তায়ালার দরবারে আমাদের শহিদ ভাইদের জন্য রহমত কামনা করছি । মোহাম্মদ মুরসি তার হাজার হাজার বিপ্লবী সমর্থককে নিয়ে গত পাঁচ বছর ধরে কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন । কিন্তু পাশ্চাত্যের কেউ এর প্রতিবাদ করেনি । জেনারেল সিসি নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে হটিয়ে বলপূর্বক ক্ষমতা দখল করে ৫০ জনকে ফাঁসি দিয়েছে । তার দেয়া মৃত্যু দন্ডের ব্যাপারে পশ্চিমারা সব সময়ই নিরব থেকেছে ।
মিশরের জালিম শাসক হয়তো গ্রেপ্তারকৃত নেতাদের অত্যাচার করে সাময়িক বিজয় অর্জন করেছে । কিন্তু তাদের ত্যাগ - ইতিহাস মানুষের মন থেকে মুছে দিতে পারবে না।
মিশরের ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা দ্য ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি এক বিবৃতিতে বলে,মুরসিকে নির্জন কারাবাসে রাখা হয়েছে । চিকিৎসা নিতে দেয়া হয়নি । দুর্গন্ধযুক্ত খাবার খেতে দেয়া হয়েছে । মৌলিক মানবাধিকারের সবকিছু থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে । আর এতে ধীরে ধীরে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে । হিউম্যান রাইট্স ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মুরসির মৃত্যুতে বলেছে, তাকে পর্যাপ্ত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে । তার মৃত্যু ও আটকাদেশ নিয়ে একটি পূর্ণাংগ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ রিপোর্ট তৈরী করতে মিশরীয় কর্তৃপক্ষের কাছে তারা আহবান জানিয়েছে । [চলবে]

Popular Posts